(১)
আমেরিকান নির্বাচন হয় প্রতি চার বছর অন্তর। গোটা পৃথিবী আমেরিকার ওপর এত নির্ভরশীল, আমেরিকান নির্বাচনের প্রভাব পড়ে প্রতিটা দেশে। এই অর্থনৈতিক ডামাডোলের বাজারে আমেরিকার গুরুত্ব আরো বেড়েছে। কারন চীন, ভারত, জাপান সহ পৃথিবীর প্রায় সব উন্নত দেশের বৈদেশিক সঞ্চয় জমা আছে আমেরিকান ফেডারেল রিজার্ভে। আমেরিকান সরকার বাহাদুরের যখন ডলারের প্রয়োজন হয়, সে ডলার নেয় ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে। বিনিময়ে ফেডারেল রিজার্ভ পায় সরকারি বন্ড। এই বন্ড ফেডারেল রিজার্ভের কাছ থেকে কেনে ভারত, চীন, জাপান সহ বহুদেশ। তাদের অর্থভান্ডার সুরক্ষিত করতে। সুতরাং আমেরিকা দেউলিয়া মানে পৃথিবী দেওলিয়া হবে। ভারতের কথা ধরা যাক। ভারত সরকারের আনুমানিক আশি বিলিয়ান ডলার বা ৪০০,০০০ কোটি টাকা জমা আছে ফেডারেল রিজার্ভে। চিনের আছে তিন ট্রিলিয়ান ডলারের বেশি।

প্রশ্ন উঠবে ভারত বা চীন তাদের ডলার কেন বিক্রি করে দিচ্ছে না? তাহলেই ত আমেরিকার ওপর নির্ভরশীলতা কমে। উঁহু সেটি হচ্ছে না। কারন ভারত যে মুহুর্তে ডলার বিক্রি শুরু করবে, টাকার দাম ্বাড়তে থাকবে। এবার টাকার দাম ডলার প্রতি ৩০ এ নেমে এলে, আউটসোর্সিংই বন্ধ হয়ে যাবে। চীনের ও একই হাল। চীনের কারেন্সির দাম কমানোর একমাত্র উপায় সঞ্চিত ডলার আমেরিকাতেই জমা রাখা। এই ভাবেই ডলারএর দাম এত বেশী-যার পুরোটাই ফানুস।

১৯৭১ সালে গোল্ড বা সোনার স্টান্ডার্ড থেকে সরে আসে ডলার। এর পর থেকেই শুরু হয়েছে এই বিশাল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যার। ১৯৭১ সালের আগে আমেরিকান ডলার বাঁধা থাকত সোনা বা ফেড়ারাল গোল্ড রিজার্ভের কাছে। ১ আউন্স সোনার দাম ৩১ ডলার। অর্থাৎ আমেরিকান সরকার ইচ্ছা করলেই ডলার ছাপাতে পারত না। রিচার্ড নিক্সনের সময় আমেরিকান সরকার বুঝতে পারে ডলারের বিনিময়ে সোনার দেওয়ার ক্ষমতা ফেডারেল রিজার্ভের নেই। ডিক্রি দিয়ে ডলারকে সোনা মুক্ত করা হয়। ফলে যে কারেন্সির যুগে আমরা বাস করছি, তাকে বলে ফিয়াট কারেন্সি-অর্থাৎ ডলার বা টাকার দামের পেছনে কোন গ্যারান্টি নেই। সরকার বন্ড ছেরে ডলার ছাপাতে পারে । মানে ঘাটতি মেটাতে ইচ্ছা মতন ডলার প্রিন্ট করলেই হল। সুতরাং ভার‍ত চীন সহ পৃথিবীর সব দেশে তাদের এত কষ্টের অর্জিত সম্পদ যে ডলারে জমা রেখেছে, তা পুরো লোপাট হয়ে যেতে পারে যদি আমেরিকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রীস বা পর্তুগালের মতন পপুলিস্ট এজেন্ডাতে চলে রাজকোষ ফাঁকা করতে থাকে। এখানেই আমেরিকান নির্বাচনে মহাগুরুত্ব।

আজকে গ্রীস থেকে পশ্চিম বঙ্গ, ভারত, আমেরিকাতে সরকারের যে বাজেট ঘাটতি বা ডেফিসিট সমস্যা -তার শুরু এই ফিয়াট কারেন্সি থেকে। ফিয়াট কারেন্সি কি মারাত্মক অর্থনৈতিক সিস্টেম সেটা না বুঝলে আমরা বুঝবো না আমেরিকা, ভারত, গ্রীস সহ সব দেশের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সঙ্কটটা আসলে কি। আসলে বর্তমানে সব দেশেই চলছে একধরনের পঞ্জি স্কিম। ধার করে আগের ধারের সুদের টাকা মেটানো। সেটাও যখন সম্ভব হয় না যেমন গ্রীসে হয়েছে, তখন দেশটা পুরো শেষ। পশ্চিম বঙ্গে মমতা সরকারের ও একই হাল। তারা যে টাকা ধার করে, যা চলে যাচ্ছে আগের ধারের সুদ দিতে। এই অবস্থা এখন পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের। এবং এর মূল হচ্ছে গোল্ড স্টান্ডার্ড থেকে ফিয়াট কারেন্সিতে সরে আসা।

কিন্ত আসলে আমেরিকার কেন্দ্র থেকে ব্যাপারটা কি হচ্ছে?

আমেরিকা যত রফতানি করে, তার থেকে দ্বিগুন আমদানি করে। ফলে চীন, জাপান, ভারত, জার্মানী সব দেশেই জমা হচ্ছে ডলার। এই সব দেশের কাছে এই ডলার গুলো হচ্ছে শাঁখের করাত। যদি এরা নিজেদের কারেন্সিতে ভাঙাতে যায়, তাহলে তাদের কারেন্সির দাম বেড়ে যাবে। অর্থাৎ এখন ৫০ রুপি = ১ ডলার নেমে আসবে ৩০ রুপিতে। এতে ভারতের রফতানি বাণিজ্য বসে যাবে। ফলে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এই ডলার আমেরিকান বন্ডে বিনিয়োগ করে-যাতে টাকার দাম ঠিক ঠাক থাকে রফতানির জন্য। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটা দেশই এই ভাবে ফেডারেল রিজার্ভে নিজেদের কষ্টাপার্জিত ডলার জমা রাখে।

আর সেই টাকা খায় কে? আমেরিকান রা। কারন এই যে ডলারটা চিন বা ভারত দিচ্ছে, সেটা যাচ্ছে আমেরিকার রাজকোষের ঘাটতি মেটাতে। আর তার বড় অংশ যাচ্ছে আমেরিকান বুড়োদের বাঁচিয়ে রাখতে এবং আফগানিস্থানে ড্রোন দিয়ে মোল্লা মারার জন্যে হাইটেক পুতুল বানাতে ।

যদি এই টাকা আমেরিকা গবেষণা বা নিজেদের ইনফ্রাস্টাকচারে বিনিয়োগ করত-তাহলে চীন, জাপান বা ভারতের জমা হওয়া ডলার সুরক্ষিত থাকত। কারন এই ধরনের গবেষণা থেকে আরো নতুন নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আসত-তাতে আমেরিকার জিডিপি বাড়ত। এবং ধার করে আমেরিকাকে এই ধার শোধ করতে হত না। কিন্ত তার বদলে এই টাকাটা যাচ্ছে যুদ্ধ করতে আর বুড়োদের বাঁচিয়ে রাখতে। ডিফেন্স আর হেলথকেউয়ার আমেরিকার সব থেকে বড় শিল্প এখন -কোটি কোটি লোকের জীবিকা। এবং তাদের ডলারটা কিন্ত আসছে চীন জাপান থেকে। আমেরিকা এদেরকে মাইনা দিচ্ছে ক্রেডিট কার্ডে। এই ভাবে ত জিডিপি বাড়ে না। ফলে একটা বিরাট অর্থনৈতিক বম্বের ওপর আমরা বসে আছি। যা আমেরিকাত ত বটেই -গোটা বিশ্বের অর্থনীতি ধ্বংশ করতে সক্ষম।

(২)
আমেরিকার ২০১২ এর নির্বাচন বুঝতে ওপরে ব্যাপারটা বোঝা জরুরী। কারন আমেরিকা আসলে খাচ্ছে নাচছে স্ফূর্তি করছে অন্যের ইনকামে। এখন আমেরিকার ধার ১৬ ট্রিলিয়ান ডলারের ওপরে। যদি এই ভাবে আমেরিকার রাজস্ব ঘাটতি বাড়তে থাকে খুব স্বাভাবিক কারনেই চীন সহ সব দেশ আমেরিকান বন্ড কিনতে চাইবে না। কারন আমেরিকার দেউলিয়া হয়ে গেলে এদের সব সঞ্চয় জলে যাবে। আর আমেরিকান বন্ড বাজারে না চললে পথে বসবে আমেরিকান সরকার। সরকারী কর্মচারীদের মাইনে পর্যন্ত দিতে পারবে না।

ফলে এবারে নির্বাচনে মুখ্য ইস্যু এই দুটি- বাজেট ঘাটতি এবং বেকারত্ব। সরকারি ভাবে বেকারত্বর হার এখানে এখন ৮% এর কাছে, বেসরকারি সংখ্যাটা আরো অনেক বেশি হবে। এর পরেও আছে। গত দশ বছরে প্রতিটা আমেরিকান ফ্যামিলির ক্রয় ক্ষমতা এবং ইনকাম কমেছে প্রায় ৫% এর কাছে। ১৯৭০ সাল নাগাদ আমেরিকাতে শুধু পুরুষরাই চাকরি করত এবং সেটা করেও তারা গড়ে ৪-৫ জন সন্তান মানুষ করেছে। বর্তমানে স্বামী স্ত্রী দুজনকেই চাকরি করতে হয়। তার পরেও সংসার চলে ক্রেডিক কার্ডে! এর মূল কারন যেসব চাকরিগুলো মোটামুটি ভাল ছিল, সেগুলো এখন চীন এবং ভারতে। ফলে আমেরিকানরা তাদের বেকারত্বর জন্যে চীন এবং ভারতকেই দুষছে। চীনকে দেখে নেব, এমন ডায়ালোগ মিট রমনি অহরহ মারছেন। বাস্তব হল, রমনির কোম্পানী বেইন ক্যাপিটাল সেই সব কোম্পানীতেই বিনিয়োগ করে যারা আউটসোর্সিং করে বেঁচে আছে! ফলে ওবামা ক্যাম্প রমনির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তুলছে বারে বারে।

আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা যে তস্য বাজে সে নিয়ে সন্দেহ নেই। বাজেটে ছাঁটাই করতেই হবে। কিন্ত ট্যাক্স বাড়ানো যাবে না। আবার বাজেট ছাঁটাই মানে চাকরি ছাঁটাই। মাথায় ঘোমটা টানতে গেলে পাছা র কাপড় ওঠে। আবার তার মধ্যে ডিফেন্স ধরে রেখে দাদাগিরিও বজায় রাখতে হবে। ফলে এই ইলেকশনে, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই দুটো জিনিসই বারবার ফিরে আসছে-কি করে বাজেট ঘাটতি কমিয়ে ধার কমানো যায়। আর কি করে আমেরিকাতে আরো নতুন চাকরি সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রথমটা করতে গেলে, জনপ্রিয়তার বিপরীতে হাঁটতে হবে। আর দ্বিতীয়টা প্রায় অসম্ভব। তবুও ৫ পয়েন্ট প্ল্যান ইত্যাদি মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে চলেছেন দুই পার্থীই। ওবামা এবং রমনির চাকরি জন্য এনার্জি এবং ইউটিলিটি সেক্টরের দিকে তাকাচ্ছেন। তা বিশুদ্ধ ভাঁওতাবাজি। কারন আমেরিকানদের এনার্জি বিল তাদের বাড়ির ইনকামের ৩-৪% এর বেশি না। তাই দিয়ে ৫০,০০০ নতুন চাকরি হবে কি না সন্দেহ আছে। তেলের আমদানী কমাতে আমেরিকা সক্ষম হয়েছে। সেটাই এত অন্ধকারে আশার আলো। সেসব মিলিয়ে বড়জোর ১০০,০০০ নতুন চাকরি আমেরিকাতে সম্ভব। কিন্ত ২১০ লাখ লোক যেখানে বেকার -সেখানে ১ লাখ চাকরি ত সিন্ধুতে বিন্দু! বাজেট ঘাটতি কমাতে গিয়ে আরো বেশি লোক চাকরি হারাবে। না কমালে, ভবিষ্যতে আরো অনেক বেশি লোকের চাকরি যাবে যদি আমেরিকান বণ্ড কেও কিনতে না চায়।

ফলে সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্ত মুশকিল হচ্ছে এই অসুবিধা বা আমেরিকার করুণ অবস্থাটা কেওই স্বীকার করতে চাইছেন না। ওবামা এবং রমনি এমন ভাব করছেন যেন দুজনের হাতেই আছে ম্যাজিক জাদুকাঠি। আসলে সব শুন্য। ওবামা তাও স্বীকার করেছেন, একমাত্র ভরসা আমেরিকানদের আরো ভালভাবে গণিত এবং বিজ্ঞানে শিক্ষিত করা। সেই অনুযায়ী কাজ শুরুও হয়েছে দেখছি স্কুলগুলোতে। আগের থেকে সিলেবাস অনেক কঠিন করা হয়েছে এবং ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা এবং হোমওয়ার্কের সময় বেড়েছে। সদ্য পাশ করা ৪০% আমেরিকান গ্রাজুয়েটদের কোন চাকরি নেই। এতে কিছু হেরফের হবে না-তবে মন্দের ভাল যে, শীতঘুম ভেঙে আমেরিকান ছাত্ররা বুঝতে শিখছে বাকী জীবন আরামে কাটবে না।

(৩)
আমেরিকাতে ২০ বছর আগেও ডেমোক্রাট এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে এত ব্যবধান ছিল না। ডেমোক্রাটরা ছিল লেফট-সেন্টার, রিপাবলিকানরা ছিল রাইট সেন্টার। দুই দলেই সেন্ট্রিস্ট বা মধ্যম ধারনার লোক ছিল বেশি। মানে অনেক বেশি সেন্সিবল লোক ছিল দুই দলে-এবং যার জন্যে বিল পাশ করা সমস্যা ছিল না। বর্তমানে ডেমোক্রাটদের মধ্যে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট ইত্যাদি টাইপের অতিবাম এবং রিপাবলিকানদের মধ্যে অতিরক্ষণশীলদের জনপ্রিয়তা ক্রমবর্ধমান। ফলে কেও কারুর কথা শোনার অবস্থায় নেই। অতিবাম বনাম অতিডানের এই লড়াই এ আমেরিকার আশুলাভ শুন্য-ক্ষতির সম্ভাবনা অনেক বেশি। তবে ওবামা এবং রমনি-দুজনেই সেন্ত্রিস্ট। কিন্ত তাদের সাগরেদরা অতিবাম এবং অতিডান। এতটাই যে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদরা ধর্ষণ ঈশ্বরের ইচ্ছা বলতে দ্বিধা বোধ করেন না! এর পরেও উনারা মহিলা ভোট খুব বেশি হারাচ্ছেন না-কারন অনেক মহিলা নারীমুক্তির মতন বিমূর্ত ধারনার চেয়ে অর্থনীতি নিয়ে বেশি চিন্তিত। কারন আজকে তারাও সংসারের মেইন ব্রেড আর্নার। ফলে রিপাবলিকানরা সেক্সিস্ট, নারী বিরোধি, ইত্যাদি ডেমোক্রাটিক প্রচার খুব কাজে আসছে না। দেখা আচ্ছে আসলে আমেরিকান নারীদের অধিকাংশ ফেমিনিস্ট না-প্রাগমাটিস্ট-নিজেদের ইনকাম এবং চাকরির স্থিরতা নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত।

এমন কি বিদেশ নীতিও এই নির্বাচনে কোন প্রভাব ফেলছে না। ওবামা সরকার যে বিদেশনীতিতে সফল তা স্বীকার করছে রিপাবলিকানরাও। ওবামা বার বার করে জানাচ্ছেন ওসামাকে বধ করেছেন তিনিই। কিন্ত তা মোটেও বাজছেনা ভুখা আমেরিকান মনে। বরং মিট রমনির বারংবার গদাঘাত যে ওবামা অর্থনীতির হাল ফেরাতে ব্যর্থ সেটাই ফিরে আসছে নির্বাচনের মূল বিতর্ক হিসাবে। তাতেও কিছু লাভ নেই। এক্ষেত্রে ওবামার সাফ উত্তর হচ্ছে রিপাবলিকানদের ভুল নীতির জন্যেই দেশ ডুবেছিল। এতটাই ডুবেছিল, যে এত দ্রুত তাকে জলের ওপরে টানা সম্ভব না।

(৩)
রমনী এবং ওবামার নির্বাচনী ইস্তেহার যতই আলাদা হোক বাস্তবে যে এরা খুব আলাদা ভাবে দেশ শাসন করতে চাইছেন বা চাইবেন-তা নয়। এদের দৃষ্টিভংগীর মূল পার্থক্য ব্যাবসার ক্ষেত্রে। এক্ষেত্র ওবামা ব্যাবসা ও শিল্পের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রনের পক্ষে। মিট রমনি এর বিপক্ষে। ওবামার মতে ফাইনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রন হারালে দেশ আবার ডুববে। মিট রমনি বলছেন এত বেশি নিয়ন্ত্রন সরকার চালাচ্ছে ফাইনান্সে, পরিবেশে এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রন সংস্থায়, আমেরিকাতে ব্যাবসাই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দুজনার বক্তব্যেই অনেকটা সত্য আছে। আমার নিজেই দেখছি ডোড ফ্রাঙ্ক আইন বলে যে নতুন নিয়ন্ত্রন এসেছে ফাইনান্সিয়াল ইন্সটিটিউট গুলোর ওপরে, তাতে তাদের এবং তাদের ভেন্ডরদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতটা নিয়ন্ত্রন ব্যাবসার জন্যে ক্ষতিকর। কিন্ত পাশাপাশি এটাও ঠিক-রিপাবলিকানরা এতই নিয়ন্ত্রন ঢিলে করে দেয় যে ২০০৮ সালের মতন সাবপ্রাইম ক্রাইসিস তৈরী হয় মার্কেটে। মাঝারি পথ কেও নিতে চাইছেন না।

এখানের ব্যাবসায়ীরা প্রায় সবাই রিপাবলিকান। আর চাকুরিজীবি শ্রমজীবিদের বড় অংশ হচ্ছে ডেমোক্রাট। সুতরাং ডেমোক্রাটিক পার্টিতে লেবার ইউনিয়ান, শিক্ষক ইউনিয়ানের প্রভাব বেশি। তার সাথে আছে লিব্যারালরা। আর রিপাবলিকান পার্টি ভর্তি আমেরিকান টপ ২% ধনীদের নিয়ে। মূলত তাদের স্বার্থেই কাজ করে এই পার্টি। তবুও এরাই ক্ষমতাই আছে ৫০ টি স্টেটের ৩০ টিতেই। কারন মূলত ডেমোক্রাট দের ব্যার্থতা অর্থনৈতিক হাল ফেরাতে। আমেরিকা চলে মূলত ব্যাবসার ওপর। ব্যাবসার ক্ষতি হয় এমন আইন কোন পার্টিই আনে না-বরং দুই পার্টিই ব্যাবসার পক্ষেই কাজ করে। এর মধ্যে রিপাবলিকানরা শ্রমিক শ্রেণীর অধিকারের সম্পূর্ন বিপক্ষে এবং মুক্ত মার্কেটের পক্ষে। কোন রিপাবলিকান স্টেটে শ্রমিকদের নুন্যতম মাইনে বারে না।

প্রশ্ন উঠবে এর পরেও রিপাবলিকানরা জেতে কি করে। এর মূলকারন দুটি-(১) শ্রমিক শ্রেনী ডেমোক্রাটদের ওপর আস্থা হারিয়ে ভোট দিতে আসে না (২) রিপাবলিকানদের ধর্মীয় এবং রেস বেস। ডেমোক্রাটিক পার্টি এখন কালো, ল্যাটিনো এবং অন্যান্য ইমিগ্রান্টদের বেস। ফলে আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইউরোপিয়ান ককেশিয়ানদের বড় অংশই রিপাবলিকানদের দিকে ঝুঁকেছে। অন্যদিকে ডেমোক্রাটিক পার্টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের বেসের জন্য কিছু করতে ব্যর্থ হয়। যেমন ওবামা বড়লোকদের ওপর নিজেই ট্যাক্স বসালেন না এত দিন-আর ভোটের সময় এসে বলছেন মিট রমনি ধনীদের ওপর ট্যাক্স বসাতে চাইছেন না।

কিন্ত ওবামার ট্রাক রেকর্ডের দিকে তাকালে দেখা যাবে যখন সেনেট এবং কংগ্রেসে ডেমোক্রাট দের সংখ্যাধিক্য ছিল, উনি নিজেই বুশ জমানার টাক্স কাট বহাল তবিয়তে রেখে দিলেন! ফলে এবার ডেমোক্রাটদের মূল সমস্যা ছিল, অনেক কম ভোটার রেজিস্ট্রেশন। ওবামার ওপর ক্রদ্ধ নিম্নমধ্যবিত্তরা। তিনি কথা রাখেন নি। তার আমলে নিম্নবিত্তদের অবস্থা হয়েছে আরো অনেক বেশি করুণ। ২০০৮ সালে মাত্র ২ কোটি লোক সরকারি ফুডস্টাম্প ব্যবহার করত। ফুডস্টাম্প এখানে ব্যবহার করে গরিবরা-যাতে সরকারি সাহায্য নিয়ে সস্তায় খাবার কিনে খেতে পাঁরে । আজকে সেই সংখ্যাটা ৫ কোটিতে। এখানে ধণতন্ত্রের এমনই রূপ যে অধিকাংশ হিউম্যানিটিজের অধ্যাপকরা পর্যন্ত ফুড স্টাম্প নিতে বাধ্য হোন! আমেরিকাতে ইতিহাস, দর্শন , সমাজবিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়ান, তারা এত কম মাইনে পান ( কারন এখানে সবই ডিমান্ড সাপ্লাই কার্ভ মেনে হয়!) তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা রাজমিস্ত্রি বা ছুতোর মিস্ত্রিদের থেকে অনেক খারাপ। মোদ্দা কথা ওবামা যাই বলুন না কেন, দারিদ্র আমেরিকাতে এত বেড়েছে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন ওবামা। এই মুহুর্তে মিট রমনি ৪৮-৪৭ পয়েন্টে এগিয়ে। কিন্ত এর পরেও জিতবেন ওবামা। কারন আমেরিকান ভোটের অদ্ভুত পাটি গণিত!

(৪)

আপাতত জনপ্রিয়তা না-পাটিগণিতই ভরসা ওবামার। এখানে নিয়ম হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ভোট সরাসরি কাউন্ট হয় না। অর্থাৎ ক্যালিফোর্নিয়ার ২২ মিলিয়ান ভোটারের মধ্যে ১৪ মিলিয়ান ওবামাকে ভোট দিলে, ওবামা পাবেন কিন্ত সেই পুরো ২২ মিলিয়ান ভোট। যার ভ্যালু ৫১।

এর সবটাই যাবে ওবামার পক্ষে। তেমন টেক্সাস জিতবেন মিট রমনি-যেখান থেকে তিনি পাবেন পুরো ৪১ আর ওবামা ০।
আমেরিকার ৫০ রাজ্যের ৪০ টি রাজ্যের ফল আগে থেকে জানা। এরা হয় ডিপ ব্লু ( মানে হার্ডকোর ডেমোক্রাট) বা ডিপ রেড স্টেট ( রিপাবলিকান)।

এই পূর্ব নির্ধাতিত ফলের বাইরে আছে প্রায় ১০ টি ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট বা সুইং স্টেট-যারা যে কোন পক্ষেই যেতে পারে। এই রাজ্য গুলি হচ্ছে ওহায়ো, ভার্জিনিয়া, ফ্লোরিডা, নেভাদা, উইনকনসিন্স, ইন্ডিয়ানা ইত্যাদি । ওবামার সুবিধা হচ্ছে তিনি মিট রমনির চেয়ে ২৩১-১৯১ তে এগিয়ে শুরু করছেন। ওহায়ো এর এর সাথে আরেকটা সুইং স্টেট জিতলেই তিনি ২৭০ পেয়ে যাবেন। সেখানে রমনিকে ফ্লোরিডা, ভার্জিনিয়া সহ আরো অনেক গুলি সুইং স্টেট জিততে হবে। এর মধ্যে মোটামুটি নিশ্চিত ওবামা ওয়াহো পাবেন। কারন সেখানকার অটো ইন্ডাস্ট্রিকে বেইল আউট করে তিনি বাঁচিয়েছিলেন-রমনি ছিলেন এর বিরোধি। ফলে পাটিগণিত এবং মিট রমনির পূর্বকৃত ওয়াহো পাপের ফলে এযাত্রায় ওবামা কান ঘেঁষে পাশ করে যাবেন মনে হচ্ছে। তবে পপুলার ভোট মিট রমনি ওবামার থেকে বেশি পাবেন।

প্রথম টেলিভিশন ডিবেটের আগে প্রায় সব সুইং স্টেটে ওবামা এগিয়ে ছিলেন। এর কারন ডেমোক্রাটরা নানা ভাবে মিট রমনিকে আস্ত রামছাগল প্রতিপন্ন করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্ত প্রথম ডিবেটে রমনি ওবামাকে বিরাট সারপ্রাইজ দেন-সেটা হচ্ছে রমনি আমেরিকানদের সামনে তুলে ধরেন, তিনি অতিডান না-তিনি মডারেট। আমেরিকা অতিবাম বা অতিডান পছন্দ করে না। তারা বরাবরের জন্য মডারেট প্রেসিডেন্টকেই ভোট দিতে ইচ্ছুক। এই প্রথম ডিবেটে ওবামার পতনের ফলে সুইং স্টেট ফ্লোরিডা এবং ভার্জিনিয়াতে মিট রমনি ওবামার চেয়ে এগিয়ে যান। ফলে যে নির্বাচন ওবামার জন্য প্রায় নিশ্চিত ছিল, তা হয়ে যায় চরম অনিশ্চিত। তবে ওহায়োর ভোটাররা ওবামার প্রতি কৃতজ্ঞতার জন্য ডিবেট দেখে সুইং করেন নি। শুধু এই রাজ্যের লোকেদের কৃতজ্ঞতা এযাত্রায় ওবামাকে বাঁচাবে। বলা যেতে পারে মিট রমনি হারবেন তার শুধু একটি লেখার জন্য-সেটি হচ্ছে তিনি ৪ বছর আগে একটি উত্তর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, যেখানে তিনি ওবামার অটো বেইল আউটের বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্ত এই বেইল আউটের জন্য ওহায়ো রাজ্যটাতে অটো শিল্প টিকে আছে। ফলে এই রাজ্যে মিট রমনি ভিলেন।

যাইহোক এখন ওবামার নির্বাচন প্রায় নিশ্চিত। যদি না ওহায়ো ঘুরে যায় এই দুদিনে।