গত দুই-এক মাসে মুক্তমনায় লেখক ভবঘুরেকে ঘিরে বেশ কিছুটা বিতর্ক হয়েছে। অনেকেই তাকে ইসলামবিদ্বেষের দায়ে অভিযুক্ত করে অনেক কথা বলেছে, সেসবের মধ্যে আমিও ছিলাম। তার পক্ষে কথা বলার মতো তিনি ছাড়া আর তেমন কাউকে বেশী দেখা যায় নি। সেই বিতর্কের পর মুক্তমনায় ভবঘুরে ও তার সমমনা কয়েকজন লেখালেখি ও মন্তব্য একদম কমিয়ে দিয়েছেন। আমি মনে করি এই পরিবর্তনটি যদি কন্টিনিঊ করে তবে সেটা মুক্তমনার জন্যে অনেক ক্ষতিকর হবে। আমি মনে করি ভবঘুরে মুক্তমনার জন্যে অত্যন্ত মূল্যবান একজন কন্ট্রিবিউটর। আমি প্রত্যাশা করি তিনি আবার নিয়মিত লিখবেন। সেই প্রত্যাশার জন্যেই এই লেখাটি। এছাড়া আমি লক্ষ্য করেছি যে গত কয়েকমাসে মুক্তমনায় ধর্মবিষয়ে লেখালেখি একদম কমে গেছে। যদিও অনেকে মনে করতে পারেন যে খামোকা ধর্ম নিয়ে কেচাকেচি অরুচিকর এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে উন্নত কোনো discourse নয়, আমি তা মনে করি না। আমার মনে হয় অযৌক্তিক ধর্মীয় বিশ্বাসকে আক্রমন মুক্তমনার কোর মিশনের প্রধানতম এবং ধর্ম নিয়ে আলোচনা কমে যাওয়া মুক্তমনা ও বাংলাসমাজের জন্যে বড়ো লস। এই লেখাটি কোন গভীর বিষয় ভিত্তিক আলোচনা নয় বরং মুক্তমনা পরিবারের মধ্যে একটি মুক্ত বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস। একারনে লেখার দুর্বলতা নিয়ে আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আমার মুক্তমনায় মন্তব্য করা শুরু হয়েছিলোই ভবঘুরের একটি লেখায় তার বক্তব্যকে আক্রমন করে। আমি মনে হয় না এ পর্যন্ত তার সপক্ষে কোনো মন্তব্য করেছি। তবু আমি তার লেখালেখি চালিয়ে যাওয়াকে সমর্থন করি এবং উৎসাহিত করতে চাই। তার লেখাগুলো কেনো বাংলাজগতে মুক্তচিন্তার প্রসারে প্রয়োজনীয় সেকথা আসার আগে তার বিরুদ্ধে আসা মূল অভিযোগগুলি নিয়ে কয়েকটা কথা বলি।

আমিও ভবঘুরেকে ইসলাম-মুসলিম বিদ্বেষী মনে করি। কিন্তু তাতে কি হয়েছে? আমি আমার জীবনে খুব কম লোকই দেখেছি যাদের কোনো কিছু বলার মতো প্যাশন আছে কিন্তু কোনো কিছুর প্রতি বিদ্বেষ নেই। ভগবান বুদ্ধের মতো নির্বানলাভকারী সকল বিষয়ের প্রতি বিদ্বেষহীন মানুষ আমাদের আইডিয়াল হতে পারে কিন্তু সেই আইডিয়ালে পৌছানো লোক বুদ্ধের মতোই বিরল। আমাদের সবারই কমবেশী বিভিন্ন বিষয়ের প্রতি অযৌক্তিক- visceral বিদ্বেষ থাকে। ধর্ম, বর্ণ, রাজনীতি, মতবাদ, চেহারাসুরৎ আরো অনেক কিছু। ভবঘুরের ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষ থাকতেই পারে। যেকোনো স্বাভাবিক বিবেচনার লোকই স্বীকার করবেন যে মুসলমানের অতীত ও বর্তমানে এমন অনেক আচরন করেছে যে তাদের প্রতি বিদ্বেষ আসা অযৌক্তিক কিছু নয়। সকল ধর্মই সমান দোষী কিংবা সকল ধর্মের অনুসারীরাই সমান মানবিকতার বিরোধী এই ধারনাগুলি এতো অর্বাচীন যে এর বিরুদ্ধে যুক্তি দেখানোও সময়ের অপচয়। বিশেষ করে বর্তমান যুগে কোনো মুসলিম দেশে মাইনরিটি হিসেবে বড়ো হওয়া কারো জন্যে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ আরো কম অস্বাভাবিক। আমি সৌভাগ্যবশত বাংলাদেশে ডমিন্যান্ট মেজরিটির একজন হিসেবে জন্ম নিয়েছি এবং বড়ো হয়েছি। আমার যতো এমপ্যাথিই থাকুক, আমি কখনো বাংলাদেশে একজন মাইনরিটির পার্সপেক্টিভ আয়ত্ব করতে পারবো না। আর আমি বাংলাদেশের সমাজজীবনের গৎবাধা কয়েকটা কলেমার অন্যতম ‘বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির লীলাভূমি’, এই আপ্তবাক্যটিকে হাস্যকর রকমের ভুল মনে করি।

আমি এটাও মনে করি যে ভবঘুরে তার বক্তব্যকে উপস্থাপন করতে যেয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন জেনে অথবা না জেনে। আমি মনে করি তার মধ্যে মৌলবাদের প্রবল লক্ষন দেখা যায় যেভাবে কখনো তিনি তার ভুল স্বীকার করে বিরুদ্ধ যুক্তি মেনে নেন না। দরকার হলে উধাও হয়ে যান কোন বিতর্ক থেকে তবু ভুল স্বীকার করেন না। এতো সব দোষ সত্বেও আমি তার লেখার ভক্ত এবং তার লেখাকে গুরুত্বপূর্ন মনে করি।

একথা বাংলাদেশের যে কোনো মুক্তচিন্তার সাধক স্বীকার করবেন যে বর্তমানে এইদেশে মুক্তচিন্তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু ইসলাম ধর্ম। যদি লিকার্ট স্কেলে এখনকার বাংলাদেশে ওপেন সোসাইটির এনিমিদের র‍্যাংকিং করতে বলা হয় তবে ইসলাম হবে ১০ আর আওয়ামী জাতীয়তাবাদ, বিএনপি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশী ইতিহাস-ঐতিহ্য জাতীয়তাবাদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ধর্ম, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র বাকী সব হবে ৫ এর নীচে। বাংলাদেশের ইতিহাস, ডেমোগ্র‍্যাফী, রাজনীতি এসব বিভিন্ন কারনেই ইসলাম মুক্তচিন্তার প্রসারে সবচেয়ে বড়ো বাধা। তার মানে এই নয় যে সারা বিশ্বের জন্যে একই অবস্থা। প্রতিটি দেশের অবস্থা ভিন্ন।

এই বাস্তবতার কারনেই বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার প্রসার করতে গেলে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা আসবেই, খুব বেশী করেই আসবে। একারনেই মুক্তমনায় ইসলাম বিরোধী লেখা আসা স্বাভাবিক ও উচিৎ। এখন আমরা মুক্তচিন্তার ফোরামে ইসলাম বিরোধী লেখার মধ্যে প্রধানত দুটি ধারা দেখতে পাই।

প্রথমেই আসে বিজ্ঞান বিষয়ের লেখা। ধর্মের প্রধান শত্রু বিজ্ঞান। বিজ্ঞান যখন গত কয়েকশ বছরে বিশ্ব-প্রকৃতি ও মানব জীবন নিয়ে একটি কনজিসটেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক দাড় করাতে পেরেছে তখনই ধর্মের অবধারিত পশ্চাৎ অপসারন শুরু হয়েছে. মুক্তমনায় একারনেই প্রচুর পরিমানে বিজ্ঞান লেখা আসে এবং সেটা বাংলাদেশে বিজ্ঞানচেতনার প্রসারে নি:সন্দেহে অমূল্য অবদান রাখছে। এখানে অবশ্যই মুক্তমনায় বিজ্ঞান লেখকদের বিশেষ করে অভিজিৎকে সর্বান্তকরনে ধন্যবাদ দিতে হয়। অন্য দেশ গুলোতে যে কাজগুলো শতশত বিজ্ঞানী-লেখক-একটিভিস্ট নিরলসভাবে করছে সেটার অনেকটা বাংলা ব্লগে অভিজিৎ অনেকটা একাই করছে সংসার ও জীবিকা সামলে নিয়েই।

আমরা দেখেছি যে বিজ্ঞান থেকে ধর্মের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো চ্যালেন্জ এসেছে মূলত দুটি ধারা থেকে, উনবিংশ শতাব্দীর বিবর্তন-বায়োলজী এবং বিংশ শতাব্দীর আধুনিক পদার্থবিদ্যা-কসমোলজী থেকে। এর আগে নিউটনের মতো শ্রেষ্ঠ মেধাবী বিজ্ঞানীও ধর্ম ও স্রষ্টায় প্রবল বিশ্বাস থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন নি। বাংলাদেশের সমাজেও ধর্মীয় চিন্তার বিরুদ্ধে বিজ্ঞান অন্যতম বড়ো অস্ত্র। কিন্তু এখানে আমার কিছু ব্যাক্তিগত মতামত আছে।

আমার মনে হয় বিজ্ঞানমনস্ক নয় এরকম অধিকাংশ শিক্ষিত লোকদের কাছে বিজ্ঞান একটি tool মাত্র একটি natural philosophy নয়। তারা মনে করে বিজ্ঞান অনেক আশ্চর্যরকম কাজ করে, তাদের জীবনে অভুতপূর্ব স্বাচ্ছন্দ দেয় কিন্তু তাই বলে তারা বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করতে হবে এটা মনে না। এর কারন বিশ্বাস না করলে তো ক্ষতি নেই। বিজ্ঞানকে অবিশ্বাস করে বিজ্ঞানের সব রকমের সুবিধা নেয়া যায়, এর জন্যে মৃত্যুর পরে কোনো বৈজ্ঞানিক দোজখে যাবার ভয় নেই। অন্যদিকে ধর্মকে অবিশ্বাস করলে ইহকাল-পরকালে ভয়াবহ শাস্তির সম্ভাবনা। এজন্যে মানুষ সহজেই বিজ্ঞান ও ধর্মকে মনের মধ্যে পুরো আলাদা দুটো কম্পার্টমেন্টে রাখে। আমি এমন অনেক মানুষ দেখেছি যারা বিবর্তন কে অস্বীকার করে না আবার আদম-হাওয়াকেও অস্বীকার করতে পারে না। তাদের সোজা কথা আল্লাহ কুদরতে সবকিছুই সম্ভব। “খোদার কি কুদরত, লাঠির ভিতর শরবৎ”!

অনেকেই আছেন যারা বিগব্যাং কে অস্বীকার করে না আবার আল্লাহর হুকুমে সৃষ্টিও অস্বীকার করে না। বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে অসংখ্য কন্ট্রাডিকটরী বিশ্বাস নিয়ে চলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অনেকেই ভাবতে পারেন এতো কন্ট্রাডিকটরী বিশ্বাস নিয়ে কেমন করে চলা সম্ভব। খুবই সম্ভব। আমরা নিজেরাই আমাদের নিজস্ব দেশ, ইতিহাস, রাজনৈতিক দল, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি সববিষয়ে নানারকম কন্ট্রাডিকটরী বিশ্বাস নিয়ে দিব্যি চলছি। এতে কারো মস্তিষ্কে রক্তক্ষরন হচ্ছে না কারো ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটছে না। মানুষের মধ্যে Cognitive Dissonance নরমালাইজ করার অপূর্ব ক্ষমতা রয়েছে। একারনে আমি মনে করি বাংলাদেশের মতো সামাজিক বিবর্তনে পিছিয়ে থাকা দেশগুলোয় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞান খুবই দরকারী অস্ত্র হলেও এর সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

ধর্মবিরোধী লেখাগুলো আরেকটি প্রধান ধারা হলো সরাসরি ধর্মের রীতিনীতি, বইপুস্তকগুলি নিয়ে আলোচনা বিশ্লেষন ইসলাম বিরোধী এই ধারায় মূলত কোরান-হাদিস এবং ইসলামের প্রারম্ভিক ইতিহাসের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয় এবং বর্তমান জ্ঞান-বিজ্ঞান, মূল্যবোধ-মানবিকতা’র সাথে এই ইসলামী ঐতিহ্যের অসামন্জস্যতা হাইলাইট করা হয়। ভবঘুরে, আবুল কাসেম, আকাশ মালিক এবং অন্যান্য আরও কিছু লেখক প্রধানত এই রকমের লেখা লিখেছেন এবং এগুলোই তাদের এরিয়া ওফ এক্সপার্টিজ। আমার কেনো জানি মনে হয় সাধারন মানুষের মধ্যে ধর্ম সম্পর্কে দ্বিধা সৃষ্টি করতে এবং নিজের বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ধর্মীয় সমালোচনার এই ধারাটি, বিজ্ঞান আলোচনার চাইতে অনেক বেশী সফল।

আমার জন্যে এই হাইপোথিসিস এর সপক্ষে কোনো তথ্য-প্রমান উপস্থাপন করা সম্ভব নয় কারন এরকম কোনো স্টাডির কথা এখনো দেখিনি। পশ্চিমা বিশ্বে হয়তো এরকম সামাজিক গবেষনা করা হয়ে থাকতে পারে বাইবেল এর অসামন্জস্যতা ও বিজ্ঞান ধারনা ধর্মীয় বিশ্বাসকে তুলনামূলকভাবে কিভাবে এফেক্ট করে, সেটা নিয়ে। তবে স্পেসিফিক কোনো স্টাডিও আমি দেখিনি বা এখন মনে করতে পারছি না। আমার এই ধারনার পেছনে রয়েছে একেবারে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা, কমন সেন্স এবং কিছুটা ইতিহাস চিন্তা।

আগেই বলেছি যে অধিকাংশ সাধারন মানুষের জন্যে বিজ্ঞান ও মুক্তচিন্তার চেতনা আয়ত্ব করা বেশ কঠিন কারন এর জন্যে সামজিক ও মনস্তাত্বিক প্রেশার নেই। কিন্তু আমাদের অধিকাংশের মধ্যেই বায়োলজীক্যাল বিবর্তন, সামাজিক বিবর্তন, ঐতিহ্য, পারিপার্শিক পরিবেশ ইত্যাদি নিয়ামকের প্রভাবে সামাজিকভাবে চলার উপযোগী কমবেশী নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে উঠে যা এতটা কাছাকাছি যে আমরা একজনের সাথে আরেকজন মূল্যবোধ নিয়ে কমুউনিকেট ও তুলনা করতে পারি। সময় ও স্থানভেদে অবশ্যই মূল্যবোধের পার্থক্য গড়ে উঠে কিন্তু আমরা এই সময়ে বাস করে মোটামুটি একমত হতে পারি যে গনতন্ত্র শ্রেয়তর, ধর্মীয় বিশ্বাস জোড় করে চাপিয়ে দেয়া উচিৎ নয়, ধর্ষন খারাপ, ক্রীতদাস সমর্থন করা যায় না, বাল্যবিবাহ খারাপ, নারীদের সমঅধিকার রয়েছে, গনহত্যা খারাপ, অন্যদেশ অন্য জাতি আক্রমন করে দখল করা খারাপ ইত্যাদি।

আমি নিজের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে অধিকাংশ সাধারন মানুষের নিজের পারিবারিক ধর্মবিশ্বাসের বিতর্কিত দিকগুলো নিয়ে ধারনা একেবারে নেই বললেই চলে। আমার মনে হয় এই অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই রয়েছে। বাংলাদেশী মুসলিমদের জন্যে এটা অবশ্যই প্রযোজ্য। কোরান ও হাদিসের বিভিন্ন বিতর্কিত আয়াত তো দূরের কথা, ইসলামের ইতিহাসের একেবারে সাধারন বিতর্কের ব্যাপারগুলি যেমন মোহাম্মদের বহুবিবাহ, বালিকাবিবাহ, যুদ্ধবন্দী হত্যা, ধর্মত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, নানা রকম দোষে গলাকেটে-পাথর ছুড়ে মারা এরকম সাধারন ব্যাপারগুলিই অধিকাংশ সাধারন লোক জানে না। সাধারন মানুষ মনে করে ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলামে জবরদস্তি নেই, মোহাম্মদ সর্বযুগের জন্যে সকল দিক দিয়ে পারফেক্ট মানব, আল্লাহর আইন আমাদের নানা সীমাবদ্ধতার জন্যে বাস্তবায়ন না করতে পারলেও আল্লাহর আইন মানুষের জন্যে সবসময়ের শ্রেষ্ঠ বিধান ইত্যাদি।

এই সাধারন মানুষদেরকেই যখন ইসলামের বিভিন্ন অমানবিক, অযৌক্তিক দিকগুলো এবং ইসলামের ইতিহাসের বিতর্কিত ঘটনাগুলি সরাসরি চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয় তখন এই কগনিটিভ ডিসোন্যান্সকে অগ্রাহ্য করা তাদের পক্ষে সহজ হয় না। আজকের এই যুগে মানুষকে এই বিশ্বাস করানো কষ্টকর যে ১০-১৫টি বিবাহ, নয় বছরের মেয়েকে বিবাহ, যুদ্ধবন্দীদের পাইকারী হত্যা, ক্রীতদাস রাখা, নারীদের ঘরে অন্তরীন রাখা, জিজিয়া কর, একের পর এক দেশ দখল, এসবই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ রীতিনীতি। মানুষকে এটাও বোঝানো শক্ত যে ভালোমন্দ নির্বিশেষে সকল হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, অধার্মিক, হেরেটিক শিয়া-সুন্নী হাজার কোটি মানুষ অনন্তকাল দোজখে মুহুর্তে মুহুর্তে বেগুনপোড়া হওয়া মহত্তম স্রষ্টার বৈশিষ্ট্য। আমি নিজে পারিবারিকভাবে যখন ধর্মে প্রগাড় বিশ্বাসী, প্রকৃতপক্ষেই ভালোমানুষ দের কাছে ইনডাইরেক্টলি এসব প্রসংগ এনেছি তখন অনিবার্যভাবেই দেখেছি যে অধিকাংশ আশ্রয় নেয় সেই বিখ্যাত Pascal’s Wager এর উপরে। বিশ্বাস না করলে ভয়াবহ পরিনাম, তাই বিশ্বাস করাই বুদ্ধিমানের কাজ। তবে এই মানুষরা এইসব জানার পরে ব্যাক্তি ও সমাজে আল্লাহর শাসন কায়েমের জন্যে অতটা উৎসাহী আর থাকে না। আমার মনে হয় বর্তমান যুগের মানুষদের মধ্যে ধর্মীয় মৌলবাদের সবচেয়ে বড়ো এন্টোডোট আধুনিক মূল্যবোধ। এইকারনে কোরান-হাদিসের সরাসরি রেফারেন্স থাকলেও সাধারন মানুষেরা কিসাস, গলা কাটা, চোরের হাত কাটা এসব কে সরাসরি সমর্থন করতে দ্বিধা করে। নিজের মূল্যবোধ পরিবর্তন করা অনেক কষ্টকর একটি ব্যাপার। অধিকাংশ মানুষ ধর্মীয় বিশ্বাসকে নিজের মূল্যবোধ অনুযায়ী সাজিয়ে নিতে চায়, বিশ্বাস অনুযায়ী মূল্যবোধ পাল্টানোর প্রয়াস করে না। অবশ্য হঠাৎ মৌলবাদীদের জন্যে ব্যাপারটা আলাদা।

আমি মনে করি মুক্তচিন্তার জন্যে কোরান-হাদিস ও ইসলামের বিতর্কিত প্রসংগগুলি বারবার হাইলাইট করা দরকার। কারন বিশ্বাসীরা যখন এই বইগুলি পড়ে তখন অবচেতনভাবেই এই অস্বস্তিকর বানীগুলি মনে খুব একটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। বিশ্বাসের coherence বজায় রাখার জন্যে অবচেতন মন সহজেই এই দিকগুলো মগজের পেছনের কোনো অবহেলিত, অন্ধকার কুঠরীতে পাঠিয়ে দেয়। এই গোপন কুঠরী থেকে পীড়াদায়ক চিন্তাগুলো সামনে আনতে বারবার হাইলাইট করার বিকল্প নেই। কিন্তু এই বিতর্কিত প্রসংগগুলি নিয়ে চরম অধ্যাবসায় নিয়ে কারা দিনের পর দিন সাধনা চালিয়ে যাবে?

আমরা অধিকাংশ অবিশ্বাসী-সংশয়বাদীরা যখন থেকে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস থেকে আলাদা হতে পেরেছি তখন থেকেই ধর্মীয় বইপুস্তক নিয়ে দিনরাত লেগে থাকার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছি। এটা স্বীকার করতে হবে আমাদের অধিকাংশের কাছে এই বইগুলি কোনো সুলিখিত সাহিত্য নয় বরং নানারকম inconsistency তে ভরা প্রাকমধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার সমাহার। আমাদের কাছে বর্তমান পৃথিবীতে জানার ও উপভোগ করার কত বিচিত্র বিষয় আছে। বিশ্বসাহিত্য, বিজ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস, শিল্পকলা-সিনেমা, রাজনীতি, আন্তজাতিক প্রসংগ, অর্থনীতি আরো কত কিছু। এসব ফেলে সেই অস্বস্তিকর বইগুলো ঘাটাঘাটি করার মতো তাগিদ খুব কম লোকেরই আছে। কাদের মধ্যে এই বিষয়গুলি নিয়ে লেগে থাকার মতো উৎসাহ আছে?

প্রথমত ও প্রধানত যাদের মধ্যে কোনো একটি বা অনেকগুলি ধর্মের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ আছে তারা এবং দ্বিতীয়ত যাদের মধ্যে এই ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি সংষ্কার করে সমাজ ও জাতিকে আধুনিকতায় আনার জন্যে প্রবল উৎসাহ আছে। মুক্তমনায় আলোচকদের মধ্যে প্রথম গ্রুপে কারা পড়েন এটা নিয়মিতরা ভালোভাবেই বোঝেন। দ্বীতিয় গ্রুপের মধ্যে কাদেরকে ফেলা যায় এটাও আমরা মোটামুটি অনুমান করতে পারি। এখানে বলে রাখা ভালো যে কাউকে পরিপূর্নভাবে না জেনে কোনো একটো গ্রুপভুক্ত বলে ট্যাগ করা নি:সন্দেহে অবিবেচনার কাজ। কিন্তু আমরা ব্লগজগতে একে অপরের সাথে ব্যাক্তিগতভাবেই খুব কমই পরিচিত। আমরা একে অপরকে জানি কেবল আমাদের লেখনী ও চিন্তার প্রকাশের মাধ্যমে। এই লেখক সত্বা এবং চিন্তাভাবনাগুলিকে যুক্তির ভিত্তিতে ট্যাগিং করা অবশ্যই ভুল কিছু নয়।

ধর্মকে আক্রমন করে যারা লেখালেখি করেন তাদের অনেক মধ্যেই মুক্তচিন্তা ও মানবিকতার অনেক ঘাটতি দেখা যায়। আমাদের বাংলাজগত তো দূরে কথা বিশ্বসমাজে অগ্রনীদের মধ্যেই নানারকম বিশাল ত্রুটি সবার কাছে স্পষ্ট। ক্রিস্টোফার হিচেন্স, স্যাম হ্যারিসের মতো মুক্তচিন্তার আইকনদের মধ্যেও অমানবিক-অযৌক্তিক, বিদ্বেষ-ফ্যাসিবাদী চিন্তার অনেক বহি:প্রকাশ রয়েছে। মুক্তচিন্তার বরেন্য অনেককে দেখা যায় যে মুক্তচিন্তার প্রচার তাদের কাছে সমাজ সংষ্কার এর চাইতেও personal ego প্রসারের মাধ্যম হিসেবে বান্ছনীয়। কিন্তু এতসব ত্রুটি থাকা সত্বেও যে তারা ধর্মকে আক্রমন করে বর্তমানে মুক্তচিন্তার প্রসারে অভুতপূর্ব অবদান রাখছেন এটা অস্বীকার করা যায় না। এখানে দেং শিয়াওপিং এর সেই বিখ্যাত কথাটি স্মরনীয়, “It doesn’t matter whether a cat is white or black, as long as it catches mice”। নিজের ভেতরে প্রবল তাগিদ না থাকলে কোরান-হাদিস এর বিতর্কিত দিক নিয়ে লেগে থাকার উৎসাহ আসার কথা নয়। এই তাগিদের উৎস হতে পারে ইসলাম বিদ্বেষ অথবা মুসলিম সমাজ সংষ্কার। উৎসের চাইতে গুরুত্বপূর্ন এই তাগিদ থেকে সৃষ্ট ফলাফল।

বাংলাজগতে যারা ধর্ম নিয়ে নিয়মিত লেখা লেখি করেন তাদের অনেকের লেখার মধ্যে অনেক চিন্তা ও চরিত্রের সীমাবদ্ধতা চোখে পড়ে। কিন্তু তাই বলে তাদের অবদান যে অনেক এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তাদের লেখালেখিকে অবশ্যই উৎসাহিত করতে হবে। তাদের লেখার ভুলত্রুটি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, ব্যাংগ-বিদ্রুপ করাতে তো কোনো বাধা নেই। আমরা আশা করতে পারি যে সমালোচনা বিতর্ক থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা নিজের লেখাকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করবেন। না করলেও ক্ষতি নেই। তারা যা করছেন সেটা সেটা চালিয়ে গেলেও কোনো আপত্তি দরকার মনে করি না। সত্যি কথা বলতে গেলে, যারা নিজেদের বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকতার অনুসারী দাবি করেন তাদের মধ্যেও ভুল ত্রুটির অভাব নেই। আমরা সবার কাছেই নিজেদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা প্রত্যেকের blind spot। মুক্তচিন্তার জন্যে দরকার হলো কেউ আংগুল দিয়ে সেই blind spot দেখিয়ে দিলে নিজেকে সংশোধন করা।

আমি অবশ্যই মনে করি যে এমনকি মুক্তচিন্তার ফোরামেও কিছু সীমারেখা থাকা উচিৎ স্পষ্টভাবে অমানবিক চিন্তা, অন্যের প্রতি ভিত্তিহীন কুৎসা, অযাচিত অশ্লীলতা এবং গালিগালাজ, অযৌক্তিক-অবৈজ্ঞানিক কুসংষ্কার, এসবই মুক্তচিন্তার ফোরামে অবান্ছনীয় কারন তা মুক্তচিন্তার সহায়ক নয় বরং বাধা। কয়েকজন সাধারন গরীব মুসলিমের অসহায় মৃত্যুকে ব্যাংগ করে ভবঘুরে সেই সীমা অতিক্রম করেছিলেন। সেকারনে তাকে মুক্তমনার পক্ষ থেকে সাময়িক স্যাংশন অবশ্যই সমর্থনীয়। কিন্ত সেকারনে তাকে এই ফোরামে লেখালেখি করা থেকে অনুৎসাহিত করা ঠিক হবে না। মুক্তমনার কোর মিশনের সমর্থক হিসেবেই আশা করছি তিনি তার লেখালেখি চালিয়ে যাবেন এবং তার সমমতধারী লেখকেরাও অনুৎসাহিত হবেন না।

আমি লক্ষ্য করেছি যে ইদানীং বাংলা ব্লগজগতে একটা ক্রাইসিসের মতো চলছে। অনেক নিয়মিত লেখক, আলোচক লেখালেখি-মন্তব্য অনেক কমিয়ে দিয়েছে। আমার মনে হয় এর পিছনে বেশ কিছু কারন রয়েছে। প্রথমত এতো লেখালেখি সত্বেও চারপাশের সমাজ ও চিন্তাভাবনার কোনো দৃশ্যযোগ্য পরিবর্তন না হওয়া, সরকার ও দেশ শাসনে আস্থাহীনতা, নিজেদের রাজনৈতিক বিভক্তি এসবই অনেককে লেখালেখি থেকে অনুৎসাহী করছে। কিন্তু আমি মনে করি এই ধরনের হতাশার কোনো কারন নেই। লেখালেখি থেকে রাতারাতি বড়ো পরিবর্তনের আশা করাটা কখনোই উচিৎ ছিলো না, বিশেষ করে আমাদের দেশের মতো সমাজে যেখানে বৃহৎ পরিবেশে মুক্তচিন্তার ট্র‍্যাডিশন বলতে গেলে ছিলো না। কিন্তু এর মধ্যেই যে পরিবর্তন গুলো হয়েছে সেগুলোও কম নয়। মুক্তমনার মতো ফোরামগুলির কারনেই বর্তমানে ধর্মবিরোধী চিন্তা প্রকাশ করা আর কেবল বিখ্যাত বুদ্ধিজীবিদের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব নয়, সাধারন মানুষও মুক্তসমাজে এটা প্রচারের সাহস করে। আসিফ মহীউদ্দীন ছুরিকাহত হওয়াটা আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয় নি, আশ্চর্য মনে হয়েছে যে একজন সাধারন ছেলে হয়েও সে এতদিন সরাসরি আক্রমনের শিকার না হয়ে তার দু:সাহসী কথাবার্তা চালিয়ে যেতে পেরেছে। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র হলেও যে বিজ্ঞান মনষ্ক, নাস্তিক জন গোষ্ঠী রয়েছে এটা এস্টাবলিশমেন্ট সমাজ মিডিয়া স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। এখন মানুষ সমাজে নানা রকম অনাচারের ঘটনায় সরাসরি ধর্মীয় বিধানকে আক্রমন করে লিখতে সাহস করে, এমনকি এস্টাবলিশমেন্ট মিডিয়ার পাতায়ও সেটা স্থান পায়। এই পরিবর্তন গুলো আমরা যারা ৮০-৯০ দশকের সমাজ এবং মিডিয়াজগৎ এর সাথে পরিচিত, তাদের কাছে অনেক সিগনিফিক্যান্ট। সুতরাং পরিবর্তন হচ্ছে এবং মুক্তমনা ও বাংলা ব্লগজগৎ এই পরিবর্তনের ফ্রন্টিয়ারে রয়েছে। এজন্যে এই ফোরামগুলির কোর মিশনের সক্রিয়তা বজায় রাখা সকল মুক্তচিন্তকের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয়।