১৯৭৯ সালের ২০ নভেম্বর মক্কা নগরীর পবিত্র কাবা শরীফে ঘটে যায় এক অভূতপূর্ব ও অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। ১৪০০তম হিজরি নববর্ষকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত গোটা দুনিয়ার মুসলিম। আর ঠিক ঐ সময়টিতেই এক কলঙ্কজনক ইতিহাস রচিত হয় পবিত্র কাবার অভ্যন্তরে। দশ হাজার হাজিকে মসজিদের অভ্যন্তরে প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে জিম্মি করে রাখা হয়। ঘটনার হোতা ৩০০ জেহাদি গেরিলা। গেরিলাদের মধ্যে সৌদি, পাকিস্তানি, মিশরিয় এবং অনেক আমেরিকান নওমুসলিমও অন্তর্ভুক্ত ছিল। গেরিলাদের প্রধান এজেন্ডা ছিল সৌদি সরকারকে উৎখাত করার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ইসলামি হুকুমত ও খেলাফতের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। যদিও মুসলিম জেহাদিদের কীর্তি ছিল এটি, ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমায়নি আমেরিকা-ইসরাইলকে সরাসরি দায়ী করে বিবৃতি প্রদান করেন। পাকিস্তানের একটি পত্রিকা গুজব ছড়িয়ে দেয় যে, আমেরিকার প্যারাট্রুপার বাহিনী বিমান থেকে পবিত্র কাবার অভ্যন্তরে লাফিয়ে পড়েছে। আর যায় কোথায়? সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মত জ্বলে উঠল পাকিস্তান, ইসলামাবাদে আমেরিকান দূতাবাস জ্বালিয়ে দেয়া হল, একজন আমেরিকান কর্মকর্তাকে গুলি করা হল, রাওয়ালপিন্ডির খ্রিস্টিয়ান কনভেন্ট পুড়িয়ে দেয়া হল। এদিকে সৌদি সরকারের নিজস্ব বাহিনী গেরিলাদের দমনে ব্যর্থ হলে বন্ধু ফ্রান্স সরকারকে অনুরোধ জানানো হয় কমান্ডো বাহিনী প্রেরণের জন্য। অবশেষে ফ্রেঞ্চ কমান্ডের কাছে মুসলিম গেরিলারা হার মানতে বাধ্য হলে ভয়াবহ এই জিম্মি নাটকের অবসান ঘটে।

উপরের ঘটনাটিতে যা লক্ষণীয় তা হল, পবিত্র কাবা শরীফ কালিমালিপ্ত হয় প্রধানত মুসলিম গেরিলা ও সৌদি সরকারের নিজস্ব বাহিনীর মধ্যকার আভ্যন্তরিন দ্বন্দ্বের কারণে, তবু অঙ্গুলি হেলানো হয় আমেরিকা-ইসরাইলের দিকে। আমেরিকা-ইসরাইল যে সতি-সাধু বা ভাজা মাছটিও উল্টে খেতে জানে না, তা কিন্তু নয়। তারা অহর্নিশি ভয়ানক সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে লিপ্ত থাকে, এটা সকলেরই জানা। কিন্তু কথা হচ্ছে, তাদেরকে যে অনেক সময়ই আহবান করা হয়, এ কথাটি আমরা মাঝে মাঝে বিস্মৃত হই। যেমন, উপরের ঘটনাটির ক্ষেত্রে সৌদি সরকার ফ্রান্সকে ডেকে এনেছিল। কারোরই ভুলে যাওয়ার কথা নয়, সৌদি সরকার কিভাবে নিজেকে বাঁচাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশের শরণাপন্ন হয়েছিল প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও পাকিস্তান শেষ রক্ষা করতে মার্কিন নৌবহরের পথ চেয়ে বসে ছিল।

কথিত আছে, গাদ্দাফি তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আমেরিকাকে ২.৫০ বিলিয়ন ডলার এবং ব্রিটেনকে ১.৫০ বিলিয়ন ডলার ঘুষ দিয়েছিলেন। আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সের সাথে গাদ্দাফির ছিল গভীর মাখামাখি, গাদ্দাফি উত্তর আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী ও বামঘেঁষা শক্তিগুলোতে লিবিয়ার তেলের টাকা ডোনেট করে তাদের সাথে সখ্যতা করতেন শুধু তথ্য পেতে, যা পরে সরবারহ করতেন বন্ধু আমেরিকান ইন্টেলিজেন্সকে। এমনকি শেষ সময়েও গদি রক্ষা করতে চেয়েছিলেন প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলারের ঘুষ দিয়ে, কিন্তু ওবামা সরকারও গাদ্দাফির প্রাইভেট আর্মির মত মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয় আরব বসন্তের জোয়ারে। ফলে গাদ্দাফি আর শেষ রক্ষা করতে পারেননি।

দিন কয়েক আগে কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাইয়ের সঙ্গে ‘নাফিস’ প্রসঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। তারা ক্ষোভে, উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল। তাদের সকলেরই ধারণা, নাফিসকে বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে আমেরিকার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার মুন্ডুপাত করে যাচ্ছিল তারা সমানে, কেউ কেউ শাপশাপান্ত করছিল। আশ্চর্যের বিষয় হল, এদের একটা বড় অংশই আবার আমেরিকায় পাড়ি জমানোর আশৈশব পরিকল্পনা করে রেখেছে। কারো কারো বন্দোবস্তও প্রায় পাকা। উড়াল দেয়ার দিনক্ষণ গুনছে। এবং আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বা হালের নাফিস ফ্যাক্টর তাদের আমেরিকা প্রজেক্ট কলুষিত করছে না মোটেই। কিন্তু কেন? বিষয়টা খুব ভালভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য অধ্যাপক এবং বিশ্বখ্যাত চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদঃ

ইসলামিক বিশ্বে আমেরিকাকে(ইউএস) দেখার জন্য রয়েছে দুটি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমটি হল, ‘কি অসাধারণ একটি দেশ আমেরিকা’ টাইপের ! আমার চেনা-জানা প্রতিটি আরব বা মুসলিমেরই বিপুল আগ্রহ রয়েছে আমেরিকাকে ঘিরে। এদের অনেকেই নিজেদের বাচ্চাদেরকে শিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠান। অনেকে ছুটি কাটাতে এখানেই চলে আসেন। কেউ কেউ ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েন, কেউবা প্রশিক্ষণ লাভ করেন। আর দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গিটি দাপ্তরিক আমেরিকার (মানে, সামরিক এবং হস্তক্ষেপকারী আমেরিকা) সাথে সংশ্লিষ্ট, যে আমেরিকা ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেগের জাতীয়তাবাদী সরকারকে হটিয়ে শাহকে ফিরিয়ে এনেছিল। যে আমেরিকা উপসাগরীয় যুদ্ধে সর্বপ্রথম জড়িত হয়েছিল এবং বেসামরিক ইরাকি জনগণের উপর ভয়াবহ ক্ষতিকারক অবরোধ আরোপ করেছিল।

সাঈদের উপরের উদ্ধৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে, মুসলিম বিশ্বের ক্ষোভ আমেরিকা, তার জনগণ বা জাতীয়তার উপর নয়, বরং তার সরকার ব্যবস্থার উপর, যে কিনা বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়ায় নিজের সাম্রাজ্যবাদী ক্ষুধাকে নিবৃত্ত করার জন্য। কিন্তু এর সঙ্গে যে অবধারিত প্রশ্নটা উঠে আসে তা হল, সারা বিশ্ব চড়ে (নাকি চষে?) বেড়াবার জন্য যে বিপুল এনার্জি দরকার, তা পায় কোথা থেকে আমেরিকা? আশ্চর্য শোনাতে পারে, তবু এটাই সত্য যে, এই বিপুল পরিমাণ শক্তির মূল যোগানদাতা কিন্তু মুসলিমরাই। আমেরিকাকে অন্য কোথাও হাতড়াতে হয় না, মুসলিম বিশ্বেই তারা পেয়ে যায় কাতারে কাতারে জেহাদি, যারা আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিতে থাকে সদা প্রস্তুত। একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

Brzezinski খাইবার পাসে

১৯৮০ সালের কথা। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জিম্মি কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা Zbigniew Brzezinski খাইবার পাসে অবস্থিত পাকিস্তানের একটি মিলিটারি বেজ থেকে রাইফেল তাক করে আফগানিস্তানকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আর বলছিলেন: “আমরা তাদের গভীর ঈশ্বর-বিশ্বাসের কথা জানি এবং আমরা আত্মবিশ্বাসী যে তাদের সংগ্রাম সফল হবে। তোমদের যুদ্ধে জয় অবশ্যম্ভাবী কারণ তোমাদের নীতি সঠিক এবং ঈশ্বর তোমাদের পক্ষে রয়েছেন।“ ব্রেজেজিন্সকির সাথে ছিল পাকিস্তানি মিলিটারি কর্মকর্তাবৃন্দ, সিআইএ এজেন্ট এবং পরম-প্রিয় মুজাহেদিনগন। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কার্টারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সেদিন ঐ মুজাহেদিন গেরিলাদের জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ার জোরাল আহবান জানান। আসার পথে আফগান গোত্র প্রধানরা যখন ব্রেজেজিন্সকিকে ফুলের মালা পরিয়ে দিচ্ছিল, তখন তিনি একটা মজার মন্তব্য করে বসেন:

Friendship is a heavy burden especially around the neck.

ব্রেজেজিন্সকির উপরের মন্তব্য হতে তার রসবোধকে ছাপিয়ে একটি কঠিন সত্য বেরিয়ে আসে। আর তা হল, আমেরিকা ও তার মুসলিম বন্ধুদেশগুলোর পাতানো মিতালির প্রকৃত চেহারা। মুসলিমরা প্রায় সময়ই মালা পরিয়ে বরন করে নেয় মার্কিনীদের, আর মার্কিনীরাও সাময়িকভাবে সে মালা গলে আটকে রাখে শুধুই স্বার্থ হাসিলের তালে। আসলে বেশ কয়েক দশক ধরেই ‘গ্লোবাল ওয়ার অন কমুনিজম-’এ আমেরিকার মূল সহযোগী ছিল মুসলিমরা। এমনকি এখনো আমেরিকার ‘গ্লোবাল ওয়ার অন টেররের’ মূল সহযোগী পাকিস্তান। শুধু তাই নয়, মুসলিম বিশ্বের জাতীয়তাবাদী নেতাদের বিনাশ করতেও আমেরিকা-জেহাদি জয়েন্ট ভেঞ্জার চলেছে ব্যাপক সাফল্যের সাথে। বিশেষ করে, ৭০ এর দশকের শেষভাগে আমেরিকার জেহাদি মদদ প্রকাশ্যেই শুরু হয়ে যায়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে শুরু হয় সিআইএর স্পন্সর করা প্রায় এক দশকের জেহাদি লড়াই । অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসতে থাকে জেহাদিদের প্রশিক্ষন পুস্তক। ভাবা যায়?

তাহলে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের অন্যতম সহযোগী শক্তি খোদ মুসলিমরাই, মুসলিম জেহাদিরা। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, আমেরিকা না থাকলে এই জেহাদিদের অস্তিত্ব থাকত কি? অথবা, প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করলে, জেহাদি তৈরিতে আমেরিকার কোন ভূমিকা আছে? নাকি আমেরিকা শুধুই মদদ দিয়েছে বা ব্যবহার করেছে একটা ব্রেইনওয়াশড শক্তিকে নিজেদের স্বার্থের অনুকূলে? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, জেহাদি জোশ রয়েছে সব ধর্মেই। আর তা আপনা আপনিই গড়ে উঠে। মুসলিম বিশ্বের জেহাদিরা যে মার্কিন প্রভাবক ছাড়াই গড়ে উঠার ক্ষমতা রাখে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি এবং দেউবন্দ সুন্নি মতবাদের অন্যতম প্রবক্তা, বিশ্ব-পণ্ডিত মোহাম্মদ তাকি ওসমানির ২০০৭ সালে লন্ডন টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে,

মুসলিমদের ব্রিটেনের মত দেশে শান্তিতে বসবাস করা উচিত, যেহেতু এখানে ইসলাম চর্চার স্বাধীনতা আছে, তবে শুধু সে সময় পর্যন্ত যতক্ষণ না তারা যুদ্ধে নামার মত যথেষ্ট শক্তি অর্জন করে।/প্রশ্ন উঠতে পারে, আগ্রাসী যুদ্ধ একটা প্রশংসনীয় আমল কিনা (ধর্মমতে)? তবে এটা যদি প্রশংসনীয় আমল হয়ে থাকে, তাহলে মুসলিমদের এই কাজ হতে শুধু এই যুক্তিতে কি নিবৃত্ত থাকা উচিত যে, ভৌগলিক ভূ-সম্প্রসারণ আজকের দিনে খারাপ চোখে দেখা হয়? আর এটা যদি প্রশংসিত নাই হবে, তাহলে ইসলাম কেন অতীতে এই অগ্রহণযোগ্য কাজটি বন্ধ করেনি? এমনকি ঐ দিনগুলোতে (ইসলামের প্রাথমিক দিনগুলোতে) আগ্রাসী জিহাদ সংঘটিত হত, কারণ ধর্মের বিশালত্ব আর মাহাত্ম্য বর্ধনের জন্য এটা সত্যিকারভাবেই এক প্রশংসনীয় কাজ ছিল।

উপরের উদ্ধৃতিতে জেহাদিদের বিনা উস্কানিতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অফুরন্ত প্রেরনাশক্তির ইঙ্গিত মেলে। সুতরাং, যারা মনে করেন, আমেরিকা দৃশ্যপট থেকে বিদায় নিলেই বা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র বন্ধ করলেই মুসলিম বিশ্বে শান্তির সুবাতাস বইবে তারা হয়ত বোকার স্বর্গে বাস করছেন।

আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানুল্লাহ ১৯১৯ সালে ৪র্থ অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে ব্রিটিশ দখলমুক্ত করেন এবং সূচনা করেন অনেক যুগান্তকারী সংস্কারের। তিনি মহিলাদের জন্য শতাব্দিব্যাপি প্রচলিত ড্রেসকোডের পরিবর্তন ঘটান । ছেলে-মেয়ে উভয়ের জন্যই প্রতিষ্ঠা করেন আন্তর্জাতিক মানের স্কুল। এমন একটি আধুনিক সংবিধান প্রণয়ন করেন যাতে সমানাধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়। তিনি এমনকি বাহাই সম্প্রদায়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন, যেখানে সর্ব ধর্মের প্রবক্তাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু এইসব সংস্কার কাল হল আমানুল্লাহর জন্য। ১৯২৯ সালে আমানুল্লাহকে পশ্চিম-পন্থী আখ্যা দিয়ে উৎখাত করা হয়। অথচ এই পশ্চিমা-শক্তিকেই যে হটিয়েছিলেন আমানুলাহ, বিদ্রোহীরা সে কথা একবারও ভেবে দেখেনি। পশ্চিমী শয়তান বিহীন (মানে ব্রিটিশ বিহীন, তখন আমেরিকা দৃশ্যপটে ছিল না) আফগানিস্তান কিন্তু শান্তিতে থাকতে পারে নি, মৌলবাদের বিষ-বাষ্প শুধু আমানুল্লাহকে টেনে নামায়নি, একই সঙ্গে আফগানিস্তানের সৌভাগ্যকেও টেনে নামিয়েছে, চাপিয়ে দিয়েছে সীমাহীন দুর্ভোগের বোঝা, যা দেশটিকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

১৯৫৩ সালে ইরানের জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেগকে ব্রিটিশ মদদে অপসারণ করেন শাহ। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগও আনা হয়। ১৯ ডিসেম্বর, ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেগ কোর্টে বলেন:হ্যাঁ, আমার পাপ- আমার বৃহত্তর অপরাধ এবং এমনকি সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল যে, আমি ইরানের তেল শিল্পকে জাতীয়করণ করেছিলাম এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি কর্তৃক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের সিস্টেমটি পালটে দিতে চেয়েছিলাম। এই ঘটনা আমার জীবন এবং আমার পরিবারের জন্য খুব ব্যয়বহুল হয়েছে এবং আমার জীবন, সন্মান এবং সম্পদ হানির ঝুঁকি তৈরি করেছে। কথা হচ্ছে, মোসাদ্দেকের এই অপসারণ কিন্তু স্বয়ং একজন মুসলিমই ঘটিয়েছিলেন। আমেরিকার পুডল হওয়ার জন্য দুপায়ে খাড়া লোকের অভাব মুসলিম দেশগুলোতে কখনোই ছিল না, তবু আমাদের শতভাগ নিন্দা শুধু আমেরিকাকেই, একভাগও বরাদ্দ নেই নিজ জাতির শাসকদের উদ্দেশ্যে।

আজকের মুসলিম বিশ্বের অনেক বিদগ্ধজন মনে করেন, মুসলিমরা যদি দেড় হাজার বছর আগের জীবন ব্যবস্থায় থাকতে চায়, আমেরিকা বাঁধা দেয়ার কে? বিশেষ করে, মুসলিমরা যদি তালেবান শাসনেই সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাদের জোর করে লিবারেইট করার কোন মানে হয় না। কিন্তু প্রশ্ন তোলা যায় যে, আফগানরা যে তালেবান শাসনে সন্তুষ্ট তার কোন পরিপূর্ণ প্রমাণ মিলেছে আজ অবধি? আর যদি তারা সন্তুষ্ট থাকেও, তারপরও কি তালেবান কোপের মুখে তাদের অব্যাহত ও নিরবচ্ছিন্ন চলতে দেয়া উচিত? তাহলে আর আমরা গ্লোবাল ভিলেজের কথা বলি কেন? বিশ্বের এক কোনে কোন নৃশংসতা হলে, তাকে সেখানকার স্থানীয় ঘটনা হিসেবেই দেখা উচিত নয়কি? তাতে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর কিইবা এসে যায়?

১৯৭৯ সালে আমেরিকা প্রবাসী ইরানি লেখিকা ও অধ্যাপিকা আজার নাফিসি স্বৈরতান্ত্রিক শাহের পতনের পর দেশে ফিরে আসেন গণতান্ত্রিক ইরান গঠনে তার ক্ষুদ্র ভূমিকা রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু অচিরেই আয়াতুল্লাহ খোমায়নির কোপের মুখে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটি খোয়াতে হয়। মুক্তমনার শ্রদ্ধেয় লেখক মীজান রহমান থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাকঃ

এটা কারুরই অজানা নয় যে দেশের প্রগতিশীল যুবসমাজের বড় আখড়া হল তেহরাণ বিশ্ববিদ্যালয়। /সেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের মুক্ত পরিবেশে পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনায় প্রভাবিত ছাত্রসমাজ কোনরকম বিধিনিষেধ বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করবে না—মেনে নেবে না তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর কোনরকম গণ্ডীবদ্ধতা। তাই গোড়া থেকেই খোমায়নি সরকার সিদ্ধান্ত নেয় যে এই শয়তানকে বশ মানাতে হবে, তার ত্যাড়া ঘাড় সোজা করতে হবে। সেই উদ্দেশ্যে প্রথমেই যে উদ্যোগটি তাঁরা নিলেন সেটা হল জুম্মার নামাজ তেহরাণের অন্য কোথাও অনুষ্ঠিত না করে বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে করা। একই সাথে এলোপাথারি ছাঁটাই শুরু হল অধ্যাপকদের, কারো কারো মুণ্ডচ্ছেদ।

আজ বাংলাদেশি তরুণ নাফিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সে নিউইয়র্কের ফেড বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছিল। তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এখনো, কিন্তু প্রায় একই ধরনের অভিযোগে অভিযুক্ত আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ইতিমধ্যে সাজা ভোগ করছেন। মধ্যপ্রাচ্যে বা ফিলিস্তিনে তীব্র বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার মানুষদের আত্মঘাতী বোমারুতে পরিণত হওয়ার পেছনে কিছু যুক্তি আবিষ্কার করা গেলেও বাংলাদেশের ছেলেদের আত্মঘাতী হওয়ার পেছনে তেমন যুক্তি আবিষ্কার করা একটি কঠিন কাজই বটে। আর, দেশের বাইরে নাফিসদের বিরুদ্ধে উথাপিত অভিযোগকে আমরা কি করে এক ফুঁকে উড়িয়ে দিতে পারি, যখন আমাদের দেশেই ১৭ ই আগস্টের দেশব্যাপী বোমা হামলার নজির আছে? নাকি এগুলোও আমেরিকার কীর্তি? মজার বিষয় হল, ‘সব কিছুর পেছনেই আমেরিকা’-এই তত্ত্বকে বৈধ করতে এমনকি হাজির করা হয় যুগান্তকারী চিন্তাবিদ এডওয়ার্ড সাঈদকে। অথচ এডওয়ার্ড সাইদের ভাষায়:

যেসব মানুষ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনে হামলার পরিকল্পনা করেছিল তারা ঐসব লোকের (ফিলিস্তিনের আত্মঘাতী হামলাকারী) থেকে পৃথক, যেহেতু তার বিপদগ্রস্ত বা দরিদ্র শরণার্থী ছিল না। তারা বরং ছিল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর, ইংরেজি বলার মত যথেষ্ট শিক্ষা-জ্ঞানসম্পন্ন, বিমান চালনার স্কুলে ভর্তি হতে সক্ষম, আমেরিকা আসতে সক্ষম এবং ফ্লোরিডায় বসবাস করতে সক্ষম।

এডওয়ার্ড সাইদ একজন নেতৃস্থানীয় অপেরা ক্রিটিক এবং পিয়ানো বাদক চিলেন। তিনি আফগানিস্তানের তালেবান শাসনকে বৈধতা দেবেন এটা ভাবাই যায় না। আসলে খ্রিস্টান হিসবে জন্ম নিলেও, সাইদ ছিলেন একজন সেক্যুলার মানুষ এবং ১৯৬৭ সালেই ইসরাইলের অধিকারকে স্বীকৃত দিয়েছিলেন, যখন বেশিরভাগ আরব বুদ্ধিজীবীর এ বিষয়ে ঘোর আপত্তি ছিল। সাঈদ ‘ওরিয়েন্টালে’ প্রধানত উপনিবেশবাদ ও যুক্তির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অপবিত্র ও অস্বাস্থ্যকর বন্ধনকেই তুলে ধরেছেন। কিন্তু এই কারণে তাকে মৌলবাদী চোখ দিয়ে দেখাটা বোকামি হবে। ‘ওরিয়েন্টালের’ ১৯৯৫ সংযোজনায় সাঈদ বলেন,

কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন-এ বর্ণিত প্যালেস্টাইন সম্পর্কিত আমার মতামত এখনো ঐরকমই রয়ে গেছে; বেপরোয়া স্থানিকতা এবং জাতীয়তাবাদী গণচিন্তার জঙ্গী সামরিক প্রবণতার বিরুদ্ধে সব রকম সংরক্ষণশীল মনোভাব প্রকাশ করেছি আমি।

সাইদ আক্ষেপ করেছিলেন যে, তার গ্রন্থটির হিব্রু অনুবাদ প্রকাশ হলেও আরবি অনুবাদ হয়নি, যেহেতু উনি গ্রন্থটির অন্তর্ভুক্ত আরব শাসন বা পিএলও সমালোচনার অংশগুলি কাটছাঁট সংক্রান্ত আরবী প্রকাশকদের প্রস্তাবে রাজি হতে পারেননি।

মুসলিম বিশ্বের অনেকের চোখে, আমেরিকা একটি ধর্ষক রাষ্ট্র, যে উপুর্যপুরি ধর্ষণ করে যাচ্ছে অসহায়া মুসলিম জাতির দেহ, খুবলে খুবলে নিচ্ছে মাংস, আর দুর্বল মুসলিমরা না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। অনেক সময় কিছু মুসলিম জাতীয়তাবাদী ধৈর্য্য হারিয়ে বোমা-টোমা ফাটিয়ে ফেলে বটে, কিন্তু আমেরিকার ব্যাপক ও ক্লান্তিহীন ধর্ষণ কি এইটুকু প্রতিক্রিয়া আশা করতে পারে না? প্রশ্ন হচ্ছে, মুসলিম দেশের সাধারণ জনগণকে যদি আমরা ধর্ষিতা হিসেব কল্পনা করি, তাহলে ধর্ষণের সব দায় আমেরিকাকে দিয়ে দিলে মুসলিম দেশের শাসকদের প্রতি ঘোরতর অবিচার করা হবে না? আমেরিকান শাসকদের সাথে মুসলিম দেশের শাসকেরাও যে ধর্ষণের সমান ও সক্রিয় অংশীদার! আর জনগণের পরিবর্তে মুসলিম দেশগুলোকেই যদি ধর্ষিতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তাহলে বলতে হবে, ধর্ষক আমেরিকাকে প্রায়ই প্রেমের জোয়ারে ডেকে আনে ধর্ষিতা, কিন্তু সে যে শুধু ধর্ষিত হচ্ছে, ভালবাসিত হচ্ছে না, সে বোধ বা অনুভূতিই তার নেই।

তথ্যসূত্রঃ
১.Chasing A Mirage, Tarek Fatah
2.Orientalism, Edward Said
3.অন্যান্য ইন্টারনেট উৎস