লিখেছেন: কামরুজ্জামান আরিফ খান

‘হোলি’ টেরোরিজমে আরো একবার বিক্ষত হল বাঙলাদেশ। এবার শিকার হল এমন একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যাঁরা নিদারুণ সংখ্যালঘু, বর্ণনাতীত নিরীহ, এবং বানীতে ও আদতে প্রেক্ষাপটজনিত কারণেই আপদমস্তক অহিংসপন্থী। মানবতার ধর্ষক হায়েনারা আরো একটি বার দেখালো তাদের হিংস্র শ্বদন্তের জোর- মজলুম জনগোষ্ঠীর উপর পাশবিক নিগ্রহে যারা বরাবরই ধারণ করে এসেছে জান্তব উন্মাদনা।

খবরে প্রকাশ, একজন তরুন, ধর্মে বৌদ্ধ- উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে কোরান অবমাননার ছবি পাওয়া যায়। প্রথম যেদিন খবরটি প্রকাশিত হয়, তা এমনই ছিল। দৈনিক ‘প্রথম আলো’র ভেতরের কোনো এক পাতায় নাতিদীর্ঘ একটি সংবাদ হিশেবে স্বল্পগুরুত্ব নিয়ে ঠাঁই পেয়েছিল সেটা। নাকুলা বাসিল নাকুলা কর্তৃক মুসলিম ও ইসলাম বিদ্বেষী চলচ্চিত্র প্রকাশের অব্যবহিতের পরই এমন সংবাদ প্রত্যক্ষ করা মাত্র তখনই আমি দারুণভাবে শঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম। বাংলাদেশের উগ্রতাবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠী কর্তৃক ঘটিতব্য পাশবিকতার পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আমি তখনই দেখে ফেলেছিলাম, আনুপূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। আমার সমূহ আশংকাকে সত্যে পরিণত করে সোমবারের (০১ অক্টোবর) পত্রিকা সংবাদ পরিবেশন করল।

এর আগে, ২০০২ সালে, ভারতের অযোদ্ধ্যাস্থ বাবরি মসজিদ উগ্রহিন্দু হায়েনার দল কর্তৃক বিদ্ধস্ত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে এসেছিল উপর্যুপরি দোজখের আজাব। কেয়ামতে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল সেইসব হিন্দুরা যারা আসলে জানেই না, বাবরি মসজিদ কিসের মসজিদ, আর রামমন্দিরই বা কোথায়। এমনকি, ওপাড়ে ঘটনা কি ঘটেছে তা জানার আগেই উন্মত্ত রামদা-কুড়ালের কোপে বিভৎসভাবে নিহত-আহত হল নিতাই-দেবেন-হারান-কানাই-গীতালি’রা; কিছু বুঝে ওঠার আগেই ‘নারায়ে তাকবীর’ বজ্রধ্বনিরা পুড়িয়ে দিল ওদের মন্দির- ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল ওদের দোকানপাট, লুটপাট হল মূল্যবান সামগ্রী; ওদের বাড়িঘর লুটপাট-ভাংচুড় হল ‘মালে গণিমত’ হিশেবে, রক্তে ভেসে গেল রাস্তাঘাট, ঢাকেশ্বরী মন্দির হয়ে গেল ধংসস্তুপ। এবং অদ্ভুতভাবে, নিদারুণ অদ্ভুতভাবে, পৈশাচিক ও উপর্যুপরি এ উন্মত্ততায় রাষ্ট্রযন্ত্রের রইল প্রচ্ছন্ন সমর্থন।

যে ব্যক্তি কোরানের অবমাননা করে ছবি তুলে ফেসবুকে উত্তোলন (আপলোড) করেছে, এবং উত্তমের প্রফাইলে তা যুক্ত (ট্যাগ) করেছে- সে অবশ্যই দোষী, এবং সেইসাথে উত্তমের সংশ্লিষ্টতাও হয়ত থাকতে পারে, তাই এই দুইজনকে ত্বরিৎ গ্রেফতার করে যথাযথ তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারত, সুষ্ঠু বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা যেতে পারত, এবং সেটাই উচিৎ ছিল; একই সাথে রামু ও কক্সবাজারের বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা সহ বাঙলাদেশের অন্যান্য বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা বিশেষ করে বৌদ্ধ মন্দির ও প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত বিহার রয়েছে, সেসব স্থানে সম্ভাব্য হামলার আশঙ্কা মাথায় রেখে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা যেত, এবং এটাই সমুচিৎ ছিল। কিন্তু হুঁশিয়ারির জন্য হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকা সত্ত্বেও বাঙলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রশাসন এসব কোন ব্যবস্থাই গ্রহণ করে নি। পত্রিকার প্রথম দিনের প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকে আমি যে পরবর্তী চিত্রনাট্য কল্পনা করে ফেলেছিলাম, আমি মনে করি, বাঙলাদেশ রাষ্ট্রযন্ত্রের ঘুমিয়ে থাকা প্রশাসকেরা নিশ্চয়ই অবুঝ ছিলেন না: বাঙলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের অনুসারীদের চরম প্রতিক্রিয়াশিলতার কথা কারোরই অজানা নয়- প্রশাসন তবুও আড়মোড়া ভাঙলেন না: আয়েশ করে শুয়ে শুয়ে ‘খেল্‌’ দেখতে চাইলেন, এবং দেখলেন।

কোরান অবমাননা করেছে যে ব্যক্তি, সে একজন ব্যক্তিমানুষই; কাজটি বৌদ্ধগণ করেন নি। কাজটি যে করেছে, সে-ই ব্যক্তিগতভাবে দায়ী ও দোষী, যে ধর্মের সে অনুসারী সেই ধর্ম বা ধর্মীয় সম্প্রদায় কোনভাবেই নয়। অজ্ঞাত এক ব্যক্তির দোষে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তাঁরা দায়ী তো দূরের কথা, অপরাধীদের সাথে তাঁদের কোন সম্পর্কই ছিলো না বলা যায়। যে বুদ্ধ-অনুসারী ও বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ নিগৃহিত হলেন, মধ্যরাতে বর্বর আক্রমনের শিকার হলেন রামু ও উখিয়ার মত দূরবর্তী অঞ্চলে, তাঁদের ক’জনের ফেসবুক ছিল, আর উত্তমের প্রফাইল দেখার সম্ভাবনাই বা ক’জন বৌদ্ধের? বৌদ্ধ মন্দির, বিহার, বুদ্ধমূর্তি বা এদের সেবক বা অনুসারী কেউই তো এঁরা কোরান অবমাননার সাথে যুক্ত ছিলেন না, এমনকি জ্ঞাতও ছিলেন না। কোরান অবমাননা করে ছবি তোলা যদি ধর্মের অবমাননা হয়, তবে এই নির্দোষ মন্দির-বিহার-বুদ্ধমূর্তি আঘাতে আঘাতে গুড়িয়ে দেয়া কি ধর্মের ভয়ংকরতম অবমাননা নয়? ইসলামের বিশ্বাস মতে, কোরান ঐশীগ্রন্থ, এবং স্বয়ং ঈশ্বরই এটা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। তাহলে কোরানের অস্তিত্ব ও মর্যাদা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া এবং তা রক্ষায় সন্ত্রাসী কর্মকান্ড পরিচালনা কি প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর এবং ঈশ্বরের বানীর উপর আস্থাহীনতারই প্রকাশ নয়?

স্বাভাবিকভাবেই, ন্যাক্কারজনক এই বর্বরোচিত ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাঙলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে, ব্যাপক সমালোচনা হবে এ নিয়ে- তাই প্রধাণমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের হোমড়া চোমড়ারা নানা বাক্যমালা সজ্জিত করে কথার ফুলঝুড়ি ছোটাবেন, আশ্বাস-প্রতিশ্রুতি দেবেন, নানা কর্মসূচী হাতে নেবেন- বিদেশী গণমাধ্যমে যা বাঙলাদেশের ভাবমূর্তির পুণর্গঠনে সহায়ক হবে। বহির্বিশ্বে পুনঃবিশ্বাস স্থাপনে তাঁরা সচেষ্ট হবেন যে বাঙলাদেশ তথা আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমি খুবই দুঃখিত যে, এ ঘটনা আবারো প্রমাণ করল যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ ও তার ‘অসাম্প্রদায়িক’ আওয়ামী লীগ সরকার কোনভাবেই নাগরিক হিশেবে যাঁরা সংখ্যালঘু, ভোটার হিশেবে যাঁরা স্বল্পগুরুত্ব বহন করেন, তাঁদের বন্ধু নয়।

পূর্বের অন্যান্য অনেক ঘটনার মত এই ঘটনাও আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল যে, বাঙলাদেশের অন্যান্য ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মতই আওয়ামী লীগের ‘অসাম্প্রদায়িক মনোভাব’ আসলে মোটেই ‘মনোভাব’ নয়, ‘মুখোবুলি’ মাত্র। এ ঘটনায় আমরা আরো প্রত্যক্ষ করলাম যে, ঈশ্বরের বানীতে পূর্ণ গ্রন্থকে ঈশ্বর পদদলিত হওয়া থেকে বাঁচাতে পারলেন না, আর এ জন্য প্রয়োজন হল মানবতার শত্রু উন্মত্ত একদল ধর্মোন্মাদদের। অপরদিকে ভগবান বুদ্ধও নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেন উন্মত্ত একদল মানুষের হাত থেকে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে। ‘মহাগ্রন্থে’র এই পদদলন আর ভস্মীভূত বিচূর্ণ ভগবানেরা চোখে আঙ্গুল দিয়ে সত্যানুসন্ধিৎসুদের দেখিয়ে দিল যে এই সব ‘পরাক্রমশীল’ ঈশ্বর বা মহামতি ‘ভগবান’ বুদ্ধরা কেবল বিরাজ করেন মানুষের মনোকল্পনারাজ্যেই, আর কল্পিত এই বস্তুগুলোকে বাস্তবে রুপায়িত করতে গিয়ে মাঝে মাঝেই নেমে আসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নির্যাতনের গজব, সংঘটিত হয় মানবতার বিরুদ্ধে পাশবিক অপরাধ। আর এগুলো কখনোই ঈশ্বরের দ্বারা নয়- যাদের কল্পনারাজ্যে ঈশ্বরের আবাস, তাদের দ্বারাই সংঘটিত হয়।