আমার মনে হয় বাংলাদেশে নাস্তিকতা নিয়ে যারা কাজ করেছেন এবং করছেন, তাদের মূল লক্ষ্য একটাই। সেটা হলো মনুষ্যত্বের বিকাশ, জ্ঞাণ ও বিজ্ঞাণ চর্চার সহায়ক একটি পরিবেশ সৃষ্টি। কালের স্রোতে শান্তিপ্রিয় বাঙালী যখন ধীরে ধীরে বাঙালী মুসলিম এবং সম্প্রতি বাঙালীত্ব ছেড়ে মুসলিম হবার দিকে পা বাড়াচ্ছিলো, তখন এই একদল তারুণ্যে বিদ্রোহ ব্লগিঙের মাধ্যমে প্রতিবাদ শুরু করেছিলো। বাংলার বিশাল জনগোষ্ঠীকে জাকির নায়েকের উদ্ভট তত্ব, সৌদি/পাকি/আফগানী উগ্র ধর্মীয় জঙ্গীবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে টিকে থাকা, দেশের রাজনৈতিক দলগুলির ধীরে ধীরে ধর্মের প্রতি আরো বেশি করে ঝুঁকে পড়ার আত্মঘাতী চক্র এবং এসবের কুফল বিষয়ে সচেতন করে তুলতে তারা বেছে নিয়েছিলো ব্লগের আপাতঃ নিরাপদ আশ্রয়। বিভিন্ন মত ও পথের নাস্তিকের বিবিধ আক্রমনে ধর্মকে পুঁজি বানিয়ে ব্যবসা করা ধর্মজোঁকের দল মুহুর্মুহ মুর্ছা যাচ্ছিলো, এমনি সময় প্রথম প্রতি-আক্রমন আসে ধর্মকারী নামক একটি বিপুল বিনোদন ভিত্তিক ওয়েবসাইট সরকারের বন্ধ করার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ততোদিনে নাস্তিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুভমেন্টের রূপ পেয়ে গিয়েছিলো।

তবে এ কথা সত্য, নাস্তিকতা বলে আসলে কিছু নেই। এটি কোনো ধর্ম নয়, এর কোনো পুরোহিত নেই, নেই কোন পুস্তক। কেউ কারো চেয়ে বড়ো নয়, ছোটো নয়। সকলেই দেশ ও মানবতাকে ভালোবেসে সবুজ ও সোনার এই বাঙলাকে মুক্ত করতে চেয়েছিলো আধ্যাত্মিকতার খোলসে সউদি ও পাকিস্তানী সংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে দেশজ সংষ্কৃতিকে রক্ষায়, আক্রমন করেছিলো শত শত বছর ধরে গেঁড়ে বসা এক মরুভূমি ভিত্তিক সংস্কৃতিকে।

বাউলের দেশ এই বাংলায় বাউলেরাই যখন লাঞ্ছিত হচ্ছিলো, তখন বাংলার এই দামাল কলম যোদ্ধারাই ব্লগস্ফিয়ারে এক বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছিলো মুক্তচিন্তার। তাদের মাঝে মত ও পথের সুস্পষ্ট বিভেদ অবশ্যই ছিলো, কেউ রসিকতা ও ব্যঙ্গকে ব্যবহার করে ধর্মীয় কল্পকাহিনী ও প্রভাবের গুরুত্ব হ্রাস করে একটু শ্বাস নেবার পরিবেশ সৃষ্টি করছিলেন, কেউবা সেই নতুন পরিবেশে জ্ঞাণের নতুন বীজতলা তৈরিতে হাত দিয়েছিলেন। কেউবা সমাজতন্ত্র ও মানুষের জন্য কাজ করার পাশাপাশি চিন্তার মুক্তির উদ্দেশ্যেও শ্রদ্ধানির্ভর নিধার্মিকতার চর্চা করছিলেন। এই পথগুলির মাঝে আন্ত-কলহ থাকলেও ভিত্তির ব্যাপারগুলিতে তারা এক হয়েই লড়াই করেছেন।

প্রতি আক্রমন এর পরেও এসেছে, আমরা নানা সময় ধর্মীয় সুবিধাভোগকারী দল, সংগঠন কিংবা ব্যক্তিদের বিষোদগার লক্ষ্য করেছি, ধর্মের কাঁঠাল ভেঙ্গে লালে লাল হয়ে যাওয়া মোল্লা কিংবা হুজুরদের নিরন্তর মিছিল দেখেছি, কারন আমরা তাদের রুটি রুজি ধরে টান দিয়েছিলাম। এটাই স্বাভাবিক। বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো স্ক্যাম, সবচেয়ে বড়ো বিনা পুঁজির ব্যবসা-ধর্মের লাভের গুড়ে টান পড়লে ব্যবসায়ীরা তো ক্ষিপ্ত হবেই।

কিন্তু ধর্ম, নৈতিকতা, সংষ্কারের কারবারী এই ধর্মবাজেরা কখনোই সোজা পথে প্রতিবাদ বা লড়াই করে নি। নাস্তিক, নিধার্মিক কিংবা মুক্তমনাদের গলা চেপে ধরতে বরাবরই তারা বেছে নিয়েছে পিঠে ছুড়ি মারা কিংবা রাতের অন্ধকারে গলা কেটে রেখে যাওয়া। বাঘের সাথে লড়াই করতে তারা বেছে নিয়েছে হায়েনার মতো নীচ যুদ্ধ কৌশল।

বিপুল জনগোষ্ঠীকে তারা বুঝিয়েছে, ধর্মের নামে ব্যবসায়ীদের আক্রমন করার অর্থই হলো ধর্মকেই মুছে ফেলা। অথচ সত্য হচ্ছে এই, যে নাস্তিকতা সবসময়ই ধর্মকে তার সঠিক স্থানে ‘ফেরৎ’ পাঠানোর কথাই বলে এসেছে, আর তা হলো ব্যক্তিগত পরিসর। ব্যক্তি তার ইশ্বরের সাথে কি আদান প্রদান করবে, কিংবা কি অনুনয় বিনয় করবে, তার গন্ডি ব্যক্তি পর্যায়েই থাকার কথা ছিলো। কিন্তু এই ব্যবসায়ীরা ব্যক্তির দুর্বলতাকে পুঁজি করে, তাদের ভুল বুঝিয়ে দেশজোড়া জঙ্গী ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার বাড়িয়েছে। আমরা একে বলে এসেছি ভুল, এবং ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার রাষ্ট্রের কর্মকান্ডে ধর্মের কোন স্থান থাকতে পারে না।

নাস্তিকতা আন্দোলনের প্রথম দিকে ব্লগগুলিতে ছাত্রশিবির কিংবা হিজবুত তাহরীরের সাথে নাস্তিকদের বাদানুবাদের সময় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতে দেখা গিয়েছে। সে সময়টা ছিলো ধর্মীয় বলদারগু বা ইংরেজিতে বুলশিটের বিপক্ষে মেধাবীদের বিবিধ উত্তর তৈরির সময়। এই সময়টায় শিবির/হিজবুতের ধর্মান্ধ কর্মীদের সাথে বাদানুবাদের সময় তীব্র অশ্লীল গালিগালাজের মুখে তাদের একমাত্র সাধের ধন, সৌদি মহাপুরুষ মোহম্মদকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা কখনো কখনো হয়ে উঠেছিলো প্রতি-আক্রমনের অস্ত্র। আর সে অস্ত্র ব্যবহারে দক্ষ সৈনিকেরও অভাব ছিলো না। ব্লগ কর্তৃপক্ষ প্রায়শঃই এই যুদ্ধ সামাল দেবার জন্য অনেক ব্যন, ডিলিট করে থাকতে দেখা যায়।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন আমরা দেখতে পাই নাস্তিকতা উত্থানের। সেটি হচ্ছে দীর্ঘ চার দশক ধরে একাত্তরে ধর্মের নামে করা অপরাধগুলি বিচারহীনতার চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছিলো। যতোবারই রাজাকারদের বিচারের কথা উঠেছে তারা ধর্মের রক্ষাকবচ ব্যবহার করেই বেঁচে গিয়েছে। এবার অসহিষ্ণু তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ তাদের এই রক্ষাকবচ ধরেই টান দিয়েছিলো, যাতে রাজাকারের পাল পালাতে গেলেও কোথাও জায়গা না পায়।

আজকে যখন দেশের তরুণ প্রজন্ম ফুঁসে উঠেছে রাজাকারদের বিচার নিয়ে চুদুরবুদুরের বিরূদ্ধে, তখন ঘড়ির কাঁটার মতোই আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজাকারদের ছানাপোনারা সেই ধর্ম নিয়েই চিৎকার শুরু করেছে। দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়কে পরিনত করেছে ‘হত্যা করে সেই অপরাধকেই জায়েজ করবার হাতিয়ার’ হিসেবে। তারা এতোই দুর্ধর্ষ যে, স্বাধীন দেশের ভেতরে বসে খোলা ময়দানে জনসমক্ষে তারা দেশের নাগরিকদের জবাই করবার হুমকি দেয়।

ঠিক এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যেই নাস্তিকতা নামের আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, যেখানে ধর্মকে ব্যবহার করে কেউ অপরাধ সংঘটন করতে পারবে না, কারো জীবন বিপন্ন হবে না কথা বলবার ‘অপরাধে’। জ্ঞাণ ও সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সুস্থ চর্চার পরিবেশ সৃষ্টিতে নাস্তিকেরা তাই বাংলার ‘বেয়াদব’ সন্তানের দল।

এরা কারো ক্ষতি করে নাই কোনোদিন, করার উদ্দেশ্যও ছিলো না, হত্যা তো দুরে থাক। শুধুমাত্র মনের কথা বলবার অপরাধে আজ এদের জীবন হুমকির সম্মুখীন, এমন রাষ্ট্র কি সত্যিই আমরা চাই?

এদের রক্ষা করুন।