বাংলাদেশে ধর্মান্ধরা হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-পাহাড়ী-আহমাদিয়া-নিরীহ মূলধারার মুসলমানদের উপর একের পর এক আঘাত করে যাচ্ছে। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-পাহাড়ী-আহমাদিয়াদের বসতি-উপসনালয়ে বিভিন্ন সময় হামলা করা হয়েছে। সাধারণ মূলধারার মুসলমানদের ফতোয়ার বেড়াজালে আটকিয়ে নানাভাবে নিপীড়ন করা হচ্ছে। পরিণামে অনেকে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। আর যারা তা পারেননি, অপেক্ষা করছেন ধুঁকে ধুঁকে মরার।

অধিকাংশ বাংলাদেশী এসব ঘটনার পিছনে নানান ধরনের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেন। কেউ বলেন, জামাত-শিবির-বিএনপির হাত আছে এসব ঘটনায়, সরকারের দুর্নাম করতে চায়, সরকারের পতন ঘটাতে চায়। কেউ বলেন, এগুলো হিজবুতিদের কাজ, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য এসব করছে। কেউ বলেন, এগুলো সংখ্যালঘু/দুর্বলদের হটিয়ে স্থানীয় প্রভাবশালীদের জমি-সম্পত্তি দখলের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে। কেউ আবার এগুলোর মাঝে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান; ‘র’, ‘মোসাদ’, ‘সিআইএ’, ‘আইএসআই’।
তবে যে যাই বলুক না কেন, নিপীড়িতদের কাছে আপনার-আমার এইসব ষড়যন্ত্র আলোচনা ‘মা মাছের সন্তানশোক’ ছাড়া আর কিছু নয়।
আর একটি দল আছে, যাদের বক্তব্য শুনে আতংকিত হতে হয়। এ দলের মানুষেরা সরাসরি বলে বেড়ায়, ‘আমার ধর্মকে অবমাননা করেছে! এত বড় সাহস! খুব ভাল কাজ হয়েছে। আরো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দাও।’ এরা আসলে আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজের ধর্মান্ধ অংশ, যাদের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা বাংলাদেশীরা। একজন মানুষের পরিচয় যদি বর্তমান সময়ে ধর্মের ভিত্তিতে করতে হয়, তাহলে, তা ভয়াবহ ভবিষ্যতের সংকেত দেয়।

হঠাৎ করেই কি এই ধর্মান্ধ শ্রেণীর উদ্ভব?

সাতচল্লিশে দেশভাগের সময় আমরা দেখেছি হিন্দু-মুসলমান-শিখ ধর্মান্ধদের মানুষ হত্যার উদ্যম উৎসব। একাত্তরে আমরা দেখেছি এই ধর্মান্ধ দলের তাণ্ডব, ত্রিশ লক্ষ মানুষের লাশ আর দু’লক্ষ নারীর আর্ত-চিৎকার।

জামাত-শিবির-কওমী মাদ্রাসা-হিজবুত তাহরীর-বিভিন্ন তরিকা হতে বেরিয়ে আসছে মুসলমান ধর্মান্ধদের দল। এদের তাণ্ডব আমরা দেখেছি বাহাত্তর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত। উদীচী হত্যাকাণ্ড, রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ, সারাদেশে জেএমবির ত্রাস, নিরীহ মূলধারার মুসলমানদের নানান ভূঁয়া ফতোয়ার মাধ্যমে অত্যাচার করার মাঝে বার বার দেখেছি ক্রমবর্ধমান এই ধর্মান্ধ শ্রেণীকে।

মধ্যবিত্ত সমাজের একটা অংশ ধর্মান্ধদের সাথে জুড়ে গেছে। শিবির-হিজবুত তাহরীর এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমি অবাক হই, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষারত বুদ্ধিমান একজন শিক্ষার্থীকে কী এমন বলে/কী দেখায় যে, এই শিক্ষার্থীগুলো ধর্মান্ধদের দলভুক্ত হয়?
মধ্যবিত্তের একটি অংশের ধর্মান্ধদের দলে সামিল হওয়াটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি অশনীসংকেত।

সরকারও হার মেনে নেয় ধর্মান্ধদের কাছে। ইউটিউব বন্ধ করে এইসব কাঠমোল্লাদের প্রশ্রয় দেয়ার ফল কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বুঝতে পেরেও ক্ষমতার লোভে কিছু করতে আগ্রহী হচ্ছে না সরকার। কিন্তু একদিন নিজেদের এই ভুলের মাশুল দিবে সরকার।

রামুর ঘটনায় অবাক হই। ধর্মান্ধদের তাণ্ডবনৃত্য শুরু হয় রাত সাড়ে এগারোটার দিকে আর প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় ভোর রাত চারটায়। ধর্মান্ধদের ক্ষমতার জাল আর সরকারের নপুংশকের মত নিস্ক্রিয়তা দেখে হতভম্ব হয়ে রই। একদিন এই জালেই আটকে পড়ে বড় ঝামেলা পোহাতে হবে সরকারকে।

ফেসবুকে কুরআন অবমাননার একটি আপত্তিকর ছবিকে ঘিরে রামু থেকে শুরু হয় ধর্মান্ধদের বৌদ্ধ নিপীড়ন। অবাক হতে হয়। বাংলাদেশে আইন-আদালত আছে। অনুভূতিতে আঘাত পেলে আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়া যায়। ব্লগ-ফেসবুক-পত্রিকা-গণমাধ্যমের সহায়তায় প্রতিবাদ করা যায়। কিন্তু ধর্মান্ধ এই শ্রেণীটি সভ্য উপায়ে এসবের প্রতিবাদ করে না। ওরা প্রতিবাদ বলতে বুঝে জ্বালাও-পোড়াও-নরহত্যা-লুণ্ঠন-ধর্ষণ। নৃশংসতার মাঝে কোনো প্রাপ্তি থাকে না-এই সরল সত্যটুকু ওদের মাথায় ঢুকে না।

ধর্মান্ধরা আসলে বাংলাদেশে কাউকে থাকতে দিবে না। এরা একটু একটু করে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে আমাদের বাংলাদেশকে।

ধর্মান্ধরা কোনো ধর্মের-জাতির-সম্প্রদায়ের অংশ হতে পারে না। এরা সমগ্র মানবতার শত্রু। ‘মুসলমান ধর্মান্ধ’দের জন্য আজ সারাবিশ্বে সাধারণ মুসলমানদের অপমানিত হতে হয়।

সহিংসতার কোনো জাত-পাত থাকে না। ধর্মান্ধদের সহিংস কাজগুলো যে কোনোভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। না হলে, অনাগত দিনগুলোতে আমি-আপনি সবাই একে একে এদের দ্বারা আক্রান্ত হব।

আজ যদি আমরা এদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়াই, তাহলে, আগামী দিনগুলোতে আমাদের হাহাকার শোনার জন্য, আমাদের বাঁচানোর জন্য কেউ অবশিষ্ট থাকবে না।

(পূর্বে লেখাটি একটি পত্রিকায় কলাম হিসেবে প্রকাশিত হয়)