মো ইয়ান
আদনান আদনান

মো ইয়ান (১৯৫৫ – ২০–)
মুক্তমনায় কেউ তাঁকে নিয়ে লিখছেনা দেখেই আমার এই লেখা। চাইনিজ এই লেখক এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। প্রতিবছর অক্টোবর মাসে আমি অপেক্ষায় থাকি কে “সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার” পাবে তা জানার জন্য। ২০১২ তে আমার তালিকায় ছিলো হারুকি মুকাকামী, ফিলিপ রথ, সালমান রুশদী, মিলান কুন্দেরা, আর চেশ নোতেবুমের নাম। কিন্তু আজ (অক্টোবর ১১, ২০১২), ক্যালিফোর্নিয়ার সময় সকাল চারটায় ঘোষণা হলো মো ইয়ানের নাম। অনেক আগে তাঁর দু’টি লেখা পড়েছিলামঃ উপন্যাস “Red Sorghum”, এবং ছোট গল্প “The Cure”. লেখা দু’টি আমার উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিলো। আমি এ-কথা খুব জোরের সাথেই বলতে পারি যে তাঁর লেখা পড়লে বাস্তবকে ভয় পেয়ে বাস্তবকে অস্বীকার না করার ইচ্ছে না জন্মে পারেনা। বাস্তবকে তিনি যেনো আরো বাস্তব করে তোলেন তাঁর লেখায়, কেননা তাঁর লেখা পড়লে ভয় লাগে, নিজের উপর ঘৃণা জন্মে।

কাহিনির সবকিছু মনে না থাকলেও আমার স্পষ্ট মনে আছে যে তাঁর লেখায় মানব জীবনের নিষ্ঠুরতা উঠে এসেছে খুব জোরালো ভাবে। আমি খুব জোরালোভাবে বলতে চাই যে তিনি যেভাবে মানব জীবনের নিষ্ঠুরতা তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন তা আমি আমার পড়া অন্য কারো লেখায় দেখিনি। তাঁর ছোট গল্প “The Cure” সম্পর্কে কিছু কথা বললেই পরিস্কার হয়ে যাবে “মানব জীবনের নিষ্ঠুরতা” বলতে আমি ঠিক কি বুঝাতে চাইছি। কিন্তু তার আগে মো ইয়ানের সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। তিনি অত্যন্ত দারিদ্রের ভিতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি ক্ষেতের ও রাখালের কাজ শুরু করেন। যতদূর মনে পড়ে, তিনি তার ছোট গল্পের বই “Shaifu, You’ll Do Anything for a Laugh”-এর ভূমিকায় এ-রকম কিছু কথা বলেছিলেনঃ

১। আমরা খেতে না পেয়ে প্রথমে গাছের পাতা, তারপর গাছের ছাল, আর তারপর গাছ খেয়ে বেঁচে থেকেছি।
২। আমি প্রথমে লেখক হয়েছিলাম ভালো ভালো খাওয়ার জন্য, অন্য কোন কিছুর জন্য নয়।
৩। সাহিত্যের আধুনিক সব বা কোনো তত্ত্ব আমার জানা নেই। কিন্তু আমার সমালোচোকেরা, আমার মতো, গল্প লিখে পাঠকের কল্পনা জগতকে ধরতে পারবেনা।
৪। লেখকের কাজ তাঁর ভাষার উন্নয়ন করা, আর বাস্তবের নিষ্ঠুরতাকে তুলে ধরা।
৫। আমি মাঠে মাঠে রাখালের কাজ করতে করতে নিজের সাথে কথা বলতে শুরু করি। বড়ো হয়েও আমার নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাসটা যায়না। আমার মা আমাকে প্রতিজ্ঞা করতে বলেন নিজের সাথে কথা না বলতে। আমি প্রতিজ্ঞা করি, কিন্তু রাখতে পারিনা। কিন্তু পরে আমি আমার নাম পাল্টে রাখি মো ইয়ান, যার মানে হলো, “Don’t Speak”.

তাঁর কথা শুনেই বোঝা যায় যে না খাওয়ার কষ্ট কি তিনি তা খুব ভালো জানেন, আর তাঁর খাওয়ার কষ্টই তাকে লেখক করে তুলেছে। যে এমন কষ্টের মধ্য দিয়ে টিকে থেকেছে তাঁর লেখায় মানব জীবনের নিষ্ঠুরতার কথা আসবেই। বরং না এসে পারেনা। তাঁর ছোট গল্প “The Cure”-এ এক গ্রামে মাঝে মাঝে অপরাধীদের একটা ব্রিজের উপর থেকে গুলি করে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। এই গল্পে অপরাধী কারা? কে অপরাধী তা অনেকটা কে ক্ষমতাবাণ তার উপর নির্ভর করে। কাজেই এখানে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যের একটা সম্পর্ক আঁকা হয়েছে, যেখানে ব্যক্তি নিরুপায়। যাদেরকে গুলি করা হয় তাদের কেউ কেউ আধমরা অবস্থায় ব্রিজের নিচে পড়ে। ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে গ্রামের লোকেরা কেউ কেউ আবার এসব দেখে। বেশকিছু কুকুরও অপেক্ষা করে মরা মানুষ খাওয়ার জন্য। আবার যারা ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে দেখে, তাদের কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে মানুষের গল-ব্লাডার খেলে মানুষের অন্ধত্ব সারে। কাজেই এই গল্প মানুষ ও হিংস্র পশুর ভিতরের একটা সম্পর্কও আঁকে, আবার অন্ধ বিশ্বাসের কথাও তুলে ধরে। এই গল্পের একজন, এমনই একজন গুলি খেয়ে মরা ও আরও একজন আধমরা মানুষের গল-ব্লাডার বুক কেটে বের করে নেয় তার মার অন্ধত্ব সারানোর জন্য। এখানে কে আসল অন্ধ? যারা গুলি করে তারা কি জানেনা যে ব্রিজের নিচে কি হয়? যারা গুলি করছে তারা কি এই মনে করে যে যারা আধমরাদের কেটে শরীরের বিভিন্ন অংশ বের করে নিচ্ছে তারা আসলে যে কাজ শেষ হয়নি তা-ই শেষ করছে? আর এইভাবে সমাজের মানুষই সমাজকে নিষ্ঠুর হতে সাহায্য করছে? আবার কিছুটা এমন আলামতও পাওয়া যায় যে ঐ গ্রামের মানুষ মানুষ খেতে শুরু করেছে। মো ইয়ান ভাষাকে এমন এক স্থানে নিয়ে গেছেন এই গল্পে যেখানে ভাষা আগে আর কখনো যায়নি। আর তাই এই গল্পের মাধ্যমে তিনি বাস্তবকে করে তুলেছেন কণ্টকসম, আর ভাষাকে দিয়েছেন এক নতুন অনুভূতিকে বর্ণনার ক্ষমতা। যেখানে কাফকার জগত অনেকটা মানসিক ও কাল্পনিক, মো ইয়ানের জগত বাস্তবে ছটফট করতে থাকা মানব জীবনের নিষ্ঠুরতা। এই বাস্তব আবার কিছুটা যাদুবাস্তবতা দিয়েও আচ্ছন্ন। মো ইয়ান তাঁর গল্পে নিষ্ঠুরতাকে ভাষা দিয়ে চলেন খুব স্বাভাবিকভাবে, যেনো নিষ্ঠুরতাই স্বাভাবিক, ঠিক যেভাবে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ সৃষ্টি করেন তাঁর যাদুবাস্তবতার জগত, যেখানে যাদুবাস্তবতাই স্বাভাবিক ও বাস্তব। মো ইয়ানের এই বৈশিষ্ট্যকেই নোবেল কমিটি বলেছেন, “Hallucinatory realism”।

আজ বিকেলে মো ইয়ানের উপন্যাস “Big Breasts & Wide Hips” কিনে বাড়ি ফিরেছি। পড়া শেষ হলে একটা রিভিউ লিখবো বলে আশা করছি।

http://www.nobelprize.org/nobel_prizes/literature/laureates/2012/