লিখেছেন: শুভজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

অ্যাকিলিসকে চেনেন তো? হ্যাঁ, ইলিয়াডের অ্যাকিলিসের কথাই বলছি। ট্রয়ের যুদ্ধের সেই গ্রীক বীর।

 

প্রশ্ন হল তার সাথে কচ্ছপের কী সম্পর্ক!

 

খোলসা করা যাক। আমরা আলোচনা করতে চলেছি “অসীম” সংক্রান্ত কিছু প্যারাডক্স নিয়ে। গণিতের জগতে অসীম বা ইনফিনিটি ব্যাপারটা নিয়ে অনেক গোলযোগ ছিল এককালে। এককালে বলতে বোঝাচ্ছি ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তখন অসীম ব্যাপারটা নিয়ে নানা গণিতজ্ঞের নানা মত ছিল। অসীম জিনিসটার সংজ্ঞাও তখন স্পষ্ট ছিল না।

 

ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডি প্যারাডক্স:

 

বার্ট্রান্ড রাসেলের আলোচনায় ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডির প্যারাডক্স বিখ্যাত হয়ে ওঠে।[১] ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডি হলেন অষ্টাদশ শতকের এক ঔপন্যাসিক লরেন্স স্টার্ন[২] এর “ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডি” উপন্যাসের নায়ক। তাঁর জীবন এতোটাই ঘটনাবহুল ছিল যে তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর একদিনের সব ঘটনা লেখার জন্য এক বছর সময় লাগতো! ভেবে দেখুন!

 

তো ধরে নিলাম, আমাদের এই নায়কের জীবনে অসীম সময় আছে। তাহলে? তাঁর সমগ্র জীবনকালে বেশ কিছু বছর আছে। তার মানেই বেশ কিছু দিন আছে।

ধরে নিলাম কোনও ব্যক্তি মোট ৮০ বছর বাঁচলেন। তাহলে তাঁর জীবনে-


মোট বছর = ৮০

মোট দিন = ৮০ x ৩৬৫ (প্রায়)
সুতরাং একথা আর বলার অপেক্ষা থাকেনা, যে কোনও ব্যক্তির জীবনকালের মোট বছরের চেয়ে অবশ্যই মোট দিনের পরিমাণ বেশী হবে।

এবার আসুন, ফিরে যাই আমাদের নায়ক ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডির কাছে, যে কিনা অসীম জীবনের অধিকারী বলে আমরা ধরে নিয়েছি। সে প্রতি বছরে তার একদিনের জীবনী লিপিবদ্ধ করতে থাকলো। তার একদিনের জীবনী লিখতে একবছর গেলো, দ্বিতীয়দিনের জীবনী লিখতে গেলো দ্বিতীয় বছরটি, এমনভাবে চলতে থাকলে, তাঁর জীবনের n -তম দিনটির জীবনী তিনি লিখবেন n -তম বছরে। আর আমাদের নায়কতো অমর! সুতরাং এভাবে চলতেই থাকবে। ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডির জীবনের প্রতিটি দিনের জীবনীই লেখা হবে।

বুদ্ধিমান পাঠক কী অনুমান করতে পারছেন ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াচ্ছে? এই ঘটনার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে, তা হল – ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডির অনন্ত জীবনের –

 

মোট বছর সংখ্যা = মোট দিন সংখ্যা
এ জিনিস তো আমাদের সাধারণ চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত! একেই বলে স্ববিরোধ বা প্যারাডক্স।

সুতরাং “অসীম” কনসেপ্ট নিয়ে মোটেই ছেলেখেলা করা যাবেনা। “অসীম”কে দেখতে গেলে “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে” দাঁড়াতে হবে, নূতন ধরণের চিন্তা করতে হবে, নূতন ধরণের চিন্তা গ্রহণ করতে হবে।

 

 

অ্যাকিলিস এবং কচ্ছপ:


আসা যাক অ্যাকিলিসের কথায়। আরেকটি প্যারাডক্স। এবার অসীমতার দৌড়ে সামিল দৌড়বীর অ্যাকিলিস এবং এক কচ্ছপ। তবে, বেচারা কচ্ছপকে কিছুটা সুযোগ দিতে অ্যাকিলিস তার খানিকটা পিছন থেকে দৌড় শুরু করেছে। কচ্ছপের স্টার্টিং পয়েন্টকে T1 এবং অ্যাকিলিসের স্টার্টিং পয়েন্ট কে A1 হিসাবে দেখানো হয়েছে।

 

 

 

 

এবার দৌড় শুরুর পর, স্বাভাবিক চিন্তায় মনে হয়, যে অ্যাকিলিসের যেহেতু বেগ অনেক বেশী, তাই তার পক্ষে কচ্ছপকে অতিক্রম করে যাওয়া অত্যন্ত সহজ। কিন্তু গ্রীক দার্শনিক জেনো (Zeno)[৩] দেখালেন আরেকরকম চিন্তাপদ্ধতি[৪], যেভাবে ভাবলে অ্যাকিলিসের পক্ষে কখনোই কচ্ছপকে অতিক্রম করা সম্ভব না। আসুন, একবার জেনোর মতন করে ভেবে দেখা যাক।

 

অ্যাকিলিস যে সময়ে তার নিজের স্টার্টিং পয়েন্ট A1 থেকে কচ্ছপের স্টার্টিং পয়েন্ট (T1) এ এসে পৌঁছলো, তখন তার ঐ অবস্থান কে A2 নাম দেওয়া হল। কিন্তু যেহেতু অ্যাকিলিস যতই জোরে দৌড়াক না কেন, A1 থেকে A2 (T1) পয়েন্টে আসতে তার কিছুটা সময় লাগছেই, এবং কচ্ছপ যতই আস্তে দৌড়াক না কেন, ঐ সময়টুকুতে সে কিছুটা পথ অতিক্রম করছেই, তাই অ্যাকিলিস যখন A2 তে এসে পৌঁছাচ্ছে, তখন কচ্ছপ এগিয়ে গিয়ে T2 বিন্দুতে রয়েছে।

 

একইভাবে, অ্যাকিলিস যতক্ষণে A2 থেকে A3 (T2) পয়েন্টে এসে পৌছাচ্ছে, সেইটুকু সময়ও কচ্ছপ থেমে থাকছেনা, সামান্য হলেও এগোচ্ছে, চলে যাচ্ছে T3 পয়েন্টে।

 

এভাবে সবসময়েই কচ্ছপটি অ্যাকিলিসের থেকে এগিয়ে থাকছে। যত সময় যাচ্ছে, অ্যাকিলিস এবং কচ্ছপের মধ্যবর্তী দূরত্ব তত কমছে, কিন্তু কখনোই অ্যাকিলিস কচ্ছপকে ধরতে পারছেনা।

 

 

গ্যালিলিওর প্যারাডক্স: 

 

এবার আমরা বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও-কথিত একটি অসীমতা সংক্রান্ত প্যারাডক্স দেখবো।

প্রথমেই আমাদের জানতে হবে স্বাভাবিক সংখ্যা কী? স্বাভাবিক সংখ্যা হল ১, ২, ৩, ইত্যাদি ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যাগুলি। স্বাভাবিক সংখ্যার মোট সংখ্যা অসীম। কারণ কেউ যদি বলে সবচেয়ে বড় স্বাভাবিক সংখ্যা p, তাহলে সেই p এর সাথে ১ যোগ করলে এমন একটা স্বাভাবিক সংখ্যা পাওয়া যায় যা কিনা p এর চেয়েও বড়। সুতরাং ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১ … এভাবে এগিয়ে স্বাভাবিক সংখ্যার কোনও শেষ পাওয়া যাবেনা।

 

এবার জানা প্রয়োজন পূর্ণবর্গ সংখ্যার সম্পর্কে। পূর্ণবর্গ সংখ্যারা হল কোনও একটা স্বাভাবিক সংখ্যার সাথে সেই সংখ্যাটিকেই গুণ করে যে সংখ্যা পাওয়া যায়। যেমন, ১ এর সাথে ১ কেই গুণ করে পাওয়া যায় ১, সুতরাং ১ একটি পূর্ণবর্গ সংখ্যা। একই ভাবে ২ এর সাথে ২ কেই গুণ করলে ৪ পাওয়া যায়, সুতরাং ৪ ও একটি পূর্ণবর্গ সংখ্যা। পূর্ণবর্গ সংখ্যাগুলিকে পরপর সাজালে তাদের যে তালিকা পাওয়া যায় তা হল ১, ৪, ৯, ১৬, ২৫, ৩৬, ৪৯, ৬৪ … একথা বলাই বাহুল্য যে, যেহেতু স্বাভাবিক সংখ্যার কোনও শেষ নেই, তাই পূর্ণবর্গ সংখ্যারও কোনও শেষ নেই।
একটা ব্যাপার এতোক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গেছে, তা হল – পূর্ণবর্গ সংখ্যারাও প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিক সংখ্যা। অন্যভাবে বলতে গেলে, স্বাভাবিক সংখ্যার জগতের একটা অংশ হল পূর্ণবর্গ সংখ্যাসমূহ। স্বাভাবিক সংখ্যার দুনিয়া, অর্থাৎ ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭, ৮, ৯, ১০ … ইত্যাদি থেকে আমরা বেছে বেছে ১, ৪, ৯ … ইত্যাদিকে তুলে এনে তাদের নাম দিয়েছি পূর্ণবর্গ সংখ্যা। ব্যাপারটা নীচের ছবির মতো –

 

 

“The whole is greater that the part.”[৫] অর্থাৎ সম্পূর্ণ কিছু সবসময়েই তার একটা অংশের চেয়ে বড় হয়। উদাহরণ হিসাবে দেখা যায়, আমরা দশটা পেয়ারা কয়েকজনকে ভাগ করে দিলে তাদের যে কারও পাওয়া পেয়ারার সংখ্যার চেয়ে অবশ্যই “দশ” সংখ্যাটি বেশী হবে। সুতরাং এ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, স্বাভাবিক সংখ্যার পরিমাণ অবশ্যই পূর্ণবর্গ সংখ্যার পরিমাণ থেকে বেশী হতে হবে।
কিন্তু এইখানেই গ্যালিলিও এক বিষম সমস্যা হাজির করলেন, তিনি দেখিয়ে দিলেন যে স্বাভাবিক সংখ্যার পরিমাণ পূর্ণবর্গ সংখ্যার পরিমাণের সাথে সমান। এ জিনিসটা যে পদ্ধতিতে গ্যালিলিও দেখালেন, তার নাম হল ওয়ান-টু-ওয়ান করেসপন্ডেন্স (One-to-one correspondence) অথবা বাইজেকশান (Bijection)[৬]
বাইজেকশান তখন কাজে লাগে, যখন কিনা কোনও কিছুর সংখ্যা সরাসরি গুণে ওঠা কষ্টকর। অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে একটার-সাথে-একটা মিলিয়ে মিলিয়ে তখন তার সংখ্যা বোঝা যায়। যেমন, ধরা যাক কোনও গোয়ালে একদল গোরু আছে। যে রাখাল গোরু চরাতে নিয়ে যায়, তার পক্ষে গোরুর সংখ্যা গোণা সম্ভব হয়না। সে খুঁটির সংখ্যা মনে রেখেছে। গোয়ালঘরে প্রতিটি গোরু একটা করে খুঁটির সঙ্গে বাঁধা থাকে। সুতরাং খুঁটির সংখ্যা এবং গোরুর সংখ্যা সমান। রাখাল সারাদিন ধরে গোরু চরিয়ে বিকেলে যখন গোয়ালে ফিরে গোরুগুলোকে খুঁটির সঙ্গে বাঁধে, তখন যদি কয়েকটা খুঁটি ফাঁকা থাকে, তাহলে বুঝতে হবে কিছু গোরু হারিয়ে গেছে, আবার যদি সবগুলো খুঁটির সঙ্গে গোরু বাঁধার পরেও কিছু গোরু বাঁধা বাকি থাকে, তবে বুঝতে হবে অন্য কারও গোরু ভুলবশত: পালে এসে ঢুকেছে।
গ্যালিলিও – গোরু, অর্থাৎ পূর্ণবর্গ সংখ্যাগুলিকে খুঁটি, অর্থাৎ  স্বাভাবিক সংখ্যার সাথে বেঁধে ফেললেন।
স্বাভাবিক সংখ্যা: ১   ২   ৩   ৪     ৫    . . . চলছে

পূর্ণবর্গ সংখ্যা :   ১   ৪   ৯   ১৬   ২৫  . . . চলছে
এইভাবে ওয়ান-টু-ওয়ান করেসপন্ডেন্স দিয়ে গ্যালিলিও দেখিয়েছিলেন যে স্বাভাবিক সংখ্যার পরিমাণ, তারই একটা অংশ, পূর্ণবর্গ সংখ্যার পরিমাণের সাথে সমান।
এই প্যারাডক্সগুলি আমাদের একটা সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায়, সেটা হল – আমাদের চিন্তায় কোথাও না কোথাও গলদ আছে। আমরা এমন এক উল্টো রাজার দেশে ঢুকে পড়েছি, যেখানে আমাদের চিরপরিচিত নিয়ম অচল। আমাদের ভুল কী হয়েছিল? একটা বিরাট গাণিতিক ধারণায় ভুল হয়েছিল। আমরা অসীমকে একটা সীমার মধ্যে বাঁধতে গেছিলাম। বৃত্তের মধ্যে আটকাতে গেছিলাম। বাস্তবিক, অসীমের ধারণা করা কষ্টকর, অসীমকে ভাবা কষ্টকর, মানুষের মন সবসময় সেটাকে একটা সীমারেখায় আটকাতে চায়। তাই ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত অসীমের সংজ্ঞা গণিত দিতে পারেনি, অসীমকে কোনও গাণিতিক নিয়মের বেড়াজালে বাঁধতে পারেনি। অবশ্য তারপরের ইতিহাস পুরো গণিতবিশ্বকেই পাল্টে দেয়, অসীমের সামনাসামনি হন প্রবাদপ্রতিম গণিতজ্ঞ জর্জ ক্যান্টর। অসীমকে তার সকল দুর্বোধ্যতা সমেত পাকড়াও করেন তিনি। সে গল্প পরে কখনো হবে।

 

তথ্যসূত্র:

১) ট্রিস্ট্রম শ্যান্ডির প্যারাডক্স এবং বার্ট্রান্ড রাসেলের বক্তব্য

২) উইকিপিডিয়ায় লরেন্স স্টার্ন সংক্রান্ত আর্টিকেল

৩) Zeno of Elea

৪) Zeno’s paradoxes

৫) ইউক্লিড রচিত জ্যামিতি বিষয়ক বই “The Elements” এর প্রথম খণ্ডে (Book I) বর্ণিত fifth axiom

৬) উইকিপিডিয়ার বাইজেকশান সংক্রান্ত আর্টিকেল।