যদি প্রশ্ন করা হয় বর্তমান পৃথিবীতে সবথেকে বড় ও শক্তিশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কোনটি তাহলে নিঃসন্দেহে উত্তর আসবে ক্যাথলিক চার্চ। জন্মের পর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় দুহাজার বছর অতিক্রম করেছে এ প্রতিষ্ঠানটি। এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও এর ব্যাপ্তি ও প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ক্যাথলিক চার্চের প্রধান পোপের রয়েছে একটি নিজস্ব রাষ্ট্র যা ভ্যাটিকান সিটি নামে পরিচিত এবং যা পরিচালিত হয় ক্যাথলিক আদর্শ দিয়ে। তবে জন্মলগ্ন থেকেই সুবিশাল এই প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে রয়েছে হাজারো অভিযোগ। উগ্রতা, ধর্মান্ধতা, জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তকরণ,অবিশ্বাসী ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নির্বিচার হত্যা, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার বিরোধিতা, ব্যাক্তি ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, নারী বিরোধীতা, অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ, তাদের সভ্যতা ও স্থাপত্যশিল্পের সম্পূর্ণ ধংসসাধন ইত্যাদি। সম্প্রতি আবার যোগ হয়েছে সমকামীতা ও বালকদের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগও। সমকামীতা অবশ্য বর্তমান সভ্য জগতে কোন অপরাধ নয় বরং একটি স্বীকৃত মানবিক অধিকার কিন্তু চার্চের পাণ্ডারা যারা সারা জীবন ধরে এসবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে আসছে ও যুগে যুগে সমকামীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছে তারাই যদি গোপনে সমকামী কর্মকাণ্ডে জড়িত হয় তাহলে তা ভণ্ডামি ও স্ববিরোধীতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে ওঠে। এসব অভিযোগ ও ভণ্ডামির সবগুলি নিয়ে লেখতে গেলে আস্ত একটা বই লিখে ফেলা যায়। যাই হোক, সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা আমার লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি এখানে একজন নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে নিয়ে আলোচনা করতে চাই। তিনি হলেন সেন্ট(সাধু? :razz: ) জেভিয়ার। ক্যাথলিক গির্জা তাকে খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাকে উপাধি দেয়া হয় ভারতের প্রেরিত ধর্মপ্রচারক (Apostle of the Indies) এবং প্রাচ্যের রক্ষাকর্তা সাধু(the Patron Saint of the East)। সমস্ত খ্রিস্টান লেখকেরা তাকে অনুকরণীয় ধর্মপ্রচারক(model missionary) বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাই ভারতবর্ষ এবং পৃথিবীর অনেক স্থানে তার নামে মিশনারিরা গড়ে তুলেছেন নানা ধরণের প্রতিষ্ঠান যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অনাথালয় ইত্যাদি। আমাদের দেশের সেন্ট জেভিয়ার’স স্কুলটির নামও এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। কিন্তু আসলেই কি এই মানুষটি এত শ্রদ্ধা ও সম্মানের ন্যায্য দাবীদার ছিলেন? নাকি অন্যান্য ধর্মীয় মহাপুরুষদের মত তারও ছিল আরেকটা কুৎসিত চেহারা যা মোটেই সুখকর নয়? আসুন পাঠক জেনে নেই এই সাধু সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যার মাধ্যমে আমরা সেন্ট জেভিয়ারকে পূর্ণাঙ্গভাবে চিনতে পারব।

তার পুরো স্প্যানিশ নামটি হচ্ছে ফ্রাঙ্কইস দে জেসু ওয়াই জেভিয়ার। ইংরেজিতে তাকে সংক্ষেপে ফ্রান্সিস জেভিয়ার বলা হয়। তার জন্ম ১৫০৫ সালে নাভারে নামক জায়গায় যা স্পেনের পিরিনিস পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত। তার বাবা জুয়ান দে জেসু কাজ করতেন আরাগনের রাজার রাজদরবারে। তার মা ছিলেন খুব সম্ভ্রান্তবংশীয় একজন মহিলা। জেভিয়ারের একজন বোন রাণী ইসাবেলার সভায় বেশ উঁচু পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। জেভিয়ার উচ্চশিক্ষার জন্য প্যারিস গেলে সেখানে সংস্পর্শে আসেন আরেকজন স্প্যানিশ ইগনেশিয়াসের। ইগনেশিয়াস, জেভিয়ার ও আরও ৪ জন পাদ্রী মিলে গড়ে তোলেন the Society of Jesus সংঘ। এই সংঘের সূচনা হয় ১৫ আগস্ট ১৫৩৪ সালে এবং খুব তাড়াতাড়ি এটি রোমান ক্যাথলিক চার্চের মিশনারি কার্যক্রমের ডানহাত হয়ে ওঠে। এই সংঘের অনুসারীদের জেসুইট বলা হয়। এই সংঘের সূচনা করেই জেভিয়ার অল্পদিনের মধ্যেই একজন কেউকেটা মিশনারি হয়ে ওঠেন। এদিকে প্রাচ্যে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ কেবল শুরু হয়েছে। পর্তুগিজরা গোয়া দখল করে ১৫১০ সালে এবং স্থানীয়দের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে। এই মিশনারি কার্যক্রম দেখভাল করার জন্য পোপ একজন যোগ্য লোক খুজছিলেন। ইগনেশিয়াস পোপকে পরামর্শ দেন যে জেভিয়ারই হচ্ছেন এ কাজের জন্য উপযুক্ত লোক। পোপ জেভিয়ারকে মিশনের রাজপরিদর্শক হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং তাকে গোয়া পাঠান। ১৫৪২ সালে জেভিয়ার গোয়া এসে পৌঁছান। তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান গোয়ার পর্তুগিজ গভর্নর আলফনসো দিসুজা। তিনি তার জন্য বাৎসরিক ৪০০০ স্বর্ণমুদ্রা সম্মানী ধার্য করেন। কিন্তু জেভিয়ার পর্তুগিজদের নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না কারণ তারা ধর্মপ্রচারের থেকে জাগতিক ব্যাপারগুলো নিয়ে মেতে ছিল। গোয়াতে থাকাকালীন তিনি সেন্ট পল’স কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন স্থানীয় খ্রিস্টানদের মিশনারি কার্যক্রমে দক্ষ করে তোলার জন্য। খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরা তার এই পদক্ষেপের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন কারণ এর আগে বিজিত অঞ্চলগুলিতে স্থানীয়দের দিয়ে মিশনারি কার্যক্রম চালানোর কথা কেউ ভাবেননি।

১৫৪২ এর অক্টোবরে তিনি করমানডেল তটে এসে পৌঁছান যেখানে আগে থেকেই পর্তুগিজরা দখল জমিয়েছিল এবং স্থানীয় পারাভা সম্প্রদায়ের জেলেদের ধর্মান্তরিত করেছিল। পারাভারা আগে আরব জলদস্যুদের ভয়ে সন্ত্রস্ত ছিল যারা প্রায়ই সেখানে লুটপাট চালাত। পর্তুগিজরা তাদের সাহায্য ও নিরাপত্তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় যদি তারা ধর্মান্তরিত হয়। পারাভারা এতে রাজি হয় কিন্তু তাদের ভাগ্যের আসলে কোন পরিবর্তন ঘটে নি। পর্তুগিজরা তাদের থেকে চড়া কর আদায় করত। এদের মধ্যে একটি কর ছিল বাৎসরিক ৪০০০ স্বর্ণমুদ্রা যা স্পেনের রাণীর স্লিপার(বাসায় পড়ার নরম জুতো) কেনার জন্য ব্যয় হত! কিন্তু জেভিয়ার পারাভাদের এই দুর্দশা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত ছিলেন না। তার একমাত্র চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পারাভাদের অধার্মিকতা। তিনি দেখেন যে পারাভারা এখনও দেব-দেবীর পূজা করে এবং পৌত্তলিক রীতি-নীতি অনুসরণ করে। তিনি এই নিরীহ গরীব জেলেদের শায়েস্তা করার উদ্যোগ নেন কারণ তারা তার মতে “দুষ্ট আত্মা” দের উপাসনা করে। এর নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়- “যখন ছেলেরা তাকে জানাল যে একজন মূর্তি তৈরি করেছে,তিনি তাদের সাথে গেলেন ও মূর্তিটিকে ভেঙ্গে হাজার টুকরো করে ফেললেন। তার নিষেধ সত্ত্বেও যখন কেউ মূর্তি তৈরি করত তিনি তাদের পারাভাদের গ্রামের সর্দারদের দিয়ে শাস্তি দেওয়াতেন বা গ্রাম থেকে নির্বাসিত করতেন। তিনি যখন একদিন শুনলেন যে একজন খ্রিস্টানের ঘরে মূর্তিপূজা করা হয়েছে তখন ঘরটিকে পুড়িয়ে দিতে বললেন অন্যদের সাবধান করে দেয়ার জন্য।” (History of Christianity in India published by the United Theological Seminary, Bangalore, 1982,Volume 1)

এর মধ্যে ১৫৪৪ সালে তার সামনে আরেকটি সুযোগ আসে যখন ত্রিবাঙ্কুর রাজ্যের রাজপুত্রদের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। প্রত্যেকেই পর্তুগিজদের সাহায্য চাইছিল জেতার জন্য। তখন গোয়ার গভর্নর জেভিয়ারকে কুইলনের তিরুবতী রাজার সভায় নিযুক্ত করেন। রাজা বলেন যে পর্তুগিজদের সাহায্যের বিনিময়ে তিনি আর্থিক অনুদান ও মালাবার উপকূলের জেলেদের ধর্মান্তরিত করতে দিতে রাজি আছেন। জেভিয়ার এতে রাজি হন ও মালাবার উপকূলে চলে আসেন। যেসব জেলেরা ধর্মান্তরিত হতে রাজি হয়নি বা পরে ধর্মত্যাগ করে তাদের হুমকি দেয়া হয় যে পর্তুগিজরা তাদের নৌকা আটক করে রাখবে এবং মাছ ধরতে দেবে না। অন্যদের ভয় দেখাবার জন্য কয়েকজনের উপর এই শাস্তি প্রয়োগও করা হয়। এখানেও জেভিয়ার আগের মতই ভয়ানক মূর্তি ও মন্দিরবিদ্বেষী ভূমিকা রাখেন। তার নিম্নরূপ বিবরণ পাওয়া যায়-“গ্রামের সবাইকে দীক্ষিত করার পর জেভিয়ার তাদেরকে গ্রামের মন্দিরটি ভেঙ্গে ফেলতে বলতেন এবং মন্দিরের মূর্তিগুলিকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিতে বলতেন।” (History of Christianity in India published by the United Theological Seminary, Bangalore, 1982,Volume 1)
গরীব জেলেরা এসবের প্রতিবাদ করতে পারত না কারণ এই সাধুকে সাহায্য করার জন্য তার পর্তুগিজ জলদস্যু বন্ধুরা হাতের কাছেই ছিল। জেভিয়ার যে এসব কাজে প্রচুর আনন্দ পেতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৫৪৫ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি the Society of Jesus সংঘের প্রতি তার লেখা চিঠিতে-“দীক্ষাস্নান হওয়ার পরে নব্য খ্রিস্টানেরা ঘরে ফিরে যায় এবং তাদের স্ত্রী ও পরিবারকে নিয়ে আসে তাদের দীক্ষিত করার জন্য। সবাইকে দীক্ষিত করার পর আমি নির্দেশ দেই মিথ্যা দেবতাদের মন্দিরগুলি ধ্বংস করার জন্য ও মূর্তিগুলি ভেঙ্গে ফেলার জন্য। আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবোনা আমার কেমন আনন্দ হয় যখন আমি দেখি যে যারা একসময় এসব মূর্তির উপাসনা করত তারাই এখন এসব মূর্তি ভাঙছে।”

ধর্মপ্রচারের এই “মহান” কাজে জেভিয়ারের সহযোগী ছিলেন রোম কর্তৃক নিযুক্ত ভারতের ভিসার জেনারেল(ধর্মরক্ষক)মিগুয়েল ভাস। জেভিয়ারের সাথে পরামর্শ করে তিনি ১৫৪৫ সালের নভেম্বরে পর্তুগালের রাজার কাছে এক বিশাল চিঠি লেখেন। এতে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ৪১ দফা পরিকল্পনা ছিল। এর মধ্যে ৩ নম্বর দফাটি হল- “আমরা সবাই যেহেতু জানি যে পৌত্তলিকতা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এক জঘন্য অপরাধ তাই এটাই উচিত হবে যে আপনার রাজ্যের কোন এলাকায় এমনকি সমগ্র গোয়ায় যেন কোন প্রকাশ্য বা গোপন মন্দির না থাকে এবং মন্দির তৈরি করার জন্য কঠিন শাস্তির ব্যাবস্থা করা হয়। কোন কর্মচারী যেন কোন ধরণের মূর্তি তৈরি করতে না পারে, তা পাথর, কাঠ, তামা বা অন্য যেকোনো ধাতুই হোক না কেন……এবং সেন্ট পল’স কলেজের দায়িত্বে যারা আছে তাদেরকে যেন ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য হিন্দুদের ঘর তল্লাসি করার ক্ষমতা দেয়া হয় যদি তাদের এমন সন্দেহ হয় যে ওইসব ঘরে মূর্তি আছে।” (Joseph Wicki, Documenta Indica, Vol. 1) এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে রাজা ১৫৪৭ সালের ৮ মার্চ গোয়ার ভাইসরয়কে নির্দেশ দেন সমস্ত মন্দির ভেঙ্গে ফেলতে। তবে মন্দির ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া যে আগে ছিলনা এমন কিন্তু নয়। খ্রিস্টান যাজক ও পুরোহিতরা নিজ উদ্যোগেই স্ব স্ব এলাকার মন্দির ধ্বংস করতে উৎসাহী ছিলেন। শুধু ১৫৪১ সালেই ধ্বংস হওয়া ১৫৬টি মন্দিরের তালিকা পাওয়া যায় Tomba da Ilha des Goa e das Terras de Salcete e Bardes বইটিতে যার লেখক Francisco Pais আর বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। তবে রাজার আদেশের পর ধ্বংস প্রক্রিয়া নতুন গতি লাভ করে। History of Christianity in India, Vol. 1 অনুযায়ী সালসেতে ২৮০টি মন্দির ও বারদেজে ৩০০টি মন্দির ধ্বংস করা হয়। বাসেইন, বান্দ্রা, থানা এবং বোম্বেতে ধ্বংস করা মন্দিরের কোন হিসেব পাওয়া যায় না। তবে মিশনারি নথিপত্রে বেশ কিছু মন্দিরকে গির্জায় পরিবর্তিত করার উল্লেখ পাওয়া যায়। সেভিওন এবং নেভেন দ্বীপে অনেক মন্দির পুড়িয়ে দেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি কারো বাসায় দেব-দেবীর ছবি বা মূর্তি রাখাও নিষিদ্ধ ছিল এবং নিষেধ অমান্যকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হত। শুধু তাই নয়,পর্তুগিজ এলাকার বাইরে কোন মন্দিরে আর্থিক অনুদান দিলে বা তীর্থযাত্রায় গেলেও প্রচুর জরিমানা দিতে হত ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হত।

স্থানীয়দের উপর চাপানো বৈষম্যমূলক আইনগুলি কেমন ছিল তার কিছু উদাহরণ নিচে দেয়া যেতে পারেঃ
১)ব্রাহ্মণদের বন্দী ও ক্রীতদাস করা হত বা নির্বাসন দেয়া হত।
২)যেসব হিন্দুরা ধর্মান্তরের ভয়ে তাদের পরিবার পরিজনকে অন্য এলাকায় পাঠিয়ে দিত তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হত।
৩)হিন্দু রীতি-নীতি ও উৎসব পালন নিষিদ্ধ ছিল।
৪)হিন্দু পুরোহিত ও যাজকদের শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম করা নিষিদ্ধ ছিল।
৫)হিন্দুদেরকে গির্জার ভাষণ শোনার জন্য বাধ্য করা হত।
৬)পারিবারিক ঐতিহ্য ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হত।
৭)অনাথ হিন্দু শিশুদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত করা হত।
৮)হিন্দুদের ঘোড়ায় বা পালকিতে চড়া নিষিদ্ধ ছিল।

উপরোক্ত বৈষম্যমূলক নিয়মগুলি অন্যান্য স্থানীয় অখ্রিস্টান অধিবাসীদের জন্যও প্রযোজ্য ছিল তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও পৌত্তলিক হওয়ায় হিন্দুদের উপর এর প্রভাব সবথেকে বেশি পড়েছিল। একইভাবে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের দেয়া হত নানা সুযোগ সুবিধা। তাদের ভূমি কর ১৫ বছরের জন্য মওকুফ করে দেয়া হত। সরকারি উচ্চপদগুলিতে তাদের নির্বিচারে নিয়োগ দেয়া হত। এভাবে ধর্মকে ব্যাবসার মত লাভজনক করে তুলেছিল জেভিয়ার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গরা।

ইনকুইজিশন কি ভয়াবহ জিনিস তা নিশ্চয়ই অধিকাংশ পাঠকই জানেন। স্পেনের ইনকুইজিশন তো ভুবনবি(কু)খ্যাত। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে এই উপমহাদেশেও ইনকুইজিশন ছিল আর সেটি ছিল গোয়ায়। পাঠক অনুমান করতে পারেন কে এই ইনকুইজিশনের উদ্যোক্তা? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন তিনি আর কেউ নন, সেন্ট জেভিয়ার। ভারতবর্ষে এসে তিনি বুঝতে পারেন খ্রিস্টধর্ম এখানের মানুষের মনে কোন স্থায়ী জায়গা করে নিতে পারে নি। বেশিরভাগই জোরজবরদস্তির ফলে বা রাজনৈতিক কারণে খ্রিস্টান হয়েছে। পুরনো ধর্ম ও রীতি-নীতির প্রতি এদের রয়েছে গভীর আকর্ষণ। তাই এদেরকে প্রকৃত খ্রিস্টান করে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন ইনকুইজিশনের মত ভয়ঙ্কর ও কার্যকরী ব্যাবস্থা। তাই তিনি ১৫৪৫ সালের ১৬ মে পর্তুগালের রাজাকে চিঠি লেখেনঃ”খ্রিস্টানদের জন্য দ্বিতীয় জরুরী জিনিসটি হচ্ছে এখানে যেন পবিত্র ইনকুইজিশন স্থাপন করা হয় কারণ এখনও অনেকেই ইহুদি এবং মুসলিম আইন অনুসারে জীবনযাপন করছে। তাদের মনে ঈশ্বরের কোন ভয় নেই বা কোন চক্ষুলজ্জাও নেই। যেহেতু এই দুর্গের বাইরে এমন অনেকেই রয়েছে তাই প্রয়োজন পবিত্র ইনকুইজিশন ও প্রচুর ধর্মপ্রচারকের। রাজা যেন তার ভারতের বিশ্বস্ত ও বিশ্বাসী প্রজাদের জন্য এইসব জরুরী জিনিসের ব্যাবস্থা করেন।” (Joseph Wicki, Documenta Indica, Vol. IV, Rome, 1956) পর্তুগালের রাজা ও পোপের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকার কারণে ইনকুইজিশন তখনই স্থাপন করা সম্ভব হয় নি কিন্তু জেসুইটদের অব্যাহত চাপের ফলে ১৫৬০ সালে এর কার্যক্রম শুরু হয়। যদিও এর প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল নব্য খ্রিস্টানদের শাস্তি দিয়ে ও ভয় দেখিয়ে “প্রকৃত খ্রিস্টান” বানানো কিন্তু ক্রমে এর শিকার হয় স্থানীয় হিন্দু, মুসলিম, ইহুদি সবাই। খ্রিস্টান যাজকেরা প্রতিটি পাড়ায় নজরদারি করে বেড়াতেন ও কাউকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ হলে ধরে এনে অকথ্য নির্যাতন চালানো হত। এমনকি অনেক ইউরোপিয়ানকেও ইনকুইজিশনের শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। এদের মধ্যে একজন হলেন ফরাসি পরিব্রাজক ডাক্তার চার্লস ডেলন যিনি ১৬৭৪ থেকে ১৬৭৭ সাল পর্যন্ত ইনকুইজিশনে বন্দী ছিলেন। তিনি তার এই কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন তার লেখা বইয়ে। বইটি পড়া যাবে এখান থেকে। তার এই বর্ণনার কথা উঠে এসেছে ডক্টর ক্লডিয়াস বুকাননের লেখা Christian Research In India বইয়েও যা প্রকাশিত হয় ১৮১২ সালে। উল্লেখ্য যে ১৫৬০ থেকে ১৮১২ সাল পর্যন্ত এই গোয়া ইনকুইজিশন চলে। বুকানন ১৮০৮ সালে গোয়া যান এবং স্বচক্ষে দেখেন ইনকুইজিশনের সুবিশাল হল, বিচারকক্ষ, বন্দীশালা এবং যেখানে বন্দীদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হত।

কিন্তু ঠিক কত লোককে পুড়িয়ে মারা হয়েছিলো বা অন্যান্য শাস্তি দেয়া হয়েছিলো তার সঠিক কোন রেকর্ড পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে সমস্ত নথিপত্র ক্যাথলিক চার্চ খুবই সতর্কতার সাথে গোপন করে গেছে। ১৮১২ সালের ২০ ডিসেম্বর গোয়ার ভাইসরয় পর্তুগালের রাজার কাছে ইনকুইজিশন সংক্রান্ত নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলার আবেদন জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। তাকে একাজ করতে নিষেধ করা হয় এবং টমাস নরিনহো নামে একজন পাদ্রীকে নিয়োগ দেয়া হয় উক্ত নথিপত্র থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করতে। পরে ওই নথিপত্রের কি হয় তা আর জানা যায়নি। তবে স্পেন ও পর্তুগাল ইনকুইজিশনের রেকর্ডের সাথে তুলনা করে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে প্রচুর মানুষ এখানে বিনা অপরাধে প্রাণ দিয়েছে, অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হয়েছে এবং প্রত্যক্ষ করেছে ধর্মের নামে মানুষ কত নিচে নামতে পারে। গোয়া ইনকুইজিশন সম্পর্কে বিশ্বখ্যাত মনীষী ও মুক্তচিন্তক ভলতেয়ারের একটি উক্তি রয়েছে-

“Goa is sadly famous for its Inquisition, equally contrary to humanity and commerce. The Portuguese monks made us believe that the people worshipped the devil, and it is they who have served him.” -Voltaire

 

ভারতবর্ষের এই সাফল্যের পর জেভিয়ার এবার প্রাচ্যের অন্যান্য রাজ্যগুলির দিকে নজর দেন। তিনি ১৫৪৫ সালের সেপ্টেম্বরে মালাক্কায় আসেন এবং পরবর্তী দুবছর পার্শ্ববর্তী এলাকায় ধর্মপ্রচার করেন। এখানেই তার দেখা হয় একজন জাপানী পলাতক খুনের আসামী আনজিরোর সাথে। আনজিরো খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে এবং জেভিয়ারকে বোঝায় যে জাপানের ধর্ম খ্রিস্টধর্মের মতই ও জাপানীরা খুব সহজেই যীশুকে গ্রহণ করবে। জেভিয়ার তাকে ১৫৪৮ সালে গোয়ায় নিয়ে আসেন এবং মিশনারি হিসেবে প্রশিক্ষণ দেন। দাগী আসামীদের নিজের স্বার্থে ব্যাবহার করা চার্চের বহু পুরনো কৌশল। যাই হোক, জেভিয়ার এবং আনজিরো দীর্ঘ যাত্রা শেষে জাপানের কোগোশিমা বন্দরে এসে পৌঁছান। তখন জাপান প্রায় ২৫০ জন জমিদারের অধিকারে ছিল যাদের উপর মিয়াকোর সম্রাটের তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তারা উদীয়মান পর্তুগিজ শক্তির ব্যাপারে শুনেছিলেন এবং তাদের অনেকেই স্থানীয় যুদ্ধ বিগ্রহে পর্তুগিজদের সাহায্য নিশ্চিত করতে চাইতেন। এদেরই একজন জেভিয়ারকে সাদরে গ্রহণ করেন এবং তাকে স্বাধীনভাবে ধর্মপ্রচারের অনুমতি দেন। কিন্তু ভারতের মত জেভিয়ার এখানে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না কারণ তার পর্তুগিজ জলদস্যু বন্ধুরা না থাকায় তিনি ইচ্ছেমত জাপানীদের গণহারে ধর্মান্তরিত করতে পারছিলেন না। তাদেরকে হুমকি ধমকি দেয়া বা শাস্তি দেয়া তার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না কারণ তিনি নিজেই জমিদারের অনুগ্রহে বাস করছিলেন। তাছাড়া তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আনজিরো তাকে ভুল বুঝিয়েছে। জাপানে বৌদ্ধধর্ম ও প্রাচীন শিনতো ধর্মের সংমিশ্রণে যে ধর্ম চালু হয়েছিল তা তার খ্রিস্টধর্ম থেকে হাজার মাইল দূরে ছিল। স্থানীয় বৌদ্ধ ও শিনতো পুরোহিতরাও সংঘবদ্ধ এবং সতর্ক ছিলেন যাতে জেভিয়ার জাপানীদের ধর্মান্তরিত করতে না পারেন। জেভিয়ার তখন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাদের হুমকি দিতে থাকেন যে বুদ্ধ হচ্ছেন স্বয়ং শয়তান আর যারা তার উপাসনা করে তারা পৌত্তলিকতার মত চরম ঘৃণ্য অপরাধ করার কারণে অনন্তকাল নরকের আগুনে পুড়বে। জাপানীরা জেভিয়ার ও তার ধর্মকে নতুনভাবে চিনতে পারল এবং তার বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হল। জেভিয়ার অবস্থা বেগতিক থেকে মিয়াকোর সম্রাটের কাছে গেলেন তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দেয়ার জন্য। কিন্তু সম্রাট তার নিজের ধর্মে সন্তুষ্ট ছিলেন এবং জেভিয়ারের মতলব বুঝতে পেরে তার সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি জানান। জেভিয়ার ভগ্নহৃদয়ে ১৫৫১ সালে গোয়ায় ফিরে আসেন। যে অল্প কয়েকজন জাপানীকে তিনি ধর্মান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তারা কিছুদিনের মধ্যেই আগের ধর্মে ফিরে যায়।

জেভিয়ার তার ভ্রমণকালে চীনের কথা অনেক শুনেছিলেন এবং জাপানের ব্যার্থ অভিযানের পর সিদ্ধান্ত নেন চীনে ধর্মপ্রচার করার। সেজন্য তিনি ১৫৫২ সালে চীনের উদ্দেশ্যে রওনা হন। কিন্তু চীনের মূলভূমিতে পৌঁছানোর আগেই তিনি কুয়ানতাং বন্দরের অনতিদূরে একটি রুক্ষ পাথুরে দ্বীপে ওই বছরেরই ২ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার সাথে ছিল শুধুমাত্র একজন চীনা ভৃত্য। ১৫৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পর্তুগিজরা তার মৃতদেহ মাটি খুঁড়ে বের করে এবং ১৫৫৪ সালের ১৪ মার্চ তা গোয়ায় ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে প্রথমে সেন্ট পল গির্জায় ও পরে বম জেসাস গির্জায় সমাহিত করা হয়। রোম ১৬৬৪ সালে তাকে সেন্ট উপাধিতে ভূষিত করে। তার মৃতদেহ একটি কাঁচের কফিনে রাখা আছে যা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবের সময় প্রদর্শনীর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। খ্রিস্টান অখ্রিস্টান নির্বিশেষে গোয়ার সাধারণ মানুষ তাকে শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে এবং বিপদে আপদে তার অনুগ্রহ প্রার্থনা করে। কিন্তু তারা কি একবারও ভেবে দেখেছে এই মানুষটির কারণে তাদের পূর্বপুরুষদের কতটা অত্যাচার ও পাশবিকতার শিকার হতে হয়েছে? ১৫৬০ থেকে ১৮১২ সাল পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ ২৫২ বছরে যত নিরপরাধ মানুষকে ইনকুইজিশনের আগুনে প্রাণ দিতে হয়েছে, বন্দীদশা বরণ করতে হয়েছে বা অন্যান্য নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের কান্না কি এইসব অন্ধভক্ত যারা তাদেরই বংশধর তাদের কানে পৌঁছায় না?

সেন্ট জেভিয়ার সম্পর্কে উপরিল্লিখিত ঘটনাগুলি যে কেউ নেট বা লাইব্রেরি থেকে খুঁজে নিতে পারেন। এত কিছুর পরেও চার্চ জেভিয়ারকে ত্যাগ করেনি বা তার কর্মকাণ্ডের বিন্দুমাত্র নিন্দা করেনি বরং তাকে সেন্ট(সাধু) হিসেবে আখ্যা দিয়েছে, নানা উপাধিতে তাকে ভূষিত করেছে এবং প্রতিষ্ঠানের পর প্রতিষ্ঠান তার নামে উৎসর্গ করেছে। এতেই বোঝা যায় চার্চের কাছে সাধুতার সংজ্ঞা শুধু যেন তেন উপায়ে কার্যসিদ্ধি করা তথা নিজের সাম্রাজ্য ও বাহুবল বাড়ানো। গির্জার সাধুদের অনেকেই যেকোনো সাধারণ মানুষের থেকেও বেশি অসাধু। এদের অনেকেই উপবাস করা, খালি পায়ে হাঁটা, নিজেকে চাবুক মারা, নারীসঙ্গ বর্জন ইত্যাদি নানা ধরণের আত্মপীড়ন করে বেড়াতেন। কিন্তু যা এদের ছিল না তা হল উদার মানবতাবাদী বৈশ্বিক চেতনা। অযৌক্তিক ও মানবতাবিরোধী ধর্মীয় বিশ্বাসগুলি যে মানুষকে কতটা পাষণ্ড ও অমানুষ করে তুলতে পারে তার অনুপম নিদর্শন হচ্ছেন সেন্ট জেভিয়ার।