না, এটি কোন  ভাবগম্ভীর প্রবন্ধ নয়। আমার ফেসবুকের একটা সামান্য স্ট্যাটাস ছিল এটি।  দু’জন প্রভাবশালী মানুষ – যারা মানবতাকে অকুন্ঠভাবে সমৃদ্ধ করেছেন – তারা চলে গেলেন, কিন্তু ব্লগে কোন লেখা এলো না। তাই ব্লগেও দিয়ে দিলাম। লেখাটাকে কোন সাহিত্যিক মূল্যায়ন নয়, স্রেফ শোকগাথা হিসেবে নিলেই বাধিত হব।
:line:

আমার দু’জন পছন্দের মানুষ চলে গেলেন পর পর … কয়েক দিনের মধ্যে।

 

এদের একজনকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় তো লেখা হয়েছেই, আমার ফ্রেন্ডলিস্টের অনেকেই স্ট্যাটাস দিয়েছেন, কেউ বা প্রবন্ধও লিখেছেন। ইনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (মৃত্যু: ২৩ অক্টোবর, ২০১২)। বলতে বাধা নেই, সুনীলের অনেক কিছুই আমাকে প্রভাবিত করেছে। ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘মনের মানুষ’ এর মতো  গল্প উপন্যাস তো আছেই, তালিকায় আছে অগনিত কবিতাও। ‘কেউ কথা রাখেনি’ কিংবা ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ’ এর মত কবিতাগুলো আমাকে আচ্ছন্ন করতো, এখনো করে পুরোমাত্রায়। আমার মনে আছে আমার অবিশ্বাসের দর্শন বইটার ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’ অধ্যায়টায় উল্লেখ করেছিলাম সুনীলের ‘একটা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে’ কবিতার  সেই বিখ্যাত লাইনগুলো –

‘ … এতগুলো শতাব্দী গড়িয়ে গেল, মানুষ তবু ছেলেমানুষ রয়ে গেল
কিছুতেই বড় হতে চায় না
এখনো বুঝলো না ‘আকাশ’ শব্দটার মানে
চট্টগ্রাম বা বাঁকুড়া জেলার আকাশ নয়
মানুষ শব্দটাতে কোন কাঁটাতারের বেড়া নেই
ঈশ্বর নামে কোন বড় বাবু এই বিশ্ব সংসার চালাচ্ছেন না
ধর্মগুলো সব রূপকথা
যারা এই রূপকথায় বিভোর হয়ে থাকে
তারা প্রতিবেশীর উঠোনের ধুলোমাখা শিশুটির কান্না শুনতে পায় না
তারা গর্জন বিলাসী … ’

সুনীলের পুরো কবিতাটি এক সময় ইংরেজীতে অনুবাদ করেছিলেন ড. জাফরউল্লাহ ইংরেজী ভাষাভাষী পাঠকদের জন্য। অনুবাদটি রাখা আছে এখানে

আর দ্বিতীয়জন হচ্ছেন পল কার্জ [Paul Kurtz] (মৃত্যু: ২০ অক্টোবর, ২০১২)। ইনি হয়তো বাঙালীদের মধ্যে সেরকমভাবে পরিচিত নন। কিন্তু যারা যুক্তিবাদী এবং বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের আন্দোলনে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত তারা পল কার্জকে খুব ভালভাবেই চেনেন। তিনি বিখ্যাত ‘Center for Inquiry’র প্রতিষ্ঠাতা, প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ‘Committee for the Scientific Investigation of Claims of the Paranormal’ (যেটা CSICOP নামে পরিচিত)-এরও। ভারতে প্রবীর ঘোষরা যেমন, ঠিক তেমনি পাশ্চাত্যে সংশয়বাদী আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন পল কার্জ। তিনিই ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জন্য সূচনা করেছিলেন ‘সেক্যুলার হিউম্যানিজম’ নামের শক্তিশালী আন্দোলনের। একটা সময় আইজ্যাক আসিমভ কিংবা আজকের দিনের ভিক্টর স্টেঙ্গর, জর্জ স্মিথ সহ বিখ্যাত লেখকদের মুক্তচিন্তার বইগুলো ‘প্রমিথিউস বুক হাউস’ থেকে বেরুচ্ছে সেই প্রমিথিউস বুক হাউসও কিন্তু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পল কার্জ। আমাদের মুক্তমনা আন্দোলনের সাথেও উনি প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে সবসময় ছিলেন। প্রথম দিকে আমার সাথে ইমেইলে যোগাযোগ ছিল। উনার প্রবন্ধগুলো অনুবাদ করার অনুমতি তিনি দিয়ে রেখেছিলেন মুক্তমনাকে। মনে পড়ছে খুব উৎসাহিত হয়ে আমি আর জাহেদ আহমদ মিলে একবার পল কার্জের একটা ইংরেজি লেখা  ‘কেন আমি সংশয়বাদী?’ :pdf: শিরোনামে অনুবাদ করেছিলাম। লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তান্বেষা পত্রিকায়। উনি পরে জানতে পেরে খুব খুশিও হয়েছিলেন। আজকে ধর্মান্ধরা যেভাবে রিচার্ড ডকিন্স কিংবা  স্যাম হ্যারিসদের যমের মত ভয় পান, আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকে তারা ঠিক সেভাবে ভয় পেতেন পল কার্জকে।  মূলত:  আজকের যুগের প্রবীর ঘোষ, রিচার্ড ডকিন্স, স্যাম হ্যারিস, স্টেঙ্গরেরা পল কার্জেরই কাজের সফল উত্তরসূরি।  কার্জের একটি বিখ্যাত উক্তি  মনে পড়ছে –

“No deity will save us; we must save ourselves.”

হ্যা, তারা চলে গেছেন। কিন্তু এ চলে যাওয়া আমাদের কাছে ‘প্রস্থান’ নয়। বরং তাঁরা রয়েছেন আমাদের মত মুক্তমনাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে।

সুনীল এবং পল কার্জের স্মৃতির প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।