(১) নির্মেঘ রাতে শিলিগুড়ি

এক চিলতে ছাদ| তিন তলার ওপর| এক নির্ঘুম ভোরে হঠাত উঠে এলাম সেখানে| মহাদেশ বদলের এ এক বিরক্তিকর জেগে থাকা| সন্ধ্যা হলেই চোখের পাতা জুড়ে ঘুম| মাঝ রাত থেকেই নিদ্রাদেবীর নিদারুন অভিমান| একেবারে ড্যাব ড্যাব চোখে উজ্জ্বল জেগে থাকা| ঘুমের লেশমাত্র দেখা নেই, ক্লান্তির বিসন্নতা সেও উধাও| তাই বিছানায় মশারীর আকাশ দেখার চেয়ে শিলিগুড়ির আকাশের প্রতিই তীব্র টান আমার|
সিঁড়ি ঘরের দরজা খুলে যেতেই এক মস্তমান কালা-পাহাড়ে চোখ আটকে গেলো| তখনো পূবের আকাশে প্রথম আলোর ঝলকানি লাগে নি| তখনো তারাদের মিটিমিটি আলো আকাশকে করছে রোশনাই| পশ্চিম থেকে পূবের কাছাকাছি সমুদয় উত্তর আকাশের বিশাল অংশ জুড়ে কালো এক মূর্তিমান উপস্থিতি| দার্জিলিং একটু উত্তর-পশ্চিমে সরে| আর কালিম্পং একেবারে সরাসরি উত্তরে| আরেকটু সরে নেপালের সীমান্ত ঘেষে মিরিক| শিলিগুড়ি থেকেই পথ উঠে গেছে পাহাড়ে| আর এত সব পাহাড়ের উজ্জ্বল আবাসন এ শহরগুলো| তাই আপাত সমতল শিলিগুড়ি নির্মেঘ রাতে হিমালয় কন্যা এ পাহাড়গুলোকে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে থাকে যেন|
পাহাড় হেলান দিয়ে সমস্ত শিলিগুড়ি ঘুমালেও ঘুম নেই শুধু আমার| নির্ঘুম চোখ আটকে আছে নির্মেঘ আকাশে| দিগন্ত কালো করে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়েই| ছাদের এক কোনে ফুটে থাকা কতগুলো গোলাপ কিংবা সাদা বেলিফুলের আবছা আলো-আঁধারি সৌন্দর্যের চেয়েও দুরের পাহাড়ের গহিনেই চোখ| দূরের পাহাড় দেখার এ এক অন্যরকম আনন্দ| ঘাড় উঁচু করে দেখা আর কাছে এসে চোখের সমান্তরালে দেখা| কাছের সবুজ, দূরে হয়ে যায় কালচে| সবুজের সাথে কালোর মিশেলে বেদনার ছিটে ফোঁটাও কি মিশে যায় হ্রদয়ে?
জানি না, রবীন্দ্রনাথ কখনো তার বহু স্মৃতির কালিম্পংকে শিলিগুড়ি থেকে কোন রাতের শেষ প্রহরে এমনি করে দেখেছিলেন কিনা? হয়তো দেখেছিলেন তার পাহাড়ে শেষ অবস্থান কালে| ১৯৪০-এর সেপ্টেম্বর মাসে| সে বার পাহাড়েই তিনি টানা তিনদিন জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে কাটালেন| সাথে পুত্রবধু প্রতিমাদেবী আর শেষ সময়ের ভালবাসার প্রিয়তমজন মৈত্রেয়ীদেবী| কালিম্পংয়েই রবীন্দ্রনাথের দূরারোগ্য কিডনির অসুখ ধরা পড়ে| জানা যায়, সে বার পাহাড়ে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ কিছুই লিখেন নি| রবীন্দ্রনাথের জন্যে এটা ব্যতিক্রম শুধু নয়,অভাবিতও বটে! এম্বুলেন্স করে এনে রবীন্দ্রনাথকে কলকাতার ট্রেনে উঠানো হোল|কালিম্পং কেন, শিলিগুড়িও রবীন্দ্রনাথের পদধূলি থেকে চিরদিনের জন্যে বঞ্চিত হোল|
বাঙালীর কাছে রবীন্দ্রনাথ ধন্য শিলিগুড়ি, কালিম্পংয়ের মতো সমস্ত স্থানগুলো শুধুই কি আবেগের? নাকি, বিশাল তার সৃষ্টির সাথে জড়িয়ে আছে বলেই সব জায়গাগুলো এত কাছের? শিলিগুড়ি তথা পশ্চিমবাংলা বেড়াতে এসে রবীন্দ্রনাথকে দূরে রাখা তাই অসম্ভব শুধু নয়, অবান্তরও বটে| এবারের পশ্চিমবাংলা বেড়ানো সে অর্থে রবীন্দ্রতীর্থ দর্শণও আমার কাছে, বিশেষত রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবার্ষিকী পালনের ডামাডোলে যখন উত্তাল দুই বাংলা|
লেখাটি কিভাবে শুরু করা যায়, সে নিয়েই গোটা কয়েকটা দিন কেটে গেলো| কখনো ভাবি শুধুই ভ্রমন কাহিনী| আবার মনে হয়, এই প্রতিদিনের চলাচল চরাচরব্যাপি; সেও তো ভ্রমন ছাড়া আর কিছু না| প্রতিদিন ঘর থেকে বের হই| সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ত্যকার গাছগুলো,প্রকৃতি,বাতাসের গন্ধ,রোদের আলো, বৃষ্টির জল, মেঘলা জল-হাওয়া সব তো বদলে যায়| কোথাও একটু না সরেই বদলে যায়| ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেই বদলে যায়| আর আমরাও দাঁড়িয়ে থেকে বদলাই| প্রতি ক্ষনে ক্ষনে বদলাই| নিমিষে বদলাই| নির্নিমেষ বদলাই| আর ভ্রমন সেতো চর্তুমাত্রিক বদলানো| জ্যামিতিক তিন মাত্রা, চতুর্থ মাত্রা হলো সময় বা কাল| স্থান-কালের সাথে পাত্রের যে বদল; সে সব মিলেই তো ভ্রমন|
ফলে যে ভাবেই শুরু করি,তাতে কি কোন রকম ফের হয়? কিন্ত তবুও কথা থাকে পাছে কিছু| সেটা বিন্যাস| জীবন অবিন্যস্ত হলেও কথার কিংবা লেখার বিন্যাস ঠিকঠাক দেখতে কে না ভালোবাসে? চারপাশের দেখা বিন্যস্ত প্রকৃতির সাথে তার ছেঁড়া অবিন্যস্ত জীবনের কথাই না হয় থাকুক এখানে| ছিমছাম পাহাড় ঘেঁষা দার্জিলিং-মিরিকের পাশে রবীন্দ্রনাথ| প্রযুক্তির বরপুত্র আধুনিক ভারতের পাশে রেলকলোনীর নোংরা-ঘিঞ্জিঘর| ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে ছত্রাকের মতো গজিয়ে ওঠা ধর্মশালা| উন্মুক্ত আকাশ-সংস্কৃতির নীচে কাঁটাতারে আটকে দেয়া দুই দেশ| কলকাতার কলেজ ষ্ট্রিট থেকে কেনা প্রিয় কোন বইয়ের পাঠ-অভিজ্ঞতা| কিংবা দীর্ঘ আকাশ পথে মেঘেদের গাঁ ঘেষে উড়ে চলা প্লেনের ভেতর অপলক চেয়ে থাকা কিছু সময়| সূর্য্যের বিষুব রেখা থেকে উত্তরে সরে যাওয়ার মতো আমিও চলি উত্তর থেকে উত্তরায়ণে|

(২) শক্তির কবিতায় পাহাড় ও জংগল

একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে,আমার প্রথম জংগল আর পাহাড় দেখা শিলিগুড়ি এসেই| সেটাকে দেখা বলি কী করে? প্রথম প্রেমের মতন তার আকর্ষন; স্থায়ী আর দুর্নিবার| পই পই করে এতোগুলো বছর চলে গেলেও আজো তেমনি কেমন সবুজ আর উন্মাতাল| আর এই শিলিগুড়ি ঘেঁষা ডুয়ার্সের জংগল থেকেই আরো দুটি জিনিসের উপরি পাওনা| এক, বাস্তবজীবনে প্রেমিকাকে জীবনসাথী করার সংকল্প| দুই, আমার দ্বিতীয় কিংবা অদ্বিতীয় প্রেম প্রকৃতির সাথে সাহিত্যকে আরো ভালো করে বুঝতে শেখা| আর যে দু’জন মহারথী আমাকে সেটা শিখিয়েছেন তাদের একজন কবি,অন্যজন ওপোন্যাসিক|
রবীন্দ্রনাথের পরে অনেক মহত কবিকে পেয়েছে বাংলাসাহিত্য| এক্ষেত্রে যদিও মহত কথাটা নিয়ে আমার নিজেরই আপত্তি, তবুও এক্ষেত্রে শক্তিমান অর্থেই ব্যবহার করলাম| আর সে মহত কবিদের অন্যতম শক্তি চট্রোপাধ্যায়| সেই শক্তিমান কবি শক্তিকে নতুন করে আবার আবিস্কার করি এই ডুয়ার্সে; সাথে কালবেলা খ্যাত সমরেশ মজুমদার| মদেশিয়াদের মহুয়া নয়,স্রেফ কথা আর চরিত্রের গাঁথুনি একজন পাঠককে এক জংগল থেকে কিভাবে অন্য জংগলে নিয়ে যায়, ডুয়ার্সে না এলে আমি সেটা কি বুঝতাম? একদিন মেটলির হাট,অন্যদিনেই বানারহাট সংলগ্ন স্বর্গছেঁড়া চা বাগান| বিমুগ্ধ পাঠকের এ এক মাতাল অন্বেষন!
একটি কবিতার আবেদন কি রকম হোতে পারে,সেটা বুঝেছিলাম সে সময়ে| কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের কবিতা; নাম “জংগলে যাবার”| কবিতাটি সমগ্র কবিতা ভাবনার যেন ঠিক মাঝখান থেকে শুরু হয়েছে| কবিতাটি শুরু হয়েছে এটা ধরে নিয়েই যে, পাঠক জংগলে যাবে| কিন্ত কেন এবং কখন জংগলে যাবে,সেটাই কবি বলে দিয়েছেন এভাবেঃ
“জংগলে যাবার কোনো দিনক্ষণ নির্ধারিত নেই,
যে-কোনো সময়ে তুমি জংগলের মধ্যে যেতে পারো|
পাতা কুড়াতেই যাও,কিংবা দিতে কুঠারের ঘা,
জংগলে যাবার জন্যে অকৃপণ নিমন্ত্রন আছে|”

যেন, কবি নিজেও অনেকবার জংগলে গেছেন,দেখেছেন পাতা কুড়ানো,দেখেছেন কুঠারের ঘা-তে গাছ কাটা| কিন্ত এতো সব বাস্তব জীবনযাপন বা কর্মসংস্থানের বাইরেও জংগলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মনকেমনকরা ভালোলাগার শিল্পসৌন্দর্য্য|
“জংগলে চাঁদের সংগে হেঁটে গেছো কখনো জ্যোতস্নায়?
পাতার করাতে চাঁদ ছিন্নভিন্ন হতে দেখেছো কি?
ফুটবলের মতো চাঁদ পড়ে আছে টিলার উপরে-
কখন,গভীর রাতে খেলা হবে,জয়োল্লাস হবে-
এসব মুহুর্তে তুমি জংগলের মধ্যে যেতে পারো|”

ছোট এ কবিতাটি আসলে শক্তি চট্রোপাধ্যায়ের আরেকটি বড় কবিতার প্রাক-কথন| যে কবিতাটি শক্তির উত্তরবংগের বিস্তীর্ণ ডুয়ার্সের জংগলের আনাচে-কানাচে পরিভ্রমণের কাব্যিক বর্ণনায় ঋদ্ধ| পর্যটনময় ডুয়ার্স-জংগলের আন্তরিক কাব্যময় চিত্রায়ণ| জংগলের সাথে মানুষ আর পশুপাখির সংকটময় সহাবস্থানের বাস্তব চালচিত্রও এটা| অনেকের মতে শক্তির শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোর অন্যতম এটি;”জংগলে মধ্যে ঘর ঈশ্বর গড়েন”| কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে,” বৃষ্টিতে ডুয়ার্স খুবই পর্যটনময়”| অর্থ্যাত আগে জংগলে যাবার যে আমন্ত্রন জানিয়েছেন কবি,এখানে যেনো তারই ধারাবাহিক আহবান;শুধু জংগলে চাঁদের সংগে রাতে হেঁটে যাওয়া নয় বৃষ্টিতেও ডুয়ার্স পর্যটনময়!
তারপর একে একে খুঁটিমারি দোতলা বাংলোয় বসে প্রকৃতি দেখা,রাতে বাদুড়ের মুখ থেকে খসে পড়া ফল,ছাতার মতন দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রাক্ষের গাছ;এসব কবিকে আন্দোলিত করেছে| অথচ পশুপাখি কেমন অচেনা এখানে? কারণ হিসেবেও কবি জানিয়েছেন তার পর্যবেক্ষন| জানিয়েছেন প্রকৃতি ভাবনার সাথে পরিবেশ নিয়েও তাঁর আশঙ্কাঃ
” এখন জংগল খুব উপদ্রুত নয়|
মানুষের ভয়ে সব পশুপাখি
অধিক অধিকতর জংগলের দিকে সরে গেছে|”

কবিতাটিতে হঠাত যেনো বাঁকবদল হয়েছে| কবিও গভীর অরণ্যে থেকে চলে গেছেন আরো উত্তরে, “এবার জংগলে সরাসরি নয়, মেটলির হাটে/জংগলের কিছু কিছু লোক ছুঁতে যাওয়া|” তারপর এ দীর্ঘ কবিতাটিতে “মাদলে-বাদলে” “ওঁরাও মরদ”-দের সাথে মিশে জংগলের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন,হাসি-কান্না, চাতালে বসা হাট,জংগল-পাহাড়-নদীর বর্ণনা এসেছে এভাবে,
“ মানুষ এখানে খুব দ্রুতগামী নয়
মাটির মানুষ নয় খরস্রোতা নদীর মতন
কিংবা শুধু পাহাড়ের মতো নয় সম্পন্ন সবুজে
বিপন্নতা আছে,ধৃতি,বৃন্ত,পাতা আছে-
শুধু হাহাকার নয়,আনন্দও আছে–|”

যতবার জংগলে যাই কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়কে সাথে নিয়ে যাই সেই নিরন্তর আনন্দের খোঁজে| এবারের পাহাড়ে-জংগলে ভ্রমনও সে অনন্ত আনন্দের সন্ধানেই|
যদিও এবারেও সঙ্গে ছিলেন না কালবেলা-কালপুরুষ খ্যাত ওপোন্যাসিক সমরেশ মজুমদার| তাই সে নিঃসংগতা এবারে আর জলপাইগুড়ি থেকে ময়নাগুড়ি এবং ধুপগুড়ি হয়ে স্বর্গছেঁড়া চা বাগান অবধি টেনে নিতে পারে নি আমাকে| কিন্ত পাহাড় আর চা বাগানের সে খেদটুকু মিটিয়েছে শিলিগুড়ি থেকে মিরিকের পথে পথে পাহাড়ের গায়ে মেঘের সাথে লেপ্টে থাকা সবুজ চায়ের পাতাগুলো| আর তার পাশেই যেন,“বাগিচার মধ্যে বস্তি ঈশ্বরই গড়েন”? এই বস্তি যদি ঈশ্বরই গড়ে থাকেন, তবে ঈশ্বরের গড়া বস্তি দেখে ঈশ্বরের করুন দশা বুঝতে খুউব কষ্ট হয় না| হায় রে ঈশ্বর!