মার্কিন মাস্তানি -ডমিনিকান রিপাব্লিক আর একাত্তরের বাংলাদেশ
-ইরতিশাদ আহমদ

‘দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে’

পেশাগত কাজে গত মাসে (নভেম্বর, ২০১২) আমাকে বেশ কয়েকবার যেতে হলো ডমিনিকান রিপাব্লিকের রাজধানী সান্তো ডমিঙ্গো-তে। মায়ামি থেকে আকাশ পথে মাত্র দুইঘন্টার ফ্লাইট। দেশটা সম্পর্কে আগ্রহ জাগলো মনে। টুকটাক জেনে নিলাম ইন্টারনেট ঘেটে। যতই ঘাটি ততই মনে হয় ‘চিনি উহারে’।

দেশটা সম্পর্কে যতই নতুন নতুন তথ্য জানতে পারি, ততই মন খারাপ হয়। মন খারাপ হলেও অবাক হই না। ডমিনিকান রিপাব্লিকের ইতিহাসে যা ঘটেছে আমার জানা এই অঞ্চলের এবং ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট বিশ্বের অন্যান্য দেশের ইতিহাসের সাথে তার তেমন কোন অমিল নেই।

হিস্পানিওলা

সেই পঞ্চদশ শতকের গোড়া থেকে সাম্রাজ্যবাদের লিপ্সার শিকার ডমিনিকান রিপাব্লিকের মতো ক্যারিবিয়ান-ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলো। হেইতির প্রতিবেশী এই দেশটা ছিল স্পেনের উপনিবেশ (১৪৯২ থেকে)। হেইতি পরে (১৬৬৮ থেকে) চলে যায় ফ্রান্সের হাতে। দুই দেশ মিলে এই অঞ্চলকে বলা হয় হিস্পানিওলা। ক্রিস্টোবাল কোলোন (ক্রিষ্টোফার কলম্বাসের স্প্যানিশ নাম) ক্যারিবিয়ান এই দ্বীপে ১৪৯২ সালে ঘাঁটি গাড়ার পরে নাম দিয়েছিলেন, লা ইসলা এস্পানোলা ইংরেজিতে যার মানে দ্য স্প্যানিশ আইল্যান্ড। সংক্ষিপ্ত হয়ে পরে এস্পানোলা এবং অবশেষে হিস্পানিওলা। এদের দূর্ভাগ্যের শুরু সেই সময় থেকে ।

কলম্বাস আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের দ্বারা নির্মিত বিশালাকৃতি দূর্গসদৃশ বাড়িগুলো এখনো বহাল তবিয়তে বিদ্যমান সান্তো ডমিঙ্গোতে। পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থান, যাদুঘর আর মহাকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা ক্যারিবিয়ান সাগরের তীরে। ‘আলকাজার দ্যে দিয়েগো কোলোন’ নির্মিত হয়েছিল ১৫১৫ তে। ক্রিস্টোবালের ছেলে দিয়েগো কোলোন, সান্তো ডমিঙ্গোর গভর্ণর থাকাকালীন সময়ে বানিয়েছিলেন এই প্রাসাদটা।

কতশত স্থানীয় আর আফ্রিকার কালো মানুষের অশ্রু, ঘাম আর রক্তের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে এই শহর কেউ তার হিসেব আর নেয় না এখন।

ডমিনিকান রিপাব্লিক ‘স্বাধীন’ একটা দেশ। এখন আর উপনিবেশ নয়। কিন্তু উপনিবেশ না হলেও সত্যিকার অর্থে স্বাধীন কি? এ যুগে ‘স্বাধীন দেশ কি ও কত প্রকার’ এই প্রশ্নের উত্তর খুব একটা সহজ-সরল নয়। স্বাধীন দেশ অনেক, ‘স্বাধীনতাও’ অনেক রকমের। সম্রাট-সম্রাজ্ঞী এই দুনিয়ায় তেমন নেই আর – থাকলেও আছে প্রতীকী নখদন্তহীন দু’একজন। তবে সাম্রাজ্য আছে, আরো বেশি করে আছে সাম্রাজ্যবাদ। সেকালের উপনিবেশ আর নেই, তীব্রভাবে আছে এখনো ঔপনিবেশিকতা।

হিস্পানিওলার ইতিহাস এক শ্রেণির মানুষের বিরুদ্ধে আরেক শ্রেণির মানুষের জঘন্য নির্মমতার ইতিহাস। অর্থ আর প্রতিপত্তির লোভে মানুষ মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনে, আর নিজেরাও পরিণত হয় জানোয়ারে । কলম্বাসের আবিষ্কৃত সেই স্বর্গভূমিকে নরকে পরিণত করতে বেশি সময় লাগে নাই সেই মানুষরূপী জানোয়ারদের।

উপনিবেশবাদের রোগ শুধু নয়, ইউরোপিয়ানরা সাথে করে নিয়ে এসেছিলো আক্ষরিক অর্থেই রোগের জীবানু। স্থানীয় ‘তাইনো’ (Taino) নামে পরিচিত অধিবাসীরা অচিরেই আক্রান্ত হলো হাম আর গুটিবসন্তে। মারা গেলো অনেকেই। যারা বেঁচে ছিল তাদের ওপরে স্প্যানিশ হানাদারেরা চাপিয়ে দেয় বর্বর দাসপ্রথা।

চিপে রস বের করে নেয়ার পরে আঁখের ছিবড়া যেভাবে পরিত্যক্ত হয় হিস্পানিওলাও তাই হয়ে গেল স্প্যানিশদের কাছে। আসলেই, শেষের দিকে শুধু চিনি উৎপাদনের জন্য আঁখ চাষ আর মাড়াইয়ের কাজটাই হতো হিস্পানিওলায়। তাই ১৬৬৮তে ফ্রান্স যখ্ন হিস্পানিওলার পশ্চিমাংশ দখল করে নেয়, স্পেনীয়রা খুব একটা গা করে নি। অবশেষে ১৮০০ সালে হেইশিয়ান বিপ্লবী ভূতপূর্ব দাস তুসো ল’ওভেরতুরের নেতৃত্বে স্প্যানিশদের হটিয়ে পুরো হিস্পানিওলাকে এক দেশে রূপান্তরিত করেন। ল’ওভেরতুরের ক্ষমতা স্থায়ী হয় নি। দুইবছরের মাথায় ফ্রান্স তাঁকে ধরে নিয়ে মৃত্যুদন্ড দেয়। পরে ১৮০৪ সালে ল’ওভেরতুরের সাথী জাঁ-জাক দেসালিন-এর নেতৃত্বে হেইতি স্বাধীনতা ঘোষনা করে। হিস্পানিওলার পূর্বাংশে (ডমিনিকান রিপাব্লিক) থেকে যায় ফ্রান্সের কর্তৃত্ব। পরে এই কর্তৃত্ব ফ্রান্স ছেড়ে দেয় স্পেনের হাতে। হেইতির প্রেসিডেন্ট জাঁ-পিয়ের বয়ার ১৮২২ সালে আবারো দুই দেশকে একীভূত করেন। পরবর্তী বাইশ বছর পুরো হিস্পানিওলা হেইতির নিয়ন্ত্রণে থাকে।

ডমিনিকান রিপাব্লিক

ডমিনিকান রিপাব্লিকের স্পেনীয়রা হেইতির এই নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয় নি। হুয়ান পাবলো দুয়ার্তে-র নেতৃত্বে হেইশিয়ানদের হটিয়ে পূর্ব হিস্পানিওলার দুই-তৃতীয়াংশ স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৮৪৪ এর সাতাশে ফেব্রুয়ারি। তখন থেকেই এই দেশের নাম ডমিনিকান রিপাব্লিক।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে চিনি শিল্প আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে ডমিনিকান রিপাব্লিকে। আমেরিকানদের (যুক্তরাষ্ট্রের) অনেকেই তখন বিনিয়োগে আগ্রহী হয় এই শিল্পে। ১৯১৬ সালে মার্কিনীরা (US Marines) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ‘রক্ষাকর্তা’র ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দখল করে নেয় ডমিনিকান রিপাব্লিক আর হেইতি। উদ্দেশ্য আর কিছু না, চিনি শিল্পের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। ‘মুক্ত-বাজার অর্থনীতি’ শুধু নিজ দেশে কেন, প্রতিবেশী দেশগুলোতেও চালু না করলে কি চলে!

ডমিনিকান সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে তাঁবেদার সরকার বসায় আমেরিকা সান্তো ডমিঙ্গোতে। জবরদখলকারী মার্কিন মেরিন কমান্ডারদের নির্দেশ মানতে বাধ্য ছিল তারা। আমেরিকার প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে প্রায় আট বছর।

স্বৈরশাসক ট্রুহিও

ডমিনিকান রিপাব্লিক আর হেইতি ছেড়ে আসার আগে আমেরিকানরা তাদের বশংবদ সেনাবাহিনী গড়ে তোলে দুই দেশেই। রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র চলে যায় বেসামরিক রাজনীতিকদের হাত থেকে মিলিটারীর বন্দুকে। ডমিনিকান রিপাব্লিকে এই প্রক্রিয়ার ফলে একনায়ক হয়ে বসেন সেনাবাহিনীর কোয়ার্টারমাস্টার সাবেক টেলিগ্রাফ কেরানি রাফিয়েল লিওনিদাস ট্রুহিও। অপহরণ, নির্যাতন, খুন অবাধে চালিয়ে যেতে থাকেন ট্রুহিও তার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার প্রয়াসে। যথারীতি, ‘বিশ্ব গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুগিয়ে যেতে থাকে মদদ। এই স্বৈরশাসক চারশো বছরের পুরনো শহর সান্তো ডমিঙ্গোর নামও বদলে দেন – নতুন নাম হয় ট্রুহিওনগর (Cuidad Trujillo বা Trujillo City)।

একটানা ত্রিশ বছর দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করার পরে ট্রুহিও’র দিনও শেষ হয়ে এলো। ততদিনে তার অন্ধ সমর্থকরাও বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ তার ওপরে। ট্রুহিওকে আর প্রয়োজন নেই আমেরিকারও। ১৯৬১-র মে মাসে তখনকার দিনে বিশ্বের অন্যতম ধনী রাষ্ট্রপ্রধান ট্রুহিও নিহত হন আততায়ীর হাতে। অনেকেই মনে করেন সিআইএ’র লম্বা হাত সক্রিয় ছিল এই হত্যাকান্ডের পেছনে। পাঠক, চেনেন নিশ্চয়ই এই করিতকর্মা মার্কিন এজেন্সীটাকে!

মার্কিন আগ্রাসন -১৯৬৫

এরপর থেকে নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছে ডমিনিকান রিপাব্লিক। কিন্তু বেরোতে পারে নি আমেরিকার প্রভাববলয় থেকে। পারবেই বা কি করে! কয়েক বছর না যেতেই ১৯৬৫ –র এপ্রিল মাসে মার্কিন বীর পুঙ্গবেরা (প্রেসিডেন্ট জনসনের আমলে) আবারো পদধুলি দেন সান্তো ডমিঙ্গোতে। অজুহাত, সে দেশে অবস্থানরত আমেরিকানদের জানমালের নিরাপত্তা বিধান।

আসল কারণ, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ‘আরেকটা কিউবা’র উদ্ভব ঠেকানো। সমাজতন্ত্রের জুজু আর সোভিয়েত-ভীতি তখন আমেরিকাকে ভালোই নাকানি-চুবানি খাওয়াচ্ছে।

আমেরিকার অজুহাতের অভাব নাই। সেই বাঘ আর মেষের গল্পের মতো। ‘উজানের পানি তুই ঘোলা না করলেও তোর বাপ করেছে!’ কিউবার সাহায্য নিয়ে নিজেদের পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য বিমানবন্দর নির্মান করছিলো ক্যারিবিয়ান ছোট্ট একটা দ্বীপদেশ, গ্রেনাডা। সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ব্যবহারের জন্য বানানো হচ্ছে এই এয়ারপোর্ট, এই ভয়ে রিগ্যান প্রশাসন দখল করে নিয়েছিল গ্রেনাডা, ১৯৮৩ সালে। আমি যে বছর আমেরিকা আসি সে বছর। এর আগে আমি গ্রেনাডা নামে যে একটা দেশ আছে তাই জানতাম না। এহেন গ্রেনাডাও বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের লোভের থাবা থেকে নিস্তার পায় নি। পরে অবশ্য আমেরিকাই গ্রেনাডার বিমানবন্দরটা বানিয়ে দেয়, পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য! ভাবখানা যেন, ‘এয়ারপোর্ট লাগবে? আমাকে বললেই তো পারতে!’ মাস্তানি ছাড়া একে আর কি বলা যায়?

যাক, ফিরে যাই ডমিনিকান রিপাব্লিকে। ১৯৬৩-তে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত অবাধ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন হুয়ান বশ। সমাজতন্ত্রের সমর্থক বশকে কম্যুনিস্ট আখ্যা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নির্বাচিত হওয়ার মাত্র আট মাসের মাথায় তাঁকে এক ক্যুর মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করে ডানপন্থী সামরিক অফিসারেরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ্য সহযোগিতায়। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে মিলিটারি। কিন্তু আবার গোল বাধলো ১৯৬৫-তে। বশ-সমর্থকরা, তারাও মিলিটারির একটা ফ্যাকশন, কন্সটিটিউশনালিস্ট হিসাবে খ্যাত, ডানপন্থীদের হাত থেকে ক্ষমতা নিয়ে নেয় জনগণের ব্যাপক অংশের সমর্থনের জোরে। পাল্টা আঘাত হানে বশ-বিরোধীরা, সেনাবাহিনীর লয়্যালিস্ট অংশ। ব্যর্থ হয় তারা। মাঠে নামে আঙ্কল স্যাম। ১৯৬৫-র আটাশে এপ্রিল চল্লিশ হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা আক্রমণ করে ডমিনিকান রিপাব্লিক। এই হামলার নায়ক ছিলেন এডমিরাল জন এস. ম্যাককেইন – স্বনামধন্য রিপাব্লিকান সিনেটর ২০০৮-এর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন ম্যাককেইনের বাবা। পাঠক, সিনিয়র জন ম্যাককেইনের নামটা মনে রাখবেন। তার প্রসঙ্গ আবারো আসবে এই আলোচনার শেষের দিকে।

নির্বাচিত রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন কি নতুন কিছু? সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসানো হয় জোকিন বালাগের-কে। বলা বাহুল্য, আমেরিকার স্বার্থরক্ষার প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছিল তার কাছ থেকে আগেই।

আমেরিকার আধিপত্য

গত কয়েকদিনে স্থানীয় যাদের সাথে আমার পরিচয় হলো তাদের দুয়েকজনকে জিগ্যেস করেছিলাম ডমিনিকান রিপাব্লিকের এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। কিছুদিন আগে বিক্ষোভরত ছাত্রদের ওপরে গুলি চালানো হ্য়। মারা যায় একজন ছাত্র। বিক্ষোভের কারণ – সরকার দেশের সবচেয়ে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়টাকে প্রাইভেটাইজ করতে চাচ্ছে। সোজা কথায়, ‘লাভজনক’ না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টাকে ব্যাবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিতে চাচ্ছে।

তিনটা প্রধান রাজনৈতিক দল আছে এখন ডমিনিকান রিপাব্লিকে। জানতে চেয়েছিলাম, যে দলটা এখন ক্ষমতায় তারা কি মার্কিনপন্থী? পরিহাস মিশ্রিত সহাস্য জবাব, “কি যে বলেন! দল তিনটাই মার্কিনপন্থী”। প্রতিযোগিতা কে কত বেশি মার্কিনপন্থী তা নিয়ে। সেই জানা কাহিনি!

যে দেশটা পরিচিত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র নামে, তার সম্রাট নাই – তবে যেমনটি বলছিলাম – আছে সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্যের বিস্তার ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়ান, সেন্ট্রাল আমেরিকা ছাড়িয়ে এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যেও। ডমিনিকান রিপাব্লিকে আমেরিকার আধিপত্যের ইতিহাস তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, এই অঞ্চলে মার্কিন মাস্তানির একটা সাদামাটা ধারাবাহিক উদাহরণ হিসেবেই একে ধরা যেতে পারে। তাই বলছিলাম মন খারাপ হলেও আমি অবাক হই নি। কারণ, ‘চিনি উহাকে’।

ক্যারিবিয়ান-ল্যাটিন আমেরিকান দেশগুলোতে মার্কিন হামলার ফিরিস্তি দেখতে চাইলে গুগলে টাইপ করুন, ‘ইউএস ইনভ্যাশন্স ইন ল্যাটিন আমেরিকা’। বারো মিলিয়নের ওপরে রেজাল্ট দেখে আমারতো চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল। লক্ষ্য করবেন, আমেরিকান সরকার-প্রভাবিত মিডিয়া এবং সরকারী মুখপত্রগুলো আমেরিকার মাস্তানিগুলোকে ইনভেশন বা আক্রমণ (invasion) বলার চেয়ে ইন্টারভেনশন বা হস্তক্ষেপ (intervention) বলাটা বেশি পছন্দ করে।

অ্যান্ডারসন পেপারস’

বিশেষ কোন কারণ ছাড়াই, মায়ামি থেকে সান্তো ডমিঙ্গো যাওয়া-আসার পথে পড়ার জন্য আমি তুলে নিয়েছিলাম যে বইটা তার নাম ‘অ্যান্ডারসন পেপারস’, জ্যাক অ্যান্ডারসন-এর লেখা। অ্যান্ডারসন ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিন্ডিকেটেড কলামিস্ট। দেশে দেশে মার্কিন মাস্তানির কথা সবিস্তারে লিখেছেন অ্যান্ডারসন তার বইতে। ডমিনিকান রিপাব্লিকের কথা এসেছে, এসেছে বাংলাদেশের কথাও। পুলিতজার পুরষ্কার পাওয়া (১৯৭২) এই সাংবাদিককে অনেকেই ‘ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমে’র জনক মনে করেন। বিতর্কিত এই সাংবাদিক মার্কিন প্রশাসনের অনেক জারিজুরি ফাঁস করে দেন।

তাঁর বই-এর শেষ অধ্যায়টা বাংলাদেশকে নিয়ে, ‘বাংলাদেশঃ বার্থ বাই ফায়ার’। ১৯৭১-এর ডিসেম্বরে ঘটা দক্ষিণ এশিয়ার ঘটনাবলী আর তার পরিপ্রেক্ষিতে নিক্সন-কিসিঞ্জারের ভুমিকাই মূলত আলোচ্য বিষয় এই অধ্যায়ের।

বই-এর এই অধ্যায়টা পড়ার আগে আমার ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্র একাত্তরের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরে তার প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত সপ্তম নৌবহর পাঠালেও, আসলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সৈন্য পাঠানোর কোন পরিকল্পনা তাদের ছিল না। ভারত আর সোভিয়েত ইউনিয়নকে একটু ঝাড়ি দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। তাই সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের হাওয়া খেয়েই ফিরে গিয়েছিল। এখন আমার মনে হয় আমার ধারণা ভুল ছিল। শুধু হাওয়া খেতেই তারা যায় নি। (অবশ্য আমার ভুল ধারণার পেছনে আমার পড়া অন্য কিছু বই-যেমন, সিসন আর রোজ-এর লেখা ‘ওয়ার অ্যান্ড সেসিশন’-এর প্রভাব ছিল।)

চীন আর রাশিয়াকে নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত ছিল আমেরিকা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে তখন আমেরিকার কাহিল অবস্থা। পুরো এশিয়া কম্যুনিষ্টদের হাতে চলে যাওয়ার সম্ভাবনাকে যে করেই হোক ঠেকাতে বদ্ধপরিকর নিক্সন প্রশাসন। এই লক্ষ্যে পাকিস্তান তখন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহযোগী আমেরিকার। ওদিকে ভারতের ঘাড়ে ভর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্ত অবস্থান নিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। নিক্সন-কিসিঞ্জার চীনকে যতটা পারা যায় নিউট্রালাইজ করতে সচেষ্ট। তার পাকিস্তানকে খুব দরকার চীনের ওপরে প্রভাব বিস্তারের জন্য। ভারতের সাথে চীনের দা-কুমড়ো সম্পর্কটাকেও কাজে লাগাতে হবে।

সপ্তম নৌবহর – টাস্ক ফোর্স ‘ও-ক্যালকাটা’

বৈশ্বিক রাজনীতির এই পটভুমিতে সপ্তম নৌবহরের ‘টিএফ ৭৪’ নামে একটা টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়। তখনকার বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন যুদ্ধবিমানবাহী ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ ছিল এই বহরে। পঁচাত্তরটা বিমান, পাঁচটা হেলিকপ্টার আর পাঁচ হাজারেরও বেশি সৈন্য ধারণ করতো এন্টারপ্রাইজ। ওই টাস্ক ফোর্সে, যার নিক-নেইম ছিল ‘ও-ক্যালকাটা’, আরো ছিল, তিনটা গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, চারটা গান ডেস্ট্রয়ার আর ছিল ট্রিপলি (হেলিকপ্টারবাহী জাহাজ) পঁচিশটা ‘মেরিন এসল্ট’ হেলিকপ্টারসহ। এন্টারপ্রাইজ আর ডেস্ট্রয়ার চারটা ভিয়েতনামের উপকূল ইয়াঙ্কি স্টেশন থেকে যাত্রা করে বঙ্গোপসাগর অভিমুখে, ট্রিপলি আর গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ারগুলো ফিলিপাইনের সুবিক বে থেকে। হাওয়াই-এর প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমান্ড, ওয়াশিংটন আর নৌবহরের জাহাজগুলোর মধ্যে ছিল সার্বক্ষণিক রেডিও যোগাযোগ সেই কটা দিন।

ডিসেম্বরের ১৫ তারিখে, বিজয় দিবসের একদিন আগে, টাস্ক ফোর্স বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে। ঢাকা থেকে মাত্র একহাজার নব্বই মাইল দূরে।

এই টাস্ক ফোর্সের তত্বাবধানে ছিলেন সেই জন ম্যককেইন, আশা করি পাঠকের মনে আছে তাঁর কথা, ১৯৬৫-তে ডমিনিকান রিপাব্লিক আক্রমণ করে যে মার্কিন মেরিন বাহিনী, তার দায়িত্বেও ছিলেন তিনি। হয়তো কাকতালীয়। (‘অ্যান্ডারসন পেপারস’ থেকে আরো জানতে পারলাম একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন জোসেফ ফারল্যান্ড। ফারল্যান্ডের সাথে ইয়াহিয়ার সম্পর্ক ব্যাক্তিগত বন্ধুত্বে পরিণত হয়। গ্লাসের দোস্ত যাকে বলে! এই ফারল্যান্ডই ১৯৫৭-তে ডমিনিকান রিপাব্লিকে রাষ্ট্রদূত ছিলেন – আর ছিলেন ট্রুহিও-র বিশেষ বন্ধু। সন্দেহ নাই, স্বৈরশাসকদের সাথে বন্ধুত্ব পাতাতে বেশ পারদর্শী ছিলেন এই ভদ্রলোক। )

তবে সান্তো ডমিঙ্গোতে যেমন, ঢাকার ক্ষেত্রেও তেমনি অজুহাত ছিল, আমেরিকানদের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্যই এই কষ্টস্বীকার। বলা হচ্ছিল ঢাকা থেকে মার্কিন নাগরিকদের উদ্ধার করার জন্য সপ্তম নৌবহরের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ এন্টারপ্রাইজের বঙ্গোপসাগরে আগমন। সেই পুরোনো অজুহাত।

শ’খানেক মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন! মশা মারতে কামান দাগা বোধহয় একেই বলে! তার আগে নয়মাস ধরে যে একটা জনগোষ্ঠীর ওপরে নির্বিচারে হত্যযজ্ঞ চালানো হলো, যাকে জেনোসাইড ছাড়া আর কোন ভাবেই বর্ণনা করা যায় না, তা নিয়ে এই পরাশক্তি ছিল নির্বিকার। উপরন্তু ব্যস্ত ছিল হত্যাকারী পাকিস্তানের সাফাই গাওয়াতে।

গ্রেনাডায়ও মার্কিন মেডিকেল ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য আমেরিকা আগ্রাসন চালিয়েছিল। মার্কিন প্রশাসন এই প্রোপাগান্ডাগুলো আসলে করে নিজ দেশের শান্তিকামী জনগণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য। বিশ্ব জনমতের থোড়াই কেয়ার করে আমেরিকা! কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি, বাংলাদেশের মুক্তি-সংগ্রামের সময়ে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সহ অনেকেই আমেরিকার পাকিস্তান-প্রীতির কড়া সমালোচক ছিলেন। আমেরিকার সাধারণ জনগণও বাংলাদেশের সমর্থক ছিলেন। মনে পড়ছে একাত্তরের অগাস্টে নিউ ইয়র্কে আয়োজিত সদ্যপ্রয়াত রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর কথা। হাজার হাজার মানুষ গিয়েছিল শুনতে আর সমর্থন জানাতে।

বিজয় দিবস, ১৫ই ডিসেম্বর?

সময় ও সুযোগ আমেরিকার পক্ষে ছিল না একাত্তরের বাংলাদেশে। কিন্তু সেই সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টায় কোন ত্রুটি ছিল না। অ্যান্ডারসন-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের মুহূর্তটাকে একুশ ঘণ্টা পিছিয়ে দেয়ার জন্য দায়ী মার্কিন কর্তৃপক্ষ।

নইলে বাংলাদেশের বিজয় দিবস হতো ১৫ই ডিসেম্বর, ১৬ই ডিসেম্বর নয়। হয়তো তাহলে বেঁচে যেতেন আমাদের হতভাগ্য শহীদ বুদ্ধিজীবিরা, যাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছিল ১৪ তারিখ রাতে।

সেই কাপুরুষ হত্যাকারীরা রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে খুন করার ওই স্পর্ধা আর সময়টুকু পেত না, যদি মার্কিন দূতাবাস সময়মতো এ.এ.কে নিয়াজির আত্মসমর্পণের বার্তাটা জগজিত সিং অরোরার কাছে সেই দিনই কালক্ষেপন না করে পৌঁছে দিতেন।

ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নিয়াজি ঢাকায় আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেলের অফিসে যান সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিতে চান, কিন্তু পারছেন না। কারণ তার নিজের রেডিও ট্রান্সমিটারটা ভারতীয় বোমার আঘাতে ধ্বংশ হয়ে গেছে। আমেরিকার কন্সাল জেনারেল হার্বার্ট স্পিভাক প্রটোকল রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, মানুষের জীবন বাঁচানোর ব্যাপারটা তার কাছে তেমন গুরুত্ব পেল না। স্পিভাক নিয়াজির আবেদনটা পাঠিয়ে দিলেন ওয়াশিংটনে, লাগলো ঘন্টাখানেক। ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) নিয়াজির যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠিয়ে দিলেন রাষ্ট্রদূত ফারল্যন্ডের কাছে ইসলামাবাদে আর বলে দিলেন জেনে নিতে ইয়াহিয়া এই প্রস্তাবে রাজি আছে কিনা। ঢাকায় সময় তখন ১৫ই ডিসেম্বর রাত সাড়ে তিনটা।

হয়তো ঠিক সেই সময়েই আলবদরেরা সক্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় তাদের জঘন্য কাজে।

সেই একাত্তরেও মার্কিন সরকারের রেডিও ট্রান্সমিটার টেকনলজি ছিল বেশ উন্নত ও শক্তিশালী। ইচ্ছে করলে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে মুহূর্তের মধ্যে বার্তা পাঠাতে সক্ষম ছিল তাদের সিস্টেম। কিন্তু কি এক রহস্যজনক কারণে তারা অবলম্বন করলো দীর্ঘসূত্রিতার পথ। পরিহাসপ্রিয় অ্যান্ডারসন-এর ভাষ্যানুযায়ী এই বার্তাটা যেন মার্কিন কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল কূটনৈতিক অনুষ্ঠানের দাওয়াতপত্র পৌঁছে দেয়ার মতো একটা ব্যাপার।

জাতিসঙ্ঘের মার্কিন প্রতিনিধিদের পাঠানো হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে খুঁজে বের করার জন্য। কাউকে না পেয়ে শেষতক বার্তাটা পৌঁছে দেয়া হয় নয়াদিল্লিতে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিং-এর কাছে। তখন দুপুর গড়িয়ে প্রায় একটা বাজে। আরো ঘন্টা দুয়েক লাগলো বার্তাটাকে তর্জমা করতে আর উপযুক্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষ খুঁজে বের করতে আর শেষমেশ পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং অরোরার হাতে পৌঁছে দিতে।

বাকীটুকু বহুলপঠিত ইতিহাস। নতুন করে লেখার কিছু নাই।

তবে পাদটীকায় এটুকু না বললেই নয়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ক্রান্তিলগ্নে যে দেশের এমন গর্হিত ভূমিকা ছিল, সেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথেই ১৯৭৪-এর মধ্যভাগ থেকে সম্পর্ক উষ্ণ থেকে উষ্ণতর হতে শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সাহায্যদাতায়। তবে এজন্যে তাজুদ্দীন আহমদকে হারাতে হয় মন্ত্রীত্ব। ‘মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য নেবো না’, অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে এমন দম্ভোক্তি করেছিলেন তিনি।

তাজুদ্দীন আহমদ, শহীদ বুদ্ধিজীবি আর মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি।

ডিসেম্বর ১৫, ২০১২।

তথ্যের উৎস ওয়েবসাইট আর বইএর তালিকা। ওয়েবসাইটগুলো দেখা হয়েছে নভেম্বর ২০১২-র শেষ দুই সপ্তাহে।

ডমিনিকান রিপাব্লিক হিস্ট্রি, http://dr1.com/articles/history.shtml

হিস্ট্রি অফ দ্য ডমিনিকান রিপাব্লিক, http://www.hispaniola.com/dominican_republic/info/history.php

ডমিনিকান রিপাব্লিকঃ গভর্ণমেন্ট এন্ড পলিটিক্স,
http://www.mongabay.com/reference/country_studies/dominican-republic/GOVERNMENT.html

হিস্ট্রি অফ ইউএস ইন্টারভেনশন্স ইন ল্যাটিন আমেরিকা,
http://www.yachana.org/teaching/resources/interventions.html

দ্য ইনভেশন অফ গ্রেনাডা, http://www.pbs.org/wgbh/americanexperience/features/general-article/reagan-grenada/

Anderson, J., The Anderson Papers, Ballantine Books, New York, 1974.

Sisson, R. and Rose, L.E., War and Secession – Pakistan, India, and the Creation of Bangladesh, University of California Press, Berkeley, 1990.

Gurtov, M., The United States and the Third World, Antinationalism and Intervention, Praeger Publishers, New York, Washington, 1974.