বাস্তবতার যাদু (পর্ব-১): বাস্তবতা কি? যাদু কি?

বিজ্ঞান এবং অতিপ্রাকৃত: ব্যাখ্যা এবং এর শত্রু

তাহলে এটাই বাস্তবতা, আর এভাবে আমরা জানতে পারি কোন কিছু বাস্তব কি না। এই বইয়ের প্রত্যেকটা অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হবে বাস্তবতার একটা নির্দিষ্ট রূপ নিয়ে – যেমন সূর্য, ভূমিকম্প, বা রংধনু, অথবা বিভিন্ন ধরনের জন্তুজানোয়ার। আমি এখন আমার শিরোনামের অন্য শব্দটার দিকে তাকাতে চাই: জাদু। জাদু একটা পিচ্ছিল শব্দ: এটা সাধারণত তিনভাবে ব্যবহৃত হয়, তাই প্রথমেই আমার যেটা করা উচিত তা হল এদের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা। আমি প্রথমটাকে বলব ‘অতিপ্রাকৃত জাদু’, দ্বিতীয়টাকে ‘মঞ্চের জাদু’ এবং তৃতীয়টাকে (যেটা আমার প্রিয় অর্থ, এবং শিরোনামে যে অর্থ ব্যবহার করেছি) ‘কাব্যিক জাদু’।

অতিপ্রাকৃত জাদু হল সেইসব জাদু যা আমরা পৌরাণিক কাহিনী আর রূপকথায় খুঁজে পাই। ( অলৌকিক ঘটনাতেও, তবে ওগুলোকে আমি আপাতত একপাশে সরিয়ে রাখব এবং শেষ অধ্যায় তাদের কাছে ফিরে আসব।) এটা হল আলাদীনের প্রদীপের জাদু, জাদুকরের জাদু, গ্রিম ভাইদের, হ্যান্স ক্রিশ্চান এন্ডারসেন আর যে কে রওলিং –এর জাদু। এটা হল ডাইনির মন্ত্রবলে রাজকুমারকে ব্যাঙে পরিণত করার, অথবা পরী-মাতার কুমড়োকে চকচকে ঘোড়ায়টানা গাড়ীতে পরিণত করার কাল্পনিক জাদু। এগুলো হল গল্প যা সবাই স্নেহের সাথে আমাদের ছেলেবেলার স্মৃতিতে মনে করি, আর ক্রিসমাসের পুতুলনাচের আসরে অনেকেই এখনো উপভোগ করি। কিন্তু সবাই জানি এধরনের জাদু হচ্ছে শুধু কল্পনা। বাস্তবে কখনো ঘটেনা।

পরী

মঞ্চের জাদু, সে তুলনায়, সত্যিই ঘটে থাকে, এবং অনেক মজা হয়। অথবা অন্তত, কিছু একটা আসলেই ঘটে, যদিও সেটা দর্শকরা যেটা চিন্তা করে সেটা না। একজন ভদ্রলোক মঞ্চের উপরে (সাধারণত লোকই হয়ে থাকে, কোন এক কারণে, তাই আমি ‘ভদ্রলোক’ই বলবো তুমি ইচ্ছা করলে ‘ভদ্রমহিলা’ বলতে পার) আমাদের বিভ্রান্ত করে মনে করায় যে আশ্চর্য কোনকিছু (দেখে এমনকি অতিপ্রাকৃতও মনে হতে পারে) ঘটে গেছে যখন আসলেই যা ঘটেছে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। রেশমের রুমাল খরগোশে পরিণত হতে পারেনা, যেমন ব্যাঙ কখনো রাজকুমার হতে পারে না। আমরা মঞ্চে যা দেখি তা শুধু একটা কৌশল। আমাদের চোখ আমাদেরকে বিভ্রান্ত করছে –অথবা আরেকভাবে বলতে গেলে, জাদুকর অনেক কষ্ট করে আমাদের চোখকে বিভ্রান্ত করেছেন, হয়ত চালাকির সাথে এমনভাবে শব্দ ব্যবহার করে যাতে তিনি তার হাত দিয়ে আসলেই কি করছেন তা থেকে আমাদের মনোযোগ সরে যায়।

জাদুকর

অনেক জাদুকর সৎ এবং তারা তাদের নিয়মভঙ্গ করে দর্শকদেরকে জানিয়ে দেন যে তিনি শুধু একটা কৌশল প্রয়োগ করেছেন। যেমন জেমস দ্য এমাজিং র‍্যাণ্ডি, অথবা পেন আর টেলার, অথবা ডেরেন ব্রাউনের মতো মানুষরা। যদিও এইসব প্রশংসনীয় শিল্পীরা সাধারণত বলে দেন না ঠিক কিভাবে তারা কৌশলটা প্রয়োগ করেছেন – তা করলে তাদের জাদু-গোষ্ঠী (জাদুকরদের ক্লাব) থেকে বের করে দেওয়া হবে –তারা নিশ্চিত করেন যে দর্শকরা যেন জানে যে এর সাথে কোন অতিপ্রাকৃত জাদু জড়িত ছিল না। অন্যরা সরাসরি ব্যাখ্যা করেন না যে ব্যাপারটা শুধু একটা কৌশল, কিন্তু তারা কি করেছেন তার উপর কোন অতিরঞ্জিত দাবীও করেন না – রহস্যময় একটা কিছু ঘটেছে এরকম একটা উপভোগ্য অনুভূতি দিয়ে দর্শকদের ছেড়ে দেন, ব্যাপারটা নিয়ে মিথ্যা না বলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কিছু যাদুশিল্পী আছেন যারা ইচ্ছাকৃত ভাবে অসাধু, এবং তারা ভান করে যে আসলেই তাদের ‘অতিপ্রাকৃত’ বা অস্বাভাবিক শক্তি আছে। হয়ত তারা দাবী করে যে তারা আসলেই শুধু চিন্তাশক্তির সাহায্যে ধাতুকে বাঁকাতে পারে বা ঘড়ি থামিয়ে দিতে পারে। এইসব অসৎ ভণ্ড (চালিয়াত এদের জন্য উপযুক্ত একটা শব্দ) খনিজ আহরণকারী অথবা তেল কোম্পানিদের থেকে বড় অংকের সম্মানী আদায় করে এই বলে যে, ‘আধ্যাত্মিক শক্তি’র সাহায্যে তারা বলে দিতে পারবে কোনজায়গায় খনন করা উচিত। অন্যান্য চালিয়াতরা শোকগ্রস্ত মানুষদের ব্যবহার করে, এই বলে যে তারা মৃত মানুষদের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে। এটা যখন ঘটে তা আর শুধু মজা বা বিনোদন থাকে না, বরং মানুষের সরলতা এবং বেদনার সুযোগ নিয়ে তাদের প্রতারণার শিকারে পরিণত করা হয়। ন্যায্য ভাবে বলতে গেলে, এদের সবাই হয়ত চালিয়াত না। এদের মধ্যে কেউ কেউ আসলেই বিশ্বাস করে যে তারা মৃতের সাথে কথা বলেছে।

জাদুর তৃতীয় অর্থ হল যা আমি আমার শিরোনামে বোঝাতে চেয়েছি: কাব্যিক জাদু। একটা সুন্দর সংগীত শুনলে আমাদের চোখে পানি চলে আসে এবং আমরা অভিজ্ঞতাটাকে ‘জাদুকরী’ বলে বর্ণনা করি। অন্ধকার চাঁদ হীন, শহরের আলোহীন রাতে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে আনন্দে আমাদের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আমরা বলি দৃশ্যটা ‘খাটি জাদু’। আমরা হয়ত একই শব্দ ব্যবহার করি একটা টকটকে সূর্যাস্ত, অথবা পার্বত্য ভূ-দৃশ্য অথবা একটা অন্ধকার আকাশের বিপরীতে এক রংধনুকে বর্ণনা করতে গিয়ে। এ অর্থে, জাদু বলতে শুধু বোঝায় প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়া, প্রাণহরা এমনকিছু যাতে গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়, এমনকিছু যা আমাদেরকে আরও বেশী করে বেঁচে থাকার অনুভূতি দেয়। এই বইয়ের মাধ্যমে আমি তোমাকে দেখানোর আশা করছি যে বাস্তবতা– বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাহায্যে বোঝা বাস্তব দুনিয়ার ঘটনা-এই তৃতীয় অর্থে জাদুকরী, কাব্যিক অর্থে, বেঁচে-থাকাটা-চমৎকার অর্থে।

বাস্তবতার যাদু

এখন আমি অতিপ্রাকৃতের ধারনাতে ফিরে যেতে চাই, এবং ব্যাখ্যা করতে চাই কেন এটা আমাদের কখনো চারপাশের পৃথিবীতে এবং মহাবিশ্বে যা দেখি কখনো তার সত্যিকারের ব্যাখ্যা হতে পারে না। অবশ্যই, কোন কিছুর অতিপ্রাকৃত ব্যাখ্যা দাবী করা ব্যাখ্যা না করারই নামান্তর। আরও খারাপ। সেটা যে কখনো ব্যাখ্যা করা যেতে পারে সেই সম্ভাবনাকেও গলা টিপে মারা হয় এভাবে। আমি কেন একথা বলছি? কারণ কোনকিছু অতিপ্রাকৃত হলে সংজ্ঞাগতভাবেই তা প্রাকৃতিক ব্যাখ্যার গণ্ডির বাইরে। সেটা নিশ্চয়ই বিজ্ঞানের এবং সুপ্রতিষ্ঠিত, পরিক্ষিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি, যা জ্ঞানের বিশাল অগ্রগতির জন্য দায়ী, যেটার সুফল গত ৪০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে আমরা উপভোগ করছি, তার গণ্ডির বাইরে। কোন কিছু অতিপ্রাকৃত ভাবে ঘটেছে একথা বলার মানে শুধু এটা বলা না যে ‘আমরা এটা বুঝি না’ বরং এটা বলা যে ‘আমরা কখনো এটা বুঝতে পারবো না, তাই চেষ্টাও করো না’।

 

বৈজ্ঞানিকরা ঠিক উলটো পথ নেন। সবকিছু –এখন পর্যন্ত –ব্যাখ্যার অসামর্থ্যের উপরেই ভিত্তি করেই বিজ্ঞান উন্নতিলাভ করে, এবং সেটাকে উদ্দীপনা হিসেবে ব্যবহার করে প্রশ্ন করে যায়, সম্ভাব্য মডেল তৈরি এবং সেগুলোকে পরীক্ষা করে, যাতে আমরা ইঞ্চি ইঞ্চি করে সত্যের দিকে পথ করে এগোতে থাকি। যদি এমন কিছু ঘটে যা আমাদের বাস্তবতা সম্পর্কে এখনকার ব্যাখ্যার বিপরীতে যায়, বিজ্ঞানীরা সেটাকে বর্তমান মডেলের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে নেন, যা আমাদেরকে সেটাকে পরিত্যাগ করতে অথবা নিদেনপক্ষে বদলাতে হয়। এরকম সমন্বয় আর পরবর্তী পরীক্ষণের মাধ্যমে আমরা প্রকৃত সত্যের কাছ থেকে আরও কাছে যেতে থাকি।

 

একজন গোয়েন্দা যদি একটা হত্যাকাণ্ডে হতবুদ্ধি হয়ে, আলসেমি করে সমস্যাটা সমাধানের চেষ্টা না করে রহস্যটাকে অতিপ্রাকৃত বলে চালিয়ে দেয় তাকে তুমি কি বলবে? বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ ইতিহাস আমাদেরকে দেখায় যেসব কিছু একসময় অতি-প্রাকৃতিক মনে করা হত – ঈশ্বর (সুখী এবং রাগী দুটোই), পিশাচ, ডাইনী, ভূতপ্রেত, অভিশাপ আর জাদু টোনার কারণে ঘটেছে বলা হতো –আসলে তাদের প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা আছে: এমনসব ব্যাখ্যা যা আমরা বুঝতে পারি এবং পরীক্ষা করে দেখতে পারি এবং আস্থা রাখতে পারি। এরকম মনে করার একেবারেই কোন কারণ নেই যে যেসব ব্যাপারে বিজ্ঞান এখন প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিতে পারছে না সেগুলোর আসলে অতি-প্রাকৃতিক উৎস রয়েছে, যেমন আগ্নেয়গিরি বা ভূমিকম্প বা রোগবালাই রাগী দেবতাদের দ্বারা সংঘটিত হয়, একসময় যা মানুষ বিশ্বাস করত। অবশ্যই, এটা কেউই বিশ্বাস করে না যে একটা ব্যাঙকে রাজকুমারে পরিণত করা সম্ভব ( নাকি রাজপুত্র থেকে ব্যাঙ? মনে থাকে না) অথবা কুমড়াকে ঘোড়ার গাড়ীতে, কিন্তু তুমি কি কখনো একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখেছ কেন এ ঘটনাগুলো অসম্ভব? বেশ কয়েক পথে এটাকে ব্যাখ্যা করা যায়। আমার প্রিয় পথ হল এটা।

 

ব্যাঙ আর ঘোড়ার গাড়ী জটিল বস্তু, এক বিশেষ নিয়মে অনেকগুলো অংশ জোড়া লাগানো, একটা বিশেষ রীতিতে যা কোন দুর্ঘটনার মাধ্যমে ঘটা সম্ভব নয় (অথবা জাদুর কাঠির নাচনে)। জটিল বলতে এটাই বোঝায়। একটা ব্যাঙ অথবা একটা ঘোড়ার গাড়ীর মত জটিল বস্তু তৈরি করা অনেক কঠিন। একটা ঘোড়ার গাড়ী বানানোর জন্য তোমাকে সবগুলো অংশ ঠিক ঠিক পদ্ধতিতে একসাথে জোড়া লাগাতে হবে। তোমার কাঠমিস্ত্রি এবং অন্যান্য কারিগরদের দক্ষতা দরকার হবে। ঘোড়ার গাড়ী হঠাৎ করে অথবা আঙ্গুলের তুড়ি মেরে হিংটিংছট বললেই হয়ে যায় না। একটা ঘোড়ার গাড়ীর গঠন, জটিলতা, কার্য সম্পাদনকারী অংশ রয়েছে: চাকা আর অক্ষদণ্ড, জানালা আর দরজা, স্প্রিং আর প্যাড-ওলা সিট। ঘোড়ার গাড়ীর মত একটা জটিল বস্তুকে সরল কিছুতে – যেমন ছাইয়ে, রূপান্তর করা তুলনামুলকভাবে সহজ। পরীমা-র যাদুর-কাঠিতে শুধু একটা ব্লো-টর্চ লাগাতে হবে। প্রায় সবকিছুকেই ছাইয়ে পরিণত করা সহজ। কিন্তু কেউই ছাইয়ের স্তূপ – অথবা কুমড়ো –কে ঘোড়ার গাড়ীতে রূপান্তর করতে পারবে না। কারণ ঘোড়ায় টানা গাড়ী খুবই জটিল। আর শুধু জটিলই নয়, এর জটিলতা কাজে আসে এমন। এক্ষেত্রে লোকজনের ভ্রমণে।

উদাহরন-১

পরীমার জন্য কাজটা সহজ করে দিই। ধরি, একটা কুমড়োকে না ডেকে, সে ডাকল একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ী বানাতে যতগুলো অংশ লাগে সেগুলোকে। একটা বাক্স ভর্তি করে। মডেল প্লেন বানাবার সেট এর মত। একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ীর সেটে আছে শয়ে শয়ে তক্তা, কাচের শার্সি, রড আর লোহার বার, প্যাডিং দেবার কাগজ আর চামড়ার চাদর, আর আছে পেরেক, স্ক্রু আর সবগুলোকে ধরে রাখার জন্য আঠার পাত্র। এখন মনে করি, নির্দেশাবলী পড়ে নিয়মমাফিক ভাবে অংশগুলো জোড়া লাগাবার বদলে , সে টুকরোগুলো একটা বিশাল বস্তায় ভরে ঝাঁকাতে লাগলো। অংশগুলো ঠিক ঠিক ভাবে জোড়া লেগে একটা কার্যকরী ঘোড়া টানা গাড়ী তৈরি হবার সম্ভাবনা কতটুকু ? উত্তর হল – কার্যত শূন্য। এর একটা কারণ হল বিশাল সংখ্যক সম্ভাব্য উপায় তুমি এলোমেলো অংশগুলো জুড়তে পারো যেগুলো একটা কার্যকরী ঘোড়া টানা গাড়ী- বা কার্যকরী কোন কিছুই – দেবে না ।

উদাহরন-২

তুমি যদি একগাদা টুকরো অংশ নিয়ে এলোমেলোভাবে ঝাঁকাতে থাকো, সেগুলো হয়ত মাঝে মাঝে এমনভাবে বিন্যস্ত হবে যেটা কোন কাজে আসতে পারে, বা আমরা কোন কারণে বিশেষ কিছু বলে চিহ্নিত করতে পারব। কিন্তু যত সংখ্যক ভাবে তা হতে পারে তা খুব ছোট। যত সংখ্যক ভাবে সাজালে সেগুলো আমরা আবর্জনার স্তূপ ছাড়া অন্যকিছু বলে চিহ্নিত করব না তার তুলনায় অতি অতিক্ষুদ্র। একগাদা টুকরো অংশকে এলোমেলো ভাবে বার বার সাজানোর কোটি কোটি রকম উপায় আছে। কোটি কোটি রকম উপায় আছে তাদেরকে আরেকরকম টুকরো অংশর স্তূপে পরিণত করার। প্রত্যেকবার যখন তুমি অদলবদল করো, তুমি একটা অনন্য আবর্জনার স্তূপ পাও যা আগে কখনো দেখা যায়নি – কিন্তু এই কোটি কোটি রকম সম্ভাব্য স্তূপের মধ্যে শুধু অতিক্ষুদ্র সংখ্যক বিন্যাস কোনরকম দরকারি কাজ করতে পারবে ( যেমন তোমাকে নাচের আসরে নিয়ে যাওয়া ) অথবা কোনরকমভাবে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ বা স্মরণীয় হবে।

 

কখনো কখনো আমরা আক্ষরিক অর্থেই গুনতে পারি কতভাবে আমরা এক সার ক্ষুদ্র অংশকে রদবদল করতে পারি – যেমন এক প্যাকেট তাসের ক্ষেত্রে, যেখানে ‘টুকরো অংশ’ গুলো হচ্ছে প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা তাস। ধর তাস বণ্টনকারী প্যাকেটের তাসগুলো অদলবদল করে চারজন খেলোয়াড়ের কাছে বণ্টন করল, যাতে প্রত্যেকের কাছে ১৩ টা করে তাস থাকে। আমি আমার ভাগের তাসগুলো তুলে বিস্ময়ে খাবি খেলাম। আমার কাছে ইসকাপনের পুরো ১৩ টা কার্ডই এসেছে! সবগুলো ইসকাপন। আমি এতটাই চমকে গেছি যে খেলা বন্ধ করে আমার তাসগুলো অন্য তিন খেলোয়াড়কে দেখালাম। জানি আমার মত ওদেরও তাক লেগে যাবে। কিন্তু তখন, একে একে প্রত্যেক খেলোয়াড় তাদের তাসগুলো টেবিলে বিছাতে লাগলো, আর প্রত্যেকের তাস দেখে আমাদের বিস্ময়ের মাত্রা বেড়ে যেতে লাগলো। প্রত্যেকের কাছে ‘নিখুঁত’ দান। একজনের কাছে ১৩ টা হরতন, আরেকজনের কাছে ১৩টা রুহিতন, আর শেষের জনের কাছে ১৩ টা চিড়িতন।
তাস

এটা কি কোন অতিপ্রাকৃত যাদু? আমরা হয়ত তা-ই ভাবতে প্রলুব্ধ হবো। গণিতবিদরা এরকম একটা চমকপ্রদ তাস বণ্টন ঘটনাক্রমে ঘটে যাবার সম্ভাব্যতা গুনে বের করতে পারেন। দেখা গেছে সেটা অসম্ভব রকম ছোট একটা সংখ্যা: প্রতি ৫৩৬, ৪৪৭, ৭৩৭, ৭৬৫, ৪৮৮, ৭৯২, ৮৩৯, ২৩৭, ৪৪০, ০০০ বারে ১ বার। জানিই না সংখ্যাটা আমি কখনো উচ্চারণ করতে পারবো কিনা! তুমি যদি বসে ট্রিলিয়ন বছর ধরে তাস খেলতে থাকো তাহলে কোন একবার এই রকম নিখুঁত বণ্টন পেতে পারো। কিন্তু – আর এখানেই ব্যাপারটা – এই বণ্টন কিন্তু এখন পর্যন্ত ঘটে থাকা অন্যসব তাস বণ্টনের থেকে কোন অংশেই কম সম্ভাব্য নয়! ৫২ তাসের যেকোনো নির্দিষ্ট বণ্টনের সম্ভাবনা হচ্ছে প্রতি ৫৩৬, ৪৪৭, ৭৩৭, ৭৬৫, ৪৮৮, ৭৯২, ৮৩৯, ২৩৭, ৪৪০, ০০০ বারে ১ বার। কারণ এটা হচ্ছে সকল সম্ভাব্য বণ্টনের মোটসংখ্যা। ব্যাপারটা এই যে বেশিরভাগ তাসের বণ্টনের ক্ষেত্রে আমরা এমন কোন বিশেষ বিন্যাস দেখি না যা আমাদের কাছে অসাধারণ কিছু বলে মনে হতে পারে। আমরা শুধু ওই তাস বণ্টনগুলোই খেয়াল করি যেগুলো কোন কারণ বসত লক্ষণীয় হয়।

 
একজন রাজকুমারকে টুকরো করে কেটে টুকরো অংশগুলো অদলবদল করে তুমি তাকে কোটি কোটি রকম জিনিসে রূপান্তর করতে পার। অবশ্য যদি তুমি তাকে টুকরো করার মত নিঠুর হও তবেই। কিন্তু এসব বিন্যাসের বেশিরভাগই দেখে জগাখিচুড়ি বলে মনে হবে – সেই সব অর্থহীন এলোমেলোভাবে বণ্টন করা তাসের দানের মত। এলোমেলোভাবে বিন্যাস করা রাজকুমারের টুকরোগুলোর সম্ভাব্য বিন্যাসের অতিক্ষুদ্র সংখ্যক বিন্যাস চেনা যাবে বা কোন কাজে আসবে, ব্যাঙের জন্য হলেও।

 

রাজার কুমার ব্যাঙে রূপান্তরিত হয় না, আর কুমড়ো হয় না ঘোড়ায় টানা গাড়ীতে। কারণ ব্যাঙ আর ঘোড়ায় টানা গাড়ী হচ্ছে জটিল বস্তু যাদের অংশগুলো প্রায় অসীম সংখ্যক আবর্জনার স্তূপে বিন্যস্ত করা সম্ভব। তারপরও আমরা জানি, প্রত্যেকটা মানুষ, প্রতিটা কুমির, প্রতিটা কোকিল, প্রতিটা গাছ এবং এমনি প্রতিটা ক্ষুদ্র বাঁধাকপি – মূলত সরলতর রূপ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। তাহলে সেটা কি ভাগ্যের ব্যাপার না, অথবা এক রকমের যাদু? না! একেবারেই না! এটা একটা প্রচলিত ভুল-ধারনা। তাই আমি এখন ব্যাখ্যা করতে চাই কেন আমরা বাস্তব জীবনে যা দেখি তা আকস্মিক ঘটনা বা ভাগ্যের জোরে বা ‘যাদুকরী’ (অবশ্যই, যা আমাদের বিস্ময় আর আনন্দে পরিপূর্ণ করে এই নিরেট কাব্যিক অর্থ বাদ দিয়ে) কোনকিছুর কারণে ঘটেনি।

………………(চলবে)