এক)

কাজীর দিঘীর পাড়ে তালগাছের মতো সটান দাঁড়িয়ে আছে গাছটি।কিন্তু সটান দাঁড়িয়ে থাকলেও কোথায় যেন একটু গাম্ভীর্য আছে ওটার।ফলে,তালগাছের মতন বিদ্রোহী বিদ্রোহী ভাবটা ওর নেই।কিছুটা যেন সেই বৃদ্ধের মতো যার ভেতরের জ্বলজ্বলে যৌবন এক বিরাট সময় ধরে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার ছোঁয়ায় একটি স্নিগ্ধ এবং প্রশান্ত রূপ ধারণ করে আছে;বিনয়ী এবং প্রাজ্ঞ বলে যার দৃষ্টিতে ঝরে পড়ে স্নেহ;যিনি ধ্যানী সাধুর মতো আত্নমগ্ন হয়ে থাকেন নিজের ভেতর।এই গাছটিও ঠিক তেমন।এর বিক্ষিপ্ত ডালপালাগুলোকে আলাদা আলাদা করে দেখলে সেই তরুণের মতোই বিদ্রোহী মনে হয়;কিন্তু যদি একবার জমাট মেঘের মতো সেই ডালপালাগুলোর সন্নিবেশনের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হয় তবে খুব সহজেই চোখে পড়ে এর শান্ত ও স্নিগ্ধ রূপটি।শুধু মানুষেরাই এর স্নিগ্ধতায় আকৃষ্ট হয় না;শত শত পাখিও পরম সুহৃদের মতো একে আঁকড়ে ধরে থাকে।এক বিস্তৃত পরিসর জুড়ে এর ছায়া পড়ে;পাখি ও গাছের ছায়া একাকার হয়ে যায়।এই কাজীর দিঘীর পাড়ে কেউ এলেই সে অন্তত খানিকক্ষণ জিরিয়ে যায় গাছটির নিচে;গাছটি যেন ওদের আগমন প্রত্যাশা করে;ওরা কাছাকাছি এলেই যেন এর ডালপালাগুলো মৃদু দোল দিতে থাকে;ধীরে ধীরে যেন বইতে থাকে শান্ত বাতাস।গাছটি কিন্তু একাকী দাঁড়িয়ে থাকে না;তার আশেপাশে বড়ো হতে থাকে তার সন্তান সন্ততিরা;যদিও মানুষের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে যায় বেশিরভাগ;ছাগলে খেয়ে ফেলে কিংবা এমনিতেই শুকিয়ে মরে যায়।গাছটি কিন্তু হতদ্যোম হয় না;সে তার মোটা মোটা শিকড়গুলোকে প্রসারিত করে দিতে থাকে আশেপাশে;ফলে তৈরী হয়ে যায় চমৎকার বসার জায়গা।গাছটির ঝাঁকড়া ডালপালাগুলোকে ভর করে বিশ্রাম নেয় অসংখ্য পাখি;আর শেকড়ের উপর ভর দিয়ে বিশ্রাম নেয় মানুষজন;কখনো কখনো মেতে উঠে আড্ডায়।গ্রামের বৃদ্ধ কাসেম আলীও পড়ন্ত বিকেলে কিংবা পড়ন্ত দুপুরে এখানে,এই গাছের নিচে,এসে বসে থাকে;তাকে ঘিরে তৈরি হয় ছোটখাট জটলা।তাস খেলতে আসা বেকার তরুণেরাও মাঝে মাঝে যোগ দেয় সেই আড্ডায়।ওরা আসলেই কাসেম আলী চঞ্চল হয়ে উঠে।তার দৃষ্টি তীক্ষ্ম থেকে তীক্ষ্মতর হতে থাকে ক্রমাগত।তার কথায় জড়ো হতে থাকে পুরনো দিনের কাহিনীগুলো।কাসেম আলী বলে, এই জমানাটা নষ্ট হইয়া গেছে।চোর বাটপারে ভইরা গেছে পুরা দুনিয়া।আদব কায়দা উইঠ্যা গেছে দুনিয়া থেইকা।এই যে তোরা আমার সামনে বিড়ি টানতাছস,আমাগো আমলে এইসব চিন্তাও করা যাইতো না।বড়দের থেইকা একশ হাত দূরে থাকতাম আমরা।
রিপন বাগড়া দিয়ে উঠে, যত্তসব মিছা কতা।তুমাগো আমলেও চুরি ডাকাতি হইতো;বাটপাড়ি হইতো;গেরামে গেরামে মারামারি হইতো।হুদাই বইকো না।
কাসেম আলী বলে, সেইসব হইতো…মিছা কতা কমু না।তয় তোগো মতন হগলেই এমুন আছিলো না।তুই জিগাইছ তোর দাদারে।গেরামের বুড়াগো কাছে জিগাইছ।তহন এক জমানা আছিলো।
বলতে বলতে কাসেম আলী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।গাছের প্রশস্ত শিকড়ে হাত বুলাতে থাকে সে।তারপর হঠাৎ বলেই ফেলে, বিশ্বাস না হইলে গাছটারে জিগা……গাছটার অনেক বয়স।
এবার সবাই হো হো করে হেসে উঠে।কবির হাসতে হাসতে বলে, ও দাদা, তোমারে আসলেই ভীমরতিতে ধরছে।কবিরাজের কাছে যাইবা না ডাক্তরখানায় যাইবা?
কাসেম আলীর রাগ হয় না।সে জানে,কথা বলার সময় মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে।আর সেই দূর্বল মুহূর্তেই গাছটির কথা বেড়িয়ে আসে তার মুখ থেকে।এরকম আরো বহুবার হয়েছে।কিন্তু ঠিক কোন কারণে এ রকম হয় তা আজো তার কাছে পরিষ্কার হয় নি।তবে ঠিকমতো আন্দাজ করতে না পারলেও একটি ব্যাপার কাসেম আলীর কাছে পরিষ্কার যে, গাছটিকে সে সত্য সত্যই ভালোবাসে।কাসেম আলীর মনে পড়ে তার দাদার কথা।এই গাছের তলায় বসেই তার দাদা জমীর আলী তাকে শুনিয়েছিলো এই গাছটির কথা।কীভাবে একদিন ক্ষেতের কাজ শেষ করে সন্ধ্যা নাগাদ এই পুকুর পাড়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো সে;কীভাবে সে দেখতে পেল সংকুচিত হয়ে বেড়ে উঠা চারাটিকে;এবং কী মনে করে সে এর চারপাশে বেড়া দিয়ে দিলো যেন গরু ছাগলে ওটিকে খেয়ে না ফেলে;- এ সব কিছুই কাসেম আলীকে শুনিয়েছিলো জমীর আলী।বহুকাল ধরে এ সরকারী খাস জমিতে তার দাদা জমীর আলীর চিহ্ন বহন করে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি।গাছটি বহন করছে তার বাবা সিদ্দিক আলীর স্মৃতিকেও;এবং জীবনের এ পড়ন্ত বেলায় এসে কাসেম আলী হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলো এ গাছটিতে জড়িয়ে গেছে তার জীবনের উজ্জ্বল ও অনুজ্জ্বল স্মৃতিগুলোও।এ কারণেই হয়তো কাসেম আলীও ভালোবাসে গাছটিকে।হয়তো এ কারণেই হঠাৎ হঠাৎ কথার খেই হারিয়ে ফেললে গাছটির কথাই সর্বাগ্রে উঠে আসে তার মুখে।কাসেম আলী মৃদু স্বরে বলে, হাইসো না মিয়ারা;গাছের মর্ম তোমরা কী বুঝবা!আমি বুঝি, আমাগো তিন পুরুষের চিহ্ন আছে এ গাছটার ভিতরে।
রুমু মুন্সী বলে, আমি যে দাদা হুনলাম গাছটা নাকি কাইটা ফেলবো।
কাসেম আলী জ্বলজ্বলে চোখে তাকায় রুমু মুন্সীর দিকে।গম্ভীর স্বরে সে বলতে থাকে, তোমরা কিন্তু বাঁধা দিও মিয়া।এই গাছ তোমাগো তিন পুরুষের স্বাক্ষী।এইটা গাছের রাজা বটগাছ।চাইয়া দেখ, কেমুন রাজার মতন আমাগো দিকে চাইয়া রইছে।
রুমু মুন্সী উপরের দিকে তাকায়।গাছটি এক বিরাট ছাতার মতন তার ডালপালাগুলো মেলে দিয়েছে এক বিরাট শূন্যে।সে শূন্যতার দিকে তাকালে মাথা ঝিঁম ঝিঁম করে উঠে।একটা হাহাকার বেজে উঠে কোথাও।রুমু মুন্সী এ ভাবে ভাবলেও ঠিক মতন কথাগুলো গুছিয়ে বলতে পারে না।তাই সে অন্য কথা পাড়ে-‘হুনছি চ্যায়ারম্যানের লোকেরা এইটার নিলাম পাইছে।সরকারী কাম বন্ধ করমু কেমনে?
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে।সেদিনকার মতো আড্ডা শেষ হয়।
দুই)
সরকারী কাজ সফলভাবেই সম্পন্ন হয়।আকাশের মতন এক বিরাট শূন্যতার দেখা পায় সবাই।এ শূন্যতার মধ্য দিয়ে তাকালে ঐ দিকের দূরের কাসিমনগর গ্রামটি স্পষ্ট হয়ে উঠে।কয়েকদিন কিছু কিছু পাখির আনাগোনা দেখা যায়।তারপর সব কিছুই আবার স্বাভাবিক হতে থাকে।বৈকালিক আড্ডার স্থল পরিবর্তন হয়।মাঝে মাঝে এখানে ওখানে ঊঁকি দেয় পুরনো মৃত শেকড়।এর উপরে এসেই কেউ কেউ বসে।স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা হয়তো চলে ওদের মাঝে।এরই মধ্যে,কয়েকদিন কেটে গেলে, একদিন গ্রামের লোকেরা সচকিত হয়ে উঠে।খবর পাওয়া যায়, যেখানে গাছটিকে কাটা হয়েছে সেখানে জমে আছে অস্বচ্ছ আঠালো পানি।তারপর উৎসাহী লোকদের নানারকম কল্পনা আর পরিকল্পনার ফানুস নিভে গেলে ব্যাপারটির ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।গাছটি মাটির যে গভীরে প্রবেশ করে আঁকড়ে ধরেছিলো মাটিকে,সেই গভীরে থাকা অংশটি এখনো তুলে নেয়া হয়নি।সেখান থেকেই এ কয়েকদিনে নিঃসৃত হয়েছে এ আঠালো রস;আশেপাশের মাটি ভিজে ভিজে গেছে সে রসে।
কাসেম আলীর কাছেও এ খবর যায়।গাছটি কেটে ফেলার পর এ-কয়েকদিন তাকে আর এদিকটায় দেখা যায় নি।খবরটি শোনা মাত্রই সে উত্তেজিত হয়ে দৌঁড়ে আসে।তারপর গর্তে থাকা আঠালো রসে সোজা হাত ডুবিয়ে দেয়;কিছুক্ষণ বিড়বিড় করে কীসব বলে সে;-লোকজন তার কথা শুনতে পায় না;অথবা শুনতে পেলেও ঠিকমতো বুঝে উঠে না।তারপর এক ঝটকায় হাত উঠিয়ে সে চিৎকার করে বলে, এই কালু, এই মিজাইন্যা এইটা কী তোরা কইতে পারস?……এইটা আঠা নারে হারামজাদা।এইটা আঠা না……এইটা গাছটার চোখের পানি।তোরা বুঝতে পারছ নাই…তোরা বুঝতেও পারবি না।

সবাই বিস্ময়ের দৃষ্টিতে কাসেম আলীর দিকে তাকায়।তারা দেখতে পায় কাসেম আলীর আঙ্গুলের ডগা থেকে কনুই পর্যন্ত লেপ্টে যাওয়া অস্বচ্ছ তরল অশ্রুবিন্দু হয়ে টিপ টিপ করে ঝরে পড়ছে বিক্ষত ভূমিতে।বটের অশ্রুবিন্দুতে চিক চিক করছে ক্ষতস্থান।