লিখেছেন: মুক্তি চাকমা

জাতীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী এটা কি বললেন! তিনি আবার পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়কও! এ থেকেই বোঝা যায় আমাদের পাহাড়িদের প্রতি সরকার কেমন মানসিকতা পোষণ করে এবং তারা আদতেই কেমন আন্তরিক পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃত সমস্যা প্রকৃতই সমাধানের জন্য।

তিনি বলেছেন, ‘ওখানে (পার্বত্য চট্টগ্রামে) অনেক রকম পলিটিকস ঢুকে গেছে। অনেক গ্রুপ সেখানে। ইংলিশ, জার্মানিরা ওখানে যাচ্ছে। তারা বড় ব্যথিত পাহাড়িদের জন্য। আসলে পাহাড়ে রাস্তা করে বিপদ হইছে।’

একজন শিক্ষিত এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদের একি ভাষা আর মানসিকতা! তার ব্যবহৃত সব বুলি যদি সেনাবাহিনীর তথাকথিত এবং চর্চিত বুলিগুলোকেই সমর্থন (আদতে হুবহু) করে তাহলে এত দীর্ঘ সময় ধরে উনি কি রাজনীতি করলেন??!! নিজের মগজটি কি খাটানো উচিত নয়! ব্রিটিশ, জার্মান সহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা সমূহ (এতটুকুও কি বোঝার ক্ষমতা নেই যে উন্নয়ন সংস্থা আর সম্পূর্ণ একটি জাতি এক বিষয় নয়!) কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামে নয় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেই সহায়তা দিচ্ছে, কিন্তু যত সমস্যা বুঝি এই পার্বত্য অঞ্চলে সহায়তা দিলে!

পাহাড়িদের জন্য ব্যথিত তো রাষ্ট্রযন্ত্র এবং তার উপাদান সরকারের হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু স্মরণাতীতকাল থেকেতো এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে এই অঞ্চলের ভূমিকেই সরকারেরা ভালোবেসে গেছে, আর অঞ্চলের মানুষগুলো বরাবরই তাদের কাছে থেকে গেছে উটকো ঝামেলা। বিভিন্ন সময়ের সরকারেরা যদি আমাদের পাহাড়িদের জন্য শুরু থেকেই ‘ব্যথিত’ হত তাহলে আর বুঝি এই ‘ইংলিশ, জার্মানিরা’ এখানে আসারই সুযোগ পেত না। কারণ প্রয়োজনই হত না।

পাহাড়ে রাস্তা করেতো বিপদ হয়েছেই! তা নাহলে ট্রাকে ভরে ভরে কোরবানীর গরুর মত করে চার লক্ষ ভাসমান মানুষকে বয়ে এনে এই অঞ্চলে ছেড়ে দেয়ার মত দুর্বুদ্ধি আসতো না।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সক্রিয় বিদেশি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ভূমিকার সমালোচনা করেছেন জাতীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। তাঁর অভিযোগ, এসব বিদেশি পাহাড়ের শান্ত পরিবেশকে অশান্ত করছে।

আবার সেই সেনাবাহিনীয়-জামতশিবিরীয়-বিএনপিয়-হালের আওয়ামিলীগিয় বুলি। আসলে একটা বিষয় আছে যেটা খুব দুঃখ নিয়েও ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি নিয়ে আসতে বাধ্য করে, সেটা হল, পার্বত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে সবাই এক ছাতার নীচে চলে আসে। সবাই অভিন্ন শব্দ আর বাক্য ব্যবহার করে। যে কাজগুলো রাষ্ট্রের করা উচিত, সরকারের করা উচিত সেগুলো তারা করার প্রয়োজন বোধ করছেন না আর আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা যদি এখানে কাজ করে তা হয়ে যায় ‘অশান্তি সৃষ্টি’। অবশ্য এটাতো নতুন কিছু নয় যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সবকিছুতেই কেবলই বিদেশী ষড়যন্ত্রের গন্ধ পান। তাই বাকী গুন থাকুক না থাকুক এদের ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় যে প্রচুর কার্যক্ষমতা সম্পন্ন, সন্দেহ নেই! ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে কখনো কখনো প্রশ্ন জাগে বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে এত কি গুরুত্ব বহন করে যে সব বিদেশী শক্তিরাই এত দেশ ফেলে কেবল বাংলাদেশের পিছনেই লাগে! আর, বাংলাদেশের মাটি দেশপ্রেমিক বীর সেনাবাহিনীরা তাদের বুকের রক্ত এবং জীবনের বিনিময়ে যেভাবে গার্ড দিয়ে রাখে, যদি নাওবা রাখে কোন বিদেশী শক্তি যেমনঃ ‘ইংলিশ’, ‘জার্মানিরা’ বা ভারতীয়রা কি এই ভূমি দখল করে নেবে!! কারণ, এই মাটি দখল মানেতো জনগণও তাদের দখলে – কোন পাগল কি এই সুবিশাল জনসংখ্যার দায়িত্ব নিবে! অবশ্য আমি তা না বোঝার কারণও রয়েছে। কারণ আমি রাজনীতি করিনা (একজন সাধারণ খেটে খাওয়া নাগরিক মাত্র), তাই ঘ্রাণ শক্তিও দুর্বল! এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বাকি সকলের মতই নিশ্চয় মনে করেন বাংলাদেশের এই পার্বত্য অঞ্চলের সাধাসিধা, সরল উপজাতিরা (ব্যবহারগতভাবে তা অবশ্য কিছু অশিক্ষিত, জংলী, অসভ্য, হিংস্র, বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠত্ত্বের কাছে অস্তিত্ত্বহীন- জাতীয় কিছু জনগোষ্ঠী, যাদেরকে রাষ্ট্র মনের আনন্দে আপন ভেবে রাখতেও পারছেনা আবার রাষ্ট্রের সীমানার বাইরে ছুঁড়েও দিতে পারছেনা হাজার হোক চক্ষু লজ্জা আর মানবিকতা বলে দুটো জিনিষ তাদেরওতো আছে, নাহয় একটু কমই হল) এই হতচ্ছাড়া অদৃশ্য বিদেশীদের মদদে বেশী চালাক আর গরল হয়ে যাচ্ছে! সবাই মিলে খ্রীষ্টান হয়ে যাচ্ছে – কি সর্বনেশে কথা! কারণ সরকারতো অনেক উদার, তারা চিন্তিত এই সরলেরা খ্রীষ্টান হয়ে গেলে যে তাদের উপজাতীয় ঐতিহ্য থাকবেনা (এমন অবশ্য আমার এক জজ বন্ধুও বলেছেন, তিনি প্রথমবারের মত বান্দরবান ভ্রমণ অভিজ্ঞতা করে আমাকে ফোন দিয়ে তার চিন্তার এবং আশংকার কথা বলেছিলেন), তবে এই চিন্তাটা হচ্ছে খোলস, মূল ভয় হল যদি সবাই খ্রীষ্টান হয় আরতো চলমান নীপিড়ন চালানো যাবেনা, কারণ পেছনে তখন খ্রীষ্টান বিশ্বের ঠেলা থাকবে – তখন দেশটাইনা আবার হারাতে হয়।

হাসি পায়, রাজনীতির বাহিনীরাতো দলমত নির্বিশেষে বটেই, শিক্ষিত-উচ্চ পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিরাও এই পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং তার আদিবাসীদের বিষয়ে এত দৈন্যতার পরিচয় বহণ করেন দেখে। আমাদের পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য রক্ষা এবং অধিকার বিষয়ে যদি সবাই এত সচেতন এবং আন্তরিক হত তাহলে অতীতের ক্ষমতাসীন জিয়ার সরকার এভাবে এই অঞ্চলে বৃহৎ একটি বহিরাগত সংখ্যার অস্বাভাবিক মাইগ্রেশন ঘটা্তোনা, পরবর্তীতে বাকী সরকারেরা অতি উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে তার সাপোর্ট দিয়ে যে্তোনা, সেনাবাহিনী তান্ডব করার সুযোগ পেতনা, আর বৃহত্তর বাঙ্গালীদের সুবৃহৎ একটি অংশ (শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত নির্বিশেষে) চোখ বন্ধ করে এই রেডি্মেড বুলি আওড়াতোনা। আমি নিজে একজন উন্নয়নকর্মী, যখন দেখি যে কোন গ্রামে পৌঁছাতে আট দিনের রাস্তা হাঁটতে হয়, অতিক্রম করতে হয় দুর্গম পাহাড়, প্রতিমূহুর্তে সম্ভাবনা থাকে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছার, তখন প্রশ্ন জাগে ওই গ্রামের লোকেরাও কি মানুষ নয় তাদেরও কি অধিকার নেই উন্নয়নের সুবাতাস পাবার! সেখানকার মানুষের জন্য যদি অন্য কেউ চিন্তা করে (সরকার চিন্তা করবে কি করে, বন্ধ চোখে কল্পনা করার মত জ্ঞানইতো নেই)তাহলেই সেই বিদেশী সংস্থা কুচক্রী হয়ে গেল! অথচ জনগনের উন্নয়নের মূল দায়িত্বটা কার ছিল- সেই বিবেকটা কি কাজ করে যারা বুলি আওড়ায় তাদের? আর আদিবাসীরা সকলে মিলে খ্রীষ্টান হতে যাবে কোন দুঃখে! এখানকার আদিবাসীদের জনসংখ্যা অনুযায়ী অধিকাংশ তো বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান হবার ইচ্ছে থাকলে (খ্রীষ্টান হয়ে যদি এতই লাভ হয়) এতদিন এরা বসে থাকতো! আমিইতো তাহলে সবার আগে খ্রীষ্ট ধর্ম গ্রহণ করে বিশাল লাভবান (তাদের ভাষায়) হতাম, খ্রীষ্টান রাষ্ট্রে গিয়ে লম্ফঝম্প করতাম, কিন্তু এখানে তাহলে কেন শুধু শুধু মরছি গ্রামে ঘুরে, গ্রামবাসীদের জন্য কাজ করে! কারণ এসব রাজনীতির নোংরা খেলা আমরা চাইনা, ধর্মের খেলা আমরা চাইনা, কেবল যা চাই, যা বুঝি তা হল এখানকার জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা হোক। যারা এত আমাদের ধর্মান্তরকরণ নিয়ে চিন্তিত, আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা নিয়ে চিন্তিত তারা কিন্তু আবার খুব সুখের হাসি দিবেন সবাই যদি মুসলমান হয়ে যায়, তখন সাত খুন মাফ এবং মুসলমানকরণের সেই প্রক্রিয়া শুরুও হয়ে গেছে।

সাজেদা চৌধুরীর দাবি, আগে পাহাড়িরা ভালো ছিল। তেমন কিছু বুঝত না। ওদের টাকা দিয়ে, নানা প্রলোভন দেখাচ্ছে বিদেশিরা।

এথেকেই বোঝা যায় আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিধান থেকে ‘শান্তি’ শব্দটাই চিরতরে মুছে গেছে। কারো ভালো থাকা সেটা বোধ করি নির্ণয় করবে সেই ব্যক্তি যার বিষয়ে বলা হচ্ছে, নিশ্চয় অন্য আরেকজন নয়। মাননীয় সংসদ উপনেতা কি আমপাহাড়ি যে উনি জানবেন কিসে আমরা ভালো থাকবো বা আদৌ ভালো আছি কিনা??!! দেশের একাংশ জনগণ (পারলে পুরো দেশের জনগন) কিছু না বুঝলে সেটাই যে আখেরে তাদের লাভ তা স্পষ্ট উল্ল্যেখ করলেন আমাদের মাননীয় সংসদ উপনেতা। অর্থাৎ, রাষ্ট্র চায় নাগরিকেরা অধিকার সচেতন না হউক, কিছু না বুঝুক – অদ্ভুত! রাষ্ট্রের এই শ্রদ্ধেয় কান্ডারীদের বক্তব্য যেতে যেতে আর কতদূর যাবে…!

আমার কিছুপ্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে- যেই ‘ইংলিশ’, ‘জার্মানিরা’, কুচক্রী বিদেশীরা এই পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করছে, উপজাতিদের আদিবাসী হতে শিখাচ্ছে, টাকা ঢেলে উপজাতিদের উন্নয়ন আর মানবাধিকার শিখাচ্ছে সর্বোপরি খ্রীষ্টান বানাচ্ছে এবং দেশের সার্বভৌমত্বকে নষ্ট করে স্বাধীন রাষ্ট্র বানানোর ধান্দায় আছে তারা কি কেবল পার্বত্য চট্টগ্রামেই টাকা দিচ্ছে! তাতো নয়, তারা সারা বিশ্বেই উন্নয়নের উদ্দেশ্যে টাকা ঢালছে তাহলে কেন শুধু তাদের টাকাতে পাহাড়িরাই চালাক হয়ে যাচ্ছে আর বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ছে!!! একই ব্যপার, ঘ্রাণ শক্তি দুর্বল বলেই হয়তোবা এই প্রশ্ন করতে হচ্ছে।

এটা কি কোন ন্যয় যখন প্রশাসনিকভাবে একটি উন্নয়ন সংস্থাকে বাধ্য করা হচ্ছে পাহাড়িদের পাশাপাশি সমতল থেকে আসা বাঙ্গালীদেরও উপকারভোগী করতে! সাধারণত রিমোট অঞ্চলকে উন্নয়নের অঞ্চল হিসেবে ধরলে বাঙ্গালীরা অন্তর্ভূক্ত হয়না, কারণ সেসব অঞ্চলে বাঙ্গালীদের বসবাস নেই, তারপরও প্রশাসন থেকে চাপ দেওয়া হয় বাঙ্গালীদের শতাংশ উল্ল্যেখ এবং বৃদ্ধির জন্য। বাঙ্গালীদের উন্নয়ন সংস্থার রেজিষ্ট্রেশন খুব সহজেই হয়ে যাচ্ছে। সেখানে পাহাড়িদের সংস্থাগুলি রয়েছে কড়া নজড়দারী আর হুমকির মুখে। পাহাড়ে অশান্তি তৈরী আর খ্রীষ্টান রাষ্ট্র সৃষ্টির চক্রান্তের যেই অপবাদ এই অঞ্চলের পাহাড়ী সংস্থাগুলিকে দেয়া হচ্ছে তা যেন আর থামতেই চাইছেনা। এ থেকেই পরিষ্কার সরকার কখনই এই অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমি অধিকার দিবেনা কারণ এই অঞ্চলের বসতকারী বাঙ্গালীদের শেকড়টাকে বরং আরো বিস্তৃতির সু্যোগ দেয়া হচ্ছে। এককালের এই ভাসমান বাঙ্গালীদের দিয়ে আমাদের ভূমি দখল করিয়ে নিয়ে এখন কিনা তাদের উন্নয়নে কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে আবার আমাদেরকেই, সাথে দেয়া হচ্ছে ‘কুচক্রী’র অপবাদ – ষড়যন্ত্রটা আসলে কাদের পক্ষ থেকে!!
পার্বত্য চট্টগ্রাম আমাদের পাহাড়ীদের জন্মভূমি কিন্তু তার হর্তা-কর্তা হলেন সেনাবাহিনী, তারাই নির্ধারণ করেন এই অঞ্চল আর আমাদের ভাগ্য, তাহলে আমরা ভালো থাকি কি করে! পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তির পায়রা ওড়ানোর গুরু দায়িত্বটি যদি এই সেনাবাহিনীর হাতেই থাকে তাহলে ‘মানবাধিকার’ আর যে রাস্তা দিয়েই হেঁটে যাক, পার্বত্য অঞ্চলে যে এসে পৌঁছাতে পারবেনা তা নিশ্চিত।

তথ্যভিত্তিঃ প্রথম আলো ০৩/১০/১২ সংখ্যা