লিখেছেন – ফারহানা আহমেদ

আসিফ মহিউদ্দিন ছুরিকাহত হলেন, আমরা বললাম ছবির হাটের গন্ডগোল এর কারন হতে পারে, এ নিছক ব্যক্তিগত শত্রুতা, ওর বন্ধুদের কেউ এই কাজ করে থাকতে পারে। আর তাছাড়া, আসিফ ছেলেটা খালি ‘আমি আমি’ করে, ওকে তো ইচ্ছা হয় আমিই ধরে মারি, যে মেরেছে তার আর দোষ কী? এরপর, ‘থাবা বাবা’ রাজীবের পালা, আমাদের মনে হলো ওই ‘কুৎসিত’ লেখাগুলো না লিখলেই পারতেন, ওইসব পড়ে আমারই তো কুৎসিত লেগেছে, ছিহ! এরপর, সানিউর রহমান ওরফে নাস্তিক নবী, তার কাজকারবার তো আরও ভয়াবহ, আর তাছাড়া সে তো ব্লগার না, কোন কালে বোধ হয় ছিলেন, কিন্তু এখন তো আর নেই, সো, তার দায় আমরা নেব কেন? মোটাদাগে এই হলো, ফেসবুক-ব্লগে যাদের মোটামুটি প্রগতিশীল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন হিসেবে জানতাম তাদের প্রতিক্রিয়ার সারমর্ম। আমাকে বিষয়টা একদিকে যেমন ব্যথিত করেছে, তেমনি একটা প্রশ্নও মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, একের পর এক ধর্মে অবিশ্বাসী ব্লগার-অনলাইন একটিভিস্টরাই কেন আক্রান্ত হচ্ছেন? জামাত-শিবির চক্রের বিরুদ্ধে তো আসিফ-রাজীব-সামিউরের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার আস্তিক ব্লগাররা আছেন। এই ব্লগাররা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখত, জামাতের বিরুদ্ধে লিখত, কিন্তু তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করত ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখিতে। তাহলে বেছে বেছে এরাই কেন?

আমার মনে হয়, এই রকম ঘটার পেছনে দুটো বিষয় কাজ করছে। প্রথমটা অনেকটা তাত্ত্বিক, নাস্তিকদের নিয়ে ধর্মব্যবসায়ী বা অ-ব্যবসায়ী দু’শ্রেণীর এস্টাব্লিসমেন্টের পক্ষের লোকজনের মনে সন্দেহ ব্যাপক। এসটাব্লিসমেন্টের স্তম্ভগুলোর মধ্যে ধর্ম অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম, কখনো কখনো তা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী, রাষ্ট্রকেই ধর্মের মদদ নিতে হয়। এসটাব্লিশমেন্টের অন্য স্তম্ভগুলোও ধ্বসে পড়ার উপক্রম হলে মদদ মাঙ্গে ধর্মের। এস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষে কাজ করার জন্য ধর্মের সবথেকে বড় সুবিধা হলো এর অতিপ্রাকৃত রহস্যময়তা। বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়া, অতিপ্রাকৃত শক্তির ভয়ে ভীত করে রাখা—এইসব অস্ত্র ব্যবহার করে ধর্ম তার কার্য হাসিল করে। নারী পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠলে, ধর্মই তাকে ঠান্ডা করে; মালিকের বিরুদ্ধে শ্রমিক যেতে পারে না, কারণ আল্লা যাকে এই যামানায় কিছু দেননি, আখেরাত তো তারই জন্য। রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহজ ব্যবহার্য অস্ত্র হলো ধর্ম, বাংলাদেশেই দেখি আমাদের পতিত স্বৈরাচারী ক্ষমতায় থাকার জন্য রাষ্ট্রধর্মের এমনই ক্লস সংবিধানে যুক্ত করেছেন, যা থেকে বের হওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কবে সম্ভব হবে কেউ জানে না।

এহেন মহাপরাক্রমশালী হাজার বছরের চেষ্টায় নির্মিত ধর্ম নিয়ে যারা প্রশ্ন করতে শুরু করে, পরকালের ভয়ংকর শাস্তির ভয় যাদের মনে কাঁপন ধরাতে পারে না, তাদের সন্দেহ করাটা, এবং কিছুটা ভয় পাওয়াটা এস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষে অসম্ভব নয়। এমনকি, এস্টাব্লিশমেন্টের পক্ষের যে সব তুলনামূলক লিবারেল ফোর্স আছে তারাও নাস্তিকদের সন্দেহের চোখে দেখে; শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ নাস্তিকদের পক্ষে কথা শুধু যে রাজনৈতিক কারণে বলেন না তা নয়, তারা নিজেরাও এদের ঠিক বিশ্বাস করেন না। করার কারণও নেই। আস্তিক লোকজনের সবসময় একটা সুবিধা থাকে, যে কোন বিষয়ে আপোষ করে নেওয়া যায় ধর্মের নামে, কেউ কিচ্ছু মনে করে না। নাস্তিকের সেই সুবিধাটা নেই, তাকে নিজের কাছেই প্রতিনিয়ত জবাব দিতে হয় আমি যে পক্ষে আছি, কেন আছি? কোন যুক্তিতে? তার মনের গঠনটা এইরকম না হলে তার পক্ষে আসলে ঈশ্বরকে নিয়েও প্রশ্ন করা সম্ভব হতো না। নারী প্রশ্নে, মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে নাস্তিকের অবস্থান তাই অনেক পরিষ্কার, অনেক র‌্যাডিক্যাল, অনেক প্রগতিশীল। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজনও নাস্তিক পাই নি, যিনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, বা নারীদের প্যাকেটে মুড়ে রাখতে চান। নাস্তিকের এই র‌্যাডিক্যাল আপোষহীন চরিত্রই তাকে মধ্যমপন্থী লোকজনের কাছে অপ্রিয় করেছে।

দ্বিতীয় দিকটা শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিক্রিয়ার সাথে জড়িত। আমি শুরু করেছিলাম অনলাইনে পড়া কিছু প্রতিক্রিয়া দিয়ে। হ্যাঁ, মোটাদাগে এই রকম প্রতিক্রিয়াই দেখেছি গণজাগরণ মঞ্চের কার্মী-সমর্থকদের মধ্যে। নাস্তিক মরলে বা মার খেলে তার প্রতি যে ঔদাসীন্য দেখাচ্ছেন আন্দোলনের সহযোদ্ধারা তাতে করে নাস্তিকরা জামাত-শিবির-হি্যবুতের সবথেকে সহজ টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। গত কয়েক দিনের ঘটনা প্রমাণ করে কেউ যদি নিহত বা আহত হন এবং তার একই সাথে অনলাইনে ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করার অভ্যাস থাকে, তাহলে তাকে নিয়ে মাতামাতি হবে না, হলেও কম হবে। বিশ্বাসের জায়গা থেকে হোক, বা শাহবাগ আন্দোলনকে ধর্মীয় গোষ্ঠিগুলোর কাছে প্রিয় রাখার যায়গা থেকেই হোক, বা নিজের প্রাণের ভয়েই হোক, আন্দোলনের উদ্যোক্তারা ধর্মীয় মৌলবাদ সংক্রান্ত আলোচনার জায়গাটা বাদ দিয়েই জামাত-শিবির নিষিদ্ধের দাবী জানাচ্ছেন। তাই নাস্তিকদের সাথে কোন রকম সংশ্রবও তারা অস্বীকার করছেন। হয়তো, এটাই সময়ের দাবী, এভাবে না হলে জামাত-শিবির কুৎসা রটানোর আরো কিছু অস্ত্র পেয়ে যেত। কিন্তু, ব্যক্তিগত জীবনে একজন ধর্মহীন লোক এবং একইসাথে শাহবাগের গণজাগরণের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে আমার কষ্টই লাগে যখন দেখি ইমরান এইচ সরকার মাইকে উপস্থিত জনতাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘এখানে কোন নাস্তিক আছেন?’ এবং, উপস্থিত জনতা সমস্বরে আওয়াজ তোলে, ‘না, না।‘

ফারহানা আহমেদ