aroj ali matubbar poster
গতকাল রাতে ওয়াজ শুনছিলাম। শীতকালে দুইটা জিনিস বারে, একটা বিবাহ অপরটা ওয়াজ। ইদানিং ওয়াজ যাতে বেশি মানুষ শুনতে পারে তাই গোলিতে গোলিতে আয়োজকরা মাইক বসায়া দেয়। ওয়াজ শুনবিনা মানে, শুনতে হবেই, এই পন করেই তারা ওয়াজ আয়োজন করছেন বলে মনে হয়। কিছুদিন আগে এক ওয়াজ শোনার অভিজ্ঞতা থেকে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিছিলাম। সেদিন জনৈক মোল্লা বিবর্তনবাদ, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। গতকাল এক মোল্লা করলেন বুদ্ধিজীবী বিষয়ক আলোচনা। উনি দাবি করলেন যে বুদ্ধিজীবী যাদের বলা হয় তাদের যেহেতু কোরান সুন্নাহর জ্ঞান নাই সুতরাং ওনারা হলেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, আসল না। উনি দাবি করলেন যে শুধু কোরানের জ্ঞান থাকলেই চলবে, জগতে আমাদের আর কোন জ্ঞানের দরকার নাই। যেই মাইকে পুরা এলাকা কাপিয়ে তিনি এই ঘোষনা দিচ্ছিলেন সেই মাইকটাকি কোরানের জ্ঞান দিয়েই বানানো হইছিলোকিনা সেই প্রশ্ন আমার মনে আসলেও তা প্রকাশ করার উপায় পাইনাই তখন। এখন করছি, ব্লগে।

কিন্তু ব্লগে কাদের কাছে করছি। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, প্রগতিশীল, আধুনিক মধ্যবিত্ত্ব অথবা উচ্চবিত্ত্ব একটা জনগোষ্ঠি আমার ব্লগ, ফেসবুকের বন্ধু এবং ফলোয়ার। ঐ মোল্লা যাদের কাছে মাইক লাগিয়ে ওয়াজ করেছেন তারা এই শ্রেণীতে পরেন না। আমি যাদের উদ্দেশ্যে ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিচ্ছি, যাদের উদ্দেশ্যে ব্লগে লিখছি, তাদের সাথে ঐ মোল্লার মাইকে ঘোষিত ওয়াজ যারা শুনছেন তাদের একট শ্রেণীগত দ্বন্দ এভাবে তৈরি হচ্ছে। এইসব দ্বন্দের একটা চুড়ান্ত উদাহরণ হতে পারে আসিফ মহিউদ্দীনের উপর হামলা। কিন্তু এটা আনন্দের কথা না। কারন ফেসবুকের এই শ্রেণী সংখ্যায় ওয়াজ শোনা শ্রেণীর হিসাবে অত্যন্ত নগন্য। বাংলাদেশে যারা নিজেদের মুক্তমনা দাবি করে তারা সংখ্যায় খুব বেশিনা। বাংলাদেশে তারা টিকে আছে, টিকে গেছে কারন এদেশের মানুষের দীর্ঘকালের মুক্তমত ও মানবতাবাদের ইতিহাস আছে বলে। বাংলাদেশের এই ইতিহাস আছে বলেই বাংলাদেশ পাকিস্তান অথবা আফগানিস্তান হয়ে যায়নাই। কিন্তু এই যে ১৫/১৬ কোটি জনতা, তার কাছে মোল্লার ওয়াজ কতো দ্রুত পৌছে, তার চিন্তা ভাবনায় সাম্প্রদায়িকতা ও অজ্ঞতার মৌলবাদ কতো দ্রুত নিজের জায়গা করে নিয়েছে, নিচ্ছে। এদেশের চিরাচরিত প্রগতিশীলতার যে ইতিহাস তার সাথে ব্রিটিশ আমলে জন্ম নেয়া আধুনিকদের প্রগিতশীলতার যে আমূল শ্রেণীগত দুরত্ব তৈরি হয়েছে তার ফাক দিয়েই কিইন্তু ওয়াহিবীবাদ, দেওবন্দী প্রভাব, জামাতি ইসলামিস্ট রাজনীতি, হিজবুতি খেলাফতী স্বপ্নদোষ ইত্যাদি এই দেশে জায়গা করে নিয়েছে। এইসকল প্রভাব ও স্বপ্নদোষ সংশ্লিষ্ট মানুষের আয় রোজকার, ক্ষমতার স্বার্থে নিজের নিজের মতো ইসলাম প্রচার করেছে, তা দিয়ে জনগণকে প্রভাবিত করেছে, উত্তেজিত করেছে, বাধ্য করেছে গোটা দেশের রাজনীতিটাই বদলে দেয়ার। একাত্ত্বরের পর যখন ধর্ম রাজনীতি নিষিদ্ধ হয় তখন থেকেই ওয়াজ বেরেছে এই দেশে। এখন তার ফলাফল আমরা দেখি। এবং খুব অবাক করা কারনে আমরা আবার অবাকও হই। কিন্তু এই সহজ সত্যটার মুখোমুখি আমরা হতে পারিনা যে এদেশের মৌলবাদী, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি নিজেদের স্বার্থ, নিরাপত্ত্বা এবং ক্ষমতার জন্যে অনেক বেশি পরিশ্রমী, আদর্শবাদী এবং উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বস্ত। সাংগঠনিক কাজের প্রয়োজনে ফান্ড কালেকশনে তারা নির্লজ্জ। পুজিবাদী দুনিয়ায় ব্যাবসায়ীর মতোই তারা নেকি ক্রেডিটএর লোভ দেখিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির মতো পরকালে বেহেশতের জমির মালিকানার নানান রকম প্রজেক্ট তারা তৈরি করে রেখেছে। ওয়াজে, মসজিদে, মাদ্রাসায়, ইসলামিস্ট রাজনৈতিক দলে বিভিন্ন কিস্তির ব্যাবস্থা আছে আজীবন যেসব কিস্তি দিয়ে যে কেউ পরকালে কয়েকটা পৃথিবীর সমান জমির মালিক হতে পারেন, মালিক হতে পারেন অগনিত হুরির।

আমাদের মুক্তমনারা এর বিপরীতে কি করেছে? তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ জ্ঞান বুদ্ধির গরিমা নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। কে কার চেয়ে বড় মুক্তমনা, কে কারচেয়ে বড় মানবতাবাদী সেইটা প্রমান করার চেয়ে বড় কোন কাজ তাদের আছে বলে মনে হয়না। তবে তাদের কেউ যখন আক্রান্ত হয়, আহত হয়, খুন হয় তখন মাঝে মাঝে তাদের টনক নড়ে। টনক কিছুক্ষন পেন্ডুলামের মতো এদিক সেদিক নড়াচরা শেষ হলে আবার শুরু হয় তাদের ব্যক্তিগত কায়দায় নিজেকে মুক্তমনা প্রমানের দৌড় ঝাপ। অন্য কোন মুক্তমনার ভক্ত বারলে তারে বানায় নবী, কিন্তু নিজে আবার ঠিকই নিজের ভক্ত পরিবেষ্টিত হয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। আমাদের এদেশের মুক্তমনাদের কোন লক্ষ্য নাই, উদ্দেশ্য নাই, ব্যক্তি প্রচার ছাড়া। দেশের একটা শ্রেণীর মাঝে হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হচ্ছে, কিন্তু সারা দেশের বিপুল জনতার হিসাবে মুক্তমনারা পিছিয়ে যাচ্ছে মোল্লাদের সাথে পাল্লা দিয়ে। নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভক্ত গোষ্ঠি নিয়ে তারা এদেশের কোটি কোটি জনতার চেয়ে প্রতিদিন দূরে সরে যায়, যোজন যোজন দূরে। আর মহল্লায় মহল্লায় অলিতে গলিতে মাইক লাগিয়ে মোল্লারা নিজেদের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা প্রচার করে। সেগুলা প্রচারের বিনিময়ে তারা টাকা পায়, দেশের মানুষ থেকে চাদা তুলে পায়, বিদেশী পেট্রো ডলার থেকে পায়। নিজেদের শ্রেণী স্বার্থ বিষয়ে তারা অত্যন্ত সচেতন। যেটা এদেশের মুক্তমনাদের শিখতে আরো অনেকদিন লাগবে।

আমি নিজে এই ত্রুটিমুক্ত হওয়ার চেষ্টা করি। ফেসবুক বা ব্লগ আমার একমাত্র জায়গা না। এদেশের যে বিরাট জনগোষ্ঠি ইন্টারনেট, ব্লগ অথবা ফেসবুকের সাথে পরিচিত না, অথবা নিয়মিত অংশগ্রহণ করেনা তাদের জন্যেই আমি একটি পাঠাগারের সাথে যুক্ত, আরজ আলী মাতুব্বর পাঠাগার। আমি চাই পাড়ায় পাড়ায় পাঠাগার গড়ে উঠুক, যা হবে এই দেশের প্রতিটি এলাকার তরুন তরুনির ইবাদত খানা। যেখানে জ্ঞানার্জন সবচেয়ে বড় ইবাদত হবে, যেখানে মানুষের চেয়ে বড় কোন সেবার বস্তু অথবা আরাধ্য থাকবেনা। যেখানে সে মুক্তভাবে, মুক্তমনে পাঠ করবে। যেখানে নিয়মিত পাঠচক্র, কর্মশালার মতো খুতবার ব্যবস্থা থাকবে। খুতবায় মোল্লাকে কিছু জিজ্ঞাস করা যায়না। এসব পাঠচক্র, কর্মশালায় প্রশ্নে কোন বাধা থাকবেনা। ওয়াজ মাহফিলের বদলে লালন সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন হবে, আয়োজন হবে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এদেশের হাজার বছরের প্রগতিশীল চর্চার সাথে সবার পরিচয় হবে, সারা দুনিয়ায় কি হচ্ছে, জ্ঞান বিজ্ঞান কোথায় যাচ্ছে তা সম্বন্ধে সবাই জানবে। ধর্ম নিয়া প্রশ্ন তোলা হবে, রাজনীতি নিয়া প্রশ্ন তোলা হবে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের সাথে প্রতিটি তরুনের সম্পর্ক তৈরি হবে। এইরকম একটা স্বপ্ন থেকেই আমরা একটি পাঠাগার চালাই, আরজ আলী মাতুব্বর পাঠার। ঠিক এই কাজগুলাই এই পাঠাগারটি করে। আগামী ২৪ জানুয়ারি পাঠাগারটির প্রথম সম্মেলন। ছয় বছর আগে প্রতিষ্ঠা হলেও পাঠাগারের কোন সম্মেলন এর আগে হয়নাই। এই সম্মেলনে, এই মাহফিলে, এই জলশায় অনেকে উপস্থিত হবেন, অনেক নতুন প্রাণের অভিষেক হবে পাঠাগারের সদস্য পদে, অনেক তরুন সদস্যের খেলাফত হবে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে। আপনাকে এইখানে দাওয়াত। অবশ্যই উপস্থিত হবেন। এবং অবশ্যই আমাদেরকে বেশি বেশি করে চান্দা দিবেন। আমরা বাকির লোভ দেখাই না, আমরা নগদে বিশ্বাসী। আমাদের সাথে থাকুন, আমাদের সহযোদ্ধা হউন, আমাদের সহযোগি হউন এবং সেই সাথে এই দুনিয়াতেই, এই বাংলাদেশেই আপনার জন্যে, আপনার সন্তানের জন্যে সুন্দর, সুস্থ্য, আশাবাদী বেহেশত বিনির্মান করুন, যেখানে শুধুমাত্র মতপ্রকাশের জন্যে আপনার উপর কেউ ঝাপিয়ে পরবেনা অস্ত্র হাতে। আমরা শুধু ফেসবুকে না, শুধু ব্লগে না, আমরা রাজপথে, অলিতে, গলিতে, মহল্লায় লড়াই করছি। আমরা হেরে গেলে আপনি হেরে যাবেন, আমরা জিতে গেলে আমাদের পাঠাগারের মতো আরো হাজারো পাঠাগার হবে বাংলাদেশে, এবং বিশ্বাস করেন সেইটা একটা দেখার মতো বাংলাদেশ হবে।