পর্ব-২

আগের পর্ব

১৯৪১ সাল, ৮ই ডিসেম্বরের পরেই, আমি তখন ২য় গ্রেডের সৈনিক। দিনের বেলায় পতাকা সমেত আর সন্ধ্যায় লন্ঠন মার্চ করতে হতো। সে আবার জাপানী রাজসিক সৈনিকদের সম্মানে যারা তখন বৃটিশ ও আমেরিকা অধিকৃত সন্ত্রাসী এলাকা গুলোর দখল নিচ্ছিলো যেমন, হংকং, সিঙ্গাপুর এবং ম্যনিলা। আমরা তখন সৈনিক কুচকাওয়াজের নির্ধারিত রণ-সঙ্গীতটি গাইতাম আর ‘বানজাই’ ‘বানজাই’ বলে চিৎকার করে বেড়াতাম! আর আমরা বয়ে বেড়াতাম আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট এর হাস্যরসাত্মক কৌতুকাবয়ব বা বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের বাতাসে সুখময় সিগারের ধোঁয়ার কুন্ডলী উদ্গীরনের কৌতুককর ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড। খুব স্বল্পসংখ্যক উঠতি বয়েসের ছেলেরা, তখন যারা ছিলো, শিশু-শ্রমীক হিসেবে কাজ করে সেই বিশ্বময় দূর্যোগে শ্রমীক ঘাটতি পূরণ করেছিলো তারা, বিশেষতঃ ১৯৪৩ থেকে যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত। আর আমরাই ছিলাম প্রথম কাতারে, শিশু-শ্রমীক হিসেবে যারা তখন সেই ঘাটতি পূরণ করেছিলাম। যুদ্ধের কারণে আমাদের স্কুল-জীবনটা ছিলো খুবই সংক্ষিপ্ত আর পড়াশুনার সুযোগও পোয়েছিলাম খুবই কম। আসলে, সারাদিন প্রায় পড়াশুনা নিয়ে ব্যাস্ত থাকাটা শীত মৌসুম ছাড়া প্রায় হতোই না, কারণ এ সময়টাতেই ঘরের বাইরের কাজকর্ম তেমন কিছু থাকতো না। এ ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় বিশেষ করে গ্রীষ্মাবকাশেও আমরা চতুর্দিকে নানান ধরনের শ্রমসাধ্য কাজ গুলো অন্যান্য বড়োদের সাথে করে যেতাম। আমরা ঘরে তুলতাম ধান, বার্লি, আলু আর মিষ্টি-আলু, কাছে-দূরের ফসলের মাঠ থেকে। আমরা বাঁধ দিতাম সমুদ্রের জল আটকাতে, নির্মান করতাম অস্থায়ী বিমান বন্দর এবং রানওয়ে। আমার দশ বছর বয়েসে এগুলো ছিলো খুউবই শ্রমসাধ্য বিষয়। আমার বাবাকে তখন কিনতে হয়েছিলো কাঠের তৈরী ভ্যান আর পিঠের বাহক, যেটা আমি আমার পিঠে বাঁধতাম আর ওতে বইতাম পাথর আর আবর্জনা। কঠিনতম কাজ গুলো ছিলো বাঁধ তৈরীর জন্যে বিপুল পরিমান পাথর বহন করা আর বিমান আবতরণ ক্ষেত্রের ভূমি সমতল করতে অত্যন্ত ভারী রোলার টানা। সাধারনতঃ কয়েক লাখ বালক এসব কাজে নিত্য নিয়োজিত থাকতো, আর আমি নিশ্চিত যে দূর থেকে আমাদের একদল কর্মী পিঁপড়ের মতোই মনে হতো! আমার মনে নেই যে ঠিক কি পরিমান বাঁধ আমরা তৈরী করেছিলাম জাপানী মিলিটারীদের জন্যে, তবে সন্দেহ নেই যে এই পরিমানটা নেহাত অনেক বড়োই হবে। আমাদের বিদ্যালয়ের জাপানী অধ্যক্ষ বলেছিলো যে, এই শ্রম আমেরিকা এবং বৃটিশদের বিরুদ্ধে জাপান যুদ্ধের উপজাত হিসেবে আমাদের প্রচুর ভাত জোগাবে সন্দেহ নেই।

 যুদ্ধের চরম অবস্থায় জাপানী মিলিটারীদের জন্যে আমরা জড়ো করেছিলাম নষ্ট, ভাঙ্গা যন্ত্রাদি এবং বিভিন্ন ধাতবাংশ। সেতু কিংবা রেল সড়ক থেকে সরিয়েছিলাম ভারী ধাতব রেল! পঞ্চম কিংবা ষষ্ঠ গ্রেডের যারা ছিলো, প্রত্যেকের ওপড়ে নির্দ্দেশ ছিলো বাজারের থলে ভর্তি এক থলে থুজা বীজ সংগ্রহের। ১৯৪৪ এবং ১৯৪৫ সালে যতোবার আমরা জঙ্গলে গিয়েছি, প্রতিবারই এ নির্দ্দেশ আমাদের তামিল করতে হতো। থুজা হচ্ছে এক ধরনের চির সবুজ গুল্ম জাতীয় উদ্ভীদের গন, পাইন এই গোত্রের-ই অন্তর্ভূক্ত। আমাদের পার্বত্য দেশে একে খুব একটা দেখা যায়না, আর এর বীজ, যে পরিমান আমাদের জন্যে নির্ধারিত ছিলো তা সংগ্রহ করতে প্রায় পুরো দিনটাই আমাদের জঙ্গলে কাটিয়ে দিতে হতো। আমরা বলতাম, সনার (Sonar, প্রতিতরঙ্গ পরিমাপক যন্ত্র বিশেষ) যন্ত্রে ব্যবহারের জন্যে যুদ্ধাস্ত্র প্রস্তুতকারী মিলিটারী কারখানায় এ বীজ থেকে তেল নিংড়ানো হতো। এমনকি আমরা কখনো কখনো পাইন গাছের ডাল-ও সংগ্রহ করতাম যে গুলো থেকে জাপানী কোম্পানী গুলো উড়োজাহাজে ব্যবহারের জন্যে তেল প্রস্তুত করতো। আমদের বলা হতো গাছের সেই ডাল গুলো সংগ্রহ করতে যেগুলোর আগায় তেল-সমৃদ্ধ পদার্থ মজুদ থাকতো। অনেক কিশোর-বালকদের নিয়ে এই ডাল সংগ্রহ অভিযান চলতো। এভাবে শীঘ্রই সেই দিন গুলো উপস্থিত হলো, যখন এই পাইনের ডাল সংগ্রহের জন্যে আমাদের পাহাড়ের গহীনে অভিযান চালাতে শুরু করতে হলো, আর সেই সব অভিযানে প্রায়শঃই আমাদের হিংস্র বন্য জন্তু-জানোয়ারের মুখোমুখী হতে হতো যেমন নেকড়ে! আমরা সব সময় দল বেধে চলতাম করতাম কাজ, এক এক দলে থাকতো ৬ জন কিংবা বেশী, এ শুধু নিজেদের রক্ষা করার জন্যে। প্রত্যেকের হাতে থাকতো ছোট্ট একটি অস্ত্র যেমন, ছোট কুড়াল কিংবা কাস্তে। নেকড়ে গুলো আমাদের তেমন পাত্তা দিতো না। ওদের ধারালো দাঁত আর তীক্ষ্ণ শ্যেন দৃষ্টি ছিলো রীতিমতো ভয়ার্ত! এরা সব সময়ই অন্যান্য বন্য প্রাণী যেমন, খড়গস কিংবা কাঠবিড়ালী এদের নিরন্তর তাড়া করতে ব্যস্ত থাকতো। আমরা কাজ করতে গিয়ে পাইন গাছ থেকে হঠাৎ পড়ে গিয়ে কিংবা নিজেদের অস্ত্রের অসতর্ক আঘাতের ভয়েই বেশী ভীত থাকতাম।

 আমাদের এই কর্মমুখর শ্রমিক জীবনের কোন অংশেই আশেপাশের কোন স্কুল বা সংগঠনের কোন জাপানী শিশু কিংবা কিশোরের অংশগ্রহন ছিলোনা। তারা স্কুলে আসতো, পড়াশুনা করতো, আবার স্কুল শেষে স্বাভাবিক নিয়মে বাড়ি ফিরে যেতো। অধিকন্তু এই জাপানী ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের একটা আলাদা করে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতো। আমার মনে পরে যখন প্রাথমিক স্কুলে পড়ি, স্কুলে যাবার পথে আমরা রাস্তার এপাশ ধরে হাঁটলে ওরা বিপরীত পাশ ধরে হাঁটতো, থাকতোও শহরের বিশেষ কোন স্বতন্ত্র্য সম্ভ্রান্ত এলাকায়। তারা সবসময় পরিষ্কার ধোপ-দুরস্ত পোষাকে, সামঞ্জস্যপূর্ণ চামড়ার স্কুল-ব্যাগে বই-পত্র নিয়ে এবং সুন্দর রঙ্গীন রুমালে বাঁধা সুদৃশ্য কাঠের বা ধাতব লাঞ্চ-বক্স এ খাবার সহ স্কুলে আসতো। আমাদের পড়তে হতো কালো স্কুল-পোষাক যার সামনের দিকে নীচ পর্যন্ত অনেক বোতাম থাকতো এবং কখনো পা-এ মোজা ব্যবহার করতে পারতাম না এমনকি শীত কালেও। পুরানো গাড়ীর টায়ার থেকে তৈরী জুতো কিংবা চপ্পল আমরা সাধারনতঃ ব্যবহার করতাম। আমাদের কেউ কেউ আবার খড়ের (জিপসিন) তৈরী জুতোও ব্যবহার করতো। জাপানী অধীনতায় বছরের পর বছর বেড়ে উঠার সময় শীতের প্রচন্ড ঠান্ডা দিন গুলোতে ব্যবহারের জন্যে একজোড়া হাত-মোজাও আমি পাইনি কখনো।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন রেশন হিসেবে প্রদেয় প্রায় সব কিছুই ছিলো কোরিয়ানদের জন্যে, জাপানীদের জন্যে নয়। সেসময় স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রত্যেকটা রাস্তা আর আশেপাশের ঘর-বসতি ছিলো কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি রাস্তায় দশ-পনেরোটি বাড়ি জাপানী কর্তৃপক্ষের পছন্দনীয় একজন স্থানীয় কোরিয়ান কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত থাকতো। জাপানী ভাষায় এদের পদবী ছিলো ‘হ্যাঞ্চো’ (Hancho)। এঁরা এই দশ-পনেরোটি বাড়ি এবং তৎসংলগ্ন রাস্তার রক্ষনাবেক্ষন সহ যাবতীয় দায়িত্ব পালন করতেন। তবে মূল বিষয় হলো এই হ্যাঞ্চো-রা জাপানীদের খুবই কার্যকর পুতুল কর্মকর্তা ছিলেন। এরা খুবই ক্ষমতাবান ছিলেন, রেশন সামগ্রী যেমন, লবন, রাবারের জুতো এইসব কিভাবে, কাকে, কতোটুকু পরিমানে বিতরণ করা হবে, সব তাঁরাই নিয়ন্ত্রন করতেন। এমনকি স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রতিদিন যে শ্রমীক নিয়োগ করা হতো সেই সব শ্রমীক সংগ্রহ অর্থাৎ কোন বাড়ি থেকে কাকে, কখন, কোথায় নিয়োগ করা হবে, এসবই হ্যাঞ্চোরা নির্ধারন করতেন। ১৯৪৪ এবং ১৯৪৫ সালে হ্যাঞ্চোদের আরেকটা গুরুত্ত্বপূর্ণ কাজ ছিলো, স্থানীয় যুবতী এবং মাঝবয়েসী মেয়েদের নিয়ে রাস্তায় সাপ্তাহিক যুদ্ধ-প্রশিক্ষন দেওয়ানো। প্রত্যেক মেয়েরই একটা ৫ ফুট লম্বা সুঁচালো আগাবিশিষ্ট বাঁশের লাঠি ছিলো। সপ্তাহের প্রত্যেক শনিবারে সন্ধ্যায় প্রতিটা মেয়েকে দুই থেকে তিন ঘন্টা বাধ্যতামূলক অনুশীলন করতে হতো। মেয়েরা এই সূঁচালো লাঠিটিকে বেয়নেট হিসেবে ব্যবহার করতে অনুশীলন চালাতো, আর সেইসব আমেরিকান সৈন্যদের মারতে যারা তাদের শহড়ে আকস্মিক আক্রমন চালিয়ে ঢুকে পরতো। জাপানীদের অধীনস্ত থাকাকালীন শহড়ের প্রতিরক্ষার দায়িত্ত্ব মূলতঃ পালন করতো মেয়েরা, আর পুরুষেরা এমনকি উঠতি বয়েসের বালকেরাও বাধ্যতামূলক ভাবে জাপানী সেনাবাহিনীতে কিংবা শ্রমীক হিসেবে যুক্ত হতো। জাপানীরা সাধারনতঃ সব কৈশোরোত্তীর্ন কিংবা বিশ বছররের নীচের সব কোরীয় পুরুষদের বাধ্যতা মূলকভাবে জাপানী সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দিতো। বয়স্ক পুরুষেরা অন্যত্র শ্রমীক হিসেবে নিয়োগ পেতো। ফলশ্রুতিতে যা হতো, কোরীয় আবাসিক এলাকা গুলো ছিলো মূলতঃ পুরুষশুন্য বা খুউবই কম। আমি মাঝে মাঝেই আমার মা-কে দেখাশুনা করতে যেতাম। তখন দেখতাম, অসংখ্য মায়েরা এবং মেয়েরা বাঁশের লাঠির প্রশিক্ষন নিচ্ছেন। এটি ছিলো অত্যন্ত কঠিন এবং বাধ্যতামূলক শ্রমময় জীবন যা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হতো। আমরা কোরিয়ান স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং মায়েরা প্রায়ই বিব্রত হতাম জাপানী দখলদারদের হাতে।

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী ধাপে, খুবই জনপ্রিয় দ্রব্যাদি যেমন ক্যান্ডির মতো জিনিষগুলো খুবই কম দেখা যেতো কোরিয়ান দোকান গুলোতে। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে বাস যাত্রী-ছাউনীর আশে পাশে প্রায়ই আমরা কোন না কোন ক্যন্ডির দোকানের সামনে থামতাম আর ভীষন লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম বড় কাঁচের বয়ামের তলায় পরে থাকা কয়েকটা অবশিষ্ট ক্যান্ডির দিকে যেগুলো দোকানদার খুবই লোভনীয় ভাবে ওখানে সাজিয়ে রাখতেন। মাঝে মাঝে মনে হতো ইস্ যদি মাত্র একটা ‘সেন’ (পয়সা), যা ছিলো সবচেয়ে ক্ষুদ্রমানের জাপানী পয়সা,  থাকতো আমার কাছে, তাহলেই তো কয়েকটা ক্যান্ডি আমি কিনতে পারতাম তা দিয়ে। সে সময়ের দিন গুলোতে একজন কোরিয়ান স্কুল-পড়ুয়া ছাত্রের পকেটে এরকম এক বা দুই সেন পয়সা থাকাটা ছিলো এক ধরনের বিরল একটা ঘটনা। সে সময়ের অন্যান্য কোরিয়ান মালিকদের দোকানের তাক গুলো ছিলো প্রায় পণ্য শুন্য। আমি মাঝে মধ্যে দু একটা দ্রব্য কোরিয়ান দোকান গুলোতে দেখতাম ছড়ানো ছিটানো অবস্থায়। তখন কোরিয়ান দোকানদারদের একটাই কাজ ছিলো আর তাহলো হাতের পাখাটা এদিক সেদিক নাড়িয়ে অপ্রত্যাশিত মাছি তাড়ানো।