বাস্তবতার যাদু

মূলঃ রিচার্ড ডকিন্স, চিত্রালংকরণঃ ডেভ ম্যাকিন

[অনুবাদকের কথাঃ রিচার্ড ডকিন্স বা তাঁর লেখার সাথে মুক্তমনার পাঠকদের নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। ‘দ্য ম্যাজিক অব রিয়ালিটি’ তাঁর ২০১১ সালে লেখা একটা শিশু কিশোরদের উপযোগী সচিত্র বিজ্ঞান বিষক বই। ডকিন্স এই বইয়ের মাধ্যমে এর পাঠকদের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছেন একটা বিষয়ই – বাস্তবতাকে সঠিকভাবে জানলে তা হয়ে ওঠে কল্পনার থেকেও বিস্ময়কর এবং একই সাথে কাব্যিক অর্থে বাস্তবতা যাদুকরী কারন এই বিস্ময়ের উৎস কোন অতিপ্রাকৃতকে অনুধাবন করা থেকে না , বাস্তবতাকেই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে দেখার মাধ্যমে। প্রতিটা অধ্যায় একটা নির্দিষ্ট প্রকৃতিগত ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক আর পৌরাণিক উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে ধরে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন তাঁর নামকরনের সার্থকতা। শুধু ঘটনা ব্যাখ্যাই নয়, যে বিষয়টা আমার কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন, সেটা হলো সহজভাবে তিনি শিখিয়েছেন কিভাবে সত্যিকার বিজ্ঞানকে চিন্তে হবে এবং কিভাবে তা অপবিজ্ঞান থেকে পৃথক করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় মানসিক উপকরন তিনি বর্ণনা করেছেন এ বইয়ে। বইটার অন্যতম আকর্ষন এর দুর্দান্ত ছবিগুলো। এই ছবিগুলো আঁকার জন্য ডকিন্স একজন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীকে সাথে নিয়েছেন। ডেভ ম্যাকিন -একাধারে ফটোগ্রাফার, কমিক বইয়ের আর্টিস্ট এবং গ্রাফিক ডিজাইনার । আমার কাছে মনে হয় ঠিক এই মূহুর্তে বাংলায় এ ধরনের একটা বই আমাদের নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরাটা অতি জরুরি যখন অজ্ঞানতা আর ধর্মের মিম –এর ভাইরাস প্রতিনিয়ত তাদের মগজ ধোলাই করে চলেছে। পুরো বইটা যথাযথভাবে ভাষান্তর করে বাংলাদেশের শিশুকিশোরদের কাছে যদি তুলে দিতে পারি তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক মনে করব। এ ব্যাপারে মুক্তমনার সুলেখকদের মতামত আমাকে অনেকখানি এগিয়ে দেবে। আপনাদের মন্তব্যের প্রত্যাশায় রইলাম। ধন্যবাদ। – ইকবাল নাওয়েদ]

:line:

book cover

১। বাস্তবতা কি? যাদু কি?
বাস্তবতা হল অস্তিত্ব আছে এমন সবকিছু। শুনে খুব সোজা সাপ্টা মনে হয়, তাই না? আসলে, তা না। হরেক রকম সমস্যা আছে। ডায়নোসারদের কথা তুমি চিন্তা কর। একটা সময় এদের অস্তিত্ব ছিল,এখন নেই। এরা কি বাস্তব? নক্ষত্রদের কথাও ভেবে দেখ। তারা এতদূরে যে, যে সময় ওদের আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় আর আমরা তাদেরকে দেখতে পাই, তদ্দিনে ওরা হয়ত নিভে গেছে। এরা কি বাস্তব?

ডাইনোসরদের আর তারাদের প্রসঙ্গে আমরা কিছুক্ষণ বাদে আসব। যাহোক না কেন, আমরা কিভাবে জানি যে কোনকিছুর অস্তিত্ব আছে, এমনকি এই মুহূর্তে ? আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় – দর্শন, ঘ্রাণ, স্পর্শ, শ্রবণ এবং স্বাদ – বেশ ভালোই কাজ করে আমাদেরকে বোঝানোর ব্যাপারে যে অনেক কিছুই বাস্তব: পাথর আর উট, সদ্য কাটা ঘাস আর তাজা কফির গুঁড়ো, শিরিষ কাগজ আর মখমল, জলপ্রপাত আর দরজার ঘণ্টা, চিনি আর লবণ। কিন্তু শুধু আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়র কোনটা দিয়ে সরাসরি উপলব্ধি করতে পারলেই কি সেটাকে আমরা বাস্তব বলব?

পঞ্চইন্দ্রিয়

সুদূর একটা ছায়াপথের ব্যাপারে তুমি কি বলবে, সেটা এতদূরে যে খালি চোখে যায় না ? একটা ব্যাকটেরিয়ার ব্যাপারে কি বলবে, শক্তিশালী অণুবীক্ষণযন্ত্র ছাড়া যেটা দেখা সম্ভব না? আমরা কি বলব যে ওদের অস্তিত্ব নেই কারণ ওদেরকে আমরা দেখতে পাই না? মোটেই না। বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে উন্নত করতে পারি। ছায়াপথের জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্র, ব্যাকটেরিয়ার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র। যেহেতু আমরা অণুবীক্ষণ এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্রগুলোকে বুঝি, এবং কিভাবে কাজ করে জানি, আমরা সেগুলোকে ব্যবহার করে আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপলব্ধির সীমাকে প্রসারিত করতে পারি – এক্ষেত্রে, আমাদের দর্শন ইন্দ্রিয়র – আর এগুলো আমাদের যা দেখতে সাহায্য করে তার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত হই যে ছায়াপথ আর ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্ব আছে।

রেডিও তরঙ্গের ব্যাপারে কি বলবে? ওটার কি অস্তিত্ব আছে? না আমাদের চোখ সেটা দেখতে পায়, না আমাদের কান। কিন্তু আবার সেই বিশেষ যন্ত্র – যেমন টেলিভিশন সেট – সেটাকে এমন সংকেতে পরিবর্তিত করে যাতে তা আমরা দেখতে আর শুনতে পাই। তাই, যদিও আমরা রেডিও তরঙ্গ দেখতে বা শুনতে পাইনা, আমরা জানি যে তারা বাস্তবতার একটা অংশ। টেলিস্কোপ আর মাইক্রোস্কোপের মত, আমরা বুঝি কিভাবে রেডিও আর টেলিভিশন কাজ করে। তারা অস্তিত্বশীল সবকিছুর ব্যাপারে একটা চিত্র তৈরি করতে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সাহায্য করে। বাস্তব পৃথিবীর ব্যাপারে। বাস্তবতার ব্যাপারে। অনেকটা যেন ভিন্ন একটা চোখের সাহায্যে রেডিও টেলিস্কোপ (আর এক্স-রে টেলিস্কোপ) আমাদেরকে নক্ষত্রমালা আর গ্যালাক্সিগুলো দেখায়। ভিন্ন পথে বাস্তবতার ব্যাপারে আমাদের ধারনা বাড়ায়।

ডাইনোসরের কথায় ফিরে আসি। আমরা কিভাবে জানি যে তারা এক সময়ে পৃথিবীতে বিচরণ করত? আমরা ত কখনো তাদের দেখিনি বা তাদের গর্জন শুনিনি বা তাদের থেকে দৌড়ে পালাতে হয়নি। হায়, একটা টাইম মেশিনও নেই যে সরাসরি গিয়ে দেখে আমরা আসতে পারি। কিন্তু আমাদের একটা ভিন্ন ধরনের ইন্দ্রিয় সাহায্যকারী রয়েছে: আমাদের ফসিল আছে, আর আমরা তাদের খালি চোখে দেখতে পাই। ফসিল দৌড়ায় না, লাফায় না কিন্তু যেহেতু আমরা জানি ফসিল কিভাবে তৈরি হয়, তাই সেগুলো কোটি কোটি বছর আগে কি হয়েছিল তা সম্বন্ধে আমাদেরকে কিছু বলতে পারে। আমরা বুঝি কিভাবে খনিজ পদার্থমিশ্রিত পানি, কাদা আর পাথরের বহু স্তরের নিচে চাপা পড়া মৃতদেহের ভেতর চুইয়ে ঢোকে। আমরা বুঝি কিভাবে খনিজ পদার্থ গুলো পানি থেকে আলাদা হয়ে স্ফটিকে পরিণত হয় আর মৃতদেহের উপাদানগুলোকে প্রতিস্থাপন করে, একটা একটা অণু করে, প্রকৃত প্রাণীটার আকৃতির কিছু চিহ্ন পাথরে খোদাই করে দিয়ে যায়। তাই, যদিও আমরা ডাইনোসরদের সরাসরি আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে দেখতে পাইনা, পরোক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে, যা পরিশেষে আমাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমাদের কাছে পৌছয়, আমরা বুঝতে পারি যে তাদের নিশ্চয়ই অস্তিত্ব ছিল। আমরা দেখি এবং স্পর্শ করি প্রস্তরীভূত প্রাচীন প্রাণের চিহ্ন।

অন্যদিকে, একটা টেলিস্কোপ এক ধরনের টাইম মেশিনের মত কাজ করে। আমরা যখন কোন কিছুর দিকে তাকাই তখন যা দেখি তা আসলে আলো, আর ভ্রমণ করতে আলোর সময় লাগে। এমনকি যখন তুমি তোমার বন্ধুদের চেহারার দিকে তাকাও তুমি তাদের অতীতের চেহারা দেখছ, কারণ আলোর তাদের চেহারা থেকে তোমার চোখ পর্যন্ত ভ্রমণ করতে এক সেকেন্ডের একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ সময় লাগে। শব্দ এর থেকে অনেক ধীরে ভ্রমণ করে, সেজন্য তুমি আকাশে আতসবাজি বিস্ফোরণের বেশ খানিকটা সময় পরে বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাও। তুমি যখন দূর থেকে একটা লোককে গাছ কাটতে দেখ, তার কুঠার গাছটাকে আঘাত করতে দেখা আর আঘাতের শব্দের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক বিলম্ব দেখতে পাবে।

আলো এত দ্রুত ভ্রমণ করে যে আমরা সাধারণত ধরে নিই আমরা যা কিছু ঘটতে দেখি তা আমরা দেখার সাথে সাথে ঘটে থাকে। কিন্তু নক্ষত্রের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। এমনকি সূর্য পর্যন্ত আট আলোক-মিনিট দূরত্বে অবস্থিত। সূর্য যদি বিস্ফোরিত হত, আট মিনিটের আগে এই বিপর্যয় আমাদের বাস্তবতার অংশ হত না। আর সেটা হত আমাদের শেষ! পরবর্তী নিকটতম নক্ষত্র, প্রক্সিমা সেন্টরাই, যদি তুমি ওটার দিকে ২০১৩ সালে তাকাও, তুমি যা দেখছ তা ঘটেছে ২০০৯ সালে। গ্যালাক্সিরা হচ্ছে পুঞ্জিভূত হওয়া অসংখ্য নক্ষত্র। আমরা আকাশগঙ্গা নামে একটা গ্যালাক্সিতে আছি। যখন তুমি আকাশগঙ্গার ঠিক পাশের বাসার প্রতিবেশী, এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির দিকে তাকাও, তোমার টেলিস্কোপ তখন টাইম মেশিন হয়ে তোমাকে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে নিয়ে যায়। স্টেফান্স কুইন্টেট নামে পাঁচটা গ্যালাক্সির একটা গুচ্ছ রয়েছে, হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যে আমরা সেটা দেখতে পাই – দর্শনীয় ভাবে এক অপরের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে তারা। কিন্তু আমরা তাদেরকে ২৮০ মিলিয়ন বছর আগে ধাক্কা খেতে দেখছি। যদি ওই ধাক্কাধাক্কি করা গ্যালাক্সিগুলোর কোন একটাতে বসবাসরত এলিয়েনদের আমাদেরকে দেখতে পাবার মত শক্তিশালী টেলিস্কোপ থেকে থাকে, ঠিক এই মুহূর্তে, এখনি, ওরা পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখত ডাইনোসরদের শুরুর দিকের পূর্বপুরুষদের। মহাশূন্যে কি এলিয়েনদের সত্যিই অস্তিত্ব আছে? আমরা কখনো দেখিনি বা তাদেরকে শুনতে পাইনি। তারা কি বাস্তবতার অংশ? কেউ জানে না। তবে আমরা জানি কি ধরনের জিনিস একদিন আমাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে। আমরা যদি একটা এলিয়েনের কাছাকাছি যেতে পারতাম, আমাদের জ্ঞানেন্দ্রিয় আমাদেরকে বলে দিতে পারত তার সম্বন্ধে। হয়ত কোন একদিন কেউ এমন শক্তিশালী টেলিস্কোপ আবিষ্কার করবে যার সাহায্যে আমরা এখান থেকেই অন্য গ্রহে প্রাণী আছে কিনা তা দেখতে পারব। অথবা হয়ত আমাদের রেডিও টেলিস্কোপগুলো এমন কোন বার্তা পাবে যা শুধুমাত্র ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীদের পক্ষেই পাঠানো সম্ভব। কারণ বাস্তবতা শুধু আমরা যা জানি শুধু তা দিয়ে গড়া না – অস্তিত্বশীল কিন্তু আমরা যাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানি না, এবং ভবিষ্যতে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে সাহায্যকারী আরও ভালো যন্ত্র বানানোর আগে জানতেও পারবো না – তারাও এর অন্তর্ভুক্ত।

অণুর অস্তিত্ব সবসময়ই ছিল, কিন্তু সম্প্রতি আমরা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছি। এবং এটা খুব সম্ভব যে আমাদের বংশধরেরা আরও অনেক কিছু সম্বন্ধে জানতে পারবে, যা আমরা জানি না। সেটাই বিজ্ঞানের বিস্ময় এবং আনন্দ: সে নতুন জিনিস উদ্ঘাটন করতে করতে যেতে থাকে। তার মানে এই না কেউ যদি কোন কিছু কল্পনা করে সেটাকেই আমরা বিশ্বাস করবো: হাজার রকমের জিনিস আছে যা আমরা কল্পনা করতে পারি কিন্তু তারা বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ – জীন-পরী আর ভূতপ্রেত, রাক্ষস-খোক্কস আর দত্যিদানো। আমাদের সবসময় সংস্কারমুক্ত থাকা উচিত, কোনকিছুর অস্তিত্ব আছে কিনা তা বিশ্বাস করার একমাত্র যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারে যদি সেটার অস্তিত্বের বাস্তব কোন প্রমাণ থেকে থাকে।

মডেল: কল্পনাকে পরীক্ষা করে দেখা
যখন আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় সরাসরি বাস্তবতা নির্ণয় করতে পারেনা, একটা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত পদ্ধতি আছে যেটা ব্যবহার করে একজন বিজ্ঞানী বুঝে ফেলতে পারে কোনটা বাস্তব।সেটা হচ্ছে সম্ভাব্য কি ঘটতে পারে তার একটা ‘মডেল’ ব্যবহার করে, যেটা তারপর পরীক্ষা করে দেখা যায়। আমরা কল্পনা করি – বলতে পার অনুমান করি –সেখানে কি থাকতে পারে। এটাকে বলা হয় মডেল। তারপর বের করি (প্রায়শই গাণিতিকভাবে হিসাব করে) যদি মডেলটা সঠিক হয় তাহলে আমাদের কি দেখা উচিত বা শোনা উচিত ইত্যাদি(প্রায়ই পরিমাপ করার যন্ত্রের সাহায্যে)। তারপর আমরা চেক করি আমরা আসলেই তা দেখি কিনা। মডেলটা আক্ষরিক অর্থে কাঠ বা প্লাস্টিকের তৈরি একটা প্রতিকৃতি হতে পারে, অথবা কাগজে লেখা একটুকরো গণিত হতে পারে, অথবা সেটা একটা কম্পিউটারে করা সিমুলেশন হতে পারে। সতর্কতার সাথে আমরা মডেলটাকে পর্যবেক্ষণ করি আর ভবিষ্যদ্বাণী করি যদি মডেলটা সঠিক হয় তাহলে ইন্দ্রিয় দিয়ে আমাদের কি দেখা (শোনা, ইত্যাদি) উচিত (যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে, হয়ত)। তারপর আমরা দেখি ওই ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ঠিক হয়েছে না ভুল হয়েছে। যদি সঠিক হয় তাহলে তা আমাদের বিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয় যে মডেলটা আসলেই বাস্তবতাকে প্রতিনিধিত্ব করে; তারপর আমরা আরও গবেষনা পদ্ধ্বতি উদ্ভাবন করতে যাই, হয়ত মডেলটাকে উন্নত করি, গবেষণালব্ধ তথ্যগুলোকে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সত্যতা সুনিশ্চিত করার জন্য। যদি আমাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হয়, আমরা মডেল বাতিল করে দিই, অথবা পরিমার্জন করে আবার চেষ্টা করি।

একটা উদাহরণ দিই। ইদানীং কালে আমরা জানি বংশগতির একক জিন, ডিএনএ নামের একটা জিনিস দিয়ে তৈরি। ডিএনএ কি এবং কিভাবে কাজ করে সে সম্বন্ধে আমরা অনেক কিছু জানি । কিন্তু ডিএনএ দেখতে কিরকম তুমি তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে পারবে না, শক্তিশালী অণুবীক্ষণযন্ত্র দিয়েও না। ডিএনএ সম্বন্ধে আমাদের জানা প্রায় সব জ্ঞান এসেছে পরোক্ষভাবে , বিভিন্ন মডেল কল্পনা আর অতঃপর তাদের পরীক্ষণের মাধ্যমে।

আসলে ডিএনএ সম্বন্ধে কেউ কিছু শোনার অনেকদিন আগে থেকেই, বিজ্ঞানীরা মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী পরীক্ষণের মাধ্যমে জিন সম্পর্কে অনেককিছু জেনে ফেলেছিলেন। উনিশ শতকে, গ্রেগর মেন্ডেল নামে একজন অস্ট্রিয়ান সন্ন্যাসী তার আশ্রমের বাগানে গবেষণা করেন, তিনি বাগানে প্রচুর সংখ্যক মটর-গাছের চাষ করেন। তিনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিভিন্ন রঙের ফুল, অথবা কুঞ্চিত বা সমতল মটর উৎপাদনকারী উদ্ভিদের সংখ্যা হিসাব করেন। মেন্ডেল কখনো জিন চোখে দেখেননি বা ছোঁননি। যা দেখতেন তা হল মটরদানা আর ফুল, আর তার চোখ ব্যবহার করে এদের বিভিন্ন ধরনগুলো গণনা করতে পারতেন। তিনি একটা মডেল উদ্ভাবন করেন, যার সাথে জড়িত ছিল সেই ধারনা যা আমরা এখন বলি জিন (যদিও মেন্ডেল সেটাকে ওই নাম দেননি)। তিনি হিসাব করে দেখেন, যদি তার মডেল ঠিক হয়, একটা বিশেষ প্রজনন গবেষণায় কুঞ্চিত মোটরের থেকে তিনগুণ সমতল মোটর থাকা উচিত। এবং তিনি ঠিক তাই পান যখন গুনে দেখেন। খুঁটিনাটি বাদ দিয়ে আসল কথা হল মেন্ডেলের জিনগুলো ছিল তার কল্পনার এক উদ্ভাবন। তিনি তাদেরকে দেখতে পারতেন না, অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যেও না। কিন্তু তিনি দেখতে পেতেন মসৃণ আর অমসৃণ মটরদানা , আর সেগুলোকে গুনবার মাধ্যমে তিনি এক পরোক্ষ প্রমাণ পান যে তার বংশগতির মডেল বাস্তব পৃথিবীর কোনকিছুর একটা ভালো প্রতিনিধি। পরে বিজ্ঞানীরা মেন্ডেলের পদ্ধতির একটা পরিবর্তিত রূপ ব্যবহার করে মোটরের বদলে অন্যান্য প্রাণী যেমন ফলের মাছির উপর গবেষণা করে দেখান যে, জিনেরা একটা নির্দিষ্ট ধারায় একে অপরের সাথে ক্রোমোজোম নামক সুতোদের মাধ্যমে গাঁথা। এসব কিছু হয়ে গেছিল জিনেরা ডিএনএ দিয়ে তৈরি এক কথা জানার অনেক আগেই।

ইদানীং কালে আমরা তা জানি , এবং আমরা একদম সঠিকভাবে জানি ডিএনএ কিভাবে কাজ করে। এজন্য ধন্যবাদ জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক, এবং তাদের পরে আসা অগণিত বিজ্ঞানীদেরকে। ওয়াটসন আর ক্রিক নিজেদের চোখে ডিএনএ দেখতে পাননি। আবারো, তারা আবিষ্কার করেন মডেল কল্পনা এবং তাদের পরীক্ষা করে। তাঁদের ক্ষেত্রে , তাঁরা আক্ষরিক অর্থেই ডিএনএ দেখতে কিরকম হতে পারে তার ধাতব ও কার্ডবোর্ডের মডেল তৈরি করেন। তাঁরা হিসেব করে দেখেন কিছু বিশেষ পরিমাপ কত হতে পারে যদি তাদের মডেল সঠিক হয়। ডাবল হেলিক্স নামে একটা মডেলের ভবিষ্যদ্বাণী, বিশুদ্ধ ডিএনএ স্ফটিকের উপর এক্স-রে রশ্মি নিক্ষেপকারী এক বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে করা রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন এবং মরিস উইলকিন্সের পরিমাপের সাথে খাপে খাপে মিলে গেল। সাথে সাথে ওয়াটসন ও ক্রিক এও বুঝতে পারলেন যে ডিএনএ-এর গঠনের উপর করা তাদের মডেল, আশ্রমের বাগানে দেখা গ্রেগর মেন্ডেলের পরীক্ষার মত ফলাফল হুবহু উৎপাদন করতে পারবে।

dna

তাহলে তিনটা উপায়ের একটা দিয়ে আমরা জানতে পারি কোন কিছু বাস্তব কিনা। সরাসরি সনাক্ত করতে পারি, আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ; অথবা পরোক্ষভাবে, ইন্দ্রিয়গুলো বিশেষ যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে যেমন অণুবীক্ষণ এবং দূরবীক্ষণ যন্ত্র; অথবা আরও পরোক্ষভাবে; বাস্তব হতে পারে এরকম মডেল তৈরি করে এবং তারপর সেই মডেলগুলো পরীক্ষা করে যে তারা সফলভাবে আমরা যা দেখি (শুনি ইত্যাদি) ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে কিনা। পরিশেষে, এ সব কিছু সবসময়ই বর্তাচ্ছে আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর, যেভাবেই যাই না কেন।

এর মানে কি বাস্তবতা শুধু সেসব দ্বারাই গঠিত যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সনাক্ত করা যায়? হিংসা বা আনন্দ কি তাহলে, সুখ বা ভালোবাসা? এরাও কি বাস্তব না?

হ্যাঁ, এরাও বাস্তব। কিন্তু তাদের অস্তিত্বের জন্য তারা মস্তিষ্কের উপর নির্ভরশীল। মানব মস্তিষ্ক, অবশ্যই, আর হয়ত অন্যান্য উন্নত প্রজাতির প্রাণীর মস্তিষ্কও, যেমন শিম্পাঞ্জী, কুকুর এবং তিমি। পাথর আনন্দ কিংবা হিংসা অনুভব করেনা, পাহাড় ভালোবাসে না। এই অনুভূতিগুলো প্রচণ্ড রকম ভাবে বাস্তব শুধু তাদের জন্য যারা তা অনুভব করে, কিন্তু মস্তিষ্কের অস্তিত্বের আগে তাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না। হতে পারে এইসব অনুভূতির – এবং হয়ত এমনসব অনুভূতি যা আমাদের কল্পনা করাও সম্ভব না – অন্য গ্রহে অস্তিত্ব আছে। কিন্তু শুধু যদি সেইসব গ্রহে মস্তিষ্ক থেকে থাকে – অথবা মস্তিষ্কের কাছাকাছি কোন কিছু তবেই। কে জানে কিরকম অদ্ভুত চিন্তাশীল অঙ্গ কিংবা অনুভবের যন্ত্র মহাবিশ্বের অন্য কোথাও লুকিয়ে আছে?

…………………… (চলবে)