তখন থাকি ঢাকা নিউমার্কেটের পাশে আজিমপুর পু্রান গোরস্থানের উল্টোদিকে যে খানাখন্দ ভরা ইরাকি গোরস্থানের মাঠ আছে ঠিক তার পেছনের একটি বাড়িতে| নিউ পল্টন লেনের তিন তলা বাড়িটি| আমরা থাকি দ্বিতীয় তলায়|আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশেই চারপাশে প্রাচীর ঘেরা একটি একতলা বাড়ি| রাস্তা পেরিয়ে লোহার গেইট দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই বেশ প্রশস্থ একটি ফাঁকা উঠোন| উঠোনের একপাশে কয়েকটি বড় বড় আম আর নারকেল গাছ| একটি আমগাছের বাড়ন্ত ডালপালা আমাদের দুইতলার একপাশের সমস্ত জানালাকে যেন পর্দা দিয়ে ঘিরে রেখেছে|আমাদের বাসার ড্রইং কাম রিডিং রুমের পাশে শখের বেতের চেয়ার আর টেবিল পাতা|সেখানেই আমার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বই-পত্র,শখের লেখালেখির সরঞ্জাম আর বউয়ের সুঁই সুতোর বাহারি উপকরণ|এগুলো একেবারে জানালা ঘেঁষে রাখা|জানালাটা একটু খুললেই কখন অলক্ষ্যে পাশের বাড়ির আমগাছের কিছু পাতা ডালসহ নেতিয়ে পড়ে যেন ড্রইং রুমের ভিতরে|

সেদিন বর্ষা কাল| শ্রাবণ মাস|বউ যথারীতি হাসপাতালে কর্মস্থলে|আমি বরাবরের মত কাজ ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে বৃষ্টির ছুঁতোয়|অলস দিনের অলসতা বাড়বাড়ন্ত বৃষ্টির মাদকতায়|ঝুম বৃষ্টি সারা সকাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল অবধি|সারাদিনের বৃষ্টিতে তিতি বিরক্ত ঢাকা শহর|

কিছুদিন আগেই বেড়িয়েছে কবি জয় গোস্বামীর কাব্যোপন্যাস ‘যাঁরা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’| প্রথমবার পড়েই জয় গোস্বামী যেন জয় করে নিয়েছেন আমাকে| সারাদিন বইটির নাম অজান্তেই ভাললাগার নেশার মত ঘুরঘুর করে মনে|সেই সাথে যোগ হয়েছে ‘উন্মেষ’ নামক একটি সংগঠনের সাপ্তাহিক সাহিত্য পাঠের আসরের বুঁদনেশা;আধুনিক কবিতার নামে বাংলাদেশে অসংখ্য ‘কবিযশপ্রার্থী (কথাটি লেখক-কবি হুমায়ুন আজাদের)’-দের কবিতা লেখার নামে যে এক উতকট কোলাহল চলছে তা থেকে দূরে থাকার অভিপ্রায়;কাব্যময় শব্দের পর শব্দ বসিয়ে বিক্ষিপ্ত ভাবের দ্যোতনা ছড়িয়ে দিলেই কবিতা হয়ে যায়- এ আহামরি প্রয়াস থেকে বিচ্ছিন্ন পাঠকদের দূরত্ব খোঁজার চেষ্টা|সেই সাথে নিজস্ব ভাললাগার মাত্রাবৃত্ত,স্বরবৃত্ত ছাড়িয়ে চতুর্দশপদী কবিতার দিকেও তখন উত্তাল ঝোঁক|

হঠাত কোন এক ফাঁকে ড্রইং রুমের জানালা খুলে দিতেই এক পশলা বৃষ্টির ছিটেয় ভিজে গেল হাত|বাইরের আমগাছের পাতা সারাদিনের বৃষ্টিতে মিহি দানার মত নেতিয়ে আছে| কয়েকটি কাক বৃষ্টি থেকে নিজেদের শরীর আড়াল করছে ভিজে নেতিয়ে পড়া আম পাতার নিচে|কবিতা লেখার মোক্ষম একটি ভাব নিয়ে চেয়ার টেনে টেবিলে ঝুঁকে লিখলাম কয়েকটি লাইন|

সারাদিন বৃষ্টি জল অঝর অঘোর ভিজে গেছ,আমপাতা?
তোমার ছায়ার নিচে পাতিকাক চোখ বুজে শুয়ে আছে ডালে
তোমার ওপর মেঘ অবিরাম ঝরে যায় শ্রাবণ বিকেলে
তোমার মায়ায় আজ জীবনের অপরুপ স্তব্ধ নীরবতা|

এই ক’টি লাইন লেখার পর মনে হোল এই যে পংক্তটি ‘তোমার মায়ায় আজ জীবনের অপরুপ স্তব্ধ নীরবতা’; এর কি কোন মানে হোল? হোল কোন অর্থ?বৃষ্টিতে গাছ ভিজছে| পাতা ভিজছে ডাল সমেত| অঢেল অজস্র বৃষ্টির ধারাপাতে হয়তো প্রকৃতিতে একটি অপরুপ স্তব্দতা নেমে এসেছে| বৃষ্টির ফোঁটায় কি ব্যস্ত নাগরিক জীবনে নীরবতা আসে?আর নীরবতা আসলেই কি ভেজা পাতার মায়ায় জীবন থমকে দাঁড়ায়?কিংবা পাতার নিচের কাকগুলো খাদ্যের অভাবে উপোস থাকছে,এ জন্যেই কি জীবন থমকে আছে? এ জীবন তো মানুষের নয়, হয়তো পাতিকাকের, হয়তো কাকপক্ষীর!

এখানেই শেষ হতে পারত| কিন্ত একটি পূর্নাংগ চতুর্দশপদী লেখার অদম্য ইচ্ছেয় থামা গেল না|লিখলাম,

যারা গিয়েছিল ভিজে ছাদে উঠে আকাশের গায়ে গায়ে পাতা
সোনালী পালঙ্ক বেয়ে নেমে আসা নরম রোদের মতো জলে
তারা আজ কেউ নেই ছাদ থেকে নেমে গেছে গাছে ভেজা চুলে
বসে আছে কেউ একা যেন বাদলের সাথে তার কত সখ্যতা?

কোথায় যেন আরেকটি প্রতীকি নারী এসে দাঁড়িয়েছে এবার|জানি না, হয়তো অজান্তেই বউয়ের কথাটি মনে হতে পারে| রোদ উঠলেই ছাদে চুল খুলে দাঁড়ায়|ভেজা চুল শুকোয়| কিন্ত এখন তো বৃষ্টি|ছাদে উঠলেই ভিজে যাবে চুল|নেমে আসতে হবে বৃষ্টিতে চুল ভিজিয়ে| কোথায় আসবে? বউ তো ঘরে নেই| হয়তো গাছের ডালেই চলে গেছে ভেজা চুলে বৃষ্টিতে গা ধুঁতে কাকেদের সাথে|আর নরম রোদের মত জলে-কথাটি কি জীবনানন্দ থেকে চুরি করে নিয়েছিলাম কিংবা হতে পারে বর্নিত নারীর নরম শরীরের কথা মনে হয়েছিল তখন?

চতুর্দশপদী তো লিখতে হবে| থামলে তো চলবে না| মাত্র আট লাইন; আরও ছয় লাইন তো টানতেই হবে| টানলাম,

মরাপাতা পড়ে থেকে কেঁদে ওঠে দেয়ালের ঘেরাটোপ জলে
স্যাঁত স্যাঁতে শেওলার সোঁদা সোঁদা ঘুনে ধরা অবিকল ঘ্রাণে
জীবন বসন্ত নামে ধাবমান বরষার ব্যাকুল শ্রাবণে
নিরুদ্ধ প্রহর এসে ছুঁয়ে যায় বৃষ্টি ভেজা আমের পাতাতে|

এইবার পাতা কিংবা ডাল থেকে মাটিতে চোখ পড়লো| জল জমে আছে পাঁচিলের পাশে পড়ে থাকা পাতায় বন্ধ হওয়া ড্রেনে| প্রাচীরের নিচের অংশে শেওলা জমে গন্ধ ছড়াচ্ছে|কিন্ত এখানে কোথায় ‘ জীবন বসন্ত নামে ধাবমান বরষার ব্যাকুল শ্রাবণে”? এখনও ভাবি কেন লিখেছিলাম এই জীবন বসন্তের কথা অঝর শ্রাবণে? হতে পারে সবে সংসার শুরু করেছি; একটা ধাবমান প্রেম বসন্তের হাওয়ায় মাতাল উড়ছে|কে তাকে থামায় বৃষ্টি বাদল ঝড়ে?

আরও দু’টি লাইন চাই| ততক্ষনে কাক ভেজা হয়ে কাজ থেকে ফিরেছে বউ|রিক্সার হুডের আড়ালে থেকেও বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে স্নান সেরে ফি্রেছে যেন একটি বিষন্ন শ্রাবণ দিনে|শেষ করেছিলাম সেদিনের সে না-হয়ে ওঠা কবিতাটি এভাবে,

বিষন্ন বর্ষার দিনে শ্রাবণের স্নান সেরে ভিজে গেছে ভূমি
ভিজে যারা গিয়েছিল তার সাথে ভিজে গেছ, আমপাতা তুমি?

ইটের পাঁজার উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঢাকা শহরে কি এমন কোন উঠোন আছে যা ভিজতে পারে বৃষ্টিতে? এখন তো মাটি-ই নেই কোথাও ঢাকা শহরময়|বর্ষার দিনে ‘স্নান সেরে ভিজে গেছে ভূমি’ যে লিখেছিলাম- এটার আর কোন বাস্তবতা নেই হয়ত আর!এখন জল ঝড় বর্ষায় ভিজে শুধু মানুষ; সেই সাথে ভিজে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া প্রকৃতি আর গাছের ডালপালা লতাপাতা, যা এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে কোন উদ্যানে| কোন শ্রাবণ বিকেলে আমপাতা কি এখনো ভিজে ঢাকা শহরের কোন বাড়ির উঠোনে?

নভেম্বর ৩০,২০১২
হ্যামিল্টন, ওন্টারিও, কানাডা|