স্বদেশী আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশদের অনুগত পুলিশ বাহিনীর কাছে অনেক নির্যাতিত হয়েছে। কিন্তু তবু জেলের ভেতরে বন্দি থাকার সময় কিছু সুযোগ সুবিধা পেত। তারা এক সাথে থাকতে আলাপ করতে, আড্ডা দিতে পারতো। তাদের ছিল বই পড়া,লেখা লেখা করা এমন কিছু ছোট ছোট মিটিং ও তারা জেলের ভেতরে করতে পারতো।

অনেক জেলে এই রাজবন্দীদের কাছে শিক্ষা পেয়ে অনেক সাধারণ কয়েদী তাদের জীবন পাল্টে যায়। তারা জেল থেকে বের হয়ে রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠে। জেল তখন বন্দি খানা থাকলেও বন্দিদের এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বলা যেত। গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের কর্মীরা এবং বামপন্থীরা এক সাথেই জেলে কাটাতেন রাজ বন্দি হিসেবে। জেল থেকে বের হওয়ার পর তাদের অনেকের চিন্তা ভাবনায় পরিবর্তন আসত। কেউ কেউ জেলে বসে নতুন আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দল পরিবর্তন করতেন।

আমরা নতুন দেশ পাকিস্তান তৈরী করলাম। এবার সবই মুসলমানের দেশে অনেক আশা আকাঙ্ক্ষাই চোখে মুখে ছিল। বৃটিশ পুলিশ যেভাবে আমাদের নির্যাতন করতো নিশ্চয় আমার দেশের পাকিস্তানী পুলিশ এমন করতে পারবে না। কেন না তারাও তো পাকিস্তানি, তারাও তো মুসলমান। কিন্তু ভুল ভাঙ্গতে বেশি দেরি হয়নি।

বৃটিশ আমলে রাজবন্দীদের জন্য ১৯৪০ সালের যে “সিকিউরিটি প্রিজনারস রুলস” ছিল ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর “ইস্ট বেঙ্গল স্পেশাল পাওয়ার অর্ডিনান্স” পাশ করার সময় তা বাতিল করা হয়। ফলে রাজবন্দীদের মযার্দা জেলা শাসকের ইচ্ছানুযায়ী দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় শ্রেণীতে নেমে আসে। রাজবন্দীদের মর্যাদা ও সুযোগ হ্রাস পায়।

পাকিস্তান সরকার গঠন করেই এই রাজবন্দী সুবিধা বাতিল করে দেয়। কেন দেয়? নিজ দেশের লোকদের কি তারা রাজনীতি করতে দেবে না? যদি দেয় তবে তাদের কেন এই সুযোগ সুবিধা কেড়ে নেয়া হলো? বাস্তবতা হলো বৃটিশ আমলের পুলিশের চেয়ে এই পাকিস্তান আমলের পুলিশ অনেক গুন বেশি নির্যাতন শুরু করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন রকম সন্দেহ হলেই তাকে জেলে পুড়ে দেয়া হলো। কোন আন্দোলন সংগ্রামই সমর্থন করতে চাইল না পাকিস্তানের শাসক।

আমরা ১৯৭১এ মুক্তি পেলাম। পাকিস্তানি ভুত আমাদের মাথা থেকে নামল। এবার আমরা বাঙ্গালি। মায়ের পেটের ভাই সবাই। এবার নিশ্চয় আমাদের উপর আমাদের পুলিশ ভাইরা আর নির্যাতন করবে না! তারা তো আমারই ভাই,বন্ধু কিন্তু এবারও দেখা গেল আমাদের হতাশ হবার পালা।

গতবছর রাজপথে বিএনপির চিপ হুইপ কে প্রকাশ্যে রাস্তায় পুলিশ পিটিয়েছে। কেউ কেউ দেখি উল্লাসিত। দিয়েছে আজকে মাইর… কেউ বলে কি দৌড়টা দিল দেখলেন…। আমি বিএনপি সমর্থন করিনা। কিন্তু এই উল্লাস আমার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি আমার অবস্থান থেকে প্রতিবাদ করেছি। এই জয়নাল আবেদিন ফারুক তো কেবল বিএনপির নেতা নয়, তিনি আমাদের মহান সংসদের সদস্য। আমারা তাকে ভোট দিয়ে সংসদের পাঠিয়েছি। সে কি কাজ করেছে তার উপর ভিত্তি করে আমরা আবার তাকে বাতিল করার এখতিয়ার রাখি। সংসদ যদি আমাদের গর্বের স্থান, হয় সংসদ যদি আমাদের সম্মানের স্থান হয় তবে আমাদের প্রতিনিধিকে কোন সাহসে পুলিশ পিটায়? অন্যায় করলে অবশ্যই আইন আছে তাকে ধরে আনতে পারে, আদালতে সোপর্দ করতে পারে কিন্তু লাঠিপেটা করার এই জঘন্য কাজ করতে কে পুলিশকে উৎসাহিত করেছে?

বিএনপি নেতা ফখরুলকে ২৬টি মামলা দেয়া হয়েছে আন্দোলনের সময়। এর মাঝে দেখলাম একটি হলো ঢাকা সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িতে ঢিল ছুড়েছে। কি হাস্যকর মনে হচ্ছে না। এমন হাস্যকর পরিস্থিতি কি ভাবে তৈরী হলো? এই পুলিশ দিয়েই এই অকাজটা সরকার করলো। মির্জা ফখরুল যদি দেশের জন্য হুমকি হয় তবে অবশ্যই তাকে গ্রেফতার করা হোক। তাকে রাজনৈতিক মামলা দিয়ে জেলে রাখা হোক। কিন্তু এই ধরনের মিথ্যা আর হাস্যকার মামলা দিয়ে কেন তাকে বন্দি রাখা হলো? আওয়ামীলীগ কি কোন আন্দোলন ই করতে দিবে না?

আমরা ভুলে যাইনি তারেক জিয়া তার সেই দাপটের কথা। ভাওয়াল গজারি বন থেকে পুলিশকে লাঠি সরবরাহ করা হয়েছিল আওয়ামীলীগের নেতাদের পিটাতে। আজ আওয়ামীলীগ কি তার ই প্রতিশোধ নিচ্ছে? তাহলে আমরা কেন বিএনপিকে ভোট না দিয়ে আওয়ামী লীগকে ভোট দিলাম। তারা মিলেমিশেই যদি আমাদের নির্যাতন করবে তবে আমরা কেন তাদের নতুন করে ভোটে ভোট জয় যুক্তি করি।

এখনকার প্রধান দুটি দলই অন্য দলের লোকদের সহ্য করতে পারে না। এরা মনে করে তাদের রাজনীতি করার কোন অধিকার নেই। বৃটিশ আমলে আমরা যে রাজনৈতিক অধিকার পেলাম,পাকিস্তান আমলেও আমরা যে রাজনীতি করার অধিকার পেলাম। এত বছর পরে এই স্বাধীন দেশে কেন সেই অধিকার পাব না। জাতীয় কমিটির জ্বালানী মন্ত্রনালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে সৈকত মল্লিকের পায়ে শর্টগান ঠেকিয়ে গুলি করেছে এই পুলিশ। দেশের সম্পদ রক্ষার আন্দোলনে প্রতিবারই রক্তাক্ত হয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। কিন্তু কেন?

আমি এই দেশের কোন ন্যায্য অধিকারের আন্দোলনে রাস্তায় বের হতে সাহস পাইনা। পুলিশ ক্রমেই মারাত্বক হয়ে উঠছে আগে লাঠি পেটা করতে। এখন নিরীহ মিছিলে টিয়ার গ্যাসের পাশাপাশি গরম পানি নিক্ষেপ করে। পেপার স্প্রে সামনাসামনি স্প্রে করে অসহ্য যন্তনা দেয়। আর আমাদের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রি বলেন এই বিষয়ে আমাদের কথা বলার কোন অধিকার নেই। সাংবাদিক,শিক্ষক,শ্রমিক এমন কোন শ্রেণি নেই যাকে পুলিশ সামনে পেলে বিনা উস্কানিতে আক্রমন করে না। এমন কোন আন্দোলন নেই যা পুলিশ দিয়ে ভেঙ্গে দিতে চায়নি। কিন্তু কেন?কেন সরকার এত উন্মাদ হয়ে উঠেছে?

আমরা বাঙ্গালীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন করেছি। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পর যুদ্ধ করে পরাজিত করেছি। আন্দোলন করা আমাদের রক্তের সাথে মিশে আছে। আমরা দমে যেতে পারিনা। আমরা অন্যায় দেখলেই রুখে দাঁড়াব। নির্যাতন দেখলেই প্রতিবাদ করবো। কারন আমরা বাঙ্গালী। আমরা জানি কি ভাবে নরপশুদের দেশ ত্যাগ করাতে হয়। আমরা জানি কি করে শাসকদের জুলুমকে প্রতিহত করতে হয়।

নির্যাতনের বিরুদ্ধে,অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন আমাদের অধিকার। আমারা স্বাধীন দেশের নাগরিক কথা বলাও আমাদের অধিকার। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক এই দেশের সম্পদ লুটেরাদের কাছ থেকে রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব। আপনাদের কাছে কোন সহানুভুতি চাইনা ,চাই অধিকার। রাজপথ থেকে গ্রেফতার করতে পারেন, তবে আমাদের যেন রাজবন্দী মর্যদা দেয়া হয়। আপনারাও এই পথেই রাজনীতি করেন তবে অন্যকে রাজনৈতিক সম্মান দিতে আপনাদের এত আপত্তি কেন? আপনারা আর নীচ হীন হবেন না। আপনারা নিজেদের এত নীচে নামিয়ে এনেছেন যে কাউকে ময়লা গাড়িতে ঢিল ছোড়ার জন্য গ্রেফতার করতে পারেন। কাপুরুষের মতো রাস্তায় পুলিস দিয়ে পায়ে গুলি করতে পারেন।এবার সাহসী হোন । আন্দোলনে ভয়ে যদি ভীত হন তবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেন । এই চক্রান্ত না করে আদালতের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে তাদের ফাঁসিতে ঝুলাতে পারেন, আমাদের আপত্তি থাকবে না।তবু আমরা বলতে পারব রাষ্ট্র রক্ষার জন্য আপনারা এই সব করছেন। কিন্তু এই সব নোঙরামি কেন?