এক
কোন লাভ নেই। হাজার যুক্তি, হাজার তর্কবিতর্ক, কোনকিছুই তাদের কানে যাবে না। যত বিজ্ঞান আর তথ্যপ্রমাণই দাঁড় করান আপনি কিছুই শুনতে রাজি হবে না তারা। বিশ্বাসের বিপক্ষে যুক্তির আশ্রয় নিতে চাইলে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে আপনার ওপর। দোষ খুঁজবে আপনার ‘পশ্চিমপ্রীতি’র। ‘ইহুদীপ্রেমিক’ বলে গুজব রটাবে আপনার বিরুদ্ধে। কালক্রমে ওরা আপনাকে একঘরে করে ফেলবে, কিম্বা একেবারেই গৃহচ্যুত। তাহলে কেন এই মিছিমিছি সময় নষ্ট করা। আমার-আপনার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মটির কোনও সংস্কার কি কখনো সম্ভব? ‘সংস্কার’ শব্দটিই তো ভয়ঙ্কর ভীতিকর ওদের কাছে—-এতে তারা পশ্চিমের গন্ধ পায়, পায় ইহুদী চক্রান্তের আভাস। এ-ধর্মে প্রশ্নের স্থান নেই, কৌতূহলের প্রশ্রয় নেই। প্রশ্ন বলতে ওরা বোঝে কত রাকাত নামাজ পড়লে কত সোয়াব হবে, অজুর পানি না থাকলে কি করা উচিত, প্রস্রাব-পায়খানা করার পর উত্তমভাবে গাত্র ধৌত করতে না পারাটি কি কবিরা গুণাহ, না, লঘুতর কোনও অপরাধ বলে গণ্য হবে হাসরের দিন! রাত্রিবেলা স্ত্রীসঙ্গ উপভোগ করার পর তৎক্ষণাৎ গোছল করা কি সুন্নত না নফল? আমাদের ধর্মীয় কালচারে এগুলোর নাম প্রশ্ন! কিন্তু আপনি যদি ভুল করেও প্রশ্ন তুলেছেন ‘সৃষ্টিকর্তার’ অস্তিত্ব নিয়ে, এবং তার চেয়েও গর্হিত অপরাধ যদি হজরত মোহম্মদ(দঃ) এর চারিত্রিক বিষয়াদি নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, তাহলে সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গার পর সূর্যোদয় দেখবার সৌভাগ্য না’ও হতে পারে আপনার। অতিভাগ্যে যদি প্রাতঃভ্রমণের উদ্দেশ্যে ঘরের বাইরে যাবার সুযোগ ঘটেও, বাড়ি ফেরার সময় আপনার স্কন্ধদেশে মুণ্ডখানা ঠিক আগের জায়গায় থাকবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এই হল আমাদের ধর্মের ‘সহনশীলতা’। একটা কথা ওরা আসলে ঠিকই বলে—-যুক্তি, মুক্তমন, মুক্তচিন্তা, প্রশ্ন, সহনশীলতা, এগুলো মূলত পশ্চিমেরই উদ্ভাবন। ‘গণতন্ত্র’, ‘সমাজতন্ত্র’ এগুলো সবই ইহুদী চক্রান্ত ইসলামের মহান বাণীকে অপদস্ত করার লক্ষে। ওদের ইহুদীবিদ্বেষ নেহাত অকারণে নয়।

 

আমাদের ধর্মে মৌলিক প্রশ্নের একটাই জবাব—-তলোয়ার। ইস্পাতের তলোয়ার যদি ব্যবহার না’ও হয়, রসনার তলোয়ার তো অবশ্যই হবে। চারদিকে জানাজানি হয়ে যাবে আপনি নাস্তিক, আপনি শয়তানের দোসর, ইসলামের শত্রু, আপনি ভয়ানক খারাপ লোক। তখন আপনার কোন বন্ধুবান্ধব থাকবে না, আপনার আত্নীয়স্বজনরা আপনাকে এড়িয়ে চলবে, আপনার স্ত্রীর ওপর চাপ পড়বে আপনার শয্যা বর্জন করতে, আপনার ছেলেমেয়েরা পদে পদে লাঞ্ছিত হবে স্কুলে, খেলার মাঠে, বাজারে, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে। যদিনা আপনি জন্মগ্রহণ করেন পাকিস্তান, বা এরকম কোনও মধ্যযুগীয়, মানবধর্মহীন ধর্মীয় রাষ্ট্রে, যেখানে আপনার শাস্তি হবে আরো গুরুতর—-আইনের জোরেই তারা আপনাকে ফাঁসিকাষ্ঠে দাঁড় করাবে। অথবা আপনার গলা কাটবে প্রকাশ্য বারান্দায়, কৌতূহলী জনতার করতালি ও হর্ষধ্বনিমুখর আবহাওয়াতে।

 

ওদের মাঝে যে উদারমনা, দয়ামায়াশীল ভালোমানুষ নেই তা নয়। ধর্মের এই অনতিপ্রচ্ছন্ন নিষ্ঠুরতাগুলো অবশ্যই ওদের দৃষ্টি এড়ায় না। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে ওরা একবাক্যে সাফাই গাইবেঃ না না, দোষটা ধর্মের নয়, দোষ মানুষের। মানুষই তার বিকৃত ব্যাখ্যা তৈরি করেছে নিজেদের স্বার্থে। সব মোল্লাদের কাজ। যেন বিকৃত ব্যাখ্যাটির দায়িত্ব মোল্লাদের, আর প্রকৃত ব্যাখ্যার ন্যায্য দাবিদার কেবল তাঁরাই। আসল ব্যাপারটা এই যে ধর্মের কোনকিছুই তাঁরা জানেন না—-মোল্লা-অমোল্লা কেউ না। সবই শোনা কথা। কোরান যারা পড়েছেন তারা এর ভাষা বোঝেন না। যারা ভাষা বোঝেন তারা নিজেদের সুবিধামত ওটার ব্যাখ্যা করে নেন। যদিও পবিত্র কোরানেই স্পষ্ট করে বলা আছে যে এ-গ্রন্থটিতে দু’প্রকারের বাণী —-একটি সর্বজনবোধ্য, আরেকটি সম্পূর্ণ বোধাতীত, আকারে ইঙ্গিতে এমনভাবে গ্রন্থিত যা বুঝবার ক্ষমতা এক আল্লাপাক ছাড়া অন্য কারও নেই (৩ঃ৭, প্রিকথল)। আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে এ আয়াতটির অর্থে কোনও দ্ব্যর্থতার অবকাশ নেই—-অতীব পরিষ্কার। সাদা আর কালো। দুয়ের মাঝামাঝি কোনও ‘কিন্তু-যদি’র ফাঁক নেই। অতএব কেউ যেন না বলেন আমাকে যে ধর্মের একটা ব্যাখ্যা সাধু-সন্ন্যাসীর, আরেকটা খুনি-জল্লাদের। পথের ফকির থেকে সিংহাসনে উপবিষ্ট পরাক্রান্ত সম্রাট, উভয়ের জন্য একই বাণী একইভাবে বোধ্য-দুর্বোধ্য আঙ্গিকে লেখা। এই একটি বিষয়ে আমার পিতৃদত্ত ধর্মটি আমার পছন্দের। এতে কোনও দ্ব্যর্থতা নেই—-ছোটবড় ভেদাভেদ নেই। সব সমান আল্লার চোখে। সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা হল দ্ব্যর্থতাহীন বাণীগুলোর বক্তব্যটিতে। এই বক্তব্যের কারণেই তো জিহাদিরা জিহাদ ছাড়া আর কিছু উচ্চারণ করতে পারে না, জল্লাদরা সবসময় তলোয়ার নিয়ে তৈরি কারো-না-কারো কল্লা কাটার জন্যে। আমাদের ‘উদারমনা’ ভালোমানুষ ইমানদাররা যখন দাবি করেন যে জিহাদ আর তলোয়ার প্রকৃত ধর্মের বাণী নয়, তখন ধর্ম সম্বন্ধে তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা কি অযৌক্তিক? সত্যিকার অর্থে তারা ধর্মের কিছুই জানেন না। জানেন না বলেই ছোটবেলার মগজ-ধোলাই-করা বিশ্বাসগুলো আজীবন অক্ষুণ্ন থেকে যায় তাদের মস্তিষ্কে—-ধর্মবিষয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন তোলার কল্পনাই তাদের মাথায় ঢোকে না। তারা চোখ বন্ধ করে সব মেনে নেন, এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সেই বন্ধ চোখের পাতা খুলে বাইরের জগতটি কিঞ্চিৎ স্বচক্ষে অবলোকন করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না। সেকারণেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ধর্মবিশ্বাস মানেই অন্ধবিশ্বাস—-এই বিশ্বাসের অন্ধ আর অনন্ধ বলে কোনও ভাগাভাগি নেই।

 

অহি-বাহিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থসমূহের প্রতিটি বাক্যবাণীতে যাদের গভীর আস্থা, তাদের ধারণা যে আমরা যারা সন্দেহপরায়ন পাপিষ্ঠ ব্যক্তি, তারা নাস্তিক, তাদের মন শয়তানের প্রভাব দ্বারা কলুষিত, তারা অবিশ্বাসী। প্রথমত আমি শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনা যেমন করি না ঈশ্বর নামক কোনও অতিপ্রাকৃত সত্ত্বার অস্তিত্বে—-ঈশ্বর আর শয়তান আমার দৃষ্টিতে একই নাটকের দুটি বিপরীত চরিত্র, ইংরেজিতে যাকে বলে প্রটাগনিস্ট এবং এন্টাগনিস্ট—-বলিউডের বোম্বেটে ভাষায় বাহাদুর আর দুশমন। দুটিরই দরকার জনপ্রিয় নাটকের জন্যে। দ্বিতীয়ত, আমার বিশ্বাস বলে কিছু নেই এটা আমি মানতে রাজি নই। অবশ্যই আছে। অনেক কষ্ট করে, অনেক সাধ্য-সাধনা করে এটি অর্জন করতে হয়েছে আমকে। পার্থক্যটা হল যে আমার বিশ্বাস কারো অর্পিত বিশ্বাস নয়, নিজেরই শ্রমার্জিত বিশ্বাস। এবিশ্বাস অন্ধ নয়, এবিশ্বাস বিবর্তনের ধারাতে আস্থাবান, সময়ের অনুগামী, বিজ্ঞানের আজ্ঞাবহ, জ্ঞানচর্চায় নিত্য নিয়োজিত। এতে অন্ধত্বের অবকাশ সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

 

অনেকের ধারণা দারিদ্র্য আর অশিক্ষা-কুশিক্ষাই প্রধানত ধর্মীয় অন্ধত্ব আর গোঁড়ামির আকর। হ্যাঁ, দারিদ্র্য একটা আরামদায়ক আবাসস্থল বটে গোঁড়ামির, এবং এই আরামের পরিবেশেই ধর্মীয় উন্মাদনা অনেকসময় ভয়াবহ আকার ধারণ করে, অনেকটা বৃষ্টিহীন খরা অরণ্যে দাবানলের আগ্রাসী রূপ ধারণ করার মত। গুবরে পোকা আর গুমাছিরা যেমন পঁচাডোবা আবর্জনা পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে, ধর্মও তেমনি দারিদ্র্যের কাদামাটিতে নবজীবনের প্রাবল্য অর্জন করে—ধর্মের বিস্তার ও সুস্বাস্থ্য রক্ষার জন্যে দারিদ্র্য নামক পুষ্টিকর খাদ্যটির অবশ্যই প্রয়োজন। তবে ধর্ম কেবল দরিদ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে তার কোনও অর্থ নেই। অতি উচ্চশিক্ষালব্ধ, শ্বেতমার্বেল নির্মিত প্রাসাদবাসীরাও এর জাদুকরি প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না সবসময়। এমনই এক অব্যর্থ নেশাকর এই ধর্ম নামক দ্রব্যটি যে একবার তাতে আসক্ত হতে পারলে সহজে তার কবল থেকে কারও মুক্তি নেই। অনেকটা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের দুঃখকষ্টহীন নষ্ট ছেলেমেয়েদের ড্রাগাসক্তির মত।
আসলে ধর্মের আঙ্গিনাতে ছোটবড়, ধনীগরিব আর বকলম-সকলমের খুব একটা তফাৎ নেই। আমি অনেক অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ দেখেছি, ধর্মবিষয়ে তারা প্রচণ্ডরকম কৌতূহলী, এমনকি সংশয়বিদ্ধ, আবার এমন অনেক উচ্চশিক্ষিত, আপাতপণ্ডিত ব্যক্তিও দেখেছি যারা একটু বয়স হলেই তসবি ছাড়া রাস্তায় বের হবার ভরসা পান না, এবং কার্যত মসজিদের সতরঞ্চিতেই অতিবাহিত হয় তাদের অধিকাংশ সময়। তারা সর্বক্ষণই উচারণ করে যাচ্ছেন আল্লারসূলের জিকির। পশ্চিম জগতে কোনও বড় গবেষণার খবর তাদের কানে আসা মাত্র কোরান খুলে বসেন কোন সুরাতে সেই গবেষণাটির সংকেত রয়েছে। নিজেরা আবিষ্কার করতে সক্ষম না হলে বিজ্ঞজনদের ঘোষণার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহ সহকারে বসে থাকেন কখন ‘প্রমাণ হবে’ যে এটি আল্লাপাকের কোরানেই ছিল বরাবর। অর্থাৎ নাসারা-ইহুদী বিজ্ঞানীরা নতুন কিছুই আবিষ্কার করেনি কখনও। সব জ্ঞানের উৎস তো পবিত্র কোরা্নই!
শিক্ষিত অশিক্ষিত উভয় প্রকার বিশ্বাসীদের একটা জিনিস ভীষণ প্রিয়—–অলৌকিকতা। অতিপ্রাকৃত যে-কোন ঘটনা, বাস্তব বা কাল্পনিক তাতে কিছু আসে যায় না, অনায়াসে সম্মোহিত করে তাদের। করে বলেই কুমারী যুবতীর গর্ভে সন্তান আগমনের সংবাদ তাদের সন্দিহান করা দূরে থাক, ভক্তিরসের প্লাবনধারায় আপ্লুত করে তোলে। এই এক অদ্ভুত মানসিকতা আমাদের, সাধারণ গুজবকে অগ্রাহ্য করতে হয়ত দ্বিধা করব না, কিন্তু গুজবটি একটু অসাধারণ হয়ে গেলে, অর্থাৎ অলৌকিকতার মাত্রায় পৌঁছে গেলে, তৎক্ষণাৎ আমরা পোষা কুকুরের মত প্রভুর পদতলে বসে চুপ করে শুনব সেটা। অনেকটা এই কারণেই ধর্মপ্রচারকদের একশ ভাগের একশ ভাগই বলতে গেলে অলৌকিকের আশ্রয় নিয়েছেন। মহাপ্রভু যীশুর একান্তই প্রয়োজন ছিল কুমারী মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করা। হজরত মুসাও প্রয়োজনের খাতিরেই সমূর্ত ঈশ্বরের সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন সুউচ্চ পর্বতপৃষ্ঠে। প্রয়োজন ছিল বলেই তাঁর লাঠির স্পর্শে নীলনদীর পানি আপনা থেকেই প্রশস্ত সড়কের রূপ ধারণ করেছিল। প্রয়োজন না হলে কি হজরত ইব্রাহিম তাঁর আপন পুত্রকে জবাই করার জন্যে পাহাড়ের চূড়াতে নিয়ে যেতেন? নিয়েছিলেন বলে বিশ্বের তিনটে ধর্ম একে অন্যকে ছাড়িয়ে গেল ওই অলৌকিক ঘটনার ওপর আপন স্বত্ব স্থাপন করতে। ওদিকে চির সন্দেহপ্রবন আরব জাতিকে আল্লার নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার লক্ষে মহাকাশের সপ্তস্তরে অবস্থিত সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে অলৌকিক মোলাকাতের অবশ্যই প্রয়োজন ছিল আমাদের মহানবী হজরত মোহম্মদ (দঃ) এর। একটা অলৌকিক কাণ্ডের কি ক্ষমতা জানেন তো? মানে রাতারাতি কয়েক লক্ষ নতুন ভক্ত সৃষ্টি হওয়া। সেই স্বর্গীয় সাক্ষাৎটি এখনো পর্যন্ত পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ মানুষকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। এমনই শক্তিশালী এই ‘অলৌকিক’ বিষয়টি। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে আমাদের তিনটে মুখ্য ধর্মেরই পবিত্র গ্রন্থগুলোতে অলৌকিকতার জয়গান করা হয়েছে বিপুল জাঁকজমক সহকারে। ক্যাথলিকদের ক্ষেত্রে এটি এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। ভ্যাটিকেনের পোপ মহাশয় মাঝেমধ্যেই সন্ত পদবী প্রদান করেন ক্যাথলিক চার্চের অতি পুণ্যবান ব্যক্তিদের যার অন্যতম শর্তই হল প্রাপক ব্যক্তিটির দলিলপত্রে অন্তত একটি উল্লেখযোগ্য অলৌকিকতা সাধনের প্রমাণ থাকা চাই!
সেকালের সাধুসন্ন্যাসী আর পীর পয়গম্বরদের একটা সুবিধা ছিল—-আধুনিক বিজ্ঞানের তখন একেবারেই শৈশবাবস্থা। অতিপ্রাকৃতকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে খণ্ডাবার চেষ্টা করবে এমন কোনও ঢালতলোয়ার তার গুদামে ছিল না সেসময়। অলৌকিককে ভূয়া বা ভাওতা বলে উড়িয়ে দেবে সেই বুকের পাটাই বা কার। বরং দুচারটে বিজ্ঞানমনা মানুষ যা’ও উঁকি দিচ্ছিলেন এখানে ওখানে তাঁরা নিজেরাই ‘অলৌকিক’এর মোহে বুঁদ হয়ে ছিলেন। বর্তমান যুগে অবশ্য অলৌকিকবাদীদের ব্যবসায় খানিকটা মন্দা পড়েছে, অনেকটা বিজ্ঞানের আশাতীত সাফল্যের কারণেই। কিন্তু তাই বলে অলৌকিকতা দূর হয়েছে সেরকম দাবি কেউ করতে পারবে না। এখনো ঘরে ঘরে নিত্যনিয়তই অলৌকিক ঘটনা ঘটছে। এবং ঘটবেও। সদ্যজাত গাভীর গাত্রদেশে আরবি হরফে আল্লার হস্তাক্ষর, মুরগির ডিমে আল্লার নাম, পূর্ণিমার চন্দ্রপৃষ্ঠে ইমাম খোমাইনীর নাম পরিষ্কার ফারসি হরফে লেখা, ঢাকার আকাশে পরিষ্কার অক্ষরে লেখা সাদ্দাম হুসেনের নাম, পাথরের গনেশ মূর্তির কৃত্রিম মূত্রনালী দিয়ে টাটকা গোদুগ্ধ নিষ্ক্রমণ, সূর্যাস্তের আকাশে মাতা মেরির মূর্তি দর্শন—-এসব হল আধুনিক অলৌকিক বাজারের খবর। অলৌকিক রোগমুক্তি দুরারোগ্য ব্যাধির কবল থেকে, যীশুখ্রীষ্ঠ যা অহরহই করতেন, এমনকি মৃতকে পুনর্জীবিত করে ফেলা, তা’ও একেবারে অচল হয়ে যায়নি।

 

ধর্মবাদীদের সবচেয়ে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছেন চার্লস ডারউইন নামক এক নাসারা ইংরেজ। তাঁর মতানুসারে মানুষ নাকি আদম-হাওয়া থেকে আসেনি, এসেছে শিম্পাঞ্জি আর বানরের বংশ থেকে। ধর্মের মূল ধরে টানাটানি—–ছয় হাজার বছর আগে বিবি হাওয়া আল্লার নিষেধ অমান্য করে হজরত আদমকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল ভক্ষণ করতে প্রলুব্ধ করেছিলেন, সেই অমান্যতার ফসলই আমাদের এই মানবকূল। ধর্মের এই চিরাচরিত বিশ্বাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লোকটি প্রচার করতে লেগে গেলেন যে মানুষের বয়স ছয় হাজার বছর তো নয়ই, মানুষ আদৌ মানুষ রূপেই আবির্ভূত হয়নি। হয়েছে ধীরে ধীরে কয়েক লক্ষকোটি বছর ধরে বানরজাতি থেকে বিবর্তিত হয়ে হয়ে। বলে কি লোকটা? এক কথাতেই সৃষ্টিতত্বের ওপর গড়ে ওঠা এত সুন্দর কেচ্ছাটি তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দেওয়া? কত বড় ধৃষ্টতা মানুষটার—–জীবজগতের সর্বশ্রেষ্ঠ বলে সৃষ্টিকর্তা নিজেই যাকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন, সেই মহান মানবজাতিকে জীবজন্তুর বংশধর বলে ঘোষণা করার উদ্দেশ্যটা কি? অথচ কি অদ্ভুত কাণ্ড, শিক্ষিতদের অধিকাংশই কেতাবের বাণী অগ্রাহ্য করে সেই নাস্তিকটার আজগুবি প্রলাপের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে। তাই মুসলমান যুবকরা যেমন উঠে পড়ে লেগে গেছে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সারা বিশ্বব্যাপী, বিশ্ববাসী তা চাক বা না চাক, অমুসলমান শিক্ষিতেরা তেমনি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কি করে ‘বিবর্তনবাদ’কে মিথ্যাচার বলে প্রমাণ করা যায় বিজ্ঞানেরই সাহায্যে। তাদের এই মহান প্রচেষ্টায় যথেষ্ট গুণীজ্ঞানী বিজ্ঞানী সহায়তা দিচ্ছেন। পশ্চিমের কোন কোন অঞ্চলে এখনো স্কুলকলেজে বিবর্তনবাদ পড়তে দেওয়া হয় না। খোদ আমেরিকাতে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি বলে নিজেদের দাবি করাতে যাদের জুড়ি নেই, সেখানেও, এই একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল প্রযুক্তিতাড়িত অত্যাধুনিক যুগেও, শতকরা ৪৬ জন নাগরিকের কাছে ‘বিবর্তনবাদ’এর চাইতে বরং বাইবেল-বর্ণিত ‘সৃষ্টিবাদ’ই বেশি গ্রহণযোগ্য। এখনো সাধারণ লোকের মুখে শোনা যায় এমন অদ্ভুত যুক্তি যে তাদের বাপদাদা চোদ্দপুরুষ কেউ বানর ছিলেন বলে জানা নেই, সুতরাং ডারউইন যে মিথ্যাবাদী ছিলেন তার প্রমাণ তো সেখানেই। এই একই যুক্তি আমাদের দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের মুখেই অহরহ শুনতে পাই। আমাদের দেশের মোল্লা-মৌলবিরা তো সুযোগ পেলেই এই যুক্তি উত্থাপন করে সুবোধ সুশীল জনগণের মধ্যে হাসির হুল্লোড় সৃষ্টি করেন।

 
আধুনিক বিজ্ঞান ও গণিতের কাছে যা ‘প্রমাণ’ বলে পরিচিত ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে তার ঠিক এক অর্থ নয়। যদিও সৃষ্টিকর্তা বা আল্লাতা’লার অস্তিত্ব ব্যাপারে এই দুটি বিপরীত মেরুতে মোটামুটি একটা বোঝাপড়া হয়ে গেছে।। দুদলই মেনে নিয়েছেন যে আল্লা আছেন তার কোনও প্রমাণ যেমন নেই, তেমনি তিনি নেই তারও কোনও সরাসরি প্রমাণ নেই। এটা পুরোপুরিই নিজ নিজ বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার।

 

দুই

ধর্মীয় গোঁড়াদের আমি একটু সমীহ করে চলি। বলা যায় না কখন কিসেতে বারুদের মত জ্বলে ওঠে। ওরা একত্র হলে বিপদের সম্ভাবনা হাজারগুণে বেড়ে যায়। গোঁড়ামি এক জিনিস যার সঙ্গে শিক্ষার খুব একটা সম্পর্ক আছে বলে মনে হয় না। শিক্ষিত গোঁড়ারা সাধারণত ছোরা-চাপাতি নিয়ে ঘোরাঘুরি করেনা রাস্তাঘাটে, যেমন করে অশিক্ষিতেরা। ওদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রাখা বুদ্ধিমানের কাজ। তবে বড় ক্ষতিটা কিন্তু এই রগচটা চাপাতি-হাঁকানো অশিক্ষিতরা করে না, করে বগলে বইপুস্তক-চাপানো লেখাপড়াজানা গোঁড়ারা। তাঁরা অজ্ঞতা দিয়ে অজ্ঞতা পোষণ করেন না, জ্ঞান দিয়ে করেন। তাঁরা জ্ঞানের মন্ত্র দ্বারা উৎসাহিত করেন বলেই মূর্খের দল চাপাতি নিয়ে রাস্তা টহল দিতে বেরুয়। এই আপাত শিক্ষিত অজ্ঞ নেতাদেরই আমার বড় ভয়।
‘অজ্ঞ’ বলছি বলে ভুল বুঝবেন না যেন আমাকে। এই ‘অজ্ঞ’দের অনেকেই আমার চেয়ে হাজারগুণে বেশি বিদ্বান। বড় বড় পদকপ্রাপ্ত অনেকে। আন্তর্জাতিক শিরোপা-সম্মান দ্বারা ভূষিতও কেউ কেউ। মহা মহা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মহা মহা ডিগ্রিপ্রাপ্ত জ্ঞানবীর। দুঃখের বিষয় যে এই মহা মহা পণ্ডিত ব্যক্তিগুলোই বড় ক্ষতিগুলো করেন সাধারণত। জেনেশুনে করেন তা বলছিনা, অজান্তে করেন, এবং সেটা আরো দুঃখজনক।
গত শতাব্দীর কতগুলো সাল ইতিহাসের গায়ে বিশেষ দাগ রেখে গেছে, বিবিধ কারণে। যেমন শুরুতেই, ১৯০০ সাল, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের মাথা থেকে বেরুল কুয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রথম আইডিয়া, যদিও সেসময় তাঁর কোন ধারণাই ছিল না এই আইডিয়াটি কোনও মাথামুণ্ডুহীন উদ্ভট কল্পনা, না সত্যি সত্যি কিছু বস্তু আছে তাতে। উদ্ভট কল্পনা যে মোটেও ছিল না সেটা তার প্রমাণ তো আইনস্টাইনের যুগান্তকারি আবিষ্কার—-বিশেষ আপেক্ষিক তত্ব। বিজ্ঞানজগতে এতবড় বিপ্লব আর ঘটেনি আগে। অনতিকাল পরে এই একই ব্যক্তি নিয়ে এলেন আরো এক বিস্ময়—-সাধারণ আপেক্ষিকতা, বা, অভিকর্ষ তত্ব। অনেক বড় বড় বিজ্ঞানীর মতে, বিশুদ্ধ নান্দনিকতার বিচারে, এই তত্বের চাইতে মনোগ্রাহী সৃষ্টি আইনস্টাইনের আগে বা পরে কারো কাজের মধ্যে প্রকাশ পায়নি। সব সুন্দরের সেরা সুন্দর তাঁর সমীকরণমালা। সেটা ঘটে ১৯১৬ সালে। ১৯২৮ সালে স্যার আলেকজাণ্ডার ফ্লেমিং-এর পেনিসিলিন আবিষ্কার। চিকিৎসাশাস্ত্রে সে যে কতবড় ঘটনা তার জীবন্ত সাক্ষী তো পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি নাগরিকই। এমন আরো অসংখ্য আবিষ্কার দ্বারা বিংশ শতাব্দীর গৌরবময় অধ্যায়টি স্বর্ণাক্ষরে খোদাই করা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। বিজ্ঞান আর চিকিৎসাশাস্ত্রে কেবল নয়, জ্ঞানবিজ্ঞানের সব শাখাতেই সৃষ্টিশীল মানুষের বলিষ্ঠ পদচিহ্ন দ্বারা ধন্য হয়েছে বিগত শতাব্দী। রাজনৈতিক অঙ্গনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, এডলফ হিটলার নামক এক আসুরিক চরিত্রের উত্থান ও পতন, ইজরায়েলের জন্ম প্যলাস্টাইনের হৃদপিণ্ডের প্রায় মধ্যিখানে, পূর্ব-পশ্চিমের ঠাণ্ডাযুদ্ধ, সোভিয়েট ইউনিয়ানের উত্থান ও পতন ৭২ বছরের ব্যবধানে, সবই বিংশ শতাব্দীরই ঘটনা। এসবের মাঝে একটি সাল আমার দৃষ্টিতে প্রচণ্ড তাৎপর্যপূর্ণ—-১৯৭৯। এই সালেরই প্রথমদিকে ইরানের শাহ পহলবী স্বদেশ ত্যাগ করে নির্বাসনে আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন, এবং বছর শেষ না হতেই ইরানের শাসনদণ্ড সর্বতোভাবে হস্তান্তরিত হয় আয়েতুল্লাহ খোমাইনি চালিত শিয়া মতবাদী গোঁড়া মোল্লাতন্ত্রের ওপর। আধুনিক যুগে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত স্বৈরতান্ত্রিক ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নজির এই প্রথম—-ইসলামিক জাতিয়তাবাদী চিন্তাধারাতে এ যে কতবড় উৎসাহ উদ্দীপক একটি ঘটনা সেটা সবাই সমভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন কিনা জানি না। আমার মতে এর একটা সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য আছে।
১৯৭৯ সাল সেখানেই শেষ নয়, শুরুমাত্র। ইরানের মতই ভূকম্পন সৃষ্টিকারি ঘটনা অত্যন্ত নাটকীয়ভাবেই সঙ্ঘটিত হতে শুরু করে পার্শ্ববর্তী দেশ আফগানিস্তানে। স্থানীয় শাসনকর্তাদের লোকদেখানো মামুলি আমন্ত্রণে পরাক্রান্ত শক্তি সোভিয়েট ইউনিয়ান তার সৈন্যসামন্ত আর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আক্রমন চালায় আফগানিস্তানের ওপর। সেই আক্রমনের অশুভ পরিণতি যে শুধু সোভিয়েট ইউনিয়ানকেই ভোগ করতে হয়েছে তাই নয়, সারা বিশ্বই তার মরণ প্যাঁচে জড়িয়ে পড়েছে কোন-না-কোনও ভাবে, সমুদ্রের অক্টোপাস যেমন করে জড়ায় তার পরিপার্শ্বের সকল জীবজন্তু তরুলতাকে। আসলে ১৯৭৯ সাল এখনো শেষ হয়নি, তার দুর্ভোগ হয়ত কয়েক প্রজন্ম ধরেই ভোগ করতে হবে আমাদের।
এ দুটি বড় ঘটনার সমতুল্য না হলেও সেই একই বছর আরো একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে, যা অন্তত আমার চোখে একটা বিশেষ গুরুত্ব ধারণ করে। সেই বছরই ইতিহাসের প্রথম মুসলমান পদার্থবিজ্ঞানীকে নোবেল পুরষ্কার দ্বারা সম্মানিত করা হয় সুইডেনে। সম্মানিত ব্যক্তিটির নাম অধ্যাপক আব্দুস সালাম—-মুসলিম জগতের কিংবদন্তী ব্যক্তিত্ব, সারা মুসলিম জাহান যার গর্বে গর্বিত। ছোট্ট একটা সমস্যা ছিল যদিও—-তিনি না ছিলেন সুন্নি মুসলমান, না শিয়া। তিনি ছিলেন আহমেদিয়া সম্প্রদায়ের মুসলমান। আহমেদিয়াদের বিরুদ্ধে আইন করেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৪ সালে যে তারা মুসলমান নয়। সে-দুঃখে তিনি দেশত্যাগ করে বিলেতের অক্সফোর্ডে গিয়ে বসবাস স্থাপন করেছিলেন সেসময়, যদিও তাঁর জন্মভূমি পাকিস্তানের জন্য তাঁর প্রাণ কাঁদত সর্বক্ষণ। যাই হোক, আইনত অমুসলমান হওয়া সত্বেও ১৯৭৯ সালে যখন তাঁর নোবেল বিজয়ের খবর বেরিয়ে গেল তখন সারা মুসলিম বিশ্বই আনন্দে আত্মহারা। এমনকি আমার অভাগা দেশ, বাংলাদেশ, যেখানে ‘৭১এর স্মৃতি তখনো টগবগে লাল, সেখানে একজন পাকিস্তানীকে নিয়ে খুব একটা মাতামাতি হবার কথা নয়। কিন্তু হয়েছিল, এবং হওয়া উচিতও ছিল, পাকিস্তানী হওয়া সত্বেও। শত হলেও আমাদের পূর্বাঞ্চলেরই এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, যাঁর সমকক্ষ কৃতিপুরুষ বলতে গোটা উপমহাদেশে তখন সি ভি রমন আর রবিঠাকুর ছাড়া আর কেউ ছিলেন না, তাঁকে নিয়ে গর্ব আমরা অবশ্যই করব। কিন্তু আমাদের দেশে গর্ব করা হয়েছিল তাঁর বিজ্ঞানের জন্য নয়, তাঁর নামটি মুসলমান হওয়ার জন্য। নামে মুসলমান হলেই যথেষ্ঠ আমাদের জন্য, আমরা উলঙ্গ হয়ে নাচতে শুরু করব।
সেবছর পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার সালাম সাহেব একা পাননি, আরো দুজন সহপ্রাপক ছিলেন তাঁর। লি শেল্ডন গ্ল্যাসো, আর স্টিভেন ওয়াইনবার্গ। দুজনই প্রায় সমবয়সী, সালাম সাহেবের চেয়ে প্রায় সাত বছর ছোট, এবং দুজনেরই জন্মস্থান নিউ ইয়র্ক শহর। তিনজন ঠিক একই বিষয়ের ওপর যুগান্তকারি কাজ করে নাম করেছিলেন বিশ্বজোড়া, এমনকি একসঙ্গে কাজও করেছেন কিছুটা সময়। অন্তরংগ বন্ধু হয়ত ছিলেন না তাঁরা, কিন্তু একটা ঘনিষ্ঠ সৌজন্য ও পারস্পরিক সম্মানের সম্পর্ক ছিল অবশ্যই। প্রভেদ যেটা ছিল সেটা ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ক্ষেত্রে। একজন ছিলেন গোঁড়া মুসলমান—-নিয়মিত নামাজরোজা করা পাক্কা মুসলমান। আর দুজন খাঁটি ইহুদী বংশোদ্ভূত। তার মাঝে গ্ল্যাসো সাহেব হয়ত সনাতন ইহুদী ধারারই অনুসারি, আর স্টিভেন ওয়াইনবার্গ হলেন পাঁড় নাস্তিক। নোবেল পুরষ্কার হাতে নেবার সময় তিনজন তিনরকম ভাষণ দিয়েছিলেন, সেটা বেশ মজার। ইহুদীদ্বয় প্রচলিত ধারাতে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানবিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন নিজেদের, কিন্তু সালাম সাহেব ওই সুবর্ণ সুযোগ অনর্থক পায়ে ঠেলে দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। বিসমিল্লাতেই শুরু করলেন এভাবেঃ

‘East and west, north and south have equally participated in the Holy Book of Islam. Allah says:
“Thou seest not, in the creation of the all-merciful any imperfection. Return thy gaze, seest thou any fissure. Then return the gaze, again and again. Thy gaze, comes back to thee dazzled, aweary. “
This in effect, is the faith of all physicists; the deeper we seek the more is the wonder excited, the more is the dazzlement to our gaze.’

মহান সৃষ্টিকর্তার চিরবিস্ময়ভরা মহাসৃষ্টির এই অনিঃশেষ দৃশ্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে চক্ষু ফেরাতে না পারার সাথে তুলনা করুন সালাম সাহেবেরই সহবিজয়ী স্টিভেন ওয়ানবার্গারের উক্তিঃ

“The more the universe seems comprehensible the more it seems pointless.”

কার দৃষ্টিভঙ্গের সঙ্গে আপনার নিজের মতামতের মিল খায় বেশি? নাকি কারও না? প্রফেসার সালাম সারা বিশ্বভুবনে পরম করুনাময়ের অশেষ করুনার বারিধারা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতেন না। তার ঠিক পাশেই বসা, প্রায় একই ধীশক্তি ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন বিজ্ঞানী ওয়াইনবার্গ বলছেন অন্য এক জায়গায়ঃ

“Religion is an insult to human dignity. With or without it you’d have good people doing good things and evil people doing bad things, but for good people to do bad things, it takes religion”.

এবার বলুন আমার মত সাধারণ মানুষ কোনদিকে যাবে। ধর্ম সম্বন্ধে এক প্রাচীন রোমান দার্শনিক একটা সুন্দর উক্তি করেছিলেনঃ “Religion is regarded by the common people as true, by the wise as false, and by the rulers as useful”. বর্তমান যুগের বিশ্বরাজনৈতিক অঙ্গনে কথাটির যৌক্তিকতা অনেকের কাছেই মনোগ্রাহী হতে পারে। স্টিভেন ওয়াইনবার্গ আরেক জায়গায় বলেছিলেনঃ

“ One of the great achievements of science has been, if not to make it impossible for intelligent people to be religious, then to make it possible for them not to be religious. We should not retreat from this achievement.”

অর্থাৎ ধর্ম থেকে দূরে থাকতে পারার ব্যাপারটি সম্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের কারণে, এই প্রাপ্তিটুকুকে কেউ যেন ছোট করে না দেখে, বা কোনক্রমে পিছুপা হয়ে না যায় সেই প্রাপ্তির গৌরব থেকে। ওয়াইনবার্গ সাহেবের অন্যান্য উক্তির সঙ্গে আমি একমত হই বা না হই, অন্তত এই উক্তিটির সঙ্গে আমি একমত না হয়ে পারছিনা। এবং আমার বিশ্বাস, অত্যন্ত উঁচুমানের বিজ্ঞানী হিসেবে প্রফেসার সালাম নিজেও হয়ত কোনও যৌক্তিক ফাঁকফোকড় খুঁজে পেতেন না এতে (দুঃখের বিষয় যে প্রফেসার সালাম মাত্র সত্তুর বছর বয়সে এন্তেকাল করেন, ১৯৯৬ সালে, নিজের পেয়ারা দেশ পাকিস্তান থেকে অনেক দূরে, অক্সফোর্ড শহরে)।

আলবার্ট আইনস্টাইন এক জায়গায় বলেছিলেনঃ

“Science without religion is lame, religion without science is blind”.

মহামহিম আইনস্টাইনের কথার বিরোধিতা করব সেরকম দুঃসাহস আমার নেই, তবু না বলে পারছিনা যে তাঁর দ্বিতীয় উক্তিটাকে আমার নিজের ভাষায় বললে দাঁড়ায়ঃ বিজ্ঞান থাকলেই কি না থাকলেই কি, ধর্ম চিরকালই অন্ধ।

“With or without science religion is always blind”

তাঁর প্রথম উক্তিটির সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত, তা’ও নয়। এর পরিবর্তে আমি বলতে চাইবঃ ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু নয়, ধর্ম দ্বারাই পঙ্গু।

“Science becomes lame when burdened by the weight of a god”.

জানি লোকে কি বলবে। বলবেঃ এ কোন পুঁচকে ছোকরা এসেছে স্বয়ং আইনস্টাইনের কথার ওপর কথা বলা! জানি, এ আমার দারুণ ধৃষ্টতা। কিন্তু কি করব বলুন, আপনাদের সৃষ্টিকর্তা তো এভাবেই সৃষ্টি করেছেন আমাকে। পবিত্র কোরানে তো তিনি নিজেই বলেছেনঃ আমি যাকে ইচ্ছা তাকে ইমান দিই, যাকে ইচ্ছা তাকে দিই না। সবই তো তাঁরই ইচ্ছা!

 

আমার মুসলমান ভাইব্রাদারদের একটা প্রবণতাঃ ধর্মের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনও ঠোকাঠুকি আছে কি নেই সে ব্যাপারে কোন প্রশ্ন দাঁড়ালে বড় বড় বিজ্ঞানীর নাম উচ্চারণ করেন। কেন, আইজ্যাক নিউটন তো নাস্তিক ছিলেন না। আইনস্টাইন তো নাস্তিক ছিলেন না। তিনি কি নিজের মুখে বলেননি যে তিনি নাস্তিকদের পছন্দ করেন না? হ্যাঁ, বলেছিলেন, দুঃখের বিষয় যে কথাটি তিনি শুধু মুখে বলেননি, কাগজে কলমে লিখেও গেছেন। আমার ভাইব্রাদাররা তাঁর আরও একটা উক্তি বারংবার আওড়াতে পছন্দ করেনঃ আল্লা কি জুয়ার গুটি খেলেন কখনো? “Does God play dice?” তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে সৃষ্টিকর্তা (বাস্তব বা কল্পিত যা’ই হোক) তাঁর প্রাকৃতিক নিয়মাবলির মধ্যে ‘সম্ভাবনাসূত্র’এর(Probability) অনুপ্রবেশ মোটেও পছন্দ করেননা। সারাজীবন তিনি চেষ্টা চালিয়ে গেছেন ওয়ার্নার হাইসেনবার্গের অনিশ্চয়তাতত্ব (Uncertainty Principle) মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য। পারেননি। আইনস্টাইনের দীর্ঘ জীবনের খুব কম বিশ্বাসই ছিল যা সত্য প্রমানিত হয়নি। দুঃখের বিষয় যে এটি ছিল তার অন্যতম। পক্ষান্তরে অনিশ্চয়তাতত্বের সপক্ষে অসংখ্য তথ্য প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে নানাদেশের নানা গবেষকের পরীক্ষা-নিরীক্ষাতে। এতে কি প্রমাণিত হয়? যে আইনস্টাইনের মতামত নির্ভরযোগ্য নয়? মোটেও না। প্রমাণ শুধু এটুকুই হয় যে তিনি এত বড় মাপের মণীষী হওয়া সত্বেও মূলত তিনি মানুষই ছিলেন। একটু-আধটু ভুলের অধিকার তাঁর মত মহাপুরুষদেরও থাকে। অতএব তিনি আল্লা বিশ্বাস করতেন বলে আল্লার অস্তিত্ব প্রমাণ হয়ে গেল এই যুক্তি যেমন হাস্যকর, আবার তিনি বিশ্বাস করতেন বলেই আল্লার অস্তিত্বের প্রশ্নটি নড়বড়ে হয়ে উঠল এই যুক্তিটি ততোধিক হাস্যকর। ধর্ম ব্যাপারটি এতই ব্যক্তিগত যে কোনও বিশেষ ব্যক্তির বিশ্বাস-অবিশ্বাস দ্বারা এর পক্ষে-বিপক্ষে কোন যুক্তিই দাঁড় করানো যায় না। আব্দুস সালাম আর আলবার্ট আইনস্টাইন বিশ্বাস করতেন বলে আমার বিশ্বাসটিও মজবুত হয়ে উঠল এর চেয়ে ভ্রান্ত ধারণা আর হতে পারেনা।
বিশ্বাসী হলেও নিউটন, আইনস্টাইন আর সালামের বিশ্বাসের প্রকৃতি ছিল ভিন্নরকম। আইজ্যাক নিউটন গণিত আর বিজ্ঞানের জন্য যে কি অবদান রেখে গেছেন সেকথা বলে শেষ করা যাবে না—-পুরো একটা লাইব্রেরি বোঝাই হয়ে যাবে তাঁর কাজ দ্বারা। কিন্তু তাঁর কতগুলো কাহিনী আছে যা অনেকেরই জানা নয়। যেমন তিনি যতটা সময় ব্যয় করতে বিজ্ঞানচর্চায় তার প্রায় সমপরিমান সময় ব্যয় করতেন বাইবেল বা তৎসংলগ্ন বিষয়াদিতে মগ্ন থেকে। তবে একটা জিনিস তিনি কখনো প্রশ্র্য় দেননি—-বিজ্ঞান আর ধর্মকে একসাথে গুলিয়ে ফেলা। এরা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন কোঠার আরাধ্য বস্তু তাঁর জীবনে। ধর্ম তাঁর বিজ্ঞানকে ঘূণাক্ষরেও প্রভাবিত করতে পারেনি, যদিও তাঁর সময়কার চিন্তাধারাতে সেটা যে খুব অস্বাভাবিক বলে গণ্য হত তা নয়। অর্থাৎ একদিক থেকে তিনি ছিলেন অসম্ভবরকম আধুনিক—নতুন যুগের বার্তাবাহক দিকদিশারী, অন্যদিকে তিনি ছিলেন প্রাচীন চিলেকোঠার এক গোপনতাপ্রিয় একাকি সাধক। দুই বিপরীতের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ দ্বারা গঠিত ছিল তাঁর ব্যক্তিত্ব।
ওদিকে প্রফেসার সালাম ছিলেন ঠিক তার বিপরীত। ধর্ম আর বিজ্ঞান তো বিচ্ছিন্ন নয়ই, তাঁর মতে, বরং ধর্মের বাণী দ্বারাই বিজ্ঞান নিত্য অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত। এটা শুধু তাঁর একারই মন্ত্র নয়, গোটা ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী, তার মৌলিক বৈশিষ্ট্য। ধর্ম থেকে জীবনের কিছুই আলাদা নয়,—- বিজ্ঞান, গণিত, শিল্পকলা, কোনকিছুই না। সব সৃষ্টিধর্মী কর্মই ধর্মভাবনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ধর্ম ও সর্বেসর্বা বিধাতৃর সার্বিক উপস্থিতি মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতি চিন্তায় কল্পনায় ভাবনায়, এই আদর্শই মুসলিম বিজ্ঞানীকে চালিত করে। এবং প্রফেসার সালাম তার একনিষ্ঠ অনুসারী। তাঁর এক ভাষণে তিনি বলেছিলেনঃ পবিত্র কোরানের সাতশ’ পঞ্চাশটি সুরাতে নাকি আল্লাপাক মানবজাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রকৃতির অন্তহীন রহস্যের দিকে দৃষ্টিপাত করে সেই রহস্য কেমন করে উদ্ঘাটন করা যাবে তার পন্থা আবিষ্কার করতে। তাঁর এই উক্তিটির সত্যাসত্য পরীক্ষা করার যোগ্যতা হয়ত আমার নেই, কিন্তু এই কোরানের পাতাতেই যখন লেখা থাকে যে আল্লাতা’লা পৃথিবীতে মাঝেমধ্যে ধূমকেতু প্রেরণ করেন দুষ্টলোকের কানকথা শোনার জন্য তখন আমার মত পাপিষ্ঠের পক্ষে ধন্ধ ছাড়া আর কোন অনুভূতিই কাজ করে না এই বাণীর কোনও অন্তর্নিহিত মর্ম আবিষ্কার করাতে। কিম্বা যখন পড়িঃ

“…..who sends down water from the sky,…., who created all living things in pairs and made the ships and beasts on which to ride upon….” (43:11)

তখন সাত আসমানের ওপর থেকে সে যে কি গভীর প্রেরণা বহন করা বাণী, তা কিছুতেই আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করে না। অথবা সেই একই সুরার অন্যত্র দেখতে পাই মেয়েদের সম্বন্ধে লেখা আছেঃ

“ …. Would they ascribe to God females who adorn themselves with trinkets and are powerless in disputation?”(43:18)

তখন দ্বিধায় পড়ে যাই কথাগুলো কোনও পুরুষতান্ত্রিক গ্রাম্য মোড়লের নারীবিদ্বেষী বিষোদ্গার না স্বয়ং আল্লাপাকেরই গভীর দর্শনসিক্ত কোনও দুর্বোধ্য বাণী। অতএব সেই যে প্রবাদ আছে, সুন্দর হল দ্রষ্টার দৃষ্টিতে—-Beauty is in the eye of the beholder. প্রফেসার সালাম যে সুন্দরকে অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছিলেন পবিত্র কোরানের পাতায় পাতায় সে-সুন্দর জানি না কেন আমার চোখে ধরা দেয়নি। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই যে তাঁর কথাই ঠিক, আল্লাতা’লা সত্যি সত্যি জ্ঞানসাধনার ওপর জোর দিয়েছেন, তখন নতুন প্রশ্ন দাঁড়ায়ঃ তাহলে সমগ্র মুসলিম জাতি, এমনকি তাঁর সাহাবাদের মধ্যেও কেউ কেউ, এমন মন্তব্য রেখেছেন কোন্‌ যুক্তিতে যে সংসারে জানার যোগ্য যত জ্ঞান সবই পবিত্র কোরানেরই কোথাও-না-কোখাও লুক্কায়িত আছে। অর্থাৎ কোরান যদি কেউ ভাল করে পড়ে তাহলে তার অন্য কিছু পড়ার দরকার হবেনা। আমি মানতে রাজি আছি যে এধরণের ঢালাও উক্তি একমাত্র মহামূর্খদের মুখেই মানায়, কিন্তু এই “মহামূর্খরা”ই কি পৃথিবীর যাবতীয় উপাসনাগৃহ জোরদখল করে বসে নেই? কেবল উপাসনাই নয়, ক্ষমতার দণ্ডধর সব শক্তিই কি সেই একই মন্ত্র অহরহ আওড়ে যাচ্ছেন না? প্রফেসার সালাম সম্ভবত এতটাই উপরতলার মানুষ ছিলেন যে সাধারণ জীবনের সমতল ভূমিতে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেটা তাঁর দৃষ্টিগোচর হওয়া সহজ ছিল না। বর্তমান যুগে মুসলিম জাতির চরম পশ্চাদপদতার পেছনে প্রধানত এই পবিত্র গ্রন্থকেন্দ্রিক চিন্তাধারাকেই আমি দায়ী বলে মনে করি।
পক্ষান্তরে আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে ধর্ম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের বস্তু। সক্রিয়ভাবে উপস্থিত এবং নিত্য পথপ্রদর্শক কোনও দৈব গাইডের ভূমিকাতে নয়, অনেকটা কোমল সুরেলা আবহ সঙ্গীতের মত। যা প্রাণকে স্পন্দিত করে, মনকে করে সিক্ত স্নিগ্ধ পরিমার্জিত। তাঁর মতে ধর্মের তিনটে স্তর। প্রথমটিকে তিনি বলেনঃ Religion of Fear. (ভীতিভিত্তিক ধর্ম) (আমার ব্যক্তিগত মতে, বাইবেল আর কোরান, বিশেষ করে কোরান, এই ভীতিতান্ত্রিক বিশ্বাসের ওপর নির্ভরশীল। কোরান যে আমি পড়িনি তা নয়, বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়েই পড়ার চেষ্টা করেছি। এবং তার প্রতিটি পাতায় দেখেছি একটি দুটি অভয়বাণীর সাথে ভয়াবহভাবে মিশ্রিত সংখ্যাতীত হুমকি আর শাস্তির শাসানি। দোজখের আগুণ, জ্বলন্ত অঙ্গারের অনন্ত দাহন, কাফেরের পলায়নের পথ রুদ্ধ চতুর্দিকে, ইত্যাদি ইত্যাদি। সমগ্র গ্রন্থব্যাপী প্রেম ভালোবাসা মায়ামমতা জাতীয় কোমল শব্দগুলো একবার কি দুবার উল্লেখ হতে দেখেছি, বাকিটা সবই মারো কাটো সূচক ভীতিসঞ্চারি দণ্ডাদেশের মত শোনায়। কোরান পড়ে আমি ভক্তিগদগদচিত্তে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি না, ভয়ে আতঙ্কে মুষড়ে পড়ি, কুঁচকে যাই। এই ভীতির চিত্রটি প্রাচীন যুগের জন্য হয়ত উপযোগীই ছিল এক হিসেবে, কারণ আদিমানুষকে অহরহই বিবিধ বিপদ আপদের সম্মুখিন হতে হয়েছে। জীবজন্তু, প্রতিকূল আবহাওয়া, খাদ্যাভাব, শিকারনির্ভর জীবন এই তো ছিল সেকালের দৈনন্দিন জীবনধারা। সুতরাং ভীতিভিত্তিক ধর্মের সূচনা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু সেই প্রাথমিক স্তরটা উৎরে যাবার পর যখন মানুষ আস্তে আস্তে পুরো একটা সুসংহত সমাজগঠনের প্রক্রিয়াতে লিপ্ত হয়ে ওঠে তখন ধর্মের একটা ভিন্ন রূপ দাঁড়িয়ে যায় প্রয়োজনের তাগিদেই। সেটাকে আইনস্টাইন ‘সামাজিক ধর্ম’ বলে আখ্যায়িত করতে চেয়েছেন। এই সামাজিক রূপেতেই তৈরি হয়েছে গির্জা-মন্দির-মসজিদ-সিনাগগ, আর পাদ্রী-পুরোত-মোল্লা-রেবাই। এই সামাজিক জালের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে আছে আপামর জনসাধারণ তাদের ক্ষুদ্র বুদ্ধি আর ক্ষুদ্র চিন্তা নিয়ে। এই জালের ভেতরেই মানুষের স্বপ্ন ভাঙ্গে, স্বপ্ন গড়ে, ঘর ভাঙ্গে, ঘর তৈরিও হয়বা। এখানে ধর্ম কারো কন্ঠরোধ করে রাখে, আবার কাউকে দেয় বেকলুস মুক্তি। এখানে সুবিচার নির্ভর করে কার কত ক্ষমতা তার ওপর। প্রফেসার সালাম একহিসেবে দারুণ ক্ষমতাবান পুরুষ ছিলেন, আবার অন্য হিসেবে একেবারেই ক্ষমতাহীন দুর্বল ব্যক্তি। সারাজীবন প্রচণ্ডরকম ধর্মপ্রাণ হওয়া সত্বেও শেষ জীবনে এই সামাজিক ধর্মের নিষ্ঠুর বিদ্বেষনীতি যে কিভাবে তাঁকে অপমান করেছিল শুনলে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। একেতো আহমেদিয়া হওয়ার ‘অপরাধে’ তাঁকে অমুসলমান ঘোষণা করে একরকম দেশছাড়া করতেই বাধ্য করা হয়, তার ওপর তাঁর মৃত্যুর পর যে অবিশ্বাস্যরকম বর্বরতাগুলো ঘটে পাকিস্তানে তার বর্ণনা বড়ই বেদনাদায়ক। তাঁর মৃত্যু হয় অক্সফোর্ডেই। তবে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী মৃতদেহ সৎকার করা হয় পাকিস্তানের মাটিতে। এবং তাঁর নোবেল বিজয়ের স্মৃতিস্মারক স্বরূপ কবরের পাথরে খোদাই করে লেখা হয়ঃ প্রথম মুসলিম নোবেলবিজয়ী। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড আপত্তির মুখে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় সেই প্রস্তরলিপি থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি মুছে ফেলতে। কেবল থেকে যায়ঃ প্রথম নোবেল বিজয়ী! এবার বুঝুন কতটা অন্ধ বিদ্বেষ থাকলে ধর্মভীরু মানুষের মন এতোটা কলুষিত হতে পারে।
আইনস্টাইন নিজে এই সামাজিক ধর্মটির প্রতি মোটেও আকৃষ্ট ছিলেন না। তিনি কখনো চার্চ বা সিনাগগে যান নি, জেরুজালেমে একবার বেড়াতে গিয়ে মূর্খ উপাসকগুলোর মাথাদোলানো আর ঘাড়বাঁকানোর সব হাস্যকর কার্যকলাপ দেখে চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। না, প্রথামাফিক উপাসনাতে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। তিনি ছিলেন সুদূরের পিয়াসী। মহাকাশের অন্তহীন রহস্যময়তার সঙ্গে তাঁর প্রাণের সংযোগ। তিনি চার্চের ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ নকল ঈশ্বরের আরাধনাতে আগ্রহী মোটেও ছিলেন না। চার্চের ভেতর কেবল পাদ্রী আর রেবাইকেই পাওয়া যাবে, ঈশ্বরের ঠিকানা অন্যত্র। ধর্মবিষয়ে আইনস্টাইন ছিলেন স্পিনোজাপন্থী। তাঁর নিজের লেখাতেঃ “Give up the idea of a personal God in favor of cultivating the Good, the True, and the Beautiful in humanity itself.”
আইনস্টাইন বলতেন, তিনি যে ধর্ম পালন করেন সে ধর্মে ভয় নেই, শাস্তি নেই, তুচ্ছ উপহারও নেই। সে-ধর্মে আছে কেবল নিখিল নীহারিকার সঙ্গে একাকার হয়ে এক নিরাকার শক্তির অপরীসিম সৌন্দর্যময় সৃষ্টির রহস্য ভেদ করে একটু একটু করে তাঁর সান্নিধ্যে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা। এ ধর্মকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘Cosmic religion’. মহাজাগতিক ধর্ম? এখানে সৃষ্টি ও স্রষ্টার দূরত্ব ক্রমান্বয়ে দূর হতে থাকে, আবার বৃদ্ধিও পেতে থাকে একই সাথে। সৃষ্টির এই অপার ঐশ্বর্যতে বিস্ময়বিহ্বল হয়ে তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণামাত্র যদি সে হাতের মুঠোতে সংগ্রহ করে আগামী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পারে, সেই ব্রত দ্বারা সে ধন্য হয়, সে তার নিজের সার্থকতা অনুভব করে। সেই কসমিক ধর্ম সবার জন্য নয়, সাধারণ বিশ্ববাসীর কাছে সে এক দুরধিগম্য বিমূর্ততার কুয়াসাতে আচ্ছন্ন, কিন্তু যারা বিজ্ঞানের গূঢ় রহস্যমালার একনিষ্ঠ সাধক, যারা সুন্দরের পূজারী, তাদের জন্য এই একটি ধর্ম যার সর্বজনীনতা অনস্বীকার্য। অন্তত আলবার্ট আইনস্টাইনের মতানুসারে। তাঁর শেষ মন্তব্যঃ এই মহাজাগতিক ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে তিনি এবং তাঁর মত অনুসন্ধানী বিজ্ঞানীদের মত ধর্মপ্রাণ মানুষ আর নেই।

 

তিন
সবশেষে আমি গোড়ার প্রসঙ্গে ফিরে যাব—–অলৌকিকতা। এমন নয় যে এটি আমার প্রিয় প্রসংগ। বরং উলটো। ‘অলৌকিক’ শব্দটির মধ্যেই একটা ছলচাতুরির গন্ধ পাই আমি। লোকদেখানো কোনও বানোয়াট জিনিস। তবুও পুরোপুরি অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই, কারণ এখানে দেবদেবী, পীরমুর্শিদ আর আল্লারসূলের ব্যাপার জড়িত। অলৌকিকতা হল জাদুকরের জাদুর মত—–হলভর্তি দর্শকের সামনে জলজ্যান্ত একটা মানুষকে লম্বা তলোয়ার দিয়ে দুটুকরো করার পর তাকে আবার আস্ত করে ফেলার সঙ্গে হজরত ঈশা (আঃ) এর মরামানুষকে স্পর্শ করামাত্র তাকে পুনর্জীবিত করে ফেলাতে তফাৎটা কি? আমাদের পেয়ারা নবী হজরত মোহম্মদ (দঃ) আল্লার সঙ্গে মোলাকাত করতে গিয়েছিলেন সাত আসমানের ওপরে (যা কোরানে একাধিকবার বর্ণিত সাত-আসমানের-ওপর-সর্বশক্তিমান-আল্লাতা’লার-সিংহাসন-গ্রহণ করার গল্পের সঙ্গে পূর্ণমাত্রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ, যদিও মহান সৃষ্টিকর্তা নিরাকার এবং তিনি আসমান জমিন পর্বত কন্দর বায়ু জল সর্বত্র সর্বক্ষণ সর্বভাবে বিরাজমান, এই মন্ত্রখানাও বারংবার উচ্চারিত হতে শুনেছি, এবং যা স্পষ্টতই পূর্ববর্ণিত সাত-আসমানে-বসবাসরত বিধাতৃর ভাবমূর্তির সঙ্গে কিঞ্চিৎ সামঞ্জস্যহীন), এবং সেটি রূপক অর্থে নয়, স্বপ্নদৃষ্টেও নয়, সাক্ষাৎ সশরীরে (অর্থাৎ কোনও দৈব শকট বা শূন্যযান, ভ্যাটিকেনের মহামতি পোপের ব্যক্তিগত শকটের মত, পাঠানো হয়েছিল নিশ্চয়ই তাঁর স্বর্গারোহণের জন্য)। এইসব কল্পকাহিনী আমি তিন বছর বয়স থেকেই শুনে এসেছি আমার নিরক্ষর দাদী-নানী-খালা-ফুফুদের মুখে। ছোটবেলায় এগুলোকে অনায়াসে রূপকথা বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু কুসংস্কারের ডোবাজলে আবদ্ধ সমাজে এরা একসময় বাস্তবতার রূপ ধারণ করে—-অকাট্য এবং অখণ্ডনীয় সত্য বলে পরিগণিত হয়। আমার নিজেরই আত্মীয়স্বজনের মাঝে অনেকেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে রসূলে করিম শুধু সশরীরে আল্লার দরবারে উপস্থিত হয়েছিলেন তা’ই নয়, তাঁর শূন্যভ্রমণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে তাঁর বাসগৃহের ছাদের ‘ফুটো’ অনেকদিন ব্যাপী সংরক্ষিত ছিল! এমন ‘প্রত্যক্ষ প্রমাণ’এর মুখে আমার-আপনার মত সংশয়বাদীদের কতটুকুই বা ক্ষমতা।
যাই হোক, লৌকিক, অলৌকিক আর পারলৌকিক, ভোজবাজি নিয়ে মোল্লা-পাদ্রী-রেবাই মহলে যত মাতামাতিই হোক তাতে আমার কিছু আসে যায় না। সেখানে বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তির স্থান কোনদিন ছিল না, কোনদিন হবেও না। অতএব এই পথে কোনরকম ‘সংস্কার’ সাধন সম্ভব হবে বলে আমি মনে করিনা—–এমনকি আধুনিক বিজ্ঞানশিক্ষার উচ্চতম শিখরে পৌঁছানোর পরও (যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তো প্রফেসার সালাম নিজেই)। আমাকে নৈরাশ্যবাদী বলুন আর যা’ই বলুন, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ধর্মীয় সংস্কার পেতে হলে কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হবে।
তবু যে আজকে ঠিক এই বিষয়টা নিয়েই লিখতে বসেছি, তার কারণ সাধারণ অলৌকিকতা নয়, তথাকথিত ‘গাণিতিক’ অলৌকিকতা। অর্থাৎ গণিতের মত একটি নির্ভুলতাবাদী শাস্ত্রকে অলৌকিকতার সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করার এক আশঙ্কাজনক প্রচেষ্টা বেশ জোরেসোরেই শুরু হয়েছে সম্প্রতি, তাতে আমি রীতিমত বিচলিত। জানি কি বলবেন। তুমি কোথাকার পণ্ডিত হয়ে গেলে রে বাবা যে বড় বড় স্কলারদের কথার বিরুদ্ধে পোদ্দারি করতে এসেছ? হ্যাঁ, স্বীকার করছি যে আমি গণিতের এক অত্যন্ত নগণ্য, চুনোপুঁটি সেবক বই কিছু নই, কিন্তু সেবক বলেই আমি যাকে আরাধনার আসনে বসিয়েছি তার সামান্যতম অবমাননা আমাকে আহত করে (জানি আপনারা ‘মূর্তি’ শব্দটা শোনামাত্র ঘাবড়ে যান, এই বুঝি আল্লার গজব নেমে এল), আমাকে ব্যথিত করে। পবিত্র কোরানের মধ্যে কতিপয় জোড়-বেজোড় সংখ্যার প্রতি একপ্রকার আসমানি দুর্বলতা কারুরই দৃষ্টি এড়াবার নয়। যেমন ‘সাত’ আসমান। ‘সত্তর’ হাজার ফেরেশতা। লায়লাতুল কাদেরের (হজরতের নবুয়তপ্রাপ্তির দিবাগত রাত্রি) এক রাত্রির উপাসনা ‘দশ’ হাজার রাত্রির নামাজের সমান। অনেকটা বড়রকমের বোনাস পাওয়ার মত। সংখ্যার ব্যবহার দ্বারা ‘সোয়াব’ আর ‘গুণাহ’কে কি সুন্দরভাবে ওজন করা হয়েছে ভাবলে চমৎকৃত হতে হয়। তবে আমার বিশ্বাস যে সংখ্যার গাণিতিক গুরুত্ব নিয়ে খুব একটা বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা মূল কোরানের কোথাও ছিল না। বিশেষ করে বাইবেলের তথাকথিত ‘বাইবেল কোড’ আমাদের কোরা্নকে স্পর্শ করেনি অনেক, অনেক শতাব্দী ব্যাপী—-এ-কৃতিত্বটুকু মুসলিম আলেমদের অবশ্যই প্রাপ্য। দুঃখের বিষয় যে বর্তমান যুগের কম্পিউটার প্রযুক্তি (যা অবশ্য অমুসলমান কাফেরদেরই আবিষ্কার) সে-অবস্থাটিতে পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। কোরানে যা প্রত্যক্ষভাবে, বা সুস্পষ্টভাবে অনুপস্থিত, তার মধ্য থেকেই অপ্রত্যক্ষ বা অনুপস্থিতকে উপস্থিত করানোর একটা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা শুরু করে দিয়েছেন একদল পাঁতি গাণিতিক। তাঁরা উঠে পড়ে লেগেছেন প্রমাণ করতে যে কোরানে সত্যি সত্যি এমন সব গোপন সংকেত আছে যা কেবল অমানবিক মহাশক্তির পক্ষেই সম্ভব। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে সেই অলৌকিকতা!

 

গণিতশাস্ত্রে মৌলিক সংখ্যা (Prime Number) বলে একটা কথা আছে যার সঙ্গে ছোটবড় সবাই মোটামুটি পরিচিত। ১,২,৩,৫,৭,…….সংখ্যামালার প্রথমদিককার এই মৌলিক সংখ্যাগুলো অনেকে গড়গড় করে বলেও যেতে পারবেন—-একটু চালাকচতুর হলে হয়ত একশ দুশ কোঠা পর্যন্তও নির্ভুলভাবে আওড়ে যেতে পারবেন। তা থেকে এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হতে পারে যে এর চেয়ে সহজ জিনিস আর নেই। এ নিয়ে মাথা ঘামানো মানে অনর্থক সময় নষ্ট করা।
পাঠক শুনে অবাক হবেন যে এই আপাতসহজ জিনিসটা নিয়ে গণিতের বড় বড় মাথাওয়ালা ব্যক্তিরা যত সময় ‘নষ্ট’ করেছেন গত দুতিনহাজার বছরে ততটা সময় হয়ত অন্য কোনও বিষয়ে ব্যয় করেননি। ‘সংখ্যা’ বলতে সাধারণ অর্থে আমরা স্বাভাবিক সংখ্যা (Natural numbers) ১,২,৩,৪,….এগুলোকেই বুঝে থাকি। এদের অর্ধেক হল জোড় সংখ্যা, ২,৪,৬,….ইত্যাদি, আর অর্ধেক বেজোড়, ১,৩,৫,৭,….এগুলো। ২ ছাড়া আর কোন জোড় সংখ্যা কখনো মৌলিক হতে পারে না, কারণ মৌলিক বলতেই বোঝায় এমন সংখ্যা যা কেবল ১ এবং সেই সংখ্যাটি ছাড়া অন্য কোনও সংখ্যা দ্বারা বিভাজ্য নয়। অতএব মৌলিক সংখ্যাগুলোর খোঁজ পেতে হলে ১ আর ২ ব্যতিত অন্যসব বেজোড় সংখ্যার দিকেই মনোনিবেশ করা দরকার। ভাবছেন, এটা এমন আর কি কঠিন ব্যাপার?
আকাশ থেকে পড়বেন যদি বলি এর চেয়ে শক্ত ব্যাপার সংসারে আর দুটি নেই। ইহজগতে এতসব নতুন তথ্য, তত্ব আর যন্ত্র আবিষ্কার হয়ে গেল, অথচ মৌলিক সংখ্যারা ঠিক কোথায় বাস করে তার সঠিক সন্ধান পাওয়া গেল না অদ্যাবধি। আপনি হয়ত বলবেন, কেন, ১,২,৩,৫,৭,……, এভাবে গুণে গেলেই তো হয়। হ্যাঁ, হয়, যদি আপনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের গোটা আয়ুষ্কাল ব্যাপী গুণে যেতে পারেন, এবং সাথে সাথে নিশ্চিত হতে পারেন যে সংখ্যাটি, যত বিশালই হোক সে-সংখ্যা, আসলেই মৌলিক (কারণ ঐ পরীক্ষাটিও সাধারণ মানুষের সাধ্যের আওতায় পড়ে না)। সেটা কোন রক্তমাংসের মানুষ বা কৃত্রিম যন্ত্রের পক্ষেও সম্ভব নয়।
বলবেন, মৌলিক সংখ্যা যদি এতই দুরধিগম্য বিষয় হয়ে থাকে তাহলে তাকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকারই বা কি। আছে। ভীষণরকম দরকার আছে। প্রথমতঃ ক্ষুদ্র অণুকণা যেমন পদার্থের ইটপাথর, মৌলিক সংখ্যাও তেমনি সকল সংখ্যার অণুপরমাণু ( অর্থাৎ ইটপাথর ছাড়া যেমন দালান হয়না, মৌলিক সংখ্যা ছাড়া ছোটবড় কোন সংখ্যাই গঠন করা যায় না)। এক হিসেবে সকল গণিতেরই অণুকণা তারা। কথাটি আমি অতি হালকাভাবে বলে ফেললাম বটে, কিন্তু এটা যে সত্য তার প্রমাণ কি? আমরা, গাণিতিকরা ভাই, প্রমাণ ছাড়া কথা বলি না। মৌলিক সংখ্যার এই মৌলিক তথ্যটি প্রমাণ করেছিলেন ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতির জনক বলে পরিচিত ইউক্লিড সাহেব, আজ থেকে প্রায় ২,৩০০ বছর আগে। এই প্রমাণটি আমাদের গণিতশাস্ত্রে Fundamental Law of Arithmetic বা Unique Factorization Theorem বলে পরিচিত। এর বক্তব্য হল, সাদামাটা ভাষায়, যে-কোন পূর্ণসংখ্যা কতিপয় মৌলিক সংখ্যা বা তাদের ঘাত(Power) এর গুণিতক, এবং একমাত্র একটি( Unique শব্দটির প্রযোজ্যতা এখানেই) উপায়েই সেটা প্রকাশ করা সম্ভব। পূর্ণসংখ্যা নিয়ে গণিতের পুরো একটা শাখাই গড়ে উঠেছে, যার নাম সংখ্যাতত্ব, বা Theory of Numbers, অথবা Number Theory. একাধারে সবচেয়ে পুরাতন এবং সবচেয়ে নতুন তত্ব গণিতশাস্ত্রের। দুহাজার বছর ধরে পৃথিবীর যাবতীয় গণিতবিশারদদের চোখের মনি, প্রাণের সখা! সংখ্যাতত্বকে কেউ কেউ গণিতের রাণী বলে আখ্যায়িত করেছেন। পূর্ণ সংখ্যার মত সহজবোধ্য জিনিস যেমন নেই, এর চেয়ে রহস্যভরা দুর্বোধ্য জিনিসও বুঝি নেই জগতে।

 

২,৩,৫,৭,……এভাবে গুণতে থাকলে যে-কোনও সাধারণ কৌতূহলী ছাত্র/ছাত্রীর মনেও নানারকম প্রশ্ন জাগতে পারে। যেমন ৩-৫, ৫-৭, ১১-১৩, ১৭-১৯, ২৯-৩১,…..এদের মত আর কতগুলো যুগ্ম মৌলিক আছে সংখ্যামালাতে? (সংখ্যাতত্বে প্রশ্নটি টুইন প্রাইম বা ‘জমজ মৌলিক’ বলে পরিচিত এবং বহুপঠিত ও আলোচিত প্রশ্ন) দ্বিতীয় প্রশ্নঃ হাতে গুণেই দেখা যায় ২ থেকে ২০ পর্যন্ত মৌলিক সংখ্যা ৮টি, আর ৯০ থেকে ১০০ পর্যন্ত মাত্র ১টি(৯৭)। তাহলে কি মৌলিক সংখ্যা একটা জায়গায় গিয়ে ফুরিয়ে যায়? অর্থাৎ মৌলিকের সংখ্যা কি সীমিত? উত্তর হলঃ না, সীমিত নয়, তবে সংখ্যা যত বাড়ে মৌলিকের আবির্ভাবও ততই কমতে থাকে—-কিন্তু একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় না। আসল সমস্যা হল কি হারে কমে। গাণিতিকদের জন্যে এই হারটাই বিশেষরকম প্রয়োজন। কেবল গাণিতিকই নয়, গণিতকে যারা ব্যবসাবানিজ্যে ব্যবহার করেন, বিশেষ করে বর্তমান যুগের ব্যাঙ্কিং এবং নিরাপত্তামূলক প্রতিষ্ঠানাদিতে তাদের জন্যেও এর দারুন প্রয়োগশীলতা (মার্কাস ডু সটয়ের অসাধারণ বই Music of the Primes তে চমৎকারভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করা হয়েছে)। এবং এ-প্রশ্নটি মোটেও ছেলেখেলা নয়—–বড় বড় পণ্ডিতরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেছেন এই আপাতসহজ প্রশ্নটির সমাধান খুঁজে পেতে । এর ওপর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেন জার্মানীর কিংবদন্তীয় গাণিতিক গাউস (সাথে সাথে পদার্থবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও সংখ্যাবিজ্ঞানী), যাঁকে আধুনিক সংখ্যাতত্বের জনক বলে অভিহিত করা হয়, সর্বসম্মতিক্রমে। তাঁর বয়স যখন ১৬ কি ১৭ তখনই ব্যক্তিগত পত্রালাপে এক বন্ধুকে জানিয়েছিলেন যে তাঁর মতে মৌলিক সংখ্যাগুলো পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গড়ে lnN হারে (N হল একটি পূর্ণ সংখ্যা, আর ln বলতে বোঝায় সাধারণ লগারিদিম, যা কলেজের প্রথম বর্ষের বিজ্ঞান ছাত্রদের কাছে অপরিচিত কিছু নয়)। এটা তাঁর জটিল অঙ্ক কষে বের করা কোনও ফলাফল ছিল না, একটা আনুমানিক হার মাত্র। কিন্তু সেই টিনেজ বয়সের আনুমানিক হিসেবে পাওয়া সংখ্যাই আশ্চর্যরকম বাস্তব প্রমাণিত হয়ে যায়। যেমন ধরুণ N=100. তাহলে গাউসের অনুমান অনুযায়ী ২ থেকে ১০০ এর মাঝে ২১ কি ২২ টি মৌলিক থাকা উচিত। আসলে সংখ্যাটি ২৫। এমন কোন তফাৎ নয়। সংখ্যা যত বড় হয় গাউসের অনুমানও ততই আসলের কাছাকাছি চলে আসে। অর্থাৎ এই lnN সংখ্যাটি কাটায় কাটায় মিলে যাবার মত কিছু নয়, বিশালকায় N এর বেলাতেই এটা অধিকতর প্রযোজ্য। এধরণের হিসেবকে বলা হয় Asymptotic Formula. এর উপকারিতা বোঝা যায় যখন N কোনও মাত্রাছাড়ানো সংখ্যাতে পৌছে যায়, যেমন এক অর্বুদ বা নির্বুদ, যাকে হাতে গোণার সাধ্য কোনও রক্তমাংসের মানুষের নাই, দারুন শক্তিশালী কম্পিউটারও যেখানে হিমসিম খেয়ে যায়।
গাউসের সেই আনুমানিক হিসেবের ওপর অনেক বড় বড় মণীষী আরো অনেক কাজ করেছেন। শেষে একটা পূর্ণমাত্রায় উপপাদ্য আকারে এর প্রমাণ প্রকাশ করেন ডে-লা-ভালিপুঁস (Charles Jean de la Vallee-Poussin) নামক এক বিশিষ্ট বেলজিয়ান গাণিতিক, এবং স্বতন্ত্রভাবে, ঠিক একই সাল ১৮৯৬ তে প্রকাশ করেন ফরাসী গাণিতিক জ্যাঁক হাডামার্ড। এই প্রমাণটি বর্তমান যুগে Prime Number Theorem নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে এই উপপাদ্যের আরো অনেক প্রমাণ প্রকাশিত হয়েছে—-একেকজন একেক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রমাণ করেছেন একই তথ্য, যার ফলে বিষয়টির অপরিসীম গভীরতা আরো সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে পেরেছে।

 

তবে সংখ্যাতত্বের সত্যিকার কোহিনুর বলতে যদি কিছু থাকে সেটি হল জার্মানীর অবিস্মরণীয় প্রতিভা বার্নার্ড রিম্যান (১৮২৬-১৮৬৬)-এর অবিশ্বাস্য অন্তর্দৃষ্টি প্রসূত ধারণা ( Riemann Hypothesis), যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন ১৮৫৯ সালে। ওতে তিনি মৌলিক সংখ্যাসমূহের সত্যিকার বাসস্থান কোনও একমাত্রিক বা দ্বিমাত্রিক বাস্তব জগতে স্থাপন করেননি, করেছিলেন জটিল সংখ্যার(Complex Numbers) জগতে। তাঁর প্রস্তাব ছিল এই যে ‘জিটা ফাঙ্কশন’ নামক একটা গাণিতিক বস্তু যার শূন্য মানের সঙ্গে মৌলিক সংখ্যার সরাসরি সংযোগ স্থাপন করে গিয়েছিলেন লেনার্ড অয়লার (১৭০৭-১৭৮৩) নামক এক সুইস-জার্মান গাণিতিক, (যাঁর অবদান এতই বিশাল এবং এতই সর্বতোমুখি যে তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গাণিতিক প্রতিভাদের অন্যতম বলে গণ্য করেন অনেকেই), সেই শূন্যগুলো বাস করে তার বাস্তবমাত্রার ১/২ রেখাটিতে। পাঠকের কাছে এটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে যে রিম্যানের এই প্রস্তাবটি আজ পর্যন্ত কেউ প্রমাণ করতে পারেননি। তার অর্থ এই নয় যে গণিতের অগ্রগতি ব্যাহত হয়ে গেছে সেকারণে। বরং এই প্রমাণের মায়ামরীচিকার পেছনে ধাওয়া করে করে কত যে নতুন বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে গণিতের বিচিত্র বিশ্বে, কত যে অপরূপ বর্ণে গন্ধে পুষ্পে পত্রে পল্লবিত হয়ে উঠেছে এই নন্দন কানন তার বর্ণনা কেবল কাব্যিক ভাষাতেই সম্ভব। এ এক অফুরন্ত মনিমানিক্যপূর্ণ ভাণ্ডার। কৌতূহলী পাঠক যদি এর আংশিক আস্বাদগ্রহণে আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে নিচের ক’টি গ্রন্থের যে-কোনটি আপনার তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হবে বলে আমার বিশ্বাসঃ

1. Dan Rockmore, (2005), Stalking The Riemann Hypothesis, Pantheon Books.
2. John Derbyshire, (2003), Prime Obsessions, Joseph Henry Press, Washington, DC.
3. Karl Sabbagh, (2003), The Riemann Hypothesis, Farrar, Strauss and Giroux, New York.
4. Marcus du Sautoy,(2003), The Music of the Primes, Harper Collins Publishers.

এগুলো হল সাধারণভাবে অগাণিতিক পাঠকের জন্য লেখা বই, গণিতের ফর্মুলা আর সমীকরণ দেখে যারা অভ্যস্ত নন এবং তাতে ওদের প্রচণ্ডরকম আকর্ষণও নেই। তবে সারমর্মটা অনায়াসে আয়ত্তে এসে যাবে এগুলো একটু মনযোগ দিয়ে পড়লেই। বড় কথা আমার উপরোক্ত বক্তব্যগুলো হয়ত তখন খুব একটা দুরধিগম্য বোধ হবে না।

চার

বছর দুয়েক আগে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু টেলিফোন করে, বেশ উত্তেজিত স্বরেই বললঃ জানো ভাই, আজকে মসজিদে গিয়ে শুনলাম তোমাদের ‘বিগ ব্যাং’ ব্যাপারটা পরিষ্কার করেই লেখা আছে পবিত্র কোরানের অমুক সুরার অমুক আয়াতে।
‘পরিষ্কার লেখা’ শোনার পর কি মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় বলুন? তবুও কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে গেলঃ খুব উত্তম সংবাদ। তাহলে বলত ভাই, এই মূল্যবান এবং ‘পরিষ্কার করে লিখিত’ তথ্যটি বিগ ব্যাঙ্গের আগে প্রকাশ পায়নি কেন তোমাদের মসজিদে? প্রশ্নটা বন্ধুর খুব মনঃপুত হয়নি বোঝা গেল। আমার ধর্মবিশ্বাস যে ওর মত পাকাপোক্ত নয় সেটা তার জানা। তাই কথা না বাড়িয়ে আস্তে করে শুধু বললঃ তুমি বিশ্বাস করতে চাওনা বলেই ধর্মসম্বন্ধে কোন কথাই মানতে রাজি নও। অনুরূপভাবে তুমিও ধর্মবহির্ভূত কোনও যুক্তি বিশ্বাস করতে চাও না বলেই এধরণের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে নারাজ।
বিখ্যাত কোরান অনুবাদক মুহম্মদ মার্মাডুক পিকথল তাঁর “The Meaning of the Glorious Koran” (A Mentor Book, 1953) গ্রন্থের ভূমিকাতে লিখেছিলেনঃ

“It may be reasonably claimed that no Holy Scripture can be fairly presented by one who disbelieves its inspiration and its message….”.

কথাটার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত আমি নই। তবু তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও আমি বলতে পারিঃ

Similarly it is reasonable to claim that no true believer can present a Holy Scripture in an objective (and/or historically accurate) manner.

অর্থাৎ অবস্থাটা দাঁড়ায় অনেকটা দাবাখেলার ‘চালমাত’এর মত। তাই বলে চেষ্টার ত্রুটি? না, সেটা দুপক্ষের কোন পক্ষেই নেই। সেজন্যেই আমি বলি ওদের সঙ্গে তর্ক করে অনর্থক সময় নষ্ট না করে একটা ভাল বই নিয়ে বসা অনেক সুখের।

 

কিন্তু ধর্মবাদীরা আমাদের শান্তিতে একটা বই পড়ার সুযোগ দেবে না। জোর করে দেখাতে চাইছে আমাদের যে কোরানের অমুক জায়গায় অমুক বিজ্ঞান লুকিয়ে আছে, অমুক পাতায় আল্লাতা’লা পরিষ্কার করে অমুক মহৎ আবিষ্কারের ফর্মুলা লিখে দিয়েছেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারা কৃষ্ণবিবর (Black Hole) বের করেছেন, বিগ ব্যাঙ্গের কথা তো আগেই বললাম, এটম বের করেছেন, (প্রটোন, নিউট্রন, ইলেক্ট্রন, এগুলোর কথা এখনো শুনিনি, তবে শুনব, অচিরেই বেরুবে সেগুলো), ভ্রূণতত্ব পেয়েছেন কোরা্নে, এমনকি চিরশত্রু চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্বও নাকি কোরানেরই কথা। হালের হিগস বোজনও যে কোরানেরই কোনও এক সুরাতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল দেড় হাজার বছর ধরে সেখবরও অবধারিত বের হয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে, সেবিষয়ে আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন। এই অদ্ভুত প্রাণীদের সঙ্গে তর্ক করার কোন মানে আছে, বলুন?
না, আমি বিজ্ঞানের পথে পা বাড়াব না আজকে। আমার বিষয় বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের ভাষা, অর্থাৎ গণিত। (কথাটা শুধু গ্যালিলিও গ্যালিলি বলেননি সপ্তদশ শতাব্দীতে, লিওনার্ড দ্য ভিঞ্চিও বলেছিলেন আজ থেকে প্রায় ৫৫০ বছর আগে) বিজ্ঞান নিয়ে অলৌকিকের ব্যবসা খুব একটা লাভবান হয়না বলে তাঁরা এখন অঙ্কের দিকে মনোযোগ দিয়েছেন। সংখ্যা দিয়ে আসলেই অনেক ভোজবাজী করা যায়, তাক লাগানো যায় রাস্তার মানুষকে, যেমন করে তাক লাগায় টুপি-থেকে-খরগোশ-বেরকরা জাদুকর, বা মুখের ভেতর থেকে টগবগে আগুন বের করা খেলোয়াড়। ধর্মের দড়িতে সাধারণ মানুষকে আজীবন শক্ত করে বেঁধে রাখার জন্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হল অলৌকিক। বিজ্ঞান দিয়ে সেটা বেশি সুবিধা হয়না বলেই এখন অঙ্কের প্রতি তাদের কৃপাদৃষ্টি। এবং অঙ্কের অন্যান্য শাখাতে নাক গলানো একটু অসুবিধা বলেই হয়ত মৌলিক সংখ্যার প্রতি তাঁদের ভীষণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আলি এডাম্‌স্‌ নামক এক আপাত-লেখাপড়াজানা হুজুর তাঁর www.hellwave.com ওয়েবপেইজে এমন সুন্দর কথা লিখেছেন যে শোনামাত্র অনেক উচ্চশিক্ষিত মানুষের মনও ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে উঠবেঃ

“ Muslims and non-Muslims alike need to think collectively as a unit, not as islands of knowledge, despite our differences to try our best to decode Allah’s message using prime numbers amongst other tools and to make noble use of it for the good of all, not the selfish few.”

পড়ে মনে হয় আল্লাতা’লা স্বয়ং মৌলিক সংখ্যাগুলোকে ব্যবহার করেছেন তাঁর মহান বাণীগুলোকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রেরণ করার জন্য। অঙ্কের সামান্য সেবক হিসেবে আমার চেয়ে বেশি খুশি কে হবে এমন প্রাণজুড়ানো কথা শুনে। কিন্তু সমস্যা হলঃ কোরানের অন্যত্র (একাধিকবার) লেখা হয়েছে যে এই বাণীগুলো তিনি সহজ আরবি ভাষায় নাজিল করেছেন যাতে সর্বসাধারণের কাছে সেগুলো সহজবোধ্য হয়। কোন্‌টা বেশি সত্য তাহলে? সহজবোধ্য আরবি (ভুলে যাবেন না যেন এই বাণী অনুযায়ী বাঙ্গালি-মারাঠী-চীনা-জাপানি-ফারসি-ইংরেজ কেউই ধর্তব্যের মধ্যে পড়েনি কোরান নাজেলের সময়) না অঙ্কের সাঙ্কেতিক ভাষা? মেনে নিলাম যে আল্লা তাঁর মৌলিক সংখ্যা নিয়ে একটু মৌলিকত্ব প্রকাশ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তখন যে প্রশ্নটা বড় হয়ে দাঁড়ায়ঃ কেন? দেড় হাজার বছরের পুরনো বাণীকে এতটাই জটিল তিনি কি মহান উদ্দেশ্য নিয়ে করতে প্রয়াসী হবেন যার মর্ম উদ্ধার করার জন্য ইউরোপ-আমেরিকার যাবতীয় কাফেরদের আবিষ্কৃত যন্ত্রের (কম্পিউটার) সাহায্য নিতে হবে?
পাঠকের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যে জনাব আলি এডাম্‌স্‌ সাহেবের আবিষ্কৃত দুচারটে মনিমুক্তা পেশ করছি এখানে। তিনি লিখছেনঃ

“Using prime numbers a new evidence for 31 events in 2012 has been found in the holy book of Islam: The Quran.
These events will (God willing) unite the world in a spiritual awakening wave once Man sees that all places of worship become safe havens to shelter the believers and realize that all worships the same God regardless of different religious paths. With sincere prayer we may avert all 31 events if we unite now and submit to God’s will as directed by the global living guide: The Quran.”

২,০১২ এখন অতিক্রান্ত—-স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারি এবার। বড় ফাঁড়া কেটে গেল, তাই না? তবে আপনার কি মনে পড়ে কখন সারা দুনিয়ার মানুষের মনে দারুণরকম একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতির মহাজাগরণ পরিলক্ষিত হয়েছিলে গতবছর? কিম্বা মনে পড়ে কি সেবছর একবারও সুন্নি মুসলমানরা শিয়াদের মসজিদ আক্রমন করে খুনখারাপ করেনি, বা আহমেদিয়াদের মসজিদ বা কপ্ট খ্রিস্টানদের গির্জা পোড়ায়নি? শেষ প্রশ্নঃ এই ৩১ টি দৈব ঘটনা, সেগুলো কি ঘটে গেছে? যদি ঘটে থাকে তাহলে আপনি-আমি কোথায় ছিলাম? নাকি কেবল আলি এডাম্‌স্‌ সাহেবের পাড়াতেই ঘটেছে? অবশ্য দোষটা সব তাঁরও নয়। প্রথমত উনি যৎকিঞ্চিৎ অঙ্ক পড়েছেন বলে সেটা জাহির করার একটা প্রবল বাসনা তাঁর থাকতেই পারে—-অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী বলে সেই প্রবাদটা কি খামোখা রটেছিল আমাদের দেশে? তার ওপর উপরওয়ালার গুরুগম্ভীর বাণীঃ

“ 44:10 Look out for a day when the sky brings clarifying smoke.
44:15 We are lifting the punishment a little but you will be back (to disbelief).
44:16 On a day when we seize you with a mighty onslaught: We are taking revenge.”

পড়ার পর আমার আত্মা শুকিয়ে যায় ভয়ে। পরম করুণাময় হঠাৎ করে এমন রেগে গেলেন কেন মানবজাতির ওপর? তিনটি লাইনেই শাস্তি আর সংহার আর প্রতিশোধের বজ্রধ্বনি। এই ‘প্রতিশোধ’ শব্দটি সম্ভবত এডাম্‌স্‌ সাহেবের কানেও একটু কড়া মনে হচ্ছিল। তাই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত করে তিনি একটা ছোট্ট ভাবসম্প্রসারণের চেষ্টা করলেন এই বলে যে প্রতিশোধ কেবল আল্লাপাকের বিরোধিতাকারিদের বেলাতেই প্রযোজ্য। (এখানে উল্লেখ না করে পারা গেল না যে কোরানের আরেক জায়গায় আল্লা নিজেই বলেছেন যে তাঁর ইচ্ছা ছাড়া পৃথিবীতে কিছুই ঘটে না, প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কর্মও তার ব্যত্রিক্রম নয়)
যাই হোক ৩১ এর কেচ্ছা এখানেই শেষ হয়ে যায়নি। ২০১২ সালেই যে আল্লার রোষবহ্নি ফেটে পড়বে পৃথিবীর ওপর তার পেছনেও আলি সাহেবের অগাধ মৌলিক-পারদর্শিতার স্বাক্ষর আছে। তিনি বলছেনঃ

“The Merciful verse contains 31 repetitions of a verse that reads: ‘what other bounties of your Sustainer you will belie?’ Sum of the verse #s of the repetitions= 1,433.
1+4+3+3=11 (a prime, while 1433 is a prime as well)”

দারুণ আবিষ্কার নিঃসন্দেহে! শুধু তাই নয়। ইসলামিক হিজরি সাল ১,৪৩৩=ইংরেজি ২,০১২! তাঁর উপসংহারঃ

“This research predicts that a 4-day event that will repeat 31 times (44:10, 44:15) before a big event (44:16) takes place on 21 December, 2,012, as predicted by the western experts according to the astronomically accurate Mayan Calendar”.

আলি সাহেবের জন্য এটা হয়ত অত্যন্ত দুঃখের ব্যাপারই ছিল যে উপরোক্ত তুলকালাম ঘটনাগুলোর একটাও ঘটেনি গত বছর, যদিও অবশিষ্ট মানবজাতির জন্য অবশ্যই পরম স্বস্তি ও শান্তির।
মৌলিক সংখ্যার ভোজবাজি তিনি একাই খেলেননি—-ধর্মের ইতিহাস জুড়েই এই খেলার অন্তহীন অবতারণা। আব্দুল কালাম আল-কাহিল বলে এক আলেম আছেন যাঁর প্রিয় মৌলিক হল ৭। তিনি বলছেনঃ
১) আসমানের সংখ্যা ৭;
২) বর্ণের সংখ্যা ৭;
৩) সপ্তাহে দিনের সংখ্যা ৭;
৪) অণুতে পরমাণুর বলয়সংখ্যা ৭;
৫) কাবাশরিফের চারপাশে আপনাকে ৭ বার ঘুরতে হয়;
৬) সাফা থেকে মারোয়া পর্যন্ত ৭ বার দৌড়াতে হয়;
৭) লুসিফার শয়তানের ওপর ৭ বার প্রস্তর নিক্ষেপের নিয়ম;
৮) ফাতিহা সুরা ৭ পংক্তি দ্বারা গঠিত এবং এর মোট অক্ষরসংখ্যা ২১=৭ এর গুণিতক।
৯) এই ৭ পংক্তির অক্ষরমূহের মধ্যে ALLAH শব্দটির A, L এবং H অক্ষরগুলো ৭ গুণ ৭=৪৯ বার বিদ্যমান।
১০) দোজখের দরজাসংখ্যা মোটমাট ৭ টি (এতে যদি একটু আরাম বোধ করেন আপনি);
এবং দোজখ শব্দটি সর্বমোট ৭৭ বার ব্যবহৃত হয়েছে পবিত্র কোরাণশরিফে।
QED
৭ এর ঐশ্বরিক মহিমা প্রমাণ হয়ে গেল!
বলা বাহুল্য যে “৭” এর দুর্বলতা কেবল ইসলামেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং ইসলামের দুর্বলতাটি সম্ভবত বাইবেল (ওল্ড টেস্টামেন্ট) এর তিন হাজার বছরের পুরনো দুর্বলতা থেকেই ধার করা, যেমন ধার করা পবিত্র কোরানের অনেক কিছুই। এই দুর্বলতার বিস্তারিত বৃত্তান্ত জানতে চাইলে সৈকত চৌধুরি ও অনন্ত বিজয় দাশের সুগবেষিত ও সুলিখিত নিবন্ধটি পড়ুন, এখানে কিংবা এখানে

লেখাটি পুনঃমুদ্রিত হয়েছে কয়েকবার। বিশেষভাবে দ্রষ্টব্য তাঁদের প্রণীত গ্রন্থ “পার্থিব”(শুদ্ধস্বর প্রকাশনী, ২০১১) এবং সে-গ্রন্থের রিভিউ, এখানে

তবুও “৭” সপক্ষে যদি ওকালতি করতে হয় তাহলে বলতামঃ অন্তত এই সংখ্যাটি কোরানের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে বেশ কয়েকবারই।

এবার চলুন ১৯ এ যাওয়া যাক। এটি খোলাখুলিভাবে উল্লেখ করা হয়নি কোরানের কোন সুরাতেই, অন্তত আমার জানামতে, কিন্তু একে জোর করে কোরানের অলৌকিকতা প্রমাণের সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন কতিপয় আপাতবিদ্বান ব্যক্তি।

 
অবশ্য ১৯-এর মাহাত্ম্য কেবল ইসলাম ধর্মেই সীমাবদ্ধ নয়। সংখ্যাটির নিশ্চয়ই এমন কোনও জাদুকরি শক্তি আছে যার কারণে বাহাইসহ আরো দুচারটে ধর্মে এই সংখ্যাটির বিশেষ কদর। কিন্তু তার আগে একটা কথা না বলে পারছি না—-১৯ কিন্তু আসলে ১৯ নয়, ১। এক মহাপুরুষ তার প্রমাণ দিয়েছেন এভাবেঃ
১৯=১+৯=১০=১+০=১ এবং ১ মানে এক এবং অদ্বিতীয় সেই মহান সত্ত্বা, পরম করুণাময় আল্লাতা’লা! তার অর্থ ১৯ সংখ্যাটি নাস্তিক তো নয়ই, রীতিমত একেশ্বরবাদী! যুক্তিকে এভাবে টেনে মুচড়ে নিজের মনোমত করতে চাইলে আমার মনে হয় যে-কোন সংখ্যাকে “১” এ পরিণত করে আল্লাপাকের দরবারে হাজির করানো সম্ভব। আমাদের গণিত মহলে একটা কথা আছেঃ আপনি যদি একটা উপপাদ্যের ওপর তাক করে বসে থাকেন যে এটা সত্য না হয়ে পারে না (আসলে হয়ত তা নয়), তাহলে আপনি ছলেবলেকৌশলে একটা-না-একটা উপায় বের করবেনই যাতে করে আপনার দিক থেকে একটা “প্রমাণ” সৃষ্টি হয়ে যাবে। এরকম অপ- বা খলপ্রমানের ইতিহাস গণিতশাস্ত্রের পাতায় পাতায়। যেমন সপ্তদশ শতাব্দীর কিংবদন্তী গাণিতিক-আইনজীবি কাউন্ট ফার্মার শেষ উপপাদ্য (Fermat’s Last Theorem) বলে খ্যাত বক্তব্যটির তথাকথিত “প্রমাণ” আবিষ্কার করেছেন, এমন দাবি নিয়ে যে ছোট-বড় কত অসংখ্য গাণিতিক এগিয়ে এসেছিলেন আড়াই শ’ বছর ধরে (তার মধ্যে এক বাংলাদেশী প্রফেসারও হঠাৎ করে নাম করে ফেলেছিলেন ১৯৫৯ সালে) তার হিসেব নেই। প্রশ্নটি এতই জটিল যে শেষ পর্যন্ত এর যে প্রমাণ প্রকাশ হয় ব্রিটিশ গাণিতিক এন্ড্রূ ওয়াইলসের হাত দিয়ে ১৯৯৩-১৯৯৫ সালে, তার দৈর্ঘ্য ছিল ১০০ পৃষ্ঠা!
দুঃখের বিষয় যে পবিত্র কোরানকে সবাই সর্বজ্ঞানের আকর বলে দাবি করা সত্বেও ফার্মার উপপাদ্যটির প্রমাণ আমি কোথাও খুঁজে পেলাম না। পেলে আমি তৎক্ষণাৎ তৌবা করে পাক্কা মুসলমান হয়ে যেতাম—-কারণ, আমার বিবেচনায়, ওটাই হত সত্যিকার মিরাকেল। কিন্তু মিরাকেলভক্তরা এতে দমবার পাত্র নন। এঁদের কাছে ‘মিরাকেল’ হল আমরা যাকে বলি কাকতালীয় সংযোগ (Coincidental connection), বা কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় (Curiosity), বড়জোর। এরকম ‘লক্ষণীয়’ বিষয় প্রতিনিয়তই পরিলক্ষিত হয় প্রকৃতির মাঝেই। যেমন আনারসের বহিরাবয়বের মধ্যে, শামুকের খোলশের ভেতরে, গাছগাছারির প্ত্রবিন্যাসের মধ্যে, ‘ফিবুনাচি সংখ্যা’ বলে একটা রাশিমালা আছে যার আবির্ভাব বরাবরই লক্ষ করেছেন কৌতূহলী গাণিতিক আর বিজ্ঞানীরা। ফিবুনাচি সংখ্যা এবং এজাতীয় আরো অনেক গাণিতিক বিষয়াদির নিয়মিত উপস্থিতি প্রকৃতির বহুবিচিত্র শাখাপ্রশাখায়, তার ওপর চমৎকার বই লিখেছেন ইয়ান স্টুয়ার্ট ( The Mathematics of Life, Published by Basic Books, 2011, US)। গণিতের সুবিন্যস্ত ধারাপ্রকৃতি কিভাবে প্রকৃতির প্রায়-নিখুঁত অবয়বের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে তার একটা মোটামুটি ধারণা পাওয়া যাবে এ-বইটা থেকে—-একটি সহজপাঠ্য বই যার জন্যে গণিতবিশারদ হবার প্রয়োজন হবে না। আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে কি এই অসামান্য বিন্যাসভঙ্গীর সামান্য ছিঁটেফোটা পাওয়া যাবে? আমার তো মনে হয়না। হয়ত সেকারণেই অলৌকিকবাদীরা উঠেপড়ে লেগেছেন কোরানের ভেতর থেকে যেভাবেই হোক সেই অনুপস্থিত বিন্যাসটিকে সাঙ্কেতিক ভাষার ছুতো দিয়ে উদ্ধার করে নিতে। সেকারণেই তারা ৭,১১, ১৯, ৩১,…..এসব মৌলিক সংখ্যাগুলোকে সামনে তুলে ধরছেন যাতে করে কোরানের ভাষাবিন্যাসের মধ্য দিয়ে সেই মৌলিকত্বটুকু এমনভাবে ফুটে ওঠে যে সেটা কোনও মানবিক শক্তি দ্বারা সম্ভব নয়—-অতএব এটা নিশ্চয়ই অলৌকিক!

 
“১৯” এর সবচেয়ে বড় চ্যাম্পিয়ন হলেন রাশাদ খলিফা নামক এক মিশরীয় মুসলিম বিজ্ঞানী। তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী ইন্টারনেট থেকেই পেতে পারেন—-সৈকত চৌধুরি-বিজয় দাশ এর বইতেও পাবেন সেটা। গতানুগতিক অর্থে ভদ্রলোক দারুণ বিদ্বান ব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই। কায়রোর বিখ্যাত এইন শামস বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, বায়োকেমিস্ট্রির পি এইচ ডি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, বিজ্ঞানের ওপর গোটা বিশেক গবেষণাভিত্তিক নিবন্ধের রচয়িতা, শেষে এরিজোনা অঙ্গরাজ্যের সরকারি রসায়ন বিভাগের পদস্থ কর্মচারি—–রীতিমত কীর্তিমান পুরুষ।
সমস্যা একটাই—–বড় বিজ্ঞানী, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক কিনা সেটা বিচার্য বিষয়। বিজ্ঞানচর্চার সাথে সাথে ধর্মচর্চাও করেছেন প্রচুর। কোরান অনুবাদ করেছেন নিজের মত করে। এবং এই ‘নিজের মত করে’ করার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর বিশেষত্ব—-তিনি কোরানের মধ্যে ‘১৯’ কে পেয়েছেন অতি কাছে থেকে—-বিসমিল্লাহ থেকে শেষ সুরা পর্যন্ত সর্বত্র তিনি ১৯ বা তার গুণিতক উদ্ধার করেছেন (যদিও তার জন্য কেবল কোরানের সাহায্যই যথেষ্ঠ ছিল না, আধুনিক অমুসলিম বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার অর্থাৎ কম্পিউটারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল)। ১৯ দ্বারা তিনি এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে একটা সুরাতে গিয়ে সংখ্যটির সঠিক গুণিতক না পাওয়ার ফলে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেলেন যে কোরান যাঁরা সংকলন করেছিলেন তাঁরাই আসলে ভুল! তার মানে পবিত্র কোরানকে সারা দুনিয়ার মানুষ যেভাবে দেখে এসেছে প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে—-নির্ভুল, নিখুঁত, দৈববাণীতে ভরপুর এক অতুলনীয় গ্রন্থ, সেই ভাবমূর্তিটা পুরোপুরি ঠিক নয়, রাশাদ খলিফার গবেষণা অনুযায়ী? শুধুমাত্র “১৯” এর হিসেবে মিল খেল না বলে? ভদ্রলোকের ধৃষ্টতার সেখানেই শেষ নয়। কোরান থেকে আরো ক’টি সুরা উদ্ধৃত করে তিনি দাবি করলেন যে ওগুলোতে আল্লাপাক একজন ভাবী রসুলের কথা উল্লেখ করেছেন—–সেই ভাবী রসুলটি আর কেউ নয়, রাশাদ খলিফা স্বয়ং! নবী (prophet) নন, কেবলই রসুল (messenger)। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে সৈকত চৌধুরি আর বিজয় দাশের সেই অনবদ্য নিবন্ধটিতে।

 
রাশাদ খলিফা কীর্তিমান পুরুষ তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু পরবর্তীকালে কতখানি সুস্থমস্তিষ্ক ছিলেন সেটা ভাববার বিষয়। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ভদ্রলোক ইসলামের প্রচলিত ধারাতে সামান্য পরিবর্তন আনার চেষ্টা করলেও প্রচলিত ইসলামের শ্যনদৃষ্টি এড়াবার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এ-ধর্মে মৌলিক যুক্তির জবাব একটাই—-মৃত্যুদণ্ড। তলোয়ার। কোন তর্কবিতর্কের অবকাশ নেই—-সে-তর্কের উদ্বোদ্ধা কোনও উন্মাদই হোক আর সুস্থমস্তিষ্কের বিজ্ঞজনই হোক। এই ধর্মে সহনশীলতার আরেক নাম দুর্বলতা। বেচারা খলিফা তাঁর উদ্ভট কথাবার্তা প্রচার করতে গিয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করলেন। ১৯৯০ সালের ৩১শে জানুয়ারি তাঁর বাসগৃহের নিকটবর্তী এক মসজিদের ভেতর তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়, ২৯টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন সহকারে। কাকতালীয় হলেও পাঠকের জন্য কৌতুকবহ হতে পারে যে ৩১ এবং ২৯ দুটি সংখ্যাই মৌলিক। এতে করে কোনও মোমিন মুসলমান যদি এমন একটা ধারণায় পৌঁছে যান যে আল্লাতা’লা সত্যি সত্যি ‘মৌলিক সংখ্যা’র প্রতি পক্ষপাতিত্বশীল তাহলে আমার বলার কিছু নেই—–এঁরা আছেন বলেই তো অলৌকিকতা এখনো টিকে আছে—-এবং হয়ত থাকবেও আগামী তুষার যুগের আগ পর্যন্ত। কোথায় যেন পড়েছিলাম এক সাধারণ লোকের মন্তব্যঃ কোরান যে একটি ঐশ্বরিক গ্রন্থ সেটা প্রমান করার জন্য মুসলমানরা যত সময় ব্যয় করে তার একাংশ সময়ও তারা ব্যয় করেনা ধর্মের মূল মন্ত্রগুলোকে অনুধাবন এবং অনুসরণ করতে। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়, এবং, কেবল মুসলমানদের বেলাতেই প্রযোজ্য নয়। ইসলামের আগে খৃস্টধর্মাবলম্বীরা সারাক্ষণই ‘অলৌকিকতা’ খুঁজে বেরিয়েছেন তাদের ধর্মগ্রন্থে। এবং তারও আগে করেছেন ইহুদীরা। শিখধর্মে তো ‘গ্রন্থসাহেব’কে প্রায় দেবতার মতই আচরণ করা হয়। একটা বিশালকায় গ্রন্থকে স্বর্ণালঙ্কারমণ্ডিত সুশোভিত শয্যায় শায়িত করে তার শিরদেশে হাতপাখা ব্যবহার করার জন্য দিবারাত্রি একজন পরিচারক নিযুক্ত রাখার অর্থই তো সেটা—-স্বয়ং ঈশ্বরের শয্যা ওটা! তবে এটা মানতেই হবে যে শিখধর্ম বা হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন-পারসি ধর্মগুলোতে গণিতের সাহায্যে তাদের ধর্মগ্রন্থের ‘অলৌকিকতা’ প্রমানের চেষ্টা আমার চোখে পড়েনি। এই বদভ্যাসটি সম্ভবত তিনটে আব্রাহামিক ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইবেলে যেমন আছে ‘বাইবেল কোড’ তেমনি আমাদের কোরানে আছে ‘কোরান কোড’। এখন কম্পিউটারের সাহায্যে যোগ দিয়েছে ১৯ এর কোড—-রাশাদ খলিফা পি এইচ ডি’র সৌজন্যে। তিনি নিজের মতবাদ প্রচার করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন বটে, তবে ১৯ এর মহিমা প্রকাশ করার জন্য নয়। বরং তাঁর ১৯ নিয়ে ইসলামিক জগতে তুমুল সাড়া পড়ে গিয়েছিল একসময়। বড় বড় আলেমউলামারা তাঁকে বাহবা জানিয়ে লম্বা লম্বা বাণী দিয়েছিলেন।

 
তবে কি জানেন? কোরানের বিভিন্ন সুরাতে ‘১৯’ সংখ্যা বা তার গুণিতকের পৌনঃপুনিক আবির্ভাবের মধ্যে কোনরকম গাণিতিক তাৎপর্য আছে বলে আমি মনে করিনা। এতে বিশ্বাসীদের প্রাণ জুড়াতে পারে, সরলমতি পর্যবেক্ষকদের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে, কিন্তু গণিতে এর কি স্থান হতে পারে সেটা কিছুতেই আমার মাথায় ঢোকে না। দুঃখের বিষয় যে মার্টিন গার্ডনারের (১৯১৪-২০১০) মত বিখ্যাত লোক যখন নামকরা পত্রিকায় রাশাদ খলিফা এবং তাঁর ১৯ মিরাকল নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় মেতে যান তখনই সেটা ফালতু বাতুলতা থেকে পণ্ডিতমহলের আলোচ্য বিষয়ের সম্মান অর্জন করে ফেলে। মার্টিন গার্ডনার মূলধারার গণিতবিশারদ বলে পরিচিত নন—–আসলে গণিতশাস্ত্রে কোনও প্রথামাফিক লেখাপড়াও তিনি করেননি। কিন্তু তিনি নাম করেছেন বিনোদ গণিতের সেরা লেখক হিসেবে। সাধারণ পাঠকের কাছে গণিতকে সহজপাঠ্য হিসেবে উপস্থিত করানোর ক্ষেত্রে তাঁর জুড়ি খুব নেই। তাঁর বিশেষ খ্যাতি তথাকথিত ‘বাইবেল কোড’এর হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গার জন্য। কোন ‘কোড’ই যে ধোপে টেকে না এটাই তাঁর প্রধান বক্তব্য। নিশ্চয়ই সেকারণেই তিনি রাশাদ খলিফার লম্ফজম্ফতে কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করেছিলেন। সৈকত চৌধুরি আর বিজয় দাশের নিবন্ধে এর ওপর সারগর্ভ আলোচনা আছে। আমি শুধু এটুকুই বলব যে এসব আলোচনাতে মার্টিন গার্ডনারের মত একজন প্রথম সারির অমুসলমান নাম সংযুক্ত হয়ে যাওয়াতে ‘অলৌকিক ১৯’ এর মর্যাদা শতগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে গেছে। তার সাথে এখন যোগ হয়েছে আরো একটি আন্তর্জাতিক মানের রচনা—-পূর্ববর্ণিত চৌধুরি-দাশ প্রণীত সেই লেখাটি। ফলটা দাঁড়ালো এই যে রাশাদ খলিফার কোরানিক ১৯ এখন গণিতের বিষয়বস্তু, সাধারণ অগাণিতিক জগতে। মোমিন মুসলমানরা হয়ত ভাবতে শুরু করেছেন, আহা, বলিনি বুঝি? এই দেখ, শুধু বিজ্ঞান নয়, গণিতের দুরূহ ফর্মুলাও আছে আমাদের পবিত্র কোরানে। এর চেয়ে বড় অলৌকিকতা আর কি হতে পারে?

 
আমি বড় গাণিতিক নই—-গণিতশাস্ত্রের পক্ষ নিয়ে বড় বড় বিবৃতি দেবার যোগ্যতা আমার নেই। তবে আমি গণিতকে ভালবাসি, ভীষণভাবে ভালবাসি। গণিতের অপার রত্নভাণ্ডার যারা যুগে যুগে পূর্ণ করে তুলেছেন, পিথাগোরাস-ইউক্লিড থেকে শুরু করে আলখোয়ারিজমি-ভাস্কর-ব্রহ্মগুপ্ত-নিউটন-অয়লার-গাউস-রিম্যানের মত দৈত্যাকার মণীষীরা, তাদের সৃষ্টির আলোকজ্জ্বল সৌধমালাতে সামান্যতম কালিমা লিপ্ত হবে অলৌকিকবাদীদের ভ্রান্ত মতবাদ দ্বারা সেটা আমি চুপ করে মেনে নিতে রাজি নই। কোরানকে একটি মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে প্রচণ্ড সম্মান করি আমি, কিন্তু এর ভেতরে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গূঢ় অঙ্ক প্রবেশ করেছে তার কোনও প্রমান আমি পাইনি আজ পর্যন্ত। রাশাদ খলিফা বা তাঁর মত পাঁতিবিজ্ঞানীরা ৭,১৯ বা ৩১ এর মৌলিকতা নিয়ে যতই মুগ্ধতা প্রকাশ করুন না কেন, একটা কথা তাঁরা ভুলে যান যে পুরো গ্রন্থটির কোন জায়গাতেই ‘মৌলিক সংখ্যা’ বলতে ঠিক কি বোঝায় তার কোন উল্লেখ নেই। মৌলিক সংখ্যা যে সকল পূর্ণ সংখ্যারই মূল, এই মূল কথাটাই কোরানের কোথাও লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। অতএব একটি দুটি আকস্মিকভাবে উৎকলিত মৌলিক সংখ্যার বারংবার আবির্ভাব দ্বারা কোনও গূঢ় রহস্যই উদ্ঘাটিত হয়না। তাছাড়া কৌতূহল উদ্রেকের কথাই যদি বলতে চান তাহলে “১৯” এর পৌনঃপুনিক সাক্ষাতপ্রাপ্তির চেয়ে হাজারগুণে চমকপ্রদ ও চিন্তাউদ্দীপক ঘটনা হল ব্রিটিশ গাণিতিক জি এইচ হার্ডি ও তাঁর ভারতীয় সহযোগী শ্রীনিভাস রমানুজনের (১৮৮৭-১৯২০) ক্ষেত্রে যা হয়েছিল। গল্পটা হয়ত পাঠকদের অনেকেরই জানা, তবুও আবার বলা যাক। রমানুজন অসুস্থ। কেম্ব্রিজের এক হাসপাতালে তাঁর চিকিৎসা চলছে। অগ্রজসম ও গাণিতিক বন্ধু হার্ডি ট্যাক্সিতে করে তাঁকে দেখতে গেছেন। সংখ্যাতত্বের পণ্ডিত দুজনই। পূর্ণ সংখ্যা দেখামাত্র তাঁরা বড় বড় চোখ মেলে তাকান। হার্ডি সাহেব ট্যাক্সিতে ওঠার সময় নাম্বারটা খেয়াল করছিলেনঃ ১,৭২৯। পছন্দ হল না। রমানুজনের রোগশয্যায় এসে বললেনঃ কি জান রমানুজন, ট্যাক্সির ১৭২৯ নম্বরটা দেখে মনে হল একটা অপয়া নম্বর। আশা করি আমি কোনও অমঙ্গল বয়ে আনিনি তোমার জন্যে। রুগ্ন রমানুজনের চোখদুটো জ্বল জ্বল করে উঠল। না প্রফেসার, মোটেও অপয়া নম্বর নয়, বরং খুবই মজাদার সংখ্যা এটি। যে-সব পূর্ণ সংখ্যা অন্য দুটি ধনাত্মক পূর্ণ সংখ্যার ত্রিমাত্রিক যোগফল দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব দুই উপায়ে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এই সংখ্যাটিঃ
১৭২৯=১*১*১+১২*১২*১২= ৯*৯*৯+১০*১০*১০

 

জাঁদরেল প্রফেসার হাঁ করে থাকলেন ছাত্রসম ধীমানের কথা শুনে। একেই বলে কৌতূহলোদ্দীপক। এই সংখ্যাটি পরবর্তীকালে হার্ডি-রমানুজন সংখ্যা নামে পরিচিত হয়ে ওঠে, যদিও অন্যান্য গাণিতিকের গবেষণাতেও এই একই সংখ্যার উল্লেখ দেখা গেছে একাধিকবার। দুঃখের বিষয় যে আমাদের নিজস্ব জাঁদরেল পণ্ডিত রাশাদ খলিফা সাহেব বেঁচে নেই—-থাকলে বলতাম, এরকম একটি ওজনের সংখ্যা এনে দিন কোরান থেকে, আমি বিশ্বাসী হয়ে যাব। কিম্বা এনে দিন ডেভিড হিলবার্টের (১,৮৬২-১,৯৪৩) ২৩ টি অমীমাংসীত ধাঁধার ( ১,৯০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তার্জাতিক গাণিতিক অধিবেশনের অতিথি বক্তা হিসেবে তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটা আজো অম্লান থেকে গেছে প্রধানত ওই তেইশটি সমস্যা উত্থাপন করার জন্যে। পুরো একটা শতাব্দী ধরে সেগুলো চিন্তা ও গভীর গবেষণার খোরাক জুগিয়েছে বিশ্বের সেরা গাণিতিকদের। ওই ২৩ টি ধাঁধার মধ্যে একটি ছিল পূর্ববর্ণিত সেই রিম্যান হাইপথেসিসটি, যা আজো ধাঁধাই রয়ে গেছে।) যে- কোন একটির প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ উল্লেখ। না, ওগুলোর সমাধান আমি চাই না, শুধু উল্লেখ পেলেই আমি খুশি—-তৎক্ষণাৎ আমি মসজিদমুখো রওয়ানা হব।

 
ফ্রান্সের অমর বিজ্ঞানী-গাণিতিক পিয়ের সিমন লাপ্লাসকে (১,৭৪৯-১,৮২৭) সম্রাট নেপোলিয়ান একবার জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ আচ্ছা মসিঁয়ে লাপ্লাস, আপনার বিজ্ঞানের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার স্থান কোথায়? লাপ্লাস সাহেব মৃদু হেসে জবাব দিলেনঃ জাঁহাপনা, আমার কাজের মধ্যে ‘বিধাতা’ নামক কাল্পনিক ধারণাটি ব্যবহার করবার প্রয়োজন দাঁড়ায়নি। বড় বড় কৃতি লোকেদের প্রায় সকলেরই অনুরূপ ধারণা—–অতিপ্রাকৃতের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতিতে তাদের কিছু আসে যায় না। জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সেটা একান্তই অবান্তর। তাঁদের কাজ প্রকৃতির গোপন রহস্য উদ্ঘাটন করা, অতিপ্রাকৃতের নয়। ডেভিড হিলবার্ট হয়ত পুরোপুরি নাস্তিক ছিলেন না, কিন্তু তিনিও বলতেনঃ গাণিতিক সত্যের সঙ্গে বিধাতার অস্তিত্ব বা সেধরণের কোনও পুর্বনির্ধারিত বিশ্বাসের কোনরকম সম্পর্ক নেই।

 
অতএব মোমিন মুসলমান ভাইবোনেরা, কোরানের অলৌকিকতা প্রমানের জন্যে দয়া করে অঙ্কের সাহায্য কামনা করবেন না।

 
অটোয়া,
১৯শে জানুয়ারি, ‘১৩
মুক্তিসন ৪২