IMG_4315

উপরের আলোকচিত্রটি আফ্রিকায় আদিম মানুষের ব্যবহার করা ১২ লক্ষ বছরের একটি পুরনো প্রস্তরকুঠারের, তাঞ্জানিয়ার পাওয়া অসাধারণ যন্ত্রটি এখন আছে লন্ডনে অবস্থিত ব্রিটিশ জাদুঘরে। মনে পড়ে ধোঁয়াটে শৈশবে স্কুল বইতে ছিল আদিমানুষের ব্যবহৃত পাথরের অস্ত্রের কিছু হাতে আঁকা ছবি, তাতে যেন বেশ দায়সারা ভাবে তৈরি কিছু ছুঁচালো পাথর খণ্ড- অস্ত্রের নিপুণতা নেই সেখানে। বিশেষ করে সাধারণ জ্ঞানের একই বইতে মনে হয়েছিল স্রেফ একটা ডিমভাজার ছবি কোনমতে বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু গত মাসে যখন সামনাসামনি এই অসাধারণ সৃষ্টিটির মুখোমুখি হলাম, অবাক বিস্ময়ে দেখলাম কি ধারালো সেই আগ্নেয়শিলায় তৈরি কুঠারের ধার গুলো, কত যত্নের, পরম মমতায়, বিপুল সময় ব্যয় করে নিখুঁত করে তোলা হয়েছে প্রতিটি ইঞ্চি। আমাদেরই আদিপুরুষরা বন্ধুর পরিবেশে টিকে থাকার জন্য আবিস্কার করেছিলেন এমন মহাস্ত্র। তাঞ্জানিয়ার বিখ্যাত ওলডুভাই গর্জে পাওয়া গেছে বলে কুঠারটির নাম
সেই স্থানের নামেই রাখা হয়েছে, আর এখানে আছে কয়েক মিনিটের এক চমৎকার ভিডিও-
http://www.bbc.co.uk/ahistoryoftheworld/objects/I3I8quLCR8exvdZeQPONrw

কিন্তু ব্রিটিশ জাদুঘরের সবচেয়ে প্রাচীন বস্তু কিন্তু এই প্রস্তরকুঠার নয়, সেটি ওলডুভাই গর্জেই পাওয়া ১৮ লক্ষ বছরের নিচের ছবির পাথরের যন্ত্রটি, যার সাহায্যে মূলত শিকারের চামড়া ছিলে মাংস কাটা হত। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী লুই লিকি ১৯৩১ সালে ওলডুভাইতে অভিযান চালানোর সময় এটি খুঁজে পান, এবং সেই অভিযানের স্পন্সর ব্রিটিশ জাদুঘরের কাছে সমর্পণ করেন।

IMG_4307

কুঠারটির নিচে লেখা আছে যে এটি ব্রিটিশ জাদুঘরের প্রাচীনতম সংগ্রহ এবং ছবির ও চিত্রকর্মের সাহায্যে বোঝানো হয়েছে যে কি করে এটি ব্যবহার করা হত।

বাকী ৩টে প্রস্তরকুঠারই যত দূর মনে পড়েছে ৫০,০০০ থেকে ৭০,০০০ বছরের প্রাচীন ( কাঁচের পিছনে থাকায় হয়ত হলদেটে ভাব এসেছে কোন ছবিতে) –

IMG_4310

IMG_4309

IMG_4312

আমাদের আদিপুরুষদের সেই সংগ্রামময় অবস্থা পাড়ি দেবার হাতিয়ার তৈরি করেছিল তারা নিজেরাই পাথর কুদে, বৈরী অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাদের প্রচেষ্টা দেখে জাদুঘরেই মাথার ভিতরে ফেনিয়ে উঠেছিল অক্ষয় কুমার বড়ালের মানববন্দনা কবিতাটি-


সেই আদি-যুগে যবে অসহায় নর
নেত্র মেলি ভবে,
চাহিয়া আকাশ পানে-কারে ডেকেছিল,
দেবে না মানবে?
কাতর আহ্বান সেই মেঘেমেঘে উঠি
লুটি গ্রহে গ্রহে,
ফিরিয়া কি আসে নাই, না পেয়ে উত্তর ধরায় আগ্রহে?
সেই ক্ষুব্ধ অন্ধকার, মরুত গর্জনে,
কার অন্বেষণ?
সে নহে বন্দনা-গীতি, ভয়ার্ত-ক্ষুধার্ত
খুঁজিছে স্বজন!


আরক্ত প্রভাত সূর্য উদিল যখন
ভেদিয়া তিমিরে,
ধরিত্রী অরণ্যে ভরা, কর্দমে পিচ্ছিল
সলিলে শিশিরে।
শাখায় ঝাপটি পাখা গরুড় চিৎকারে
কাণ্ডে সর্পকুল,
সম্মুখে শ্বাপদ-সংঘ বদন ব্যাদানি
আছাড়ে লাঙ্গুল,
দংশিছে দংশক গাত্রে, পদে সরীসৃপ
শূন্যে শ্যেন উড়ে;-
কে তাহারে উদ্ধারিল? দেব না মানব-
প্রস্তরে লগুড়ে?


শীর্ণ অবসন্ন দেহ, গতিশক্তিহীন,
ক্ষুধায় অস্থির;
কে দিল তুলিয়া মুখে স্বাদু পক্ব ফল,
পত্রপুটে নীর?
কে দিল মুছায়ে অশ্রু? কে বুলাল কর
সর্বাঙ্গ আদরে?
কে নব পল্লবে দিল রচিয়া শয়ন
আপন গহ্বরে?
দিল করে পুষ্পগুচ্ছ, শিরে পুষ্পলতা,
অতিথি সৎকার!
নিশীথে বিচিত্র সুরে বিচিত্র ভাষায়
স্বপন সম্ভার!


শৈশবে কাহার সাথে জলে স্থলে ভ্রমি
শিকার-সন্ধান?
কে শিখাল ধনুর্বেদ, বহিত্র চালনা
চর্ম পরিধান?
অর্ধদগ্ধ মৃগমাংস, কার সাথে বসি’
করিনু ভক্ষণ?
কাষ্ঠে কাষ্ঠে অগ্নি জ্বালি কার হস্ত ধরি
কুর্দন নর্তন?
কে শিখাল শিলাস্তূপে, অশ্বত্থের মূলে
করিতে প্রণাম?
কে শিখাল ঋতুভেদ, চন্দ্রে-সূর্যে মেঘে
দেব-দেবী নাম?


কৈশোরে কাহার সাথে মৃত্তিকা কর্ষণে
হইনু বাহির?
মধ্যাহ্নে কে দিল পাত্রে শালি অন্ন ঢালি’
দধি-দুগ্ধ-ক্ষীর?
সায়াহ্নে কুটিরদ্বারে কার কণ্ঠ সাথে
নিবিদ উচ্চারি?
কার আশীর্বাদ লয়ে অগ্নি সাক্ষী করি’
হইনু সংসারী-?
কে দিল ঔষধি রোগে, ক্ষতে প্রলেপন-
স্নেহে অনুরাগে?
কার ছন্দে-সোম গন্ধে-ইন্দ্র অগ্নি বায়ু
নিল যজ্ঞ ভাগে?


যৌবনে সাহায্যে কার নগর পত্তন,
প্রাসাদ নির্মাণ?
কার ঋক্ সাম যজুঃ চরক সুশ্রুত,
সংহিতা পুরাণ
কে গঠিল দুর্গ, সেতু, পরিখা, প্রণালী,
পথ, ঘাট, মাঠ?
কে আজ পৃথ্বীরাজ-জলে স্থলে ব্যোমে
কার রাজ্য পাট?
পঞ্চভূত বশীভূত, প্রকৃতি উন্নীত
কার জ্ঞানে বলে?
ভুঞ্জিতে কাহার রাজ্য-জন্মিলেন হরি
মথুর কৌশলে?


প্রবীণ সমাজ পদে, আজি প্রৌঢ় আমি
জুড়ি দুই কর,
নমি, হে বিবর্তবুদ্ধি! বিদ্যুৎ-মোহন,
বজ্রমুষ্টিধর!
চরণে ঝটিকাগতি ছুটিছ উধাও
দলি নীহারিকা।
উদ্দীপ্ত তেজসনেত্র-হেরিছ নির্ভয়ে
সপ্তসূর্য শিখা।
গ্রহে গ্রহে আবর্তন-গভীর নিনাদ
শুনিছ শ্রবণে?
দোলে মহাকাল-কোলে অণু পরমাণু
বুঝিছ স্পর্শনে?


নমি, হে সার্থক কাম! স্বরূপ তোমার
নিত্য অভিনব!
মর দেহ নহ মর, অমর অধিক
স্থৈর্য ধৈর্য তব?
লয়ে সলাঙ্গুল দেহ, স্থূলবুদ্ধি তুমি
জন্মিলে জগতে!
শুষিলে সাগর শেষে, রসাইলে মরু
উড়ালে পর্বতে!
গড়িলে আপন মূর্তি-দেবতালাঞ্ছন
কালের পৃষ্ঠায়!
গড়িছ ভাঙ্গিছ তর্কে, দর্শনে, বিজ্ঞানে
আপন স্রষ্টায়!


নমি, হে বিশ্বগ ভাব! আজন্ম চঞ্চল,
বিচিত্র, বিপুল!
হেলিছ-দুলিছ সদা, পড়িছ আছাড়ি;
ভাঙ্গি সীমা-কূল!
কি ঘর্ষণ-কি ধর্ষণ, লম্ফন-গর্জন,
দ্বন্দ্ব মহামার!
কে ডুবিল-কে উঠিল, নাহি দয়ামায়া,
নাহিক নিস্তার!
নাহি তৃপ্তি, নাহি শ্রান্তি, নাহি ভ্রান্তি ভয়।
কোথায়-কোথায়!
চিরদিন এক লক্ষ্য,-জীবন বিকাশ
পরিপূর্ণ তায়!

১০
নমি তোমা নরদেব, কি গর্বে গৌরবে
দাঁড়িয়েছ তুমি!
সর্বাঙ্গে প্রভাতরশ্মি, শিরে চূর্ণ মেঘ,
পদে শষ্প ভূমি।
পশ্চাতে মন্দির-শ্রেণী, সুবর্ণ কলস,
ঝলসে কিরণে;
কলকণ্ঠ-সমুত্থিত নবীন উদ্‌গীথ
গগনে পবনে।
হৃদয-স্পন্দন সনে ঘুরিছ জগৎ,
চলিছে সময়;
ভ্রূভঙ্গে-ফিরিছ সঙ্গে-ক্রমব্যতিক্রম
উদয়-বিলয়।

১১
নমি আমি প্রতিজনে,-আদ্বিজ চণ্ডাল,
প্রভু, ক্রীতদাস!
সিন্ধুমূলে জলবিন্দু, বিশ্বমূলে অণু;
সমগ্রে প্রকাশ।
নমি কৃষি-তন্ত্রজীবী, স্থপতি, তক্ষক,
কর্ম, চর্মকার।
অদ্রিতলে শিলাখণ্ড-দৃষ্টি অগোচরে,
বহু অদ্রি-ভার!
কত রাজ্য, কত রাজা গড়িছ নীরবে
হে পূজ্য, হে প্রিয়!
একত্বে বরেণ্য তুমি, শরণ্য এককে.-
আত্মার আত্মীয়।