অনেক কেষ্ট বিষ্টু থাকার পরও ম্যাডাম শেষপর্যন্ত তার গাড়িতে তুললেন সরলমনা লোকমানকে। জনশ্রুতি আছে, পঞ্চাশোর্ধ লোকমানের মুখে মা ডাক শুনতে বড় ভালবাসেন ম্যাডাম। তাছাড়া, লোকমানের বোকা বোকা প্রশ্নও ব্যাপক আনন্দ দেয় ম্যাডামকে, রাষ্ট্রচিন্তায় উদ্বিগ্ন ম্যাডাম ক্ষণিকের তরে খিলখিল করে হেসে উঠেন। তাছাড়া গোপনীয়তার স্বার্থে ম্যাডাম যার তার সাথে মন খুলে দু’চারটা কথাও বলতে পারেন না। কিন্তু এই সরলমনা লোকমানের সাথে তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে বাক্যালাপ করেন। ম্যাডাম ভাল করেই জানেন, লোকমান জান দেবে, তবু ম্যাডামের মান যেতে দেবে না।

লোকমানকে গাড়িসঙ্গি করে ম্যাডাম যে ভুল কাজ করেননি, তার প্রমাণ মিলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই সরলমনা লোকমান প্রশ্নের থুবড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছে। যেমন, তার প্রথম প্রশ্নটা ছিল:
‘আম্মা, আপনে টিপাইমুখের কথা কইছেন?’
ম্যাডাম হাসেন। এরকম একটা কিছুই তিনি অনুমান করছিলেন লোকমানের কাছ থেকে, বেচারা লোকমানের অস্থিরতা দূরীকরণের প্রচেষ্টা চালান, ‘টিপাই-মুখের কথা বলব না মানে? ইন্ডিয়া আশ্বাস দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন কিছু কখনোই বরদাশত করবে না।‘

‘রানি সুলতানারেও তো ইন্ডিয়া একই কথা কইছিল, আম্মা। কিন্তু ইন্ডিয়া তো কথা রাখবার পারে না। টিপাইমুখ টিপ টিপ কইরা আগায় যাইতেছে।’- উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্নে করে লোকমান।
‘দূর বোকা, সুলতানা মিথ্যা কথা বলেছে! সুলতানা হল নতজানু স্বভাবের। তাই ওকে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে একটি কিছু বুঝিয়ে দেয়, আর ও তাই গড়গড় করে বলে‘ –ম্যাডামের ত্বরিত উত্তর।

‘এইডা তো ভাইবা দেখি নাই, আম্মা। ওরা তাইলে আপ্নেরে বেজায় ভয় পায়! খুব ভাল লাগল, আম্মা। মনে পইড়া যাইতেছে, আপনে একবার এম্পিগো যে চোখ রাঙ্গানিডা দিছিলেন না! মনে আছে, চুপ বেয়াদ্দপ, হো হো, হো হো’ –লোকমানের হাসি থামতেই চায় না।
ম্যাডামও খিল খিল হাসে। লোকমানের বোকার মত হাসি দেখে না হেসে পারা যায়!

‘আইচ্ছা, আম্মা, আপনার এই সফরের উদ্দেশ্য কি?’
‘দেশটির সাথে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটানো।‘
‘দেশটির সাথে আপনাদের?’
‘হ্যা আমাদের, কেন তোমার সন্দেহ হচ্ছে?’
‘না, সন্দেহ হইব ক্যান, সম্পর্ক উন্নয়ন তো মাশাল্লা অনেক আনন্দের সংবাদ। তয় আম্মা এই অসাধ্য সাধন কেমনে করলেন? আমরা শুনছিলাম, দ্যাশের সাথে দ্যাশের সম্পর্ক হয়, কিন্তু আপনেরা একটা দল হইয়া শেষমেষ ইন্ডিয়ার মত একটা বড় দ্যাশের লগে সম্পর্ক কইরা ফালাইলেন?’

‘আচ্ছা, এতক্ষণে বুঝা গেল। তুমি আসলেই একটা আহাম্মক। আমি তো ‘আমাদের’ বলতে ‘আমাদের দেশ’কে বুঝিয়েছি। যারা দেশকে ভালবাসে, তাদের কখনো আলাদা করে ‘দেশ’ শব্দ উচ্চারণ করতে হয় না। তারা ‘আমাদের’ বললেই, বোঝা যায়, তারা ‘দেশের’ কথাই বলছে। অথচ তুমি গাধা হওয়ায় তা বুঝতে পারনি।‘

‘আসলেই, আম্মা, আমি কি বুকা। আচ্ছা, আম্মা, আপনে নিশ্চয়ই কড়া কড়া কথা শুনাইয়া দিয়া আসছেন তাগো?’
‘কড়া কথা কেন?’
‘আম্মা, আপনে কি ফেলানি, হাবু শেখের কথা ভুইল্যা গ্যাছেন? বিএসএফ যে গুলি কইরা একের পর এক সীমান্তে মানুষ মারতাছে, তা আপনে কন নাই?’
‘তুমি তো আচ্ছা বেকুব, কোন বাড়িতে বেড়াতে গেলে সেই বাড়ির লোকদের মুখের উপর কি কড়া কথা বলতে আছে? তাছাড়া, আমি ওখানে গিয়েছি আমাদের দুটি দেশের মাঝে ভগ্নিত্ব-বোধ জোরদার করার জন্য। ভগ্নিতে-ভগ্নিতে মিলে মিশে থাকতে চাই আমরা।’

‘এইডা কি কন, আম্মা, আপনে বেড়াইতে গ্যাছেন? কয়দিন আগেও তো আপনে দেশি-বিদেশি সব দখলদারদের প্রতিহত করবার ডাক দিছেন। যারা আমাগো তেল-গ্যাস-পানিসহ সবকিছু লুইটা পুইটা খাইতেছে, ট্রানজিটের মাধ্যমে দেশ দখলের পায়তারা করতাছে, বন্দর, শিল্প, বাণিজ্য সব কিছু হাতায় নেয়ার ষড়যন্ত্র করতাছে, তাগো বিষদাঁত ভাইঙ্গা দেবার আহবান তো আর কেউ না, আপনেই জানাইছেন, আম্মা অবতার। তাইলে সেই শত্রু দ্যাশে আপনে কি কইরা বেড়াইতে যাইতে পারলেন? আমি তো কিছুই বুঝতাছি না, আম্মা। মনে লয়, আমি ভুল শুনছি।‘

‘আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো তোমাকে নিয়ে! তোমাকে বুঝাই একটা। আর তুমি বোঝ আরেকটা। আমি তো তোমাকে একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। ওরা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এখন আমি তো ওদের বাড়ি যেয়ে ওদের সাথে ঝগড়া করতে পারি না। আমি বরং কাজ করছি কৌশলে। স্পষ্ট বলে এসেছি, বর্ডার কিলিং আমাদের দুটি দেশের মধ্যকার বিরাজমান চমৎকার সম্পর্ক নষ্ট করছে।’
‘চমৎকার সম্পর্ক নষ্ট করতাছে??? তার মানে, আগে সম্পর্ক ছিল?‘

‘ওহ, তুমি এসব কুটনৈতিক ভাষা বুঝবে না। শুধু আমাকে বল, আমরা কি এমন দেইনি ইন্ডিয়াকে, যা সুলতানা দিচ্ছে। তবু সুলতানা কিছু কুটনৈতিক কথা বলে সম্পর্ক ভাল করে নিয়েছে। আমিও এখন সেই কথাগুলো বলার চেষ্টা করছি। আসলে পররাষ্ট্রনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নাই, স্থায়ী শত্রু-মিত্র বলে কিছু নাই, স্থায়ী সম্পর্ক বলতে কিছু নাই, ভাল সম্পর্ক-খারাপ সম্পর্ক বলে কিছু নাই। সম্পর্ক একটা কুটনৈতিক শব্দ, বুঝলে হে বোকা লোকমান।’

‘বুঝতে পারছি আম্মা। মানে, কারো লগে সম্পর্ক থাকলে আমরা বুঝুম যে, হেই সম্পর্কের পাছায় একটা কুট নীতি কাম করতাছে, তাই না, আম্মাহুজুর? যাউকগা, আমাগো বুঝুনের কুনো দরকার নাই। আপনে বুঝলেই চলবো, আম্মা। আপনে আমাগো জননী। জননী নিজের জান-সম্ভ্রম দিয়া হইলেও সন্তানরে রক্ষা করে, এইডা আমরা জানি। তয় মনে একটা ছোটটু কৌতূহল জাগতাছে। আগে মনে হইছিল, আপনে এই দ্যাশটারে অন্তর থেকে অপছন্দ করেন।’

‘এখন যে পছন্দ করি, কে বলল? আমি সবাইকে পছন্দ করি না, বুঝলে? সবাইকে পছন্দ করতে হয় না। ভাল দেখে একজনকে বাছাই করতে হয়। যেমন, আমি পছন্দ করি বর্তমান দুনিয়ার মোড়ল আম্রিকাকে। আর বাই ডিফল্ট আম্রিকা যারে ভালবাসে, আমারও তাকে ভালবাসতে হয়।‘
‘কিন্তু আমি তো শুনছিলাম, আপনে চায়নারেও খুব ভালবাসেন।‘
‘ধুর, চায়নার কথা বলো না। ওরা দেহে যেমন ছোট, মনের দিকেও তেমন ছোট। মুখেই যত পিরীতি, কামে নাই। এই দেশে বোমা পড়লেও ওরা কিছু বলবে না। শুধু নিয়ম মাফিক মৌখিক প্রতিবাদ জানিয়ে দায়িত্ব সারবে।‘

‘আইচ্ছা, আরব দেশের লগে আপনের অনেক দহরম-মহরম, তাই না আম্মা? একজন পবিত্র মানুষ হিসেবে আপনি পবিত্র দ্যাশের সাথে সম্পর্ক রাখবেন, এইডাই তো স্বাভাবিক।‘
‘ওরাও আম্রিকার প্রেমিক। কান টানলে মাথা আসে। আমি শুধু আম্রিকারে খুশি করতে চাই, বুঝলে, শুধু আম্রিকা। তাহলেই দেখবে, কেমন সব দেশ সুড়সুড় করে আমার কাছে চলে আসবে। সুলতানার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে সবাই।‘

‘তাইলে, আপনে আপাতত আর ইন্ডিয়ার নাম মুখে লইবেন না, তাই না, আম্মা?’
‘যাকে অন্তর থেকে ভালবাসি না, ভাবছি, তার নাম আর সত্যিই মুখে আনবো না।‘
‘কিন্তু দ্যাশের মানুষ তো তাইলে এই দ্যাশের অপকর্মের কথা ভুইলা যাইতে পারে, আম্মা।‘

‘না, ভুলবে না। আনন্দের ব্যাপার হল, মানুষজন এখন শিক্ষিত হয়েছে। কোন কিছু হলে নিজে থেকেই ইন্ডিয়ার দোষ দেয়। আমাদের কিছু বলে দিতে হয় না। যেমন, লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ লোকদের উপর জরিপ করে দেখা গেছে, তাদের অনেকেই মনে করে, সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে এটা করছে বিদ্যুৎ সেক্টর ইন্ডিয়ার হাতে তুলে দেয়ার জন্য। সুতরাং, বুঝতেই পারছ ব্যাপার কত দূর গড়িয়েছে। এখন সিস্টেম আপন গতিতেই চলবে। আমাদের আর আলাদাভাবে উদ্দীপনা দিতে হচ্ছে না জনতাকে। আজ জেগেছে এই জনতা, এই জনতা….।‘

‘কিন্তু আম্রিকা তো জামাতরে আবার পছন্দ করে না, আম্মা। তাইলে জামাতরে জোটে রাইখা আম্রিকারে কেমনে ম্যানেজ করবার পারবেন?’
‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি, জামাতকে আগামী ইলেকশানে জোটেই রাখবো না।‘
‘সেকি আম্মা, তাইলে তো আমাগো ভরাডুবি হইয়া যাইতে পারে।‘

‘কেন, একানব্বই সনে তো জামাত আলাদা ইলেকশান করেছিল। যদিও তলে তলে রেখেছিলাম। এবারও এদের তলে তলে রাখব, ভাবছি। আম্রিকা কিচ্ছুটি টের পাবে না। সত্যি বলতে কি, প্রকাশ্যে ব্যাটাদের নিয়ে সত্যিই লজ্জায় পড়তে হয়! এখনো মধ্যযুগে বাস করে। ‘

‘আম্মা, একটা জিনিস জানতে ইচ্ছা হইতেছে। আপনিই কি একলাই কথা কইছেন? ওরা আপনেরে কিছু কয় নাই? ওগো তরফে কোন দাবী-দাওয়া নাইকা?’
‘হ্যা, ওরা সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছে’।
‘আপনি কি বললেন?’
‘আমি বলে দিয়ে এসেছি, আমার দেশের পবিত্র মাটি ওদের দেশের সন্ত্রাসীদের কখনোই ব্যবহার করতে দেয়া হবে না।‘
‘কিন্তু আম্মা, এই কথাডা তো রানি সুলতানার মুখেও হুনছি। কম কইরা হইলেও হাজারবার।‘

‘তুমি অকাট মূর্খ। এইটা সুলতানার বা আমার নিজের তৈরি ভাষা না। এটা হইল সরকারী ভাষা। সরকারে থাকলে যে কেউই এই ভাষায় কথা বলতে পারে।‘
‘কিন্তু আম্মা আপনে তো সরকারে নাই। তাইলে আপনের মুখে এই কথা ক্যান?‘
‘তুমি কি সময়কানা নাকি?’

লোকমান ঘড়ির দিকে তাকায়, ‘না, আম্মা, আমার সময় জ্ঞান এখনো ফকফকা। এই দ্যাখেন, আমি আপনেরে সময় কইয়া দিতিছি, এখন সকাল আট ঘটিকা, ৩১ শে অক্টোবার, ২০১২ ইংরেজি সন। আর বাংলা তারিখ হইল…’
‘ঠিক আছে, নিষ্কর্মা বাংলা তারিখ বলার কোন দরকার নেই।‘

‘কিন্তু সময়ের লগে সরকারী ভাষার কি সম্পর্ক, এইডাই তো অহন তামাত মাথায় ঢুকলো না, আম্মাবতার।’
‘তুমি চিরকালই বোকা রয়ে গেলে। সময়ের সাথেই তো সরকারী ভাব ও ভাষার সম্পর্ক। আমার বা সুলতানার কথাবার্তা বুঝতে হলে এখন থেকে ঘড়ি দেখবে সবসময়। আর সঙ্গে নির্বাচনের তারিখটাও মিলিয়ে নিও।‘

লোকমান একবার ঘড়ি দেখে, একবার ম্যাডামের দিকে তাকায়। ম্যাডাম ওদিকে উচ্চস্বরে আওড়ে যাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা,
‘দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে’।