শাহবাগের স্বতঃফূর্ত জনরোষ এবং যুদ্ধপরাধী বিচারে কোন ঠাসা জামাত-শিবির এবং তাদের ‘ভদ্র ফ্রন্ট’ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে কার হাতে – এই প্রশ্নের উত্তরে পাঠক কি বলবেন ? আরেকবার ভাবুন কারণ বাইরে থেকে যা মনে হয় , ভিতরের অবস্থা প্রায়ই সেটা থেকে হয় সম্পূর্ণ অন্যরকম। দেলোয়ার সাঈদীর বিচারের রায় প্রকাশ হওয়ার পর সারা দেশে এই রায়ের প্রতিবাদের নামে যা আরম্ভ হয়েছে সেটাকে জঙ্গিবাদ বলাই উত্তম। এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা অর্ধ শত ছাড়িয়ে গেছে যার মধ্যে পুলিশ সদস্যরাও আছে। এক জায়গায় ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছে।অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হচ্ছে যে , নিজেরা রাজনীতি করতে জামাত-বিএনপি অক্ষশক্তি যত না আগ্রহী তার চেয়েই তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিতারিত করতে বেশী আগ্রহী। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা যাকে বলে। তারা বিশ্বাস করছে যে, দেশে যদি এমন অবস্থা তৈরী করা যায় যাতে পরিস্থিতি সরকারী নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং ব্যপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে , তাহলে সশস্ত্র বাহিনী ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারির মত পুনরায় পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসবে। এর সম্ভাবনা কতটুকু এবং এই সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপ কি ধরণের পটভূমি দাবী করে ?

একটি দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে । আমি এখানে প্রধান দুইটি পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করতে চাই। প্রথমটি শ্রেফ ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণের এবং দ্বিতীয়টি জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত।
সচরাচর উচ্চাভিলাষী সমরনায়কেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য সামরিক বাহিনীর সাহায্যে একটি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এটাকে সবাই সামরিক অভ্যুত্থান বলে থাকেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরণের ‘সফল সামরিক অভ্যুত্থানের’ সংখ্যা চারটি। প্রথমটি ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যখন জুনিয়র সেনাকর্মকর্তাদের নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এরপরে একই বছর ৭ই নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দিয়ে আরেকটি অভ্যুত্থান ঘটানো হয় মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সপক্ষে যেটাকে ‘বেসামরিক রং’ দেয়ার জন্য প্রায়ই ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব’ বলা হয়ে থাকে – এটার সামনের কলামে ছিলেন সেনা বাহিনীর নন কন্ডিশন্ড কর্মচারীরা। এরপরে সর্বশেষ সামরিক অভ্যুত্থানটি ঘটে ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ তৎকালীন সেনা প্রধান লেঃ জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে । গন আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগ পর্যন্ত এরশাদ সাহেব ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে সক্ষম হন।

২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারী বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে । সামরিক বাহিনী তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিন আহমেদকে ক্ষমতায় রেখে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় যা ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারি বর্তমান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শপথ নেয়ার আগ পর্যন্ত জারী ছিলো। ২০০৭ এর ১১ জানুয়ারী থেকে ২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারী পর্যন্ত সময়টা ডঃ ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বধীন একটি টেকনোক্র্যাট সরকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো এবং এর পেছনে ছিল সামরিক বাহিনীর বিশেষ সেল যার নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন সেনা প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। সে সময় দেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হয় সামরিক আইন বলবতের পরিবর্তে – যেটা বিশেষভাবে লক্ষনীয়। যে অবস্থায় দেশে জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছিল সেটাকে যৌক্তিকতা দেয়া হয়েছিল একটি কারণ দেখিয়ে যে , দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ছিল হুমকীর সম্মুখীন। জাতীয় নিরাপত্তা হুমকীর সম্মুখীন হয় বিভিন্ন কারণে। বিদেশী আক্রমণকে অনেকেই প্রধান হুমকী হিসেবে দেখতে চাইলেও জাতীয় নিরাপত্তার ভিত্তিটা আসলে রাষ্ট্রের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল। একটি রাষ্ট্রের প্রতিটি ভৌগলিক অংশ এবং প্রতিষ্ঠানের উপর যখন সেই রাষ্ট্রের সরকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তখন সে রাষ্ট্রে অরাজকতা দেখা দেয়। এ প্রসঙ্গে সোমালিয়া এবং আফগানিস্তানের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এই দুইটি দেশের সম্পূর্ণ ভৌগলিক অংশের উপর কোন কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রন নেই। বিভিন্ন সশস্ত্র দল বা মিলিশিয়া এই দেশ দুটির বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রন করছে। সোমালিয়ায় এমনকি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অস্তিত্ব নেই , তারা মার্কিন ডলার বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। ২০০৭ সালের জানুয়ারী মাসে তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলে , রাজপথের দ্বারা দেশ শাসিত হতে থাকে। সরকারী কর্মচারীরা হয়ে পড়েন নিষ্ক্রিয়। তারা তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক দলের আনুগত্য দেখাতে থাকেন যার ফলে তৎকালীন তত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে সরকারী আদেশ বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে , দেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এই সময় দেশে সোমালিয়ার মত পরিস্হিতি সৃষ্টি হওয়ার আশংকা দেখা দেয়া যার সূযোগ নিয়ে বিভিন্ন জঙ্গী মিলিশিয়ারা দেশে অরাজকতা কায়েম করার মানসে তৎপর হয়ে উঠে অবাক হওয়ার কিছুই থাকত না। দেশ দাড়িয়ে ছিলো গৃহযুদ্ধের দোরগোড়ায় । ধর্মীয় মৌলবাদী এবং বামপন্থী সশস্ত্র গ্রুপগুলোর জন্য এ এক সূবর্ণ সুযোগ। এমতাবস্থায় জাতীয় নিরাপত্তা সুসংহত করতে সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয় বাধ্য হয়েই যদিও তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা থেকে সেসময় বিরত থাকেন যা সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

শাহবাগের জন আন্দোলন বর্তমানে তুঙ্গে । লাখো মানুষ ৭১ এর যুদ্ধাপরাধদের বিচারের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ যার পেছনে রয়েছে পুরো বাংলাদেশের জনতার সমর্থন। অন্যদিকে জন বিচ্ছিন্ন জামাত- বিএনপি অক্ষশক্তি যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রত্যাখ্যান করে তাদের স্বাধীনতা বিরোধী চেহারা জন সম্মুখে উন্মোচন করেছে। তাদের সরাসরি প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা বর্তমান সরকারকে দেখছে যদিও সরকার জনদাবি বাস্তবায়ন করছে। তারা চাইবে এ সরকারে পতন ঘটুক যত শীঘ্র সম্ভব , দেশের গনতন্ত্র এবং জাতীয় নিরাপত্তাকে ধ্বংস করে হলেও। তারা চায় না যুদ্ধপরাধীদের পেছনে ফেলে ইতিবাচক পরিষ্কার রাজনীতি নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হতে। তারা চাইবে এখন দেশে গৃহযুদ্ধে দাবানল ছড়িয়ে পরুক – ১৯৭১ তো এদের কাছে মুক্তি সংগ্রাম ছিলো না , ১৯৭১ ছিলো গৃহ যুদ্ধ ! শাহবাগে চালানো হতে পারে ইতিহাসে নৃশংসতম গণহত্যা। শোনা যায় বিশ্ব সন্ত্রাসের কুখ্যাত খলনায়ক পাকিস্তানী সামরিক গোয়েন্দা আই এস আই এখন জামাত-শিবির এবং তাদের ভদ্র ফ্রন্ট বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছে। কথা সত্যি যদি হয় তাহলে, গাড়ী বোমা , ট্রাকবোমার ব্যবহৃত সেমটেক্সের মত উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন বিস্ফোরক যে কোন মূহুর্তে বাংলাদেশের উপকূলে খালাস হওয়ার অপেক্ষা করছে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী শাহবাগের জনতাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে , আগামীতেও দেবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই শাহবাগে পাকিস্তানী প্রযুক্তিতে তৈরী বিস্ফোরকে গণহত্যা চললে দেশে জাতীয় নিরাপত্তা বলে আার কিছু থাকবে না। এটা হবে একটা গেইম চেঞ্জার। দেশকে নিশ্চিত গৃহযুদ্ধ থেকে বাঁচাতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর তখন সরাসরি হস্তক্ষেপ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় থাকবে না। , তা সে সরকারে আদেশেই হোক আর অনিচ্ছাতেই হোক। এতে আর কিছু না হোক জন বিচ্ছিন্ন জামাত- বিএনপি অক্ষশক্তির নিজেদের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করার যোল কলা পূর্ণ হবে ! অাসুন আমরা সবাই মিলে অক্ষশক্তির এই নীল নক্সা প্রতিহত করি।