(১)
মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতাগুলো আগ্রহের। মানুষ তার ইন্দ্রিয় দিয়ে তার আশেপাশের জগত সম্পর্কে তথ্য গ্রহণ করে। সেই তথ্য আশেপাশের জগত সম্পর্কে তার ভেতরে ধারণা তৈরি করে তোলে। জগত যেমনই হোক, তার সম্পর্কে ধারণা তার ইন্দ্রিয় আর সেই ইন্দ্রিয়-বাহিত তথ্যের উপরে নাড়াচাড়া করা চিন্তাযন্ত্রের সরঞ্জাম দ্বারা সীমাবদ্ধ। নাকি মানুষ তার সরঞ্জাম-সীমবদ্ধতার ঊর্দ্ধে?

মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতাটা জগতের সীমাবদ্ধতা হয়ে ওঠে না। কোনো মহাপরিকল্পক ছাড়া কীভাবে মহাবিশ্ব তৈরি হতে পারে, টিকে থাকতে পারে সেটা ভাবাটা একটা মানুষের পক্ষে হয়তো কষ্টকর, হয়তো অসম্ভব। কিন্তু তাতে মহাপরিকল্পকবিহীন মহাবিশ্বটা অসম্ভব প্রতিপন্ন হয় না।

সমাজ সম্পর্কেও মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা আছে। সমাজের ঝোঁক বিবর্তন, কিন্তু মানুষের চিন্তার ঝোঁকটা হলো পরিকল্পন। ভাষার ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়। যদিও মূলত কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার বাইরেই অধিকাংশ ভাষার উৎপত্তি, বিকাশ ও বিবর্ধন, তথাপি ভাষা নিয়ে মানুষের বিবিধ পরিকল্পনমূলক ভাবনাচিন্তাই কাজ করে থাকে। যেমন,মানুষ অনেক সময়ে ভাবে – যোগাযোগের জন্যে সর্বজনীনতা “আবশ্যক”; ভাষার নানারূপের কিংবা নানা ভাষার সহাবস্থান “সমস্যাজনক”; ফলে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ভাষার প্রমিতকরণ আর তার আরোপ “জরুরি”।

তথাপি রংপুরের ট্রাক ড্রাইভার এখন যেমন চট্টগ্রামের চাঅলার সাথে বাৎচিত করে, প্রমিতকরণ যুগের পূর্বেও চট্টগ্রামের বণিক রংপুরের সরাইখানায় গিয়ে গল্প গুজব করতো। প্রমিতকরণ দুই ভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে তাদের যোগাযোগের মাধ্যমটা বাছাইয়ে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু প্রমিতকরণের অনুপস্থিতিটা তাদের যোগাযোগকে অসম্ভব করে তোলে না। বলপ্রয়োগমূলক আরোপের অনুপস্থিতি তো নয়ই। অর্থাৎ আরোপমূলক প্রমিতকরণের অনুপস্থিতিতেও মানুষের যোগাযোগ থেমে থাকে না, ব্যাহত হয় না। ব্যাপারটা আরো প্রতীয়মান হয় যখন সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই ভাষার মানুষ একত্র হয়। ভিন্নভাষীর মধ্যকার ভাষার মাধ্যমটা অংশগ্রহণকারী ভাষাভাষীরাই নির্ণয় করে নিতে সক্ষম, দূরের কোনো গোলটেবিল বৈঠককারীর অনুপস্থিতিতে।

হ্যাঁ, ভাষার প্রাতিষ্ঠানিকতা নিয়ে সমস্যা হয় প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রের। ভাষা সমাজের প্রাণ। রাষ্ট্র সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে ভাষা নিয়ন্ত্রণ সমাজ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের অন্যতম হাতিয়ার। যেমন “রাষ্ট্র পাকিস্তান” একমাত্র রাষ্ট্রভাষা উর্দুর প্রচলনের মাধ্যমে সমগ্র পাকিস্তানে তার নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিকতা জারি করতে চায়।

সমাজের কিছু বিষয়ে এক ধরনের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন কিনা, যেমন সহিংসতারোধ, সেটা আলোচনার বিষয়। কিন্তু সেখানে ভাষা আসে অনেক পরে। আদৌ যদি আসে। আমার সামাজিকতার খাতিরে আমি আমার বিদ্যমান সমাজের খাদ্যাভ্যাস পোশাক আশাক রুচি অভিরুচির সাথে একধরনের সমতা তৈরি করি। সেই আপোষকে সমাজের পক্ষ থেকে একধরনের পরোক্ষ প্রভাব ভাবা যেতে পারে। কিন্তু সেখানে বাধ্যবাধকতা নেই। বা বাধ্যবাধকতা থাকাটা অনিবার্য নয়। ফলে সেখানে বিভিন্নতার সুযোগ আছে। আমি ভিন্ন অভিরুচির প্রকাশ ঘটাতে পারি সমাজে। এর ফলস্রুতি যদি হয় অগ্রহণযোগ্যতা, সেটা সামাজিক মিথস্ক্রিয়াতেই উদ্ভাসিত হবে। সেখানে আগে থেকে – “প্রকাশ করা আদৌ যাবে না” এহেন – সীমাবদ্ধতা আরোপের প্রয়োজন আছে কি?

রাষ্ট্রের কি প্রয়োজন আছে প্রচলিত খাদ্যাভ্যাস পোশাক আশাক রুচি অভিরুচি প্রমিতকরণের বা তা আরোপের? ভাষার ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন প্রযোজ্য। বহিরাগত তার নতুন সমাজের প্রচলিত ভাষাটাই তার প্রয়োজনে রপ্ত করতে চাইবে, সেটা প্রমিত হোক কি না হোক। রাষ্ট্রপক্ষের কথা বাদ দিলে সমাজের আর কারো কাছেই প্রমিতকরণ আরোপের অনুপস্থিতি তাদের মিথস্ক্রিয়াতে কোনো অসম্ভাব্যতা তৈরি করে না। এক উপায়কে সহজতর করার লক্ষ্যে বলপ্রয়োগে অন্যান্য উপায়কে রুদ্ধ করার আবশ্যিকতা তাই নেহায়েত সন্দেহযুক্ত।

পাকিস্তান যখন উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে তখন কী কী সমস্যা দেখা দেয়? এখানে সমস্যা হয় দুই স্তরের। একটি সমস্যা রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিত্বের সমস্যা। উর্দু একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবার অর্থ বাংলাকে রাষ্ট্র অগ্রাহ্য করছে। যে বাংলাভাষাভাষী রাষ্ট্রের ভাষায় তার প্রতিনিধিত্ব চায়, সে বাংলাকেও রাষ্ট্রের ভাষা আরোপতায় বিদ্যমান দেখতে চাইবে। এই সমস্যার ইতি ঘটে বাংলাকেও রাষ্ট্র ভাষা ঘোষণার মাধ্যমে। যদিও সেটা অন্যান্য সমস্যার দিকে আঙুল তুলে দিতেও ব্যর্থ নয়।

দ্বিতীয় স্তরের সমস্যাটি হলো ভাষার উপর রাষ্ট্রীয় আরোপের সমস্যা। এই সমস্যাটি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার মাধ্যমেও সমাধিত হয় না। কেননা এতে রাষ্ট্রে নিজ ভাষার প্রতিনিধিত্ব বাড়লেও ভাষার উপর রাষ্ট্রের আরোপমূলক চরিত্র নাকচ হয় না। তা নিয়ে সে একরকম চুপ থাকে। ভাষার উপর থেকে রাষ্ট্রের আরোপ প্রবণতার অপসারণ ফলে আরো ভিন্ন, আরো প্রশস্ত চাওয়া।

উভয় চাওয়াই রাষ্ট্রভাষা একমাত্র উর্দু হওয়াকে সমস্যা মনে করে। এর প্রতিবাদ তথা ভাষা আন্দোলন দুটোর যেকোনো একটা সমস্যা থেকেই উৎসারিত হতে পারে।

আমাদের ভাষা আন্দোলনে প্রথম সমস্যাটাই যে রাজনৈতিকভাবে বেশি বেগবান ছিলো সেটা নিঃসন্দেহে বলা চলে। তবে দ্বিতীয় সমস্যাটা নিয়ে চেতনা যে একেবারে অনুপস্থিত ছিলো তা বলা যায় না। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” বলার মাঝে প্রথম সমস্যার প্রতি ইঙ্গিতটা প্রবল হলেও “ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়” বলাটা দ্বিতীয় সমস্যাটার প্রতি আমাদের সচেতনতার উপস্থিতিকেই জানান দেয়।

এখানে “ওরা” কেবল পাকিস্তান রাষ্ট্র নয়, “আমার” আমি কেবল আমি বাঙালি নই, “মুখের ভাষা”টাও কেবল আমার বাংলা ভাষা নয়। এটা প্রতিটি মানুষের কথা। “ও”দের বিরুদ্ধে। যারা কেড়ে নিতে চায়। মুখের ভাষা।

মুখের ভাষা কোনটা? আমার মুখের থেকে যে ভাষা বের হয় তা-ই তো মুখের ভাষা। সে ভাষা আমার মায়ের ভাষা হতে পারে। আমার বাবার ভাষাও হতে পারে। কিন্তু কোনোটা হবারই আবার বাধ্যকতা নেই। আমার প্রথম ভাষা হবারও বাধ্যকতা নেই। প্রমিত বা প্রধান ভাষা রূপ হবারও বাধ্যকতা নেই। সে ভাষা কোনো বিশেষ প্রচলিত রূপ (যেমন আঞ্চলিক) হবারও বাধ্যকতা নেই। সে ভাষা আজ আর কাল এক থাকারই আসলে কোনো আবশ্যিকতা নেই। আপনার কাছে যা বিকৃত, আমার কাছে তা-ই মুখ-নিঃসৃত বাণী। মুখের সেই যা-ইচ্ছে-তাই বাণীটা লেখায় নিঃসৃত হলেই বা হীন হয় কীসে? আবদুল লতিফের কাছ থেকে তার বাবা-দাদা সঞ্চারিত নিজ মুখের ভাষাটা কেড়ে নেওয়া যদি না যায়, আপনার বা আমার যেকোনো “মুখের” বা “লেখার” ভাষাই বা কেড়ে নেওয়া যায় কী করে? সমস্যা হলো রাষ্ট্র সেটা কেড়ে নিতে চায়। বা যখন চায় তখন সেটা সমস্যা।

মানুষ বিভিন্নতার সমস্যাকে প্রয়োজনের তাগিদে নিজেরাই সমাধান করে নিতে সক্ষম। সেটা কী কোরে করে তার সম্পূর্ণ মডেলটি চিন্তা করতে আমরা সীমাবদ্ধ হতে পারি, কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতাটা সম্ভাবনাকে নাকচ করে না। একে আমরা বলতে পারি স্বতস্ফূর্ত শৃঙ্খলা। যে শৃঙ্খলা কোনো একক মানুষ বা গোষ্ঠির কোনো আরোপিত পরিকল্পনাপ্রসূত নয়, বরং মূলত একাধিক পক্ষ ও গোষ্ঠির মিথস্ক্রিয়া দ্বারা নির্ধারিত। সমাজ মূলত কোনো কেন্দ্র আরোপিত শৃঙ্খলার বিপরীতে এক ধরনের স্বতস্ফূর্ত শৃঙ্খলা। কেন্দ্রীয় আরোপ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা। সমাজে তা প্রধানত অনাবশ্যক ও সম্ভবত নিবার্য।

স্বতস্ফূর্ত শৃঙ্খলা রাষ্ট্র আর তার মন্ত্রক বুদ্ধিজীবীদেরকে অপ্রয়োজনে পরিণত করে তোলে। কিন্তু মানুষের চিন্তার সীমাবদ্ধতা ও অসহায়ত্বটা রাষ্ট্রকে আবার প্রয়োজনে পরিণত করে। ঠিক যেমন তা ধর্ম ও ঈশ্বরকে পরিণত করে। কখনো রাষ্ট্র বুঝি অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন হয়ে দেখা দেয়? তা ধর্মও বুঝি দেয় না? নাকি সেগুলোও পুনরায় সেই চিন্তার অসহায়ত্ব আর সীমাবদ্ধতাই?

গরীবের নাকি দুটোই লাগে। গরীবের পেটে ভাত নাই, তাকে ইচ্ছে মতো বলতে দিলে তো আর পেটে ভাত জুটবে না। সত্যি কথা। কিন্তু বলতে না দিলেইও কি তা অধিক জুটবে?

(২)
সবাই স্বার্থপর। কেউ কেউ কেবল নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। বাকিরা মানুষের চিন্তার সীমানায় আরোপের সন্ত্রী হয়ে হাঁটে।