আমি একা জন্মাইছি, একা মইরা গেছি। আমি কি মুসলমান, আমি কি বাঙালি, আমি কি অনার্য? আমারে একটা শ্রেণীতে ফেইলা দেখলেই কি আমি তা হইয়া যাই? আমারে মুসলমান হইয়া উঠতে হয়, বাঙালি হইয়া উঠতে হয়, নাস্তিক হইয়া উঠতে হয়। ফলে ওগুলা আমার বানানো সত্তা। ওই সত্তাগুলারে আমি বানাইয়া উঠি। কিন্তু আমার মূল সত্তা হইলাম ব্যক্তি আমি। তারে হইয়া উঠতে হয় না। সে-ই আমার আদি সত্তা।


ফ্যাসিবাদ কী জিনিস? যে নিজের জীবনে নীতি চাপাইতে চায়, সে নীতিবান। যে অন্যের জীবনে নীতি চাপাইতে চায়, সে ফ্যাসিবান। তা সে যেই নীতিই হোক। ফ্যাসিবান আর যাই করতে কউক, ব্যক্তিসাধনা করতে কয় না। আত্মসাধনা করতে কয় না। ফ্যাসিবান আত্মরে বিলাইয়া দিতে কয়। তার ফ্যাসিগোষ্ঠির মাঝারে। ফ্যাসিবান আপনারে বোঝায়, আপনার দেখভালের দায়িত্ব আপনার না। আপনার নীতি ঠিক করার দায়িত্ব আপনার না। সেই দায়িত্ব ফ্যাসিগোষ্ঠির। আপনি বাদে অন্যের।

আত্মসাধনা হইলো নিজের দেখভাল নিজে করার সাধনা। নিজের নীতি নিজে ঠিক করার সাধনা। আত্মনিয়ন্ত্রণের সাধনা। কোনো মত পথ জাতি ধর্মের কাছে সমর্পণের আগে নিজের কাছে সমর্পণের সাধনা। সকল ফ্যাসিবাদরে বিলাইয়া দেয়ার সাধনা। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির উপর তার নিজের অধিকার আসে সবার পরে। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির মালিক ব্যক্তি নিজে না। ফ্যাসিবাদে ব্যক্তির মালিক হইলো মূলত তার ফ্যাসিগোষ্ঠিটা। আত্মসাধনায় নিজের মালিক হইলো কেবল নিজেই। আত্মসাধনায় নিজে আসে আগে, অন্যসকল মত পথ জাতি ধর্ম আসে পরে।


ধর্মের সবচেয়ে বড় অনাচার ঘটে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। এতে ধর্মেরই ক্ষতি। রাষ্ট্র একচেটিয়া বলপ্রয়োগের কারখানা। যেই মতই বলপ্রয়োগের কারখানার অবলম্বন করে, সেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধর্মরে রাষ্ট্রের হাত হইতে মুক্তি দিতে হবে। কে কীভাবে ধর্ম পালন করবে সেইটা রাষ্ট্রের দেখার বিষয় না। মত নিশ্চিহ্ণ হয় না। ইসলামও নিশ্চিহ্ণ হবে না। ফলে আমরা বড়জোর তার মুক্তি কামনা করতে পারি। ইসলামের মুক্তি তারে বিচিত্র উপায়ে বাড়তে দেওয়াতে। ইসলামের কোনো অদ্বিতীয় রূপ নাই। নানা রকম ইসলামের অস্তিত্ব আছে, এইটা মানতে হবে। আরো নানা রকম ইসলাম তৈরি হইতে পারে, এইটাও মানতে হবে। যে যার মতো ইসলামরে খুঁইজা নিক। ইসলামের সমালোচনা যেখানে মুসলমানরে একাট্টা করতেছে, ইসলামের বিচিত্র বর্ধন সেইখানে মুসলমানরে ব্যক্তিসচেতন কইরা তুলবে। মুসলমান বুইঝা উঠবে যে প্রত্যেকের ইসলাম আলাদা। কোনো একক অদ্বিতীয় ইসলামের অস্তিত্ব নাই। ফলে এইটা নিয়া একাট্টা হওয়ারও সুযোগ নাই। অন্যের চাপানো ইসলামের উপর ভরসা না কইরা সে নিজের ইসলামের সন্ধান করবে। এইভাবে ব্যক্তি হইয়া ওঠার মাধ্যমে মুসলমানের মুক্তি ঘটবে। আর মুসলমানের মুক্তিতেই ইসলামের মুক্তি।

ফরহাদ মজহার সাহেব ইসলামের রাজনৈতিক ব্যবহারের সবচেয়ে অদেখা শক্তিটা উদ্ধার করতে যাইতেছেন। ফরহাদ মজহার ইসলামের নামে সর্বহারা অনার্য ভাববাদীদের একাট্টা করবেন যেইদিন, সেই দিন তারে ঠেকানোর মূল অস্ত্রটা ওনার ইসলামের রাজনীতিটারে নিষিদ্ধ করায় নিহিত না। বরং নানান রকম ইসলাম দিয়া ওনারে গৌণ করাতেই নিহিত। সমাজে যদি নানারকম ইসলাম জারি থাকে, ফরহাদ মজহার তখন সবাইরে এক ইসলামের তলে একাট্টা করতে পারবেন না। এতে সর্বহারা অনার্য ভাববাদীরা ওনার ইসলামের হাত হইতে মুক্তি পাইবে। ইসলামও ওনার হাত হইতে মুক্তি পাইবে। ইসলামের রাজনীতি নিষিদ্ধ রাখলে ফরহাদ মজহারের মতো নিষ্ঠাবান শক্তিশালী মতধারার নেতারা ঠিকই তলে তলে সংগঠিত হইয়া উঠতে পারবেন। ধরা খাইয়া যাবে কেবল ওনারে ঠেকা দিবার উঠতি ইসলামগুলা।


নিষিদ্ধতা অল্পই কাজ করে। যদি ধইরা ধইরা খতম কইরা দিতে না পারেন, তাইলে নিষিদ্ধতা নিষিদ্ধরে শক্তিশালীই করে কেবল। আপনি জাসদরে হয়তো নিষিদ্ধ করলে করতে পারেন। সমাজতন্ত্ররে নিষিদ্ধ করতে পারবেন না। সেইটা কাগজে কলমে থাকবে, বলবৎ হবে না। বরং সমাজতন্ত্রীরা তখন একাট্টা হইয়া উঠবে। নিষিদ্ধের মুক্তভাবে চিন্তার সুযোগ নাই। ফলে নিষিদ্ধ নানা মতে বিরাজ করে না। নিষিদ্ধরা সবাই একছাতার তলে চইলা আসে। আজকে সমাজতন্ত্রী দলগুলা নিষিদ্ধ হইলে সবাই একাট্টা হইয়া যাইতো আর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হইতো কোনো একটা কম্যুনিস্ট পার্টি। তারা তখন নিষিদ্ধ থাকতো নাকি বৈধ থাকতো ডাজ নট ম্যাটার। গণসমর্থনের কারণে বৈধতা পাওয়া সময়ের ব্যাপার হইতো কেবল। সমাজতন্ত্রী পার্টি করা বৈধ বিধায় আজকে কোটি কোটি বামপন্থী দল তৈরি হইছে। একটা আরেকটারে ঠেকা দিতেছে। বড়জোর জোট করতেছে। একাট্টা একদল হইয়া উঠতে পারতেছে না।


বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তির জন্যেও বাঙালি জাতীয়তাবাদী আরো দল লাগবে। মানুষের বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনারেও রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের বাইরে রাখতে হবে। জাতীয়তাবাদী চেতনার উপর যতোদিন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থাকবে, বাঙালি জাতীয়তাবাদী দল ততোদিন একটাই থাকবে – আওয়ামী লীগ। সে তার রকমের জাতীয়তাবাদটা রাষ্ট্রের মাধ্যমে সবার উপর চাপাইয়া দিয়া অন্যান্য রকমের বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হওয়ারে নিশ্চিহ্ন কইরা দিতে থাকবে। এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ক্ষতি হবে। ধর্মের মুক্তি হোক। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুক্তি হোক। জয় বাংলা!