পর্ব-১, আগের পর্ব

কোরিয়া ১৯৫০: এক কিশোর সৈনিকের স্মৃতিগাঁথা (পর্ব-৩)

[বিশেষ দ্রষ্টব্য: গত পর্বে জনাব কাজি মামুন এর অনুরোধ সত্ত্বেও আমি ব্যর্থ হয়েছি মূলতঃ সময়াভাবে। সেজন্যে আগেই ক্ষমা চেয়ে নেয়াটা কর্তব্য বলে মনে করছি। তবে পড়ার ধারাবাহিকতা যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে যত্নবান থাকতে আমি চেষ্টা করবো।]

এই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে প্রত্যেক কোরিয়ান জমির মালিকের প্রতি জাপানী সরকারকে চাল সরবরাহের জন্যে একটা বাধা ধরা কোটা নির্ধারিত ছিলো। যখন জমির মালিকেরা নির্ধারিত কোটা অনুযায়ী চাল সরবরাহের জন্যে যথেষ্ট পরিমানে চাল উৎপাদনে ব্যর্থ হতো, তখন এই মালিকেরা বাধ্য হতো স্থানীয় বাজার থেকে তা ক্রয় করে কোটা পূর্ণ করে স্থানীয় জাপানী কর্তৃপক্ষের কাছে সরবরাহ করতে। জাপানী কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত কোটার কারণে মৌসুমের শেষ অবধি চলার মতো যথেষ্ট পরিমানে চাল আমাদের আর অবশিষ্ট থাকতো না। কিছু কিছু চাষী নিজেদের উৎপাদনের উপড়ে আস্থা হাড়াতো, আর আস্থা হাড়িয়ে ওরা খাদ্যের অন্বেষনে খুঁজে ফিরতো খাওয়ার উপযোগী নরম ঘাস, বুনো গাছ, শেকড় কিংবা গাছের ছাল। অনেক সময় আমি দেখেছি মা আমার চোখের জল লুকোচ্ছেন, কারণ তাঁর কাছে যথেষ্ট পরিমানে চাল নেই বাড়ির সবার অন্ন সংস্থানের জন্যে, বিশেষ করে তাঁর ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে। জাপানী সরকার সব সময়ই বলতো চাল তাদের দরকার মূলতঃ যুদ্ধরসদের জন্যে, কিন্তু আমরা জানতাম যে স্থানীয় জাপানীদের যথেষ্ট পরিমানে চাল আছে তাদের নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্যে। জাপানের দখলদারীত্বের সময় প্রচুর জাপানী এই অধিকৃত কোরিয়ায় বসবাস করতো। এমনকি তখন কোচাং এর মতো একটি ছোট্ট উপশহড়েও স্থানীয় মূল অধিবাসীদের বাইরেও একটি সংরক্ষিত জাপানী বসতি এলাকা ছিলো আর সেখানে এই যুদ্ধ কালীন সময়েও বিলাসব্যাসনে পর্যাপ্ত খাদ্যের নিশ্চয়তা সহ জাপানীরা বসবাস করছিলো। ভালোই ছিলো এই জাপানীরা, এমনকি পছন্দসই খাবারও তাদের জন্যে কোন সমস্যা ছিলো না। কারণ, অনেকদিন আগেই জাপান সরকার এক বিষদ আইনী কাঠামো কার্যকর করোছিলো, যা ছিলো আমাদের বিরুদ্ধে এক ধরনের জাতিগত বৈষম্যের নামান্তর। যা আমাদের নিজভূমে করেছিলো পরবাসী বা পরিণত করেছিলো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে। ১৯৪০ সালে কোরিয়াতে প্রায় সাত লক্ষ জাপানী নাগরিকের বাস ছিলো এবং এদের অধিকাংশই হয় সরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো নতুবা ছিলো পুলিশ বিভাগে কর্মরত।

১৯৪৫ সালে কোরিয়া যখন স্বাধীনতা লাভ করে, দেশে তখন একটা বৌদ্ধিকবৃত্তিকতা জনিত শূন্যতা বিরাজ করছিলো। বাম ভাবাদর্শগত জোটটি দ্রুত সামনের সারিতে এগিয়ে আসে, এরা কমিউনিষ্ট প্রপাগান্ডা সম্বলিত প্রচার সামগ্রী বিতরণে খুবই একাগ্র এবং সিদ্ধহস্ত ছিলো। তাদের এই গোপন অথচ ঝটিকা তৎপরতা তরুণ এবং উঠতি কিশোরদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এমনকি একটা বিশেষ আবেদনও ছিলো। সত্যি বলতে কি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কৃষকের বা শ্রমীকের উঠতি তরুণ ছেলেরা বিশেষ ভাবে এইধরনের বাম সংগঠন গুলোতে যুক্ত হতো। তবে ডানপন্থী সংগঠন গুলো এগিয়ে আসার আগে এরা সংগঠিত হতে পেরেছিলো খুবই স্বল্পতম একটি সময়ের জন্যে। অচীরেই ডান ভাবাদর্শ ব্যপক শক্তি অর্জন করে এবং নিয়ন্ত্রন নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে স্বল্প কিছু কোরিয়ান নাগরিক জাপানী ছত্রছায়ায় স্বাচ্ছ্বন্দের সাথে বসবাস করতো। অথচ আমরা সহ অধিকাংশ কোরিয়ান নাগরিকই যাপন করতাম অত্যন্ত কঠিন এবং মানবেতর জীবন। ব্যপক সামাজিক অনুশাসন ও আইনী কাঠামোর মধ্যেও এই জাপানী দখলদারীত্ত্ব মাঝে মাঝেই অত্যন্ত অপ্রীতিকর অস্বস্তির জন্ম দিত। তবে আমাদের অনেকেই মনে করতেন যে জীবন যাত্রার মান ১৯৪৫ পরবর্তী স্বাধীন দেশে জাপানী দখলদারীত্ত্বকালের চাইতে খুব একটা সুখকর হয়নি। কেউ কেউ মনে করতো, আমরা তো আমাদের নিজেদের সরকারের পরিচালনাধীনেই আছি এ সরকার তো জনগনের, এটিই আমাদের আরাধ্য ছিলো, আমরা তো আমাদের স্বাধীন মাতৃভূমিই চেয়েছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের মতোই, তখন খোলা বাজারে পর্যাপ্ত সামগ্রীর সরবরাহ ছিলো, কিন্তু তা জীবনযাত্রাকে মোটেও স্বাভাবিক করতে পারেনি, যে অভাব সেই অভাবই রয়ে গেলো, সবই আছে বাজারে কিন্তু কিছুই আমাদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নয়। আমরা আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম ঠিকই, কিন্তু হায়, আমরা যদি শুধু জানতাম কিকরে এই অর্জিত স্বাধীনতা কে ব্যবহার করতে হয়! একটা গনতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতির অধীনেই আমরা বাস করতাম, কিন্তু সত্যিই আমরা জানতাম না যে গনতন্ত্র জিনিসটা আসলে কি ছিলো। কিছু কিছু ক্ষুদ্র মনোবৃত্ত্বির মানুষেরা অন্যকে আঘাত করতে চাইতো যে, এটি তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা। পরষ্পরকে অগ্রাহ্যকরার প্রবণতা ছিলো ভয়ংকর, ছিলো অজ্ঞানতার ভীষন কালো অন্ধকার!

এই রকম এক বিশ্বজন বিস্ফোরোন্মুখ পরিবেশে তীব্র গনআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে জাপানের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্খায় আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলন, যা আমাদের দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ১৯২০ সালের পটভূমিতে। এসময় দেশে জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিষ্ট ভাবাপন্ন দুটি পৃথক ধারা অব্যাহত ভাবে গোপনে দেশের নিয়ন্ত্রনভার কুক্ষিগত করতে গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯১৯ সালের ১লা মার্চের পরে আসন্ন কর্মসূচী সহ চলমান আন্দোলন, মিছিল মিটিং এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের তৎপরতা জাপানী কর্তপক্ষ হঠাৎ বন্ধকরে দেয়। কতিপয় কোরিয়ান এসময় দেশ ছেড়ে চীন এবং তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়ে বিদেশ থেকে কোরিয়ান জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিষ্ট ভাবাপন্ন প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা জোড়দার করে। রীহ সাইংমান (Rhee Syngman) এসময় চীনের সাংহাই ভিত্তিক এ ধরনের একটি দলের তৎপরতার নেতৃত্ত্ব দিচ্ছিলেন, প্রাদেশিক কোরিয়ান সরকার নামে তার দলের তৎপরতা পরিচিত ছিলো। (রীহ হলো পারিবারিক পদবী, কোরিয়ান নামে পারিবারিক নামটি সবসময় নামের প্রথমে আসে)। কিম ইল সাঙ (Kim Il Sung) এরকম আর একটি প্রতিবিপ্লবী দলের নেতৃত্ত্বে ছিলেন। মাঞ্চুরিয়ায় ইনি গেরিলা নেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন, ১৯৩১ সালে জাপান যখন মাঞ্চুরিয়া অধিগ্রহন করে তখন তিনিই জাপানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অংশ গহন করেছিলেন। চীন-কোরিয়া বর্ডার এলাকায় কিম ইল সাঙ এবং তার অনুসারীরা এসময় এক শক্ত প্রতিরক্ষাবূহ্য রচনা করে সফল এবং প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রন আরোপে সক্ষম হন। পরবর্তীতে ইনিই যুদ্ধোত্তর উত্তর-কোরিয়া সরকারের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রকবৃন্দের মধ্যমনিতে রুপান্তরিত হন যখন তৎকালীন রাশিয়া ৩৮-সমান্তরাল রেখা বরাবর অধিগৃহীত উত্তর কোরিয়াকে সেভিয়েত ভুক্ত রাষ্ট্র সমূহের অন্তর্ভূক্ত করে একে প্রসাশনিক সহায়তা দিতে থাকে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র দায়িত্ত্ব নেয় কোরিয়ার দক্ষিনের বাকী অর্ধাংশের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তোর কালে অনেক উচ্চপদস্থ দক্ষিন কোরীয় সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ তখনো জাপানী সেনাবাহিনীর হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তাদের কিছু অংশ তখন জাপানী কোয়ান্টাং (Kwantung Army) সেনাছত্রী হয়ে চীনে জাপানী বিরুদ্ধবাদী কোরিয়ান এবং চৈনিক গেরিলা নিধনে ব্যাস্ত ছিলো। তারা জাপানীদের মতোই এমনকি তার চেয়েও বেশী ভয়ংঙ্কর এবং নৃশংস ছিলো গেরিলাদের প্রতি। ক্ষমতাধর জাপানীদের তুষ্ট করতেই তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োজিত করেছিলেন। কোরিয়ান অফিসারবৃন্দ সম্ভবতঃ এই ধারনা পোষন করতেন যে তাদের মাত্রাতিরিক্ত বর্বরতায় জাপানীদের সন্তুষ্টি আসবে পক্ষান্তরে তাদের কাছে বাড়বে বিশ্বাসযোগ্যতা এবং নির্ভরতা, যা তাদের প্রসংশা বয়ে আনবে। সুতরাং এক ধরনের ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয় সেই সব জাপান-বিরোধী বিরুদ্ধবাদী কোরিয়ান এবং চীনা গেরিলা যোদ্ধাদের মধ্যে যারা তখন চীন-কোরিয়া বর্ডারে এবং মাঞ্চুরিয়ায় বিশ্বযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধত্তোর কালে অবস্থান করছিলেন। এঁরাই পরবর্তীতে উত্তর-কোরীয় কমিউনিষ্ট সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আসন অলঙ্কৃত করেছিলেন। এইরকম এক ঐতিহাসিক ঘটনা বলয়ে অনেক অনেক দক্ষিন এবং উত্তর-কোরীয় সেনা কর্মকর্তাবৃন্দ পরষ্পর বিপরীত শিবিরে অবস্থান করছিলেন, এবং অল্পদিনের মধ্যেই তাঁরা আবার পরষ্পরের মুখোমুখী হলেন সেই পুরোনো বিবাদকে কেন্দ্র করে সদ্য বিভাজিত কোরিয়ায়, যা ছিলো মূলতঃ কোরিয়ানদের বিরুদ্ধেই কোরিয়ানদের লড়াই!