১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। আর এ মানবাধিকার দিবসে বিশ্বজিৎ নামে এক মানবের করুণ পরিণতির খবর পেলাম। খবরটা পেয়েই মুক্ত-মনা খুললাম। আমি আসলে মুক্ত-মনায় বিশ্বজিৎকে নিয়ে কোন লেখা খুঁজছিলাম। কয়েকদিন যাবৎ নিজে লেখার সময় করতে পারিনা বলে অন্যের লেখায় বিশ্বজিতেত হত্যার প্রতিবাদ করতে, নিজের মনের ক্ষোভ ঢালতে্‌,মনের বেদনা লাঘব করতে চেয়েছিলাম। কোন লেখা না পেয়ে এবং হরতালে সময় পেয়ে নিজেই লিখতে বসলাম।
বিশ্বজিৎ নিজের নামের অর্থকে ভুল প্রমাণ করে মরতে বাধ্য হল ৯ ডিসেম্বর। নিরীহ, নিরাপরাধ একজন পথচারীর নিস্তেজ মৃত্যু। ছাপোষা দর্জি। জীবিকার ধান্দায় ঘর থেকে বের হতে হয়েছে।
সরকারী দলও তো চেয়েছিল মানুষ জন ঘর থেকে বের হোক তাদের প্রাত্যহিক কাজে।নাকি মনে প্রাণে তা চায়নি! আসলে তারা কি চেয়েছিল? তারা বিরোধীদলের গুন্ডাদের সাথে তাদের গুন্ডাদের মারামারি চেয়েছিল!আর ধরেই নিয়েছিল যারা পথে বের হয় তারা সব গুন্ডা?
বিশ্বজিৎতে যখন মারা হয় তখন আমি কুমিল্লার আলেকেরচর নামক জায়গায় আটকা। রাতের বাসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছি সাপ্তাহিক ছুটি কাটিয়ে। ভোর পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাবার কথা। কুয়াশা আর যানজটে আটকা পড়েছিলাম। কুয়াশা কাটতে কাটতে ভোর সাড়ে পাঁচটা। আধঘন্টা না চলতেই শোনা গেল মিরেরসরাই আর সীতাকুন্ডে গন্ডগোল। বাস নিরাপদ জায়গায়— মানে কোন পেট্রোল পাম্পে, যাত্রা বিরতি দেয় এমন কোন হোটেলের সামনে বা কোন শাখা রাস্তায় গিয়ে থেমে থাকার আগেই পিকেটাররা বাস থামিয়ে দেয়। আটকে দেয়। সুপারভাইজারের কাছ থেকে চাঁদা নেয়। বাসে বসেছিলাম রাত পৌনে এগারটা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত।আর বাসটি এক জায়গায় স্থির হয়ে ছিল সকাল ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত।
বাসের সবাই চাকরি বা ব্যবসা সুত্রে ঢাকা চট্টগ্রাম আসা যাওয়ার যাত্রী। আরামদায়ক বাসের সীট। অনায়াসে ঘুমিয়ে যাওয়া যায়। তবে আমি একলাই মহিলা যাত্রী। জেন্ডার অসংবেদনশীল পরিবেশে আট ঘন্টা এক স্থানে স্থির হয়ে থাকা। শুধু দুইবার অপরিচ্ছন্ন টয়লেট ব্যবহার করেছি। তেমন কিছু খাইনি বাথরূমের ভয়ে। পুরুষ যাত্রীদের রাতে কুয়াশায়ও বাস থেকে অহরহ নেমে টয়লেটের বিকল্প খুঁজতে হয়নি। পথের পাশেই প্রস্রাবের পরমারাধ্য স্থান।
মনে হয়েছিল যুদ্ধে আটকে গেছি। মহা দুর্ভোগ। গুন্ডারা চাঁদা নেওয়ার পরও তাদের আনাগোনা থামায়নি। পরে আবার এসে গ্লাস ভেঙ্গে ফেলবে হুমকি দিয়ে দ্বিতীয়বার চাঁদা নেয়। বাসে যাত্রীদের রাখা জলের বোতল নিতে নিতে একজন বলল, আরে এটা ওস্তাদকে দিব। নেতাকে দিব। কাওসার ভাইকে দিব। দিয়ে বলব কিনে এনেছি। আমি সিনেমা দেখে সময় কাটানোর জন্য ট্যাব খুলেছিলাম। ভয়ে বন্ধ করে সীটের পাশে ব্যাগে রেখে দিয়েছি। টান দিয়ে নিয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।
পাশ দিয়ে সাইদী, নিজামী,গোলাম আজম, খালেদা, তারেক জিয়ার ছবি হাতে স্লোগান দিয়ে মিছিলের আসা যাওয়া। টায়ার পুড়ানো মহা উৎসাহে চলছে। দুপুর বারটার দিকে ইসলামী মজলিশের সমাবেশ। মাইকে জ্বালাময়ী বক্তৃতা।
যৌক্তিক কারণেই এসি বন্ধ। ছাদের উপরে একটূ ফাঁকা করার ব্যবস্থা আছে। ঐ ফাঁকা গরম রোধ করতে পারছে না। দরজা খুললে টায়ার পোড়ানোর বিশ্রী গন্ধের সাথে গুন্ডারাও আসে।কাজেই বন্ধ দুয়ার। মোবাইলের চার্জও শেষ দিকে। একাত্তরের স্মৃতির সাথে, অসহায়ত্বের সাথে কি কিছুটা মিল খুঁজে পেলাম!
দুপুর দুইটায় বাস ছাড়ার সুযোগ পায়। সন্ধ্যা পাঁচটায় চট্টগ্রাম পৌঁছে আর বাইরের খবর রাখতে পারিনি। ক্লান্ত। অবসন্ন। একা থাকি বলে স্নান সেরে নিজের খাবারের ব্যবস্থা করে শুয়ে পরা।সকালে পেলাম বিশ্বজিতের খবর। আগেরদিনে নিজের ভয়াবহ পরিস্থিতিকে আর ভয়াবহ মনে হল না। অক্ষত তো ছিলাম। কোন দ্রব্য তো খোয়া যায়নি।
বিশ্বজিতের মৃত্যুতে শোক করে বিশ্বজিৎকে ফিরিয়ে আনা না গেলেও তার পরিবার ছাড়া শোক করার কেউ নেই। শোক লাঘবে শান্তনা দেয়ার কোন দল নেই। আছে শুধু জনগনের অনুশোচনা । আজ বিশ্বজিতের জন্য কথা বলতে কলম খুলেছি।মানবাধিকারের কথা বলতে। মানবিকতার ব্যথা তুলতে! কিন্তু এ সব লেখালেখিতে বিশ্বজিতের পরিবারের কি? তাদের কাছে তো সবই শূন্য।সবই খালি।সবখানেই হাহাকার।
সরকারী আর বিরোধী দলের গুন্ডাদের কাছে আমরা জিম্মি।এর নামই কি রাজননীতি! আমি থুতু দেই এমন রাজনীতিকে। বিশ্বজিতের পরিবারকে এ রাজনীতি কি দিল? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পুলিশেরা কি দিল। সাংবাদিকরা তো ছবিসহ খবর দিল। এ সব ছবিতে খুনীরা চিহ্নিত।পুলিশ সাংবাদিক পথচারী সবাই দেখল যে একজন নিরস্ত্র মানব সন্তানকে কতিপয় অমানুষ(জন্তু বললে জন্তুদের অপমান করা হবে)হত্যা করছে।ছবিতে স্পষ্ট তাদের চেহারা। পত্রিকার পাতায় বিস্তারিত তাদের পরিচয়। সাথে তাদের আরও কিছু অপকর্মের কথাও। প্রধানমন্ত্রী কি এ দায় নেবেন। হানিফ তো নেননি। এ দায় আমাদের। আমরা যারা ভোট দেই। আমরা যারা এ দেশে জন্মেছি। আমরা যারা বিবেকের তাড়না অনুভব করি।