[মডারেটরের নোট: অধ্যাপক ইরতিশাদ আহমদ মুক্তমনার একজন নিবেদিতপ্রাণ সদস্য। তিনি বহুদিন ধরেই মুক্তমনার সাথে, মুক্তমনাদের মুক্তবুদ্ধির আন্দোলনের সাথে জড়িত আছেন। তাঁর একটি চমৎকার বই প্রকাশিত হয়েছে এবারের বই মেলায়  ‘আমার চোখে একাত্তর’ শিরোনামে।  বইটি প্রকাশ করেছে চার্বাক প্রকাশনী। বইমেলায় বইটি পাওয়া যাচ্ছে বইটি পাওয়া যাচ্ছে প্যাপিরাস, র‍্যামন এবং কাশবন প্রকাশনীর স্টলে।

বইটির একটি চমৎকার ভূমিকা লিখেছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিন্তাবিদ এবং বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে লেখাটি মুক্তমনায় প্রকাশ করা হল।]

:line:

 

ইরতিশাদ আহমদ-এর

আমার চোখে একাত্তর

ভূমিকা

 অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশক: চার্বাক (ফাহমিদা সুলতানা শিল্পী)
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি, ২০১৩

 

একাত্তরের যুদ্ধকে নিয়ে কাহিনীর শেষ নেই, এবং না-থাকাটাই স্বাভাবিক।  এমন সর্বস্পর্শী ঘটনা আমাদের ইতিহাসে এর আগে কখনো ঘটে নি। সে সময়ের পূর্ববঙ্গের সব মানুষই কোনো না কোনো ভাবে এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, এবং এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। সে-স্মৃতি মুছে ফেলা কঠিন, মুছে ফেলাটা সঙ্গতও নয়, কেননা ওই ঘটনার ভেতর আমাদের অতীতের তো অবশ্যই বর্তমানেরও ব্যাখ্যা আছে, রয়েছে সামনের দিকে এগুবার জন্য দিশা।

 

ইরতিশাদ আহমদের ‘আমার চোখে একাত্তর’ সেই অসংখ্য কাহিনীরই একটি। কিন্তু এটি শুধু ব্যক্তিগত কাহিনী নয়; এখানে কথক প্রধান হয়ে ওঠেননি, তাঁর অভিজ্ঞতাই তাঁকে কথকে পরিণত করেছে, এবং অভিজ্ঞতার তুলনাতেও অধিক মূল্যবান হচ্ছে ঘটনার পটভূমি, এবং ঘটনাকে বুঝবার চেষ্টা। পটভূমির বিশ্লেষণ এবং ঘটনাকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা এই সংক্ষিপ্ত রচনাটিকে একটি বিশেষ তাৎপর্য দিয়েছে, এবং একাত্তর সম্পর্কে অনেক রচনা থেকেই স্বতন্ত্র করে তুলেছে। কাহিনী পরিণত হয়েছে ইতিহাস-মূল্যায়নের অংশে।

 

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে লেখক না-কিশোর না-যুবক এক ছাত্র। কলেজের। তিনি সরাসরি যুদ্ধে যেতে পারেন নি, তাঁর পরিচিতদের কেউ কেউ গেছেন, যাঁরা গেছেন তাঁরা সবাই যে ফিরে এসেছেন তা নয়। সরাসরি না হলেও ওই যুদ্ধে তাঁরও এক ধরনের অংশ গ্রহণ ছিল। যুদ্ধের পটভূমি যখন তৈরি হচ্ছিল তখন মিছিলে তিনি যোগ দিয়েছেন, যুদ্ধের সময় তাঁর এইচএসসি পরীক্ষা দেবার কথা সেটি তিনি দেন নি, এবং অন্যদেরকে নিরুৎসাহিত করার জন্য সমমনা কয়েকজন মিলে গোপনে একটি চিঠি ছাপিয়ে নিয়ে সহপাঠীদের নামে ডাকযোগে পাঠিয়েছেন। তখনকার পরিস্থিতিতে কাজটি যে ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তাতে সন্দেহ কী। চিঠিতে কিছুটা কাজ হয়েছে নিশ্চয়ই। ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ততাটা ছিল এই রকমেরই।

 

ইরতিশাদ তাঁর এই বইয়ের জন্য তথ্য সংগ্রহ করেছেন নানা সূত্র থেকে এবং তাদেরকে সাজিয়েছেন সতর্কতার সঙ্গে, পৃঙ্খানুপুঙ্খ রূপে। যুদ্ধের বীভৎসতার বিবরণ আমরা বহু পেয়েছি। কিন্তু যুদ্ধের সূচনা, পরিণতি ও চরিত্রকে বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ তেমন পাইনি। লেখক ওই পটভূমিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, যার জন্য দশ পর্বের এই ইতিহাসবিবৃতিতে আটটিই ব্যয় করা হয়েছে পটভূমিটাকে জানবার ও বুঝবার চেষ্টায়। কাজটা তাঁর নিজের জন্য আবশ্যক ছিল, কিন্তু যা তিনি করেছেন তা আমাদের সকলের জন্যই জরুরী ও উপকারী। ঘটনার পরম্পরাকে তিনি ঐতিহাসিকতায় পৌঁছে দিয়েছেন মন্তব্য এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাহায্যে। সবটাই করা হয়েছে তাঁর নিজস্ব অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এমনিতে এ ধরনের বিশ্লেষণ সকলের পক্ষে গ্রহণযোগ্যতা পাবে কী না সে নিয়ে সন্দেহ থাকে, কিন্তু ইরতিশাদ এমন সব সাক্ষ্যপ্রমাণ ও যুক্তি হাজির করেছেন যে ভিন্নমতাবলম্বীর পক্ষেও তা প্রত্যাখ্যান করা কঠিন হবে। তাঁর অবস্থানে দৃঢ়তা আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গির অসচ্ছতা নেই। সর্বোপরি তিনি একগুঁয়ের মতো কথা বলেন নি। বৈজ্ঞানিকের সততা, এমন কি সংশয় নিয়ে তাঁর মূল্যায়নকে উপস্থিত করেছেন যার দরুন কেউ যদি তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন তবুও উত্তেজিত হবার অবকাশ পাবেন না। আমি নিজে তো এমন কোনো জায়গা খুঁজে পেলাম না যেখানে ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারি।

 

হতে পারে তার মূল কারণ দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে আমার বিরোধ নেই, মিল রয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই এই রচনাটিকে একাধারে সুগ্রথিত ও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। এটা তিনি কোথাও অস্পষ্ট রাখেন নি যে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতীয়তাবাদ অবশ্যই ছিল, একাত্তরে পূর্ববঙ্গের বাঙালী যে জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছিল সে-বিষয়ে অন্যদের মতো তাঁরও কোনো সন্দেহ ছিল না, কিন্তু ওই অল্পবয়সেই তিনি জাতীয়তাবাদের পরেও যে যাবার ক্ষেত্র ও আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বুঝে নিয়েছিলেন। এক কথায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিটা সমাজতান্ত্রিক। জাতীয় পরিচয়ে বাঙালীরা সেদিন এক হয়ে গিয়েছিল বটে, কিন্তু বাঙালীদের ভেতর শ্রেণীবিভাজন ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। নেতৃত্ব ছিল আওয়ামী লীগের হাতে যেটি ছিল উঠতি ধনীদের দল। সাতচল্লিশে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদ বাঙালী হিন্দু বিত্তবানদের সরিয়ে দিয়ে বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্তকে সাহায্য করেছিল সম্পত্তি সংগ্রহে, এবার অবাঙালী বিত্তবানদের হটিয়ে দিয়ে ওই একই শ্রেণী ও তার সহযোগীদের জন্য ধনসংগ্রহের পথ আরো উন্মুক্ত করে দেবে এই ছিল আশা। ওদিকে মেহনতি মানুষ, যারা ছিল একাত্তরের যুদ্ধের মূল শক্তি, যারা প্রাণ দিয়েছে, এবং অকল্পনীয় দুঃখ সহ্য করেছে; তাদের স্বপ্ন ছিল দারিদ্র্য থেকে মুক্তির। আওয়ামী লীগের নেতারা অধিকাংশই কলকাতায় গিয়ে সুখে না থাকুন স্বস্তিতেই ছিলেন, দুর্ভোগের বড় ঝাপটাটা গেছে সাধারণ মানুষের ওপর দিয়েই। ইরতিশাদ তরুণ বয়সেই এই বৈপরীত্যটা লক্ষ্য করেছেন, এবং চিন্তিত হয়েছেন। চল্লিশ বছর পরে ‘আমার চোখে একাত্তর’ লিখতে গিয়ে শ্রেণীবিভাজনের সেই সত্যটাকে তিনি ভুলতে পারেন নি।

 

পরিষ্কার ভাবেই বলেছেন তিনি যে জাতীয়তাবাদকে তিনি চূড়ান্ত সত্য বলে মেনে নিতে পারেন নি, যে জন্য যোগ দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রীদের সাথে। পরে তিনি আমেরিকায় গেছেন উচ্চশিক্ষার জন্য। শিক্ষাশেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন, এবং বর্তমানে সপরিবারে সেখানেই বসবাস করেন, কিন্তু তাঁর অবস্থান বদলায় নি। একাত্তরকে তিনি তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিষ্কারভাবেই দেখতে পেয়েছেন। ওই যুদ্ধ তার জন্য প্রকৃত অর্থেই ছিল মুক্তির জন্য যুদ্ধ। আশা ছিল যুদ্ধের মধ্য দিয়ে সমাজের সকল মানুষের মুক্তি আসবে। দেখেছিলেন ‘জনগোষ্ঠীর চেতনা’ উজ্জ্বল ভাবে জ্বলে উঠেছে, যে-দেখাটা অনেক দুর্ভোগ সত্ত্বেও তাঁর জন্য ছিল একটি দুর্লভ অভিজ্ঞতা। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি গৃহযুদ্ধ বা বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধ মনে করেন নি, মনে করেছেন সমাজ বিপ্লবের সংগ্রাম ও সম্ভাবনা। সমাজ বিপ্লবের কথাটা তিনি নাম করে বলেন নি, কিন্তু সেটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন, যার কথা এই রচনায় সবটা জুড়ে রয়েছে, এবং একে একটি ঐক্য দিয়েছে ও এতে বর্ণিত ঘটনার একটি পরিচ্ছন্ন বিশ্লেষণ উপস্থিত করেছে। বলাবাহুল্য সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয় নি। উঠতি ধনীরা রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে গেছে এবং মেহনতি মানুষ সেখানেই রয়ে গেছে যেখানে তারা আগে ছিল। একাত্তরের সতেরোই ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শহরে পথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে তাঁর মনে হয়েছিল, ‘দেশের “মুক্তিযুদ্ধ” হয়তো শেষ হয়েছে, গণমানুষের মুক্তির যুদ্ধ শেষ হতে এখনো অনেক বাকী।’ এই বাক্য দিয়েই তাঁর কাহিনীর শেষ; এবং এটা অবশ্যই একজন হতাশাবাদীর কথা নয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এই বইটি তিনি কেবল যে স্মৃতির দ্বারা তাড়িত হয়ে লিখেছেন তা নয়, স্বপ্নের তাড়নাও ছিল সঙ্গে। দেশে গণমানুষ আছে, তাদের মুক্তির সংগ্রাম চলছে এবং চলবে এই আশার কথাটা সমগ্র রচনাটির ভেতর ব্যাপ্ত রয়েছে।

 

যে-সত্যটিকে জাতীয়তাবাদীরা স্বীকার করেন না, এবং অন্যরা অনেকেই গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন মনে করেন না, তা হলো এই যে মুক্তিযুদ্ধের ওই চেতনা তৈরিতে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকাই ছিল মুখ্য। পূর্ববঙ্গকে স্বাধীন করার রণধ্বনি বামপন্থীরাই তুলেছিলেন। একেবারে শুরুতেই লেখক দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন বাম দলগুলোই জনগণের মধ্যে মুক্তির ওই আকাঙ্খা  জাগিয়ে তোলে, ওই কৃতিত্ব তাদেরই। এই প্রসঙ্গে তিনি একাত্তরের মার্চের দুই তারিখে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন পূর্ববাংলা শ্রমিক আন্দোলনের নামে প্রচারিত একটি খোলা চিঠির উল্লেখ করেছেন যেটিতে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে উদ্দেশ্য করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজনে একটি ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এটিকে তিনি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল বলে মনে করেন, কারণ এতে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ও ‘মুক্তিবাহিনী’ শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলো জাতীয়তাদীরা তখন মোটেই উচ্চারণ করতেন না। তিনি যথার্থই মনে করেন যে চিন্তাচেতনায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের তুলনায় বামপন্থীদের একাংশ অনেক এগিয়ে ছিলেন। জাতীয়তাবাদীরা যেখানে ক্ষমতার হস্তান্তরে উৎসাহী ছিলেন, বামপন্থীরা সেখানে স্বপ্ন দেখতেন ক্ষমতার রূপান্তরের।

 

বামপন্থীরা কেবল যে মুক্তির পক্ষে জনসচেতনতা তৈরি করেছেন তা-ই নয়, হানাদার দস্যুদের সঙ্গে সরাসরি লড়াইও করেছেন। এমন কি দুই কুকুরের কামড়াকামড়ি তত্ত্বে যাঁরা বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরাও বিদেশী কুকুরটির মোকাবিলা করতে মোটেই পিছপা হন নি। বিশেষ করে সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে তরুণ-তরুণীরা যে-ভূমিকা রেখেছিল ইরতিশাদ সেটিকে উল্লেখযোগ্য মনে করেছেন। তা সেটি উল্লেখযোগ্য বটে।

 

কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার এই যে মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীরা নেতৃত্ব দিতে পারেন নি। তাঁরা বিভ্রান্ত ও বিভক্ত ছিলেন। মস্কোপন্থীরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে চেয়েছেন, কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদেরকে গুরুত্ব দেয় নি। পিকিংপন্থীদের কেউ কেউ বুঝে উঠতে পারেন নি যে পিকিং যে পাকিস্তানকে সমর্থন করছে সেটা মতাদর্শিক বিবেচনায় নয়, তার নিজস্ব জাতীয়তাবাদী ভারতবিরোধী স্বার্থের কারণেই। তবু তাঁরাও পাকিস্তানী দস্যুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্রভাবেই রুখে দাঁড়িয়েছেন। বামপন্থীদের জন্য একটা বড় অসুবিধার জায়গা ছিল এটি যে, জাতীয়তাবাদীরা ক্ষেত্রবিশেষে পাকিস্তানীদের চাইতেও বামপন্থীদেরকে বড় দুশমন ভেবেছেন এবং তাদেরকে যুদ্ধে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করেই ক্ষান্ত হন নি, বাম-বিরোধী ভারত সরকারের সাহায্যে তাদের ওপর অত্যাচারও করেছেন। বামপন্থীদের পক্ষে আরও একটি বড় দুর্বলতা ছিল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে না-থাকাটা। জনগণকে সংঘবদ্ধ করার ব্যাপারে মওলানার জনপ্রিয়তাকে তাঁরা কাজে লাগাতে পারতেন; সেটা তাঁরা করেন নি।

 

মওলানা ভাসানীর কথা এই বইতে স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে। মওলানাই স্বাধীনতার কথা প্রকাশ্য জনসভায় সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন, কিন্তু তিনি পূর্ববঙ্গ নয়, পূর্ব পাকিস্তানের কথা বলতেন। ইরতিশাদের ধারণা এর কারণ ভাসানী ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ভাসানীর এই সন্দেহ যে ভ্রান্ত ছিল না যুদ্ধের সময়েও তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। শেখ মুজিব যে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে না গিয়ে পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেফতার বরণ করলেন তার পেছনেও ভারত সম্পর্কে তাঁর আস্থার অভাব কাজ করেছে বলে ইরতিশাদ মনে করেন। তাঁর এই ধারণাও অযৌক্তিক নয়।

 

ইরতিশাদ নিজেও তাঁর ওই অল্পবয়সেই মুক্তিযুদ্ধের ভারত-নির্ভরতা নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেছেন। যে ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নিজের দেশে বামপন্থীদেরকে নিষ্ঠুর ভাবে পীড়ন করছেন তিনি বাঙালীর প্রকৃত মুক্তিতে সত্যি সত্যি আগ্রহী এটা বিশ্বাস করা তাঁর জন্য সহজ ছিল না। পরে তাঁর কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে ভারত সরকারের অভিপ্রায় ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানকে পরাভূত করা আর আওয়ামী লীগের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা নিশ্চিত করা।

 

একাত্তরের যুদ্ধ পাকিস্তানী শাসকদের নির্বুদ্ধিতার অতিউজ্জ্বল নিদর্শন বটে। তারা জানতো না তারা কি করছে। বামপন্থীদের ব্যর্থতাটাও ঐতিহাসিক; তাঁরা জানতেন না কি করতে হবে। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকদের জন্য ঘটনাটা ছিল চরম সঙ্কটের, তাঁরা ঠিক করতে পারছিলেন না কি করবেন; এবং কল্পনাও করতে পারেন নি পাকিস্তানী হানাদারেরা কতটা নৃশংস হতে পারে।

 

এ বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শেখ মুজিবের মূল্যায়ন। ইরতিশাদ কট্টর বামপন্থীদের গতানুগতিক দৃষ্টিতে শেখ মুজিবকে দেখেন নি; বরঞ্চ জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে শেখ মুজিব যে সততা ও সাহসের পরিচয় দিয়েছেন তার যথার্থ প্রশংসা করেছেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সাতই মার্চের বক্তৃতা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য। এই বক্তৃতাকে তিনি রাজনীতিতে পরস্পরবিরোধী শক্তির মধ্যে সময়োপযোগী ভারসাম্যরক্ষার প্রজ্ঞাদীপ্ত সফল দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। তাঁর এ মত যে সঠিক তাতে সন্দেহ নেই।

 

এই বক্তৃতার পেছনে অবশ্য অনেক রকমের চাপ, উত্তাপ ও তৎপরতা ছিল। আওয়ামী লীগের চরমপন্থী অংশ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য চাপ দিচ্ছিল। ইয়াহিয়া খানের কর্মকাণ্ড ওই ঘোষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছিল। কিন্তু শেখ মুজিব ধীর স্থিরভাবে তাঁর বক্তব্য ঠিক করেছেন।

 

ইরতিশাদ উল্লেখ করেছেন সাত তারিখের বক্তৃতার আগে শেখ মুজিব তৎকালীন ঢাকার সেনাপ্রধান খাদিম হোসেন রাজার কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন এই বলে যে, দলের চরমপন্থীদের চাপের মুখে পরদিনের জনসভায় স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া ছাড়া তাঁর পক্ষে কোনো উপায় থাকবে না, তাই তাঁকে যেন গ্রেফতার করা হয়। খাদিম হোসেন রাজার মনে হয়েছিল যে সামরিক বাহিনীর মনোভাব জানবার জন্যই কাজটা করা হয়েছিল। মুজিবের প্রস্তাবে তিনি রাজি হন নি, উল্টো জানিয়ে দিয়েছেন যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সামরিক বাহিনীর পক্ষে কামান-ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া উপায় থাকবে না। এই তথ্য পাওয়া গেছে পাকিস্তানী আমলা হাসান জহীরের বই থেকে। ইরতিশাদ তাঁর লেখায় সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ঘটনাটি সত্য কী না এ বিষয়ে। অতিসম্প্রতি খাদিম হোসেন রাজার নিজের লেখা একটি বই প্রকাশিত হয়েছে, নাম ‘এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই অউন কান্ট্রি’, যেটি তিনি আগেই লিখেছিলেন, কিন্তু ছাপা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে, হয়তো সেটাই তাঁর ইচ্ছা ছিল, কেননা বইতে ইয়াহিয়া খান, নিয়াজী ও টিক্কা খান সম্পর্কে যে-সব মন্তব্য আছে তা নিয়ে তাঁর জীবনকালে বিতর্ক তৈরি হোক সেটা সম্ভবত তিনি চান নি। এ বই থেকে জানা যাচ্ছে সত্যি সত্যি আওয়ামী লীগের দূত জেনারেল রাজার সঙ্গে দেখা করেছিলেন, একবার নয় দু’বার, একবার সন্ধ্যায় আরেকবার মধ্যরাতে। পাকিস্তানী সেনাপতি প্রথমবার বলেছেন শেখ মুজিব ইচ্ছা করলেই সেনাছাউনিতে চলে এসে তাঁর ‘অতিথি’ হতে পারেন, তাতে তাঁর আপত্তি থাকবে না, দ্বিতীয়বার সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে অকল্পনীয় রক্তপাত ঘটবে। খাদিম হোসেন জানাচ্ছেন যে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত অবস্থায় সাত তারিখের বক্তৃতাটি তিনি সরাসরি শুনেছেন, এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আল্লাহর কাছে শোকর করেছেন। শেখ মুজিবের প্রজ্ঞারও তিনি প্রশংসা করেছেন।

 

খাদিম হোসেনের স্মৃতিকথা থেকে পাকিস্তানী হানাদারদের মনোভাবের বিষয়ে কিছু তথ্য জানা যায় যা ঘটনাপ্রবাহকে বুঝতে সাহায্য করে। এদের মধ্যে একটি হলো এই যে, জানুয়ারীর শেষ ও ফেব্র“য়ারীর প্রথম দিকেই ইয়াহিয়া খান সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন যে রাজনৈতিক নয় সামরিক উপায়েই ‘সঙ্কটের’ সমাধান করবেন। তা থেকে বোঝা যায় যে ঢাকায় যে ‘সংলাপ’ চলছিল সেটা ছিল একেবারেই অর্থহীন এবং সামরিক প্রস্তুতির একটি আচ্ছাদন মাত্র।

 

যুদ্ধের শুরুতেই চট্টগ্রাম থেকে বেতারে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর অনেকেই শুনেছেন, ইরতিশাদও শুনেছেন। পাকিস্তানী হানাদারেরাও যে সেটা শুনছিল খাদিম হোসেনের বইতে তার উল্লেখ আছে। খাদিম বলছেন যে, মেজর জিয়া একটি ট্রান্সমিটারের সর্বোত্তম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাঙালীদেরকে উত্তেজিত করছিলেন, যে জন্য বিমান থেকে আক্রমণ করে ওই প্রচারব্যবস্থাকে স্তব্ধ করে দিতে হয়েছিল।

 

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে এবং প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ছাত্রদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা ইরতিশাদের বইতে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তাঁদের ছাত্র সংগঠন পূর্ববংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন একাত্তরের বিশে জানুয়ারী আসাদ দিবসে স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের দাবীকে সামনে আনার জন্য দেশব্যাপী হরতাল ডেকেছিল, এবং সেই হরতাল সফল হয়েছিল। এটিও ইতিহাসের অন্তর্গত একটি ঘটনা, যেটি বড় বড় বিবরণগুলোতে থাকে না। কিন্তু থাকার মতো বটে, বিশেষ করে বামপন্থীদের তৎকালীন ভূমিকা এবং দেশবাসীর মনোভাব বোঝার জন্য।

 

ছাত্রদের ভূমিকাতে সামরিক বাহিনী যে বিশেষ ভাবেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল তার প্রমাণ আছে খাদিম হোসেনের বইতে। পঁচিশে মার্চের সেই নৃশংস ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনায় যেসকল লক্ষ্যবস্তুকে প্রাথমিক আক্রমণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছিল তাদের মধ্যে ঢাকা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোর উল্লেখ ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট, এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদেরকে ঢাকাসহ পূর্ববঙ্গের প্রত্যেকটি শহরে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ছাত্রনেতাদেরকে খুঁজে বের করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল; রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে কোনো ইতর বিশেষ করা হয় নি।

 

এটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয় যে, জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টিতে – তা তারা পাকিস্তানীই হোন কি বাঙ্গালী হোন –  প্রধান শত্রু ছিলেন সমাজতন্ত্রীরাই, যে খবরের সমর্থন পাই খাদিম হোসেনের স্মৃতিকথাতেও। সেখানে বলা আছে যে, সাতই মার্চে স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবের ওপর যাঁরা চাপ দিচ্ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন কয়েকজন কট্টরপন্থী কমিউনিস্ট যাঁরা নিজেদের আদর্শের প্রতি আনুগত্য ঠিক রেখেই আওয়ামী লীগের ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন, এবং ভেতর থেকে মুজিবের দলকে দুর্বল করার তালে ছিলেন। কী চমৎকার আবিষ্কার ও আন্তরিক সহমর্মিতা! সরকারের ভেতরের লোক হিসাবে খাদিম হোসেন জানাচ্ছেন যে, তাঁর সময়ে তিনি লক্ষ্য করেছেন যে ‘রাষ্ট্রীয়’ নিরাপত্তা নিয়ে গভর্নরের সঙ্গে গোয়েন্দাপ্রধানদের যে বৈঠক হতো তাতে ব্যতিক্রমবিহীন ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হতো আন্ডারগ্রাউন্ড কমিউনিস্টদের কাজকর্মের ওপর, যাদেরকে ধরা যেতো না, এবং যাদের তুলনায় সরকারকে দেখা যেত এক কদম পিছিয়ে রয়েছে। এটা মিথ্যা নয় যে, বামপন্থীদের যত না শক্তি ছিল তাঁর চেয়ে বেশি ছিল আপোস না-করার মনোভাব; সরকারী লোকেরা তা জানতো, এবং সে জন্য তাদেরকেই প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করতো। ব্যাপারটা একাত্তরের পরেও দেখা গেছে; দেশের নতুন শাসনকর্তারা আলবদর রাজাকারদের খোঁজেন নি, খোঁজ করেছেন বামপন্থীদের।

 

পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা বাঙালী ছাত্রদের রাজনীতি-সচেতনাকেও বিপজ্জনক জ্ঞান করতো। ইরতিশাদ উল্লেখ করেছেন যে, ইয়াহিয়া খানের আমলে ছাত্রদেরকে নামমাত্র মূল্যে সিনেমার টিকেট দেওয়া হতো যাতে করে তারা মিছিলে মিটিং-এ না গিয়ে সিনেমা হলে ঘোরাঘুরি করে। তাদেরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আরো একটি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল বলে আমরা জানি; সেটা হলো রেল-স্টিমার-বাস-লঞ্চ সর্বত্র অর্ধেক দামে ভ্রমণের সুযোগ দেওয়া। এর আগে আইয়ুব খান নীতিগ্রহণ করেছিলেন যে, শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধুলা ও আনন্দ-উৎসবের নানা রকমের আয়োজন করে দেবেন। সেটা তিনি দিয়েছিলেনও। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয় নি, ছাত্ররা বেতমিজই রয়ে গেছে; তাদের দেওয়া এগার দফা আওয়ামী লীগের ছয় দফাকে ছাড়িয়ে গেছে, এবং জনগণকে স্বায়ত্তশাসন নয়, স্বাধীনতা তথা মুক্তি অনিবার্য আবশ্যকতার বিষয়ে সচেতন করে তুলেছে।

 

ছাত্রদের ভেতরও জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক বিভাজনটি ছিল। লেখক লক্ষ্য করেছেন ছাত্র ইউনিয়নের দুই গ্রুপের ছেলেমেয়েরা ছাত্রলীগের সদস্যদের তুলনায় পরীক্ষায় ভালো ফল করতো; সাংস্কৃতিকভাবেও তারা ছিল অধিকতর অগ্রসর; কিন্তু ছাত্র সংসদের নির্বাচনে ছাত্রলীগই জয়ী হতো। রাজনীতির বড় এলাকাতেও এই বিভাজন ও পার্থক্যটি সত্য ছিল। সমাজতন্ত্রীরা অগ্রসর, কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা জনপ্রিয়। এর পেছনে সামাজিক একটা কারণ ছিল, জনগণ সাংস্কৃতিকভাবে জাতীয়তাবাদীদেরকেই কাছের মানুষ বলে মনে করেছে। বামপন্থীরা, যাঁরা সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চান, তাঁদের জন্য এখানে শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।

 

ওই যে আপনজন মনে করা না-করা সে-ব্যাপারটা যুদ্ধের সময়েও দেখা গেছে। সপরিবারে ইরতিশাদরা যখন চট্টগ্রাম শহর ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে নৌকায় করে গ্রামের বাড়িতে যাবার উদ্যোগ নিয়েছেন তখন মাঝি হঠাৎ বেঁকে বসলো, কারণ তাঁদের ভেতর দু’জনের চেহারা ভিন্ন রকমের দেখে তার সন্দেহ হয়েছে ওরা শত্রুপক্ষের লোক। এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে। এর চেয়ে ভয়ানক কাণ্ডও ঘটেছে। যুদ্ধে যাচ্ছে যুবক, চেহারাটা ঠিক বাঙালীর মতো নয়, পড়েছে ইংরেজী মাধ্যমে তাই তার বাংলা বলায় কৃত্রিমতা, এই অপরাধে সে নিহত হয়েছে এমন খবরও আমরা পেয়েছি। সাধারণ মানুষরাই এ ধরনের কাণ্ড ঘটিয়েছে। বিদ্বেষটা ছিল সকল অবাঙালীর প্রতিই; কিন্তু বাঙালীকেও যে অবাঙালী বলে ভুল করা হতো এর পেছনে যে মনোভাবটি কাজ করেছে তাকে নিছক জাতিবৈরিতা বলা যাবে না, এর সঙ্গে শ্রেণীর বোধটাও জড়িত ছিল। অবাঙালীরা আমাদের লোক না, এই বক্তব্যটা এটাও জানাচ্ছে যে ওরা আমাদের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাভোগী, যেসকল সুবিধা অবাঙালী বলেই ওরা পেয়েছে। কারণ অবাঙালীরাই ছিল শাসকশ্রেণী।

 

‘আমার চোখে একাত্তার’ আসলে ইতিহসের বই, খণ্ড ইতিহাসের বলে মনে হবে, কিন্তু এটি বৃহতের খণ্ড মাত্র নয়, এর ভেতর বৃহতের বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান। অনেক ঘটনাই আমরা ভুলে যেতে বসেছি, এবং কোনো কোনো ঘটনা এখন আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় না যতটা সেই সময়ে ছিল। যেমন, সত্তর সালের বারই নভেম্বরের সেই প্রলয়ঙ্করী ঝড় যা পূর্ববঙ্গবাসীর মনে এই ধারণাকে আরো পরিষ্কার করে দেয় যে পাকিস্তানী শাসকদের দৃষ্টিতে পূর্ববঙ্গ উপনিবেশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। এবং যার ফলে আওয়ামী লীগের জন্য একচেটিয়া বিজয় একেবারেই নিশ্চিত হয়ে পড়ে। ইরতিশাদ আমাদেরকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে যুদ্ধ শুরু হবার আগে অনেক জায়গাতেই বিহারীদের সঙ্গে যে ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তাও ছিল ভয়াবহ। নেতৃত্বের অভাব ছিল, যাঁরা নেতা ছিলেন তাঁরা অনুসারীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন নি, ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের ভেতর বিচক্ষণতার মারাত্মক রকমের অভাব ছিল। অন্যদিকে আবার বাঙালী আলবদর আলশামসদের যে নৃশংসতা সেটি ছিল যেমন অবিশ্বাস্য তেমনি সুসংগঠিত।

 

শ্রেণীর প্রসঙ্গ উঠেছে। লেখক অবাক হয়ে দেখেছেন যে যুদ্ধ যখন তুঙ্গে উঠেছে সেই সময়েই রাজনীতিতে যে সকল সহপাঠী তাঁর নিজের চেয়েও বেশি সক্রিয় ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই এইচএসসি পরীক্ষা দিতে উৎসাহী। এ ব্যাপারে জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতন্ত্রীরা বেশ একাকার হয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনো মন্তব্য করেন নি, কিন্তু পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, শ্রেণীগত ভাবে মধ্যবিত্ত দোদুল্যমান থাকে, এবং সমষ্টিগত স্বার্থকে নিজের স্বার্থের চেয়ে বড় করে তুলতে তার অপারগতাটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

 

ইতিহাসের এ বই গল্পের মতো প্রবহমান, কৌতূহলোদ্দীপক ও আকর্ষণীয়। লেখকের অনুভূতি গভীর কিন্তু তার লেখায় আড়ম্বর বা আড়ষ্টতা কোনোটাই নেই। তার ভাষা ঝরঝরে, বুদ্ধিদীপ্ত এবং হৃদয়গ্রাহী। চীন সরকার যে রেডিও পিকিঙের মাধ্যমে নক্সালবাড়ি আন্দোলনকে পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিল, তার পেছনের উদ্দেশ্য যে আন্তর্জাতিকতাবাদ ছিল না, ছিল ভারত সরকারকে বিব্রত করার ইচ্ছা এটা ওই আন্দোলনের নেতারা বোঝেন নি, কিন্তু তরুণ ইরতিশাদ বুঝেছিলেন। এ ধরনের বোঝার ব্যাপারটাই এই রচনাটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

তাঁকে ধন্যবাদ তাঁর নিজের উপলব্ধিকে অন্যদের কাছে পৌঁছে দেবার উদ্যোগ নিয়েছেন। এ বই পড়লে কেবল যে নতুন প্রজন্মই লাভবান হবে তা নয়, পুরাতন প্রজন্মের মানুষও তখনকার ঘটনাকে নতুনভাবে বিবেচনা করতে উৎসাহী হবেন। তাঁর অনেক উক্তি অত্যন্ত বিদগ্ধ ও স্মরণীয়। যেমন, তিনি যখন লেখেন, যুদ্ধ ‘শুরু করেছিল পাকিস্তানীরা, শেষ করেছে ভারতীয়রা’, তখন ওই উক্তি সমস্ত যুদ্ধটাকেই নতুন ভাবে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। যে কেউ এ বই পড়লে বুঝবেন যে এটি একাধিকবার পড়বার মতো রচনা বটে।

 

একাত্তর ছিল অবিশ্বাস্য। পুরাতন পৃথিবীটাকে সে বদলে দিয়েছিল। পারস্পরিক সংবেদনশীলতা যেমন বেড়েছিল, তেমনি অবিশ্বাসও দেখা দিয়েছিল। কথা ছিল নতুন একটা পৃথিবী গড়ে উঠবে। কাজটা যে জাতীয়তাবাদীরা করবেন, এমনটা আশা করার কারণ ছিল না। দায়িত্ব ছিল বামপন্থীদেরই। কিন্তু একাত্তরে তাঁরা অনেকেই বিভ্রান্ত ছিলেন, তাঁদের বিভাজনও ছিল মর্মান্তিক। একাত্তরের পরেও তাঁরা সমাজ বদলের স্বপ্নটাকে বাস্তবায়িত করতে পারেন নি। নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। পুরাতন নেতৃত্ব অকার্যকর হয়ে পড়েছে। নেতাদের কেউ কেউ প্রাণ হারিয়েছেন, কেউ কেউ ক্লান্তি ও হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। অনেকে ক্ষমতার কাছাকাছি যাবার আশায় জাতীয়তাবাদীদের এদল ওদলে যোগ দিয়েছেন। ফলে তাঁরা ইতিহাস প্রবাহের ভেতর থাকতে পারেন নি, পরিত্যক্ত হয়েছেন; ক্ষতি করেছেন নিজেদের, এবং সেই সঙ্গে সমাজ-পরিবর্তনের আন্দোলনের।  ইরতিশাদ আহমদের আশাবাদের ভিত্তি সেই সব মানুষেরা যাঁরা মনে করেন গণমানুষের মুক্তির যে সংগ্রাম একাত্তরে একটা স্তরে গিয়ে পৌঁছেছিল সেটিকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না-পারলে আমাদের জন্য যে ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে তাকে কিছুতেই আশাব্যঞ্জক বলা যাবে না। কথাটি তিনি এভাবে বলেন নি, কিন্তু তাঁর সমস্ত বই জুড়ে ওই কথাটি পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। সিদ্ধান্ত হিসাবে নয়, উপলব্ধি হিসাবে।

এই বইটি লেখার জন্য তাঁকে অভিনন্দন।

 

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

১০.০১.২০১৩