ফাক্‌! চাঞ্চল্যকর এক ব্যতিক্রমী শব্দের নাম ফাক্‌। বাংলা অনুবাদকরা কি করে যে হোয়াট দ্যা ফাক্‌ আর ইউ টকিং অ্যাবাউট কিংবা আর ইউ ফাকিং কিডিং মি এর অনুবাদ করে থাকেন সেটা কোনোভাবেই আমার মাথায় আসে না। অথবা, কেউ যদি বিশ্বখ্যাত পরিচালক Quentin Tarantino এর বিখ্যাত ফিল্ম Reservoir Dogs এর বাংলা ডাবিং বা সাবটাইটেল তৈরী করতে চান, তাহলে কি করে তিনি ফাক্‌ শব্দকে বাংলা করবেন সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। নিরানব্বই মিনিটের এই Reservoir Dogs ফিল্মটিতে সর্বমোট ২৬৯ বার, অর্থাৎ, প্রতিমিনিটে গড়ে প্রায় তিন বার করে ফাক্‌ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে পথচারী, যাজক থেকে শুরু করে জাদুকর, নায়ক থেকে খলনায়ক সবার মুখেই মানিয়ে যায় ব্যতিক্রমী এই শব্দটি। বিশেষ্য, বিশেষণ থেকে শুরু করে সর্বনাম, অব্যয়, ক্রিয়া সবগুলো রুপেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে বহুরূপী এই শব্দাশ্চার্য। আবার ভিনদেশীয় ভাষায় গিয়ে শব্দটির তীব্রতার পরিবর্তন হয়ে যায় নাটকীয়ভাবে। শুধু বাংলা প্রতিশব্দ দিয়েই যদি উপরের লাইনগুলোতে ফাক্‌ শব্দটিকে প্রতিস্থাপিত করা হয়, তাহলে রীতিমত একটা কেলেংকারীর ব্যাপার হয়ে যাবে।

এই উচ্চমার্গীয় শব্দটার কতগুলো যে রূপ হতে পারে সেটা বাস্তবে দেখতে পেরেছিলাম শিকাগো শহরে এসে। আফ্রিকান আমেরিকান এক মাসুম বাচ্চা ছিনতাইকারী যখন পিস্তল ধরে আমার সব কিছু নিয়ে যাচ্ছে (কাহিনী এখানে), তখন পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার শুধু বলেছিলাম, আমার মোবাইল ফোনটা কি না-নিলেই নয়। তারপর টানা এক মিনিট ধরে মধুময় যে বাক্যসম্ভার দিয়ে আমাকে সে চিরঋণী করে তুলেছিলো, একটা শব্দ ছাড়া সেখান থেকে কিছুই উদ্ধার করতে পারিনি; ক্ষণে ক্ষণে, বিভিন্ন রূপে ঘুরে ফিরে এসেছিলো – ফাক, ফাকিং, ফাকার, ফাকেন, ফাকড্‌। এই একটা শব্দকে বিভিন্ন আঙ্গিকে সাজিয়ে, নিমিষের মধ্যে গন্ডায় গন্ডায় বাক্য তৈরী করে গেলো সেই শব্দের কারিগর। সেদিন হয়তো তাকে ডেকে বললেই পারতাম, হে মহান! আপনি শুধু একজন ছিনতাইকারীই নন, একজন সফল ভাষাবিদও বটে, দয়া করে এই অধমকে আপনার পায়ের ধূলো দিন।

তবে শুধু ছিনতাইকারী আর গৃহহীণ ভবঘুরের দলই নয়, আমেরিকায় তথাকথিত ভদ্রলোকেরা হরহামেশাই এই শব্দটির উপযুক্ত ব্যবহার করে যাচ্ছেন। বলতে গেলে শব্দটাকে তারা প্রায় পবিত্রই করে তুলেছেন। এরা যখন বলে ইউ আর অ’’সাম, সেটার মানে ইউ আর গুড্‌। আর যখন বলে ইউ আর ফাকিং অ’’সাম, সেটার মানে ইউ আর ভেরি গুড্‌ অথবা এক্সিলেন্ট। ফাকিয় ঘরানার শব্দ যোগ না করলে প্রশংসাটা এখানে ঠিক জমে উঠে না। শুধু মনে হয়, বাক্যের মধ্যে কি-যেন একটা নেই নেই ।

আমার ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং ক্লাসের প্রফেসর ইতালিয়ান এক ভদ্রমহিলা। একদিন পড়াতে পড়াতে দেখি ক্লাসের মাঝখানে হঠাৎ লাল হয়ে উঠলেন। লালের পর নীল বেগুনী বিভিন্ন রঙ্গে রঞ্জিত হতে হতে তিনি বললেন, এমন কিছু শব্দ আছে, যেগুলো প্রসেস করতে গেলে সফটওয়্যারগুলোও তালগোল পাকিয়ে ফেলে এবং সে-সমস্ত শব্দের উদাহরন দেখতে হবে বাসায় গিয়ে টেক্সট্‌ বইয়ের মধ্যে। বাসায় গিয়ে বই খুলে দেখি, কিছু আমেরিকান মানব সন্তান ‘ম্যানহাটন’কে আদর করে যখন বলে ম্যানফাকিংহ্যাটন কিংবা অ্যাবসোলুটলিকে আরেকটু আকর্ষণীয় করে বলে অ্যাবসোব্লাডিলুটলি, মাল্টিটাস্কিংকে আরো কার্যকর করে বলে মাল্টিফাকিংটাস্কিং, সে-সমস্ত মানব সন্তানদের কথা বুঝতে গেলে সফট্‌ওয়্যারগুলোকেও একটু এ-দিক সে-দিক করে বিশ্লেষণ করতে হয়। মানেটা দাঁড়ালো, আজকাল ফাকিয় ঘরানার শব্দগুলো রীতিমত ব্যাপক গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, আমেরিকার মত এমন একটা দেশে বোধ হয় একমাত্র ইতালিয়ান মহিলাদের পক্ষেই এত অল্পতেই লজ্জায় রঙ্গিন হয়ে উঠা সম্ভব।

টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট হবার কারণে, এক সময় এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্ডারগ্র্যাড লেভেলে ক্লাশ নিতে হতো আমাকে; বিশেষ করে প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজের ক্লাশ বা ল্যাবগুলো। কিন্তু, এমন অনেক দিন গেছে যখন আমাকে কষ্ট করে মনে করতে হতো, কোর্সটার নাম ফাক্‌গ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ না-কি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজ। কিছু না বুঝলে স্টুডেন্টদের ভাষ্য হলো ফাকিং কমপ্লিকেটেড, আর বুঝলে ফাকিং ইন্টারেস্টিং। বুঝুক আর না বুঝুক, ‘ফাক্‌’ সেখানে থাকতেই হবে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার লাইন ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত টাইপের ব্যাপার-স্যাপার।

মাঝে মধ্যে আবার স্টুডেন্টদের কাছ থেকে শুনতে হয় তাদের বীরত্বগাঁথা। একজন এসে বলে, আমি গত সামারে এমন একটা মশা নিয়ে কাজ করলাম, মানুষ যেটার নামই জানে না। কিন্তু, আমি যে-কাজটা করছি, সেটা করতে পারলে সেই রকম একটা ব্যাপার হয়ে যাবে। আমি বলি, কি মশা? সে বলে, তুমি সেটা চিনবে না। সেটা একটা স্পেশাল মশা। সারাজীবন মশার সাথে গলা জড়াজড়ি করে মানুষ হলাম, আর আজ দুইদিন আগের আমেরিকান বাচ্চা, তিনদিন মশার উপর কাজ করে আমাকে বলে আমি মশা চিনবো না। আমি বলি, বলো কি নাম? সে বলে, এডিস্‌। মনে মনে বলি, আমি আসছি ঢাকা থেকে, আর তুমি আসছো আমাকে এডিস শেখাতে। এডিস্‌ বলার সাথে সাথে আমাকে আর পায় কে! উজাড় করে শুনিয়ে দিলাম সেই মশা কত ডিগ্রি কোণ করে বসে, কোথায় বাসা বাঁধে, কিভাবে বংশবৃদ্ধি করে। তৃপ্তির হাসি মুখে তুলে যেই না একটু ভাব নিতে যাবো, তখনি শুনি তার প্রতিক্রিয়া, আর ইউ ফাকিং ক্রেইজি। হাউ ডু ইউ নো অল অব দিস ফাকিং ফ্যাক্টস্‌ অন মসকিইটোজ্‌। সঠিক তথ্য দেবার কারণে সারা জীবন মানুষকে গুড! ভেরি গুড! বলতে শুনেছি। কিন্তু, এখানে এসে শুনতে হলো ফাকিং ক্রেইজি

কিন্তু, এভাবে আর কয়দিন। ভাবলাম, এর একটা বিহিত করতেই হয়। এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে করে কেউ ফাক্‌-জাতীয় শব্দ বললেই সেটাকে সাথে সাথে পরিবর্তন করে আমার নিজস্ব শব্দ বসিয়ে দেয়া যায়। অতএব, ফাক্‌ প্রতিস্থাপনের জন্য তৈরী করে নিলাম নিজস্ব এক অভিধান, সংক্ষেপে ফাকাভিধান। আমার ফাকাভিধানে ফাকিং প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় এক্সট্রিমলি দিয়ে। অতএব, কেউ যখন বলে, ইউ আর ফাকিং গুড্‌। আমি সেটাকে প্রতিস্থাপিত করে বানিয়ে নেই, ইউ আর এক্সট্রিমলি গুড। কেউ যখন বলে ফাকিং নাইস ওয়েদার, ফাকাভিধান অনুযায়ী সেটা হয়ে যায় এক্সট্রিমলি নাইস ওয়েদার

ফাকাভিধানের কল্যাণে দিনকাল একরকম ভালোই কাটছিলো। কিন্তু, বিপত্তি ঘটে হলিউডের সিনেমায় আমার প্রথম আবির্ভাবের দিনে। চলচ্চিত্রে কাজ করার জন্য জীবনে প্রথম অফার এসেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ে। সিনেমার চিত্রায়ণ হচ্ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে। নায়ক নায়িকা কলেজে পড়ে। কলেজ হিসেবে সাজানো হয়েছে শহীদুল্লাহ হলকে। আমি রুমের দরজা খুললেই দেখি কলেজের ভিতর নায়িকা অনবরত নেচে যাচ্ছেন। সিনেমার দেখানো কলেজগুলো আজগুবী; সেগুলোতে পড়তে হয় না, নাচলেই হয়। আর নায়ককে উল্টা পাশ থেকে এসে ধাক্কা দিয়ে নায়িকার খাতা বই মাটিতে ফেলে দিতে হয়। তারপর যদি সেগুলো মাটি থেকে উঠয়ে দেয়া যায় তাহলেতো কথাই নাই। নায়ক কলেজ থেকেই হয় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। কিন্তু, সমস্যা হচ্ছে কলেজ দেখালে পরিচালককেতো সেই কলেজের কিছু স্টুডেন্টও দেখাতে হবে। সেই স্টুডেন্টরা কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতর দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। তো আমার জন্য অফার হলো, কলেজ ছাত্রের ভুমিকায় দূর দিয়ে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া। যে-দিন প্রথম অফার পেলাম, সে-দিন অফার পাওয়ার সাথে সাথে চিন্তিত মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাকে বলা হলো, আরে অতো চিন্তার কিছু নাই, আপনাকে বড় পর্দায় দেখানো হবে। আমি বলি, না সেটা চিন্তা করছি না; আমাকে যে এই অফার দেয়া হলো সেটা লুকোবো কি করে সেটা চিন্তা করছি

তবে, হলিউডের পরিচালক অফার গ্রহণ কিংবা বর্জন করার কোনো সুযোগই দেয়নি। শিকাগো শহরের মাঝখানে চারদিকের রাস্তা বন্ধ করে অনেকগুলো পুলিশের গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু, সেই বিশেষ জায়গাতেই অবস্থিত এক অফিসে আমার পূর্ব নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট থাকায়, নিরাপত্তা ব্যবস্থা পেরিয়ে আমাকে ভিতরে ঢুকতে দেয়া হলো। কাজ শেষে কৌতুহলের বশে এগিয়ে গেলাম জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের গাড়ীর কাছে। রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করছিলাম হচ্ছেটা কি! হঠাৎ দেখি রাস্তার সব মানুষ উলটো দিকে পড়িমরি করে দৌঁড়ে পালাচ্ছে। সর্বশেষ ঢাকা শহরের কোনো এক হরতালে, পুলিশের তাড়া খেয়ে রাস্তার মানুষকে এমন করে দৌড়াতে দেখেছিলাম। নিশ্চয় কোনো অজানা বিপদ এ-শহরে এসেও উপস্থিত হয়েছে! সেই ভেবে ছুটে দৌঁড়ানো মানুষের সাথে আমিও দিলাম দৌঁড়। কয়েক সেকেন্ড পরেই শুনলাম- কাট্! সাথে সাথে সবাই থেমে গেলো। আমিও হতভম্ব হয়ে থেমে গেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি ক্যামেরা, বিশাল ফ্যান, সাজানো সেট। এ যাত্রায় অফার বর্জন করার সুযোগ আর পেলাম না, চলচ্চিত্রে অংশগ্রহণটা হয়েই গেলো।

কিন্তু, কোন সে মুভ্যিতে অংশ নিলাম, সেটাতো জানতে হবে। শহরে নতুন আসা বালকের মত মিনমিন করে সাইডে সরে এলাম। প্রোডাকশানের সাথে সংশ্লিষ্ট এক মেয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে, অলস ভঙ্গিতে মনিটরে দেখছে সবকিছু ঠিকঠাক রেকর্ড হচ্ছে কিনা। তাকে, জিজ্ঞেস করলাম, কোন মুভ্যি? সে আমাকে সরাসরি উত্তর না দিয়ে অনেকগুলো চেয়ারের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। সবগুলো চেয়ারের মাঝে শিল্ড আকৃতির লোগোর ভিতর ইংরেজী S অক্ষরটি লেখা। আমার আর বুঝতে বাকী থাকলো না। সাত-পাঁচ না ভেবে, তৎক্ষণাত তার দিকে তাকিয়ে গর্বের হাসি ফুটিয়ে বলে ফেললাম, ওহ্‌, S। S ফর স্পাইডারম্যান (Spiderman)। বলেই নিজের ভুল নিজে বুঝতে পারলাম। কিন্তু, ততক্ষণে ভ্রুকুঞ্চন করে মেয়েটি জবাব দিয়ে দিলো-S ফর সুপারম্যান (Superman), ইউ ফাকিং স্টুপিড্‌। তার জবাব শোনার সাথে সাথেই ভাবলাম, ফাকাভিধান দিয়ে বাক্যটাকে ঠিক করে নেয়া যাক। কিন্তু, নাহ! যখন বুঝতে পারলাম এ-যাত্রায় ফাকিংকে এক্সট্রিমলি দিয়ে প্রতিস্থাপিত করেও সুবিধা করা যাচ্ছে না, তখন নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো-ফাক্‌। সেটা বলেই সামনে তাকিয়ে দেখি, চেহারায় হতভম্ব ভাব ফুটিয়ে আমার দিকে সোজা তাকিয়ে আছে হেনরি ক্যাভিল, দ্যা ফাকিং সুপারম্যান

এই সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলিঃ রঙ্গ ভরা অঙ্গনে মোর (:: পর্ব ১ :: পর্ব ২ :: পর্ব ৩ :: পর্ব ৪ :: )

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]