গতকাল সিনিয়র অনেকর সাথে আড্ডা দিচ্ছি। একজন প্রশ্ন করলো এর পরিণতি কি হবে?এর অর্জনটাই বা কি?তার পর একে একে তাদের বিজ্ঞ মন্তব্য করে এর পরিণতি ব্যাখ্যা দিতে লাগলেন। সবার বলা শেষ হলে আমি জানতে চাইলাম। আচ্ছা একটা কথা বলেন তো আপনারা তো সবাই সংগ্রামের(মুক্তিযুদ্ধ) আগে জন্ম। অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে এসেছেন। আপনারা কি এই কয়দিন আগে (কাদের মোল্লার রায়ের আগে) চিন্তা করতে পারছেন যে দেশে এমন একটা গণ জাগরণ হবে? কোন আলামত কি আপনারা পেয়েছিলেন? কোন রকমের অনুমান কি আগে আপনাদের ছিল? সবাই নিরব। একজন বলল না এটা আমরা চিন্তাই করতে পারি নাই।

এবার আমি বললাম যে আন্দোলন সম্পর্কে আপনি চিন্তাই করতে পারেন নি। যে আন্দোলনের কোন পূর্বাভাসই আগে পাননি। যে আন্দোলনের ধারনা-ই আপনার ছিলনা । সেই আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে কেন এত চিন্তা করছেন? আন্দোলনের সম্ভাবনা যেহেতু চিন্তা করতে পারেন নাই তাই এর পরিণতিও আমাদের মাথায় আসার কথা না। (ভাষা গত ভাবে হয়তো আমি আর একটু বেশি নমনীয় ছিলাম) কিন্তু তারা কেউ এর কোন উত্তর করতে পারেনি।

এক সপ্তাহ স্থায়ী হাবার পরে আর কি পরিণতি আশা করে তারা? আসলে ভাল কি মন্দ এসব ব্যপার না। কোন গণজোয়ার ই তারা বেশিক্ষন সহ্য করতে পারেনা। এইটা নিয়ে এক ধরনের অস্বস্তিতে থাকেন এর কারন হয়তো বের করা যাবে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।আমি বলি, এই যে এক সপ্তাহ পার করলো এটাই এই আন্দোলনের বড় সফলতা। এমন একটা আন্দোলন বাংলাদেশে করাটাই এর বড় অর্জন। উল্লেখ করতে হলে হয়তো বলতে হবে। সংসদে নতুন বিল পাস হলো। পরবর্তীতে রাজাকারদের বিচারে হয়তো আরো বেশি মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন হবে। কিন্তু এই কয়টা হাতে কলমের হিসাবই শেষ নয়।

ফেসবুক থেকে রাজ পথে নেমে এসেছে তরুন সমাজ। যারা রাজনীতিকে অবজ্ঞা করতো তাদের কণ্ঠে বেজে উঠেছে রাজনৈতিক স্লোগান। যারা ভয়ে স্কুল কলেজ থেকে বাড়ির বাইরে কোথাও যেত না তারা এসেছে আন্দোলনের ডাকে। এই সব হলো হিসাব করা অর্জন।

তারও বাইরে আরো কিছু অর্জন আছে। প্রতিটা আন্দোলন মঞ্চেই দেখা যাবে স্লোগান ধরছে একজন নারী। এই বৃহত্তর আন্দোলনে নারী পুরুষের মাঝে ভারসাম্যতা এটা আগে কখনো দেখা যায় নি। কখনো কি চিন্তা করতে পেরেছি যে লাখ খানেক জনতার মাঝে একজন নারী নেতৃত্ব দিবে কেবল তার নেতৃত্বের জোরে?(হাসিনা খালেদা কিভাবে নেতৃত্ব দেয় সেটা সবাই জানি।) । আর আমাদের সমাজ,আমাদের দেশ এত সহজে তাদের এই আসন ছেড়ে দিবে? যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ ধর্মিক সেই দেশে কি করে এত নারীরা নেতৃত্বে চলে এলো? কেবল যে তারা মাইক হাতে স্লোগানই দিল তা নয় এই আন্দোলনে প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই তারা ছিল পুরুষের সমকক্ষ।

এটা নিঃসন্দেহে একটা বড় অর্জন।

কাউকে কাউকে গল্প বলতে শুনতাম। এই সময়ে যদি এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ হতো তবে নাকি একজনও মুক্তি যুদ্ধা পাওয়া যেত না।এই স্বার্থপর সময়ে নাকি কেউ যুদ্ধে যেতে চাইত না। এই গল্প আপনাদেরও অজানা না। এই এক সপ্তাহে এক জীবনের ভ্রান্ত ধারনা পাল্টে গেল। হাজার মানুষের মুখে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মিথের মৃত্যু ঘটল।হাজার আপস কামী মানুষের হাজার খানেক অজুহাত মাটিতে মিশিয়ে গেল। এই অর্জন কি ছোট করে দেখার কোন সুযোগ আছে?

এই স্বার্থপর সমাজে এই তরুনরা সারাদিন এক বোতল পানি ভাগ করে দেখিয়েছে যে তারাও সময়ে ত্যাগ করতে জানে। রাত জেগে পথে কাটিয়েছে আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে। এক প্লেট খিচুরি দুজনে ভাগ করে খেয়েছে। শীতে কম্বল ভাগাভাগি করে থেকেছে। গোসল না করে,চুল দাঁড়ি না কেটে,অভুক্ত পেটে স্লোগানের পর স্লোগান দিয়েছে। মায়েরা রান্না করে খাবার নিয়ে এসেছে তার অচেনা সন্তানদের খাওয়াতে। ভিখারি ভিক্ষার টাকা এনে জমা দিল সবাই মিলে খাবে বলে। ভাই বোনের হাত ধরে এসে যোগ দিল স্লোগানে। হয়তো অনেক তরুন বাবার রক্ত চোখ উপেক্ষা করে এসে চিৎকার করলো “ফাঁসি চাই ” বলে। আমরাও এই ত্যাগকে যদি মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের সাথে তুলনা করি খুব কি উনিশ বিশ হবে? “আমাদের ধমনীতে শহিদের রক্ত। তাদের এই রক্ত কোন দিন পরাজয় মানে না”। এই পরাজয় না মানাটা কি অর্জন নয়!

দীর্ঘদিন আওয়ামীলীগের দখলে থাকা “জয় বাংলা” এবার এসেছে জনগনের কাছে। সব পেশার,সব বয়সের,সব দলের মানুষ কণ্ঠ মিলিয়ে বলেছে জয় বাংলা। একাত্তরের পরে আবার জয় বাংলায় মুখরিত হয়েছে আকাশ বাতাস। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে যারা ইতস্তত করতো,যারা কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের বিষয় এড়িয়ে যেত। তারা বুকে পেল বল। তারা মনে পেল উদ্দাম। দীর্ঘদিন রাজাকাররা বুক ফুলিয়ে চলেছে এই দেশে। তাদের বর্বোরচিত আচরন দেখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগত।এখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে আর কোন দ্বিধা দন্দ্বের সৃষ্টি হবে না। মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে অহংকার করার মতো শক্তি এই প্রজন্ম চত্তরে ফিরিয়ে এনেছে। সবার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে মুক্তির দিনের সোনালী দিনের গল্প। এই প্রজন্ম চত্ত্বর প্রমাণ করেছে তারা মুক্তি যুদ্ধের মতো এমন ঘটনা সময়ের সাথে হারিয়ে যেতে পারেনা। এরা ছিল আমাদের রক্তে ,প্রয়োজনে বিস্ফোরিত হয়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসছে। চোখ মুখ,নাক,কান,বাহু দিয়ে বেড়িয়ে এসছে রাজ পথে।

যে রাজ পথে কেবল যান বাহন চলত। যে রাজ পথ থেকে বাসায় ফিরতে পারলেই আনন্দ হতো। যে রাজ পথে সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ থাকত। যে রাজপথ কিছু কুলাঙ্গারদের অস্ত্র মিছিলে প্রকম্পিত থাকত। সেই রাজপথে মানুষকে নামিয়ে এনেছে। প্রমাণ করেছে এই রাজপথ আমাদের । কোন গুণ্ডা সন্ত্রাসীদের এই পথ দখলের অধিকার নেই। কোন স্বাধীনতা বিরোধিতাকারী এই পথে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে চলার স্পর্ধা করতে পারেনা। সকল রাজাকার এবং তাদের দোষরদের স্পর্ধা কে মাটিতে মিশিয়ে এই রাজপথ মানুষকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এই কি প্রজন্ম চত্ত্বরের অর্জন নয়?

মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের কথা বলা লোকের অভাব কখনোই ছিলনা। এমন কি জামাতি শুয়োর গুলাও মুক্তি যুদ্ধের পক্ষের শক্তি এই পরিচয় দিত। এই আন্দোলন মুখোশ খুলেছে সব। এই হাসিনা,এই খালেদা কে কত ঢঙ্গের মুখোশ লাগিয়ে ঘোরে বেড়ায় তারও প্রমাণ এবার হলো। এতদিন যে বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতার ঘোষক তকমা নেবার চেষ্টা করেছিল। তাদের আসল চরিত্রও এই সুযোগে প্রকাশ পেল। তালে বেতালে তাদের কিছু কথা থেকে বিএনপির মাঝেও কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক আছে কিনা তাও প্রমাণ হলো। এই মুখোশ উন্মক্ত হওয়ায় অন্তত মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতিতে আর কেউ সুবিধা করতে পারবে না বলেই আমার ধারনা।

ভোটের রাজনীতিতে নিজেদের ক্ষমতা ভাগাভাগি করার যে দন্দ্ব নিয়মিত দেখতে পাই। সেনাবাহিনী সুযোগে যেভাবে এই দেশের মানুষের উপর স্টিম রোলার চালাবার চেষ্টা করে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে ভোটের আগে বিদেশি এমবেসিতে দৌড় ঝাঁপ পারে। এর বাইরেও যে তাদের ক্ষমতা থেকে টেনে নামাবার জোর এই বীর জনতার আছে এটা তারা ভুলেই গিয়েছিল। ভেবেছিল এই আপা আর এক ম্যাডামের কথার বাইরে এই দেশে কেউ কিছু করতে পারবে না। এই দম্ভও ধুলিসাৎ হলো। এই জনতা যদি ক্ষেপে যায় তবে এই এমবাসি গদি ধরে রাখতে পারবে না। এই সেনাবাহিনী অস্ত্র দিয়ে তাদের রুখতে পারবে না। এই রাজনৈতিক চাটুকারিতা জনতাকে ভুল বুঝাতে পারবে না। তাই সময় থাকতে সাবধান হও। এই আন্দোলন ই শেষ নয়। এই তরুনরা হয়তো সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবার এমন করে নামতে পারে। প্রতিবার আপনাদের তটস্থ করে তুলতে পারে। এই সতর্কতাই এই আন্দোলনের সফলতা।

জয় বাংলা।
রাজাকারের ফাঁসি চাই।
জামাত শিবির নিষিদ্ধ কর, করতে হবে।