মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী হলেও একটি বিষয় বেশিরভাগ মানুষই সম্পূর্ণরূপে নির্বোধ, তাহলো ধর্ম। কারণ এব্যাপারে বেশিরভাগ মানুষই প্রশ্নহীন। অথচ মহাবিশ্বের সবকিছু নিয়েই মানুষের প্রশ্নের অন্ত নেই। যতোই সে প্রশ্ন করছে ততোই তার জ্ঞান বাড়ছে। কেবলমাত্র ধর্ম নিয়ে প্রশ্নহীন বলেই ধর্মজ্ঞান সম্পূর্ণ নির্দিষ্ট একটি গন্ডিতেই সীমাবব্ধ। ফলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জ্ঞানী-মূর্খ সকলেই ধর্মরক্ষার্থে আত্মাহুতি দিচ্ছে এমনকি মাতা-পিতাও সন্তানকে হত্যা/বলি দিচ্ছে ধর্মের জন্য। পশু কখনো মানুষ হয় না কিন্তু মানুষ প্রায়ই বিভিন্ন কারণে পশু হয় এবং ধর্মের কারণে যেরূপ পশু হয় তা বোধকরি অন্য কোনকিছুতেই হতে পারে না, যা দেখে বোধকরি পশুরাও লজ্জা পায়। যাহোক, মানুষের পশুত্ব নয় বরং অন্ধত্ব নিয়ে এ লেখা।

পত্রিকায় হুমায়ুন আহমেদ স্যারের সাক্ষাতকার পড়ে মনে হলো ভূত এবং ভগবান/আল্লা সত্যিই কি ভীতিকর! কেবলমাত্র হুমায়ুন স্যারের মতো উচ্চশিক্ষিত কেন ড. কামাল হোসেন সাহেবও ক’মাস আগে এক টিভি সাক্ষাতকারে বললেন তিনি পরকালে বিশ্বাস করেন। হুমায়ুন স্যার তার সাক্ষাতকারে বলেছেন আরজ আলী মাতুব্বরের বই পড়েছেন, তথাপিও আল্লার অস্তিত্বে তার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে। উনি হয়তো শ্রদ্ধেয় মাতুব্বর সাহেবের বই পড়লেও তা বোঝেননি বা বুঝতে চাননি, পড়তে হয় তাই পড়েছেন। আমরা প্রায় সবাই পড়াশোনা করি শুধুমাত্র পাশ আর একটা সার্টিফিকেটের জন্য কারণ একটা চাকুরি প্রয়োজন। ওই পর্যন্ত হলেই আমরা খুশি। কালেভদ্রে দু’একটা বই পড়লেও তাতে কি লেখা তা নিয়ে একটুও চিন্তা করি না। মাতুব্বর সাহেবের বই পড়ে অন্যসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে হুমায়ুন স্যার যদি একটু চিন্তা করতেন যে ভদ্রলোক এটা কি লিখেছেন? কেন লিখেছেন? ইত্যাদি। মাতুব্বর সাহেবের ‘সত্যের সন্ধানে’র শুধুমাত্র দ্বিতীয় প্যারার দু’টি লাইন কেউ পড়ে যদি সামান্য চিন্তা করতেন বা এর মর্মার্থ বোঝেতেন তাহলে বোধকরি মাথা থেকে আল্লা/ভগবান দূর হয়ে যেতো। যেমন, […কোন বিষয় বা কোন ঘটনা একাধিকরূপে সত্য হইতে পারে না। একটি ঘটনা যখন দুই রকম বর্ণিত হয়, তখন হয়ত উহার কোন একটি সত্য অপরটি মিথ্যা অথবা উভয়ই সমরূপ মিথ্যা; উভয়ই যুগপৎ সত্য হইতে পারে না হয়ত সত্য অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়…।] হয়তো তিনি এ বই পড়ে বুঝতেই পারেননি অথবা সামান্য এক কৃষকের মূল্য দিতে চাননি বলেই এর কোন গুরুত্বই দেননি। আমার এক মন্তব্যে লিখেছিলাম, মাতুব্বর সাহেবের বইটি এক হাজী ও এক আমেরিকান সিটিজেনকে (নামাজি) পড়তে দিলে হাজি বললেন, খ্রীস্টানরা ওই কৃষককে টাকা দিয়ে লিখিয়েছে আর আমেরিকান-বাঙালি বললেন, তার বিশ্বাস একজন কেউ আছে এবং আশ্চর্য যে, এরপর তারা নামাজে যেন আরো বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছেন, হয়তো এই ভেবে যে বইটি পড়ে তাদের গুণা হয়েছে!

প্রশ্ন, হুমায়ুন স্যার কেন যে আল্লার নাম জপতে জপতে আজগুবি ফেস (মুখমণ্ডল) দেখলেন? আল্লার নাম জপলে যদি ভয়ংকর ফেস এসে উপসি’ত হয়, তাহলে কি ধরে নেবো যে আল্লার চেয়ে ভূত বা শয়তান বেশি শক্তিধর? ছেলেবেলায় বহু ভূতে পাওয়া রোগিকে দেখেছি, ওঝাকে দেখেছি ভূত তাড়াতে। তারা বলতো ওমুককে মা-কালিতে ধরেছে, তমুককে ধরেছে দূর্গা, শিব আর মো: মোতালেবকে জ্বিনে পেয়েছে ইত্যাদি। অর্থাৎ হিন্দু-খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বীদের (কথিত ভূতে) ধরলে ওই ভূতের নাম হতো হিন্দু দেব-দেবীদের নামে আর মুসলানদের ধরলে হতো জ্বিন-পরী অর্থাৎ মুসলমান ভূত। যাহোক, যদি দেবতা কাউকে ধরে বা পেয়ে বসে তাহলে তো ভালোই কারণ আমরা তো ওদের পূঁজো দেই বা স্মরণ করি যেন বিপদে না পড়ি! যে সরষে ভূত ছাড়ায় তাতেই যদি ভূত থাকে তাহলে মানুষ যাবে কোথায়? আবার ভূত ছাড়াতে ওঝার প্রয়োজন কেন? ওঝারা কি দেবতাদের চেয়েও বড়ো? দেবতা বা ভূতেরা যদি ওঝার কথা শোনে তাহালে আল্লা/ভগবানের প্রয়োজনটা কি? তেমনি হুমায়ুন স্যার যাকে দেখতেন তাকেই মনে মনে আসসালামুয়ালাইকুম দিতেন, চমৎকার ভদ্রতা! অথচ একদিন নূরানী চেহারা মানুষ তার মনের কথা জানতে পেরে তাকে পেছন থেকে ডেকে সালামের উত্তর দিলে তিনি কেন ভয় পেয়েছিলেন বোধগম্য নয়! তাহলে কি ধরে নেবো যে ভূত এবং ভগবান দুটোই সমান ভীতিকর এবং দুটোই একই চেহারা (যেমন খুশি) ধারণ করতে পারে? অর্থাৎ নূরানী চেহারা শুধু আল্লার ফেরেশতা বা আল্লা একাই নয়, শয়তানও ধারণ করতে পারে! তাহলে শয়তানের আর আল্লার সাথে পার্থক্য রইলো কি এবং কিভাবে আল্লা/ভগবান অতুলনীয় থাকলো?

স্যারের গায়েবী আওয়াজ বা ভৌতিক অথবা দৈববাণী শোনা ও দেখা ইত্যাদি ঘটনার কিছু ব্যাখ্যা এবং আমার গ্রাম্য-কিশোর জীবনের বহু বাস্তব অভিজ্ঞতার সামান্য তুলনা করার চেষ্টা করছি। আমি লেখক নই, সাহিত্য জানি না, হুমায়ুন স্যারের সমালোচনা আমি করছি না, কারণ সে যোগ্যতার বিন্দুবিসর্গও আমার নেই। নিজ জীবনের ভয়ার্ত কাহিনীগুলোর আংশিক বলছি, যা প্রায় স্যারের অভিজ্ঞতার খুব কাছাকাছি।

ভৌতিক আলোচনায় যাবার আগে দু’একটি কথা। কিছুদিন আগে এক টিভি চ্যানেলে এক সাংবাদিকে দেখলাম বাচ্চাদের সাথে কথা বলছেন, একটি বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করলেন, “বাবু চাঁদ কোথায় থাকে?” বাচ্চাটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্বরে (বাচ্চারা যেভাবে মিষ্টি করে বলে) গে-র-মে অর্থাৎ গ্রামে…। এরপর একদিন নিজেই একটি শিশুকে একই প্রশ্ন করলে তার উত্তর ছিলো আরো চমকপ্রদ। সে বলছিলো চাঁদ নয়, চাঁদমামা, থাকে নানুবাড়ি। আমি যতোই বলি ঢাকাতেও থাকে সে ততোই বলে না নানুবাড়ি! প্রসঙ্গটি তুললাম এজন্য যে, ওরা প্রায় সকলেই চাঁদ চিনে না, কারণ ঢাকাতে চাঁদ কখন ওঠে ও ডোবে, ওরা জানে না। হয়তো বা বড় হলে বইতে পড়বে চাঁদের কাহিনী এবং জানবে এমন একটা কিছু আছে, গ্রামে না গেলে চাঁদের আলোও কোনদিন ওরা দেখবেও না, চিনবেও না (আমরাও শহরে এসে চাঁদতে ভুলতে বসেছি)। শিশুরা যেমনি চাঁদ চিনে না, তেমনিই ওরা ভূত-ভগবানও চিনতো না, যদি কিনা এসব কাহিনী শিশুকাল থেকে না শেখানো হতো। সামাজিক এবং ধর্মীয় কারণে হয়তো বড় হয়ে ভূত-ভগবান কিছুটা শিখতো, কিন্তু হৃদয়ে তেমন কোন ছাপ বা দাগ কাটতো না; আজগুবি ও অদৃশ্য ভূত এবং ভগবান কাউকেই ভয় করার প্রয়োজনও হতো না। কিন্তু জন্ম নেবার পর থেকেই এ দুটিকে শিশুদের কাছে প্রচণ্ডরকম ভয়ার্ত শাসক বা শোষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ফলে শিশু বয়সে মনে যে দাগ কাটে তা আমৃত্যু তার মনেনে থাকতে বাধ্য। আমাদের মনেও এগুলো এমনভাবে দাগ কেটেছে যে, তা কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

যেমন, সম্ভব হয়নি হুমায়ুন আহমেদ স্যারের মতো একজন উচ্চ শিক্ষিত বিখ্যাত লোকের বেলাতেও। এসব কুসংস্কারে আমি সেই কিশোর বয়সেই সন্দিহান ছিলাম, কারণ আমার এক গুরু ছিলেন, যিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, অন্ধকার রাতে একাকী ভূতড়ে স্থানে যেতে পারতেন। তবে আজও মন থেকে এগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। যদিও মায়ের কথায় প্রতিবাদ করতাম, তথাপিও এখনও মায়ের শেখানো আদেশ অনুযায়ী ঘরের বাইরে যাবার পূর্বে ডান পা আগে ফেলি, কথিত সৃষ্টিকর্তার নাম মুখে চলে আসে। ঝাটা ডিঙ্গিয়ে গেলে মা বলতেন, লক্ষ্মীছাড়া করে কি রে! এরূপ কাজ করলে নাকি সংসারের লক্ষ্মি ছেড়ে যায়। আমি মাকে বলতাম, মা লক্ষ্মী হলো হিন্দুদের দেবতা, তুমি তো হিন্দুর মেয়ে নও। মা আমতা আমতা করতেন। বলতেন, কিছু একটা শুভ-অশুভ তো আছে তাই অনেককিছু মেনে চলতে হয়। যাহোক, এখনও হঠাৎ কোন বিপদের সম্মুখীন হলে সৃষ্টিকর্তার নামই আগে চলে আসে। আসলে এসব ভোলা এতো সহজ নয়। কারণ ছেলেবেলায় গ্রামে আত্মীয়-স্বজন এবং পিতা-মাতা আমাদের নিজেদের নাম উচ্চারণ করার পূর্বেই এসবই শিক্ষা দিয়েছে। মূলত যা আমাদের শিক্ষাজীবনের সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান ধাপ।

অর্থাৎ পিতা-মাতারা সন্তানদের মুখে বোল না ফোটার পূর্বেই শেখায় কিভাবে দোয়া-দরুদ/প্রার্থনা করতে হবে, কেন সৃষ্টিকর্তাদের ভয় করতে হবে, ভয় না করলে কিরূপ দোযখের বা নরকের আগুনে পুড়তে হবে, বিষাক্ত সাপের কামড় খেতে হবে, পচা পুঁজ-রক্ত পান করতে হবে ইত্যাদি। আরো শেখানো হয়, ভূত কি জিনিষ! কোথায় কোথায় থাকে? কিভাবে মানুষ মেরে রক্ত খায় ইত্যাদি সব আজগুবি কাহিনী। ভূতের যতো গল্পবাই, ছবি ইত্যাদি নিয়ে শিশুর সামনে রাখা হয়। দেবতাদের নানারূপ মূর্তি দিয়ে ভয় ও ভক্তি করতে শেখানো হয় (বিজ্ঞজন যাকে বলেছেন, শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়)। ধর্মীয় পুস-কাদি দিয়ে শেখানো হয় ভক্তি, পড়তে না জানলেও ওসব পসুস-কাদিগুলোকে ছালাম দিতে শেখানো হয়। যদি অন্যায় করে তাহলে সৃষ্টিকর্তারা এবং ভূত দুটোরই ভয়ংকর ভয়ংকর কাহিনী শোনানো হয়। সুতরাং আমাদের জীবনের সর্বপ্রথম শিক্ষাই ভূত এবং ভগবান অর্থাৎ ভীতিকর একটি জীবনবোধ। অতএব দেখা যাচ্ছে যে, এ দুটোকেই আমরা পেয়েছি বংশানুক্রমে এবং চিরসত্যরূপে(!) অর্থাৎ এ শিক্ষাই শিক্ষাজীবনের প্রথম ধাপ। এ ধাপ পার হয়ে কোনো শিশু আসতে পেরেছে কিনা সন্দেহ আছে। এদের মধ্যে প্রথম পেয়েছি ভগবান, একটু বড়ো হওয়ার সাথে সাথে (যখন দুষ্টামি শুরু) তখন পেয়েছি ভূত বা শয়তান! একবার ভাবুন তো, ভূত এবং ভগবানের কথা যদি বাচ্চাদের কোনদিন শোনানে না হতো তাহলে কেমন হতো? অবশ্যই তারা চাঁদ না চেনার ন্যায় ভূতও চিনতো না এবং অনেক খোলা মনের সর্বোপরি কুসংস্কারমুক্ত হতো। অতএব ভূত নিয়ে যারা নাটক-সিনেমা করে, ছোটদের জন্য গল্প বই লিখে তাদের গল্পবই, নাটক-সিনেমা সব বর্জন করা উচিত। কারণ এতে বাচ্চাদের অপকার ছাড়া উপকার হয় না।

হুমায়ুন স্যারের দু’একটি সাক্ষাতকার পড়ে বুঝলাম, তিনি আমৃত্যুই কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি যখন এসব স্বপ্ন বা দৈব ঘটনা দেখেন ও শোনেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, আর আমি তখন গ্রামের এক দূরন্ত কিশোর; এসব বাস্তবে দেখেছি এবং বহুল প্রচারিত ভূতড়ে গল্প শুনেছি। পার্থক্য ওনি শহরে থেকে ভার্সিটিতে পড়তে এসে দেখেছেন ও শুনছেন আর আমি গ্রামে থেকে। শুধু নূহাশ পল্লীর গান ছাড়া (এটা তিনি শুনেছেন অনেক পরে)।

২০১০ সালে কালের কণ্ঠের ঈদ সংখ্যায় তিনি বলেছেন, “ভূত বিশ্বাস করি না, কিন্তু ভয় নামক অনুভূতিটি তো বিশ্বাস করি। আমার কাজ ভয় নিয়ে, ভূত একটা উপলক্ষ মাত্র” একথা আমিও মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি, ভূতে বিশ্বাস না করলেও, কুসংস্কারমুক্ত হলেও মাঝে মাঝে মনের অতল গহ্বর থেকে ভয় উঠে। তিনি আরো বলেছেন, “আমি অত্যন্ত গোঁড়া মুসলিম পরিবার থেকে এসেছি। উৎসাহের শুরুটা সেখানে। আমি প্রচণ্ড আস্তিক, তবে…পরের উত্তর দেব না।” গোঁড়া ধর্মীয় পরিবার থেকে প্রায় সকলেই এসেছি, গোঁড়ামি নিজের বুদ্ধি খাটানোর ফলেই না তা উবে গেছে। কিন্তু অপরের বুদ্ধিতে চললে বা পরগাছা হয়ে থাকলে যেতো না, যা ধর্ম আমাদের কাছে প্রতিনিয়তই প্রত্যাশা করে। অর্থাৎ আমরা যেন ধর্মের কাছে নতি স্বীকার করে বেঁচে থাকি। এতে একশ্রেণীর সীমিত বুদ্ধিসম্পন্ন লোককে বিনা পুঁজিতে ব্যবসা চালানোর সুযোগ করে দেই। স্যার বলছেন, প্রচণ্ড Avw¯—K তিনি। অতএব ভূত ও ভগবানের ভয় মোটেও তাকে যে ত্যাগ করেনি বলাই বাহুল্য। আবার বলেছেন, [‘জীবন’ পরম করুণাময়ের অতি পবিত্র এক উপহার। এই উপহার নিয়ে নিরানন্দে থাকার কোনো উপায় নেই।] জীবন পরম করুণাময়ের অতি পবিত্র উপহার! অতএব তিনি যেহেতু করুণাময়তে সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাসী জীবন যাপন করেছেন সেহেতু ভূত এবং ভগবানও যে ওনার পিছু ছড়েনি এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। যদিও উনি বলেছেন ভূতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি মনে করি, ভগবানে বিশ্বাস করলে তাকে ভূতেও বিশ্বাসী হতে হবে, কারণ ভূত আর ভগবান ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ভগবান থাকলে ভূত বা শয়তান থাকতেই হবে। শয়তান না থাকলে কে ভগবান বা আল্লার বান্দাদের দাগা দেবে? আর শয়তান দাগা না দিলে কেনই বা বান্দারা আল্লাকে ডাকবে? অতএব ভূতে অস্বীকার করলে চলবে না স্যার! ভূতে অস্বীকার করা আর ভগবানকে অস্বীকার করা একই কথা! যাহোক সত্যিই উনি ভূতে অবিশ্বাসী ছিলেন কি-না? দেখা যাক (প্রথম আলোতে দেয়া) নিচের সাক্ষতকারটির কিছু বক্তব্য।

বিশ্বাসীদের বিশ্বাস মতে বা প্রচলিত ধরণা থেকে বোঝা যায় যে, ভূত এবং ভগবান কোনটাকেই দেখা যায় না কেবল এদের কথা শোনা যায় এবং স্পর্শ অনুভব করা যায়। আবার এদের বিশ্বাস না করলে ভয়ের অনুভূতিটাও আসার বা থাকার কথাও নয়। অতএব উনি যে বলেছেন ভূতে বিশ্বাস করি না, তবে ভয় নামক অনুভূতিতে বিশ্বাস করেন, মূলত তা ঠিক নয়। উনি ভূতে বিশ্বাসী বলেই ভয় উনাকে ছাড়েনি, যেমন ছাড়েনি আমাদেরও যদিও ছাড়াতে চাই কিন্তু আজন্ম লালিত ভূত ও ভগবানকে ভুলতে চাইলেও মাঝেমধ্যে গা ছমছম করে ওঠে এখনো।

এ সাক্ষাতকারটিতে হুমায়ুন স্যার বলেছেন, “…গাছের নিচে দাঁড়িয়ে পেশাব করছি। অর্ধেকের মতো পেশাব করা হয়েছে, পেশাবের মাঝখানে খুব মিষ্টি একটা গলা, মেয়েদের গলা: এখানে এই কাজ করছেন? আমরা এখানে বেড়াই! আমার যা মনে হলো, যেহেতু মেয়ের গলা, আর পেশাবের মাঝখানে ঘুরে দাঁড়াতেও পারছি না। মনে হলো, প্রায়ইতো নুহাশপল্লীতে লোকজন ঘুরতে আসে—এদেরই কেউ হয়তো। তড়িঘড়ি পেশাব শেষ করে ঘুরে তাকালাম, দেখি কেউ নেই। কেউ না। আমি দৌড়ে বার হয়ে এসে খুঁজলাম, দেখলাম কোথাও কেউ নেই।Ó এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন: Ò…ওটা ওই কোনো একটা এনটিটি, যাদের আমরা চোখে দেখি না। ওদের কেউ। এটা একটা ইজি ব্যাখ্যা। দ্বিতীয় ব্যাখ্যাটা: আমার সাবকনসাস লেবেল এই কাজটা পছন্দ করে নাই। সাবকনসাস লেবেল হয়তো চায় নাই আমি এই কাজটা করি, তাই নিজে নিজে একটা এনটিটি তৈরি করে তাকে দিয়ে আমাকে বলিয়েছে। শেষটাই আমার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।” এনটিটি কি তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই, অতএব এ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না। তবে মনে হয় ভূত বা শয়তান জাতিয় অদৃশ্য কোন বস্তু হবে। তাহলে অবশ্যই ওনি ভূতে বা শয়তানে বিশ্বাসী ছিলেন অথচ পূর্বে তিনি বলেছে তিনি ভূতে বিশ্বাস করেন না ভয়ে বিশ্বাস করেন, এটা কি স্ববিরোধী নয়? ব্যক্তিগতভাবে অদৃশ্য বা অনুভব করা যায় না এমন কোন কিছুতে আমি বিশ্বাসী নই। গ্রামের দুষ্টু ছেলেরা যাদের পছন্দ করে না, তাদের ভয় দেখানোর জন্য বনজঙ্গেলে ঢুকে গলার স্বর পাল্টিয়ে বা ভয়ানক শব্দ করে বা গায়ে ঢিল ছুঁড়ে অথবা গাছের মাথায় উঠে তাদের শরীরে গরম পানি(!) ছেড়ে ভয় দেওয়ার অনেক বাস্তব ঘটনা জানি।

যাহোক, স্যারের ওই ঘটনার চেয়েও ভয়ংকর ঘটনা নিজের জীবনেই ঘটেছে তাই বলছি। একেবারে কবরের মধ্যে পড়ে গিয়ে মৃত মানুষের ডাক শুনেও যে মোটেও ঘাবড়াইনি তা নয়। তবে পরে আমার অত্যন্ত সাহসী গ্রাম্য সেই ওস-াদের কাছে যে ব্যাখ্যা শুনেছি তাতে ভয় কেটে গিয়েছিলো।

তখন বৈশাখ মাসে কালবৈশাখীর সময়। এসময় আমাদের দুটো নেশা ছিলো, একটা আম কুড়ানো অন্যটা শুকনো মাঠে, পুকুর-ডেবার কিনারে অথবা অল্প বৃষ্টির পানি জমে থাকা স্থান থেকে কৈ-মাছ ধরা। সেদিন, এক সন্ধ্যায় মহোল্লাসে মহাকলরবে, মহাপ্রলয় যেন মহাকাশ থেকে নেমে এলো। এমনিতেই কৃষ্ণপক্ষ তার উপরে কালবৈশাখীর ঘনো কালো মেঘে যেন সমস- পৃথিবীটা গভীর অন্ধকারে ডুবে গেলো। ওর তান্ডবে কোথায় কি ক্ষতি হয়ে গেলো বোঝার উপায় নেই। আমাদের চিন্তা ঝড় থামলেই প্রথমে বাড়ির চারিদিকের জমিতে কূপিবাতি বা হ্যারিকেন নিয়ে নামতে হবে অথবা আমগাছের নিচে যেতে হবে। আজকের ইচ্ছা কৈ-মাছ টোকানো কারণ যেমনি ঝড়, তেমনি বিদ্যুৎ চমকানি, তেমনি মেঘের ডাক ও বৃষ্টি ঝরছে, অতএব প্রচুর কৈ-মাছ পাওয়া যাবে। কারণ ঝড়ের পরপর প্রচুর বৃষ্টি ও মেঘ গর্জন করেছে অতএব মাছ পাওয়া যাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কালবৈশাখীর ছোবলের পর আম কুড়ানোর সুখের চেয়ে মাছ কুড়ানোর সুখ যে কতো বেশি তা গ্রামের মানুষ ছাড়া আর কে বেশি জানে (এখন আর সেদিন নেই, বাচ্চাদের কাছে বললে ওরা বলে গল্প বলছি)!

ঝড় থেমে গেছে, বৃষ্টির বেগও কিছুটা কমার সাথে সাথে আমি ও বয়সে অনেক ছোট এক চাচাতো ভাই বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়লাম আম কৈ-মাছ কুড়াতে। না, তেমন বেশি মাছ পাওয়া গেলো না। ইতোমধ্যে আমার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো কবরস্থান ঘেঁষে শুকনো ডোবাটি পানিতে ভরে গেছে। ডেবাটি উঁচু কবরস্থানের কিছুটা নিচে তারও নিচে বড় একটি দিঘি। দিঘিতে কৈ-মাছ থাকে অতএব ভাবলাম, এ ডোবায় অবশ্যই মাছ উঠেছে। কবরস্থানের চারপাশ ঘেঁষে গভীর জঙ্গল। শুধু যেখানটায় কবর দেয়া হতো সেখানটায় উপরে কোনো বড়ো গাছ নেই। সম্পূর্ণ শুকনো ডোবাটি হাঁটুপানিতে ভরে গেছে। দু’ভাই সেখানে নেমে পড়লাম। ডোবায় জমে থাকা পানির নিচে বেশ ঘাস, লতাপাতা তার মধ্যে বেশ কিছু কৈ-মাছ লুকিয়ে আছে। হাত দিয়ে যা পারলাম ধরলাম। ছোটভাই লন্ঠন ও মাছের হাড়িটা ধরে আছে।

কিছু সময় পর আমার প্রস্রাব পেলে পিছনদিকে অর্থাৎ কবরস্থানের দিকে মুখ করে, একটু সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে শুরু করলাম। বেশি দূরে জঙ্গলের দিকে যাওয়া উচিত হবে না, কারণ সেখানে প্রচুর সাপ বাস করে। যাহোক প্রস্রাবরত অবস্থায় হঠাৎ আমার চোখ পড়লো কবরগুলোর ওপর। কবরস্থানটি সমতলভূমি থেকে বেশ উঁচু। কবরগুলোর উপরের জায়গাটুকু পূর্ব থেকে পশ্চিমে ফাঁকা, তবে পশ্চিম দিকটায় কিছু ছোট ছোট গাছগাছালি ঝোপঝাড় আছে, দক্ষিণে ও উত্তরে বেশ ঘন জঙ্গলে ভরা। উত্তর-দক্ষিণের বড়ো বড়ো গাছের ডালগুলো কবরের ওপরে চলে এসেছে। আকাশ মেঘে পূর্ণ তাই অন্ধকারও যেন তীব্র। আমি পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে মুখ করে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলাম, ঠিক কবরগুলোর উপরে দু’দিকে দু’টি বিশাল পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক দৈত্য-দানব আকৃতির কিছু।

প্রথমে চমকে গেলেও পুনরায় ভালো করে দেখলাম, চোখ ঘষলাম দু’হাতে, পরিষ্কারভাবে দেখার জন্য। কিন্তু না যা দেখছি তা ঠিকই আছে এক বিশাল দানব দাঁড়িয়ে আছে, আমার তো ভুল হবার কথা নয়। কারণ প্রতিদিনের মতো সেদিনও বৈশাখের এই তাপদাহ থেকে মুক্তি পেতে ভরদুপুরে গ্রামের কৃষকরা ও গৃহবধূরা যখন কেউ বাড়ির দক্ষিণ দিকের বড়ো আমগাছের নিচে শীতল-পাটি বিছিয়ে, কেউ ছনের ছাউনির ঘরের দক্ষিণের খোলা বারান্দায় একটুখানি বিশ্রামের আশায় গা এলিয়ে দিয়েছে। ঠিক তখনই সেই ভরদুপুরে আমি একা একা গুলতিবাট আর কিছু আগুনে পোড়ানো মাটির তৈরি গুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম পাখি শিকার করতে। অতএব সন্দেহ হলো দিনের বেলায় যখন এসেছিলো তখন তো সব ফাঁকাই দেখেছি। ওই তো ওখানে, যেখানে দৈত্যটি দাঁড়িয়ে সেখানেই একটি পাখি দেখে ডাল ও পাতার ফাঁক দিয়ে গুলির নিশানা ঠিক করতে গিয়ে উপরে পাখির দিকে নজর রেখে খুবই সাবধানে পায়ের নিচের ঝরা-মরা শুকনো পাতার মচমচে শব্দ পাখির কানে না দিয়ে বিড়ালের মতো সন্তপর্ণে পজিশন ঠিক রাখতে গিয়ে অযত্নে থাকা একটি পুরানো কবরের মধ্যে প্রায় কোমর পর্যন্ত দেবে গিয়েছিলাম। আর কবরের মধ্যে পড়ার শব্দ শুনে পাখিটিও ফুঁড়–ত করে উড়ে গিয়েছিলো। তখন মনে হলো কে যেন বলেছিলো, “আয়-আয়!” কিন্তু আমি কিছু দেখিনি, ওতে ভ্রুক্ষেপও করেনি। তখন যদি আমি ভয় পেতাম বা ওইরূপ ভৌতিক শব্দে বিশ্বাস করতাম তাহলে অনেক বড় রচনা-রটানা ঘটে যেতো। এখন বুঝি ওটা ছিলো শোনার ভ্রান্তি বা আজন্ম লালিত ভয়ের কারণ ছাড়া আর কিছু না। আমি না হয়ে হয়তো অন্য কেউ হলে ওই কবরবাসী (লাশটি) চিরদিনের মতো ভূত হয়ে যেতো, কারণ নিজে বিখ্যাত হওয়ার জন্য অনেকেই গ্রামে বিভিন্ন কুসংস্কারমূলক মুখরোচক ভূড়তে গল্প বলে থাকে। তাই হয়তো সে বলতো যে, সে কবরের মধ্যে দেবে যায়নি তাকে টেনে নিয়েছিলো ইত্যাদি।

পরদিন খুব ভোরে দৈত্য দেখতে গিয়েছিলাম, দেখলাম উপর থেকে বিশাল দুটো রেইট্রি ডাল ভেঙ্গে পড়ে এমনটা হয়েছে যে ডালদুটোকে দুদিক ছড়ানো দুটি বিশাল পা মনে হয়েছে রাতের অন্ধকারে। আসলে ভয়ের চোটেই মানুষ অকল্পনীয় এবং অলৌকিক অনকেকিছু দেখে, যা নাই তাও দেখে। আমরাও অনেক দেখেছি, যা এখানে ব্যাখ্যা করলে লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে। যেমন দেখেছে স্যারের মামা, ভয়ংকর সাপ! সাপটি যে ভয়ংকর রাতের অন্ধকারে কি করে তিনি বুঝলেন? আর সাপ যে তেড়ে কামড়াতে আসে না সেটাও গ্রামের লোকদের জানা নেই। সাপকে আমরা প্রচণ্ড ভয় পাই, সাপটি বিষাক্ত কি বিষহীন তা পরে, প্রথম দেখাতেই ভয়ে নার্ভাস হয়ে যাই এবং অন্ধকারে দেখলে তো কথাই নেই। স্যার তার মামার গল্প শোনালেন, “…সঙ্গে সঙ্গে ফনা তুলে ফেলল সাপ। ভয়ংকর সাপ। মামা শুধু বলার সুযোগ পেল, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও আমি বাকি জীবন তোমার সেবা করব। সাপ ধীরে ধীরে ফনা নামিয়ে নিল। মামা পা তুলল, সাপটা চলে গেল। …মামা সারা দিন শুধু আল্লাহকে ডাকেন। আমি বড় মামাকে বললাম, বড় মামা এই যে শুধু আল্লাহকে ডাকেন—এভাবে ডেকে কিছু কি পাইছেন? জবাবে মামা বললেন পাইছি। জিজ্ঞেস করলাম কী পাইছেন? আমি আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে একটা পর্যায়ে নিজেকে দেখতে পাই। দেখি আমি নিজের সামনে বসে আছি। আমি হেসে বললাম, এটা এমন আর কি! আয়না ধরলেই তো আমরা নিজেকে দেখতে পাই। মামা বললেন, এটা সে দেখা না—আমি দেখতে পাই আমি আমার সামনে বসে জিকির করছি। তখন আমার ইচ্ছে হলো এই লাইনে একটু ভেবে দেখা যায়।”

মামার কাহিনী আর বিভিন্ন দরবেশদের কাহিনী এক। এরূপ অবাক করা কাহিনী প্রচার না করে কেউ দরববেশ হতে পারে না। অবশ্য ধার্মিকরা বিশ্বাস করেন ভগবান/খোদা চাইলে সাপের মুখ কেন সিংহের মুখও বন্ধ হয়ে যায় যেমন ওল্ডটেস্টমেন্টের ড্যানিয়েল নবীকে সিংহের খাঁচায় ফেলা হলে ক্ষুধার্ত সিংহগুলো তাকে খায়নি দেখে সে দেশের রাজা তাকে বের করে এনে তার ঈশ্বরে বিশ্বাস করেছিলো! তবে স্যারের মামা অন্ধকার রাতে কি জাতের সাপের পাল্লায় পড়েছিলো তা তিনি বলেননি, বলেছেন ভয়ংকর সাপ। একটু ব্যাখ্যা করে দেখা যাক। গ্রামে সচরাচর তিন-চার প্রকারের সাপ খুব বেশি দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মেটেসাপ ও ঢোঁড়াসাপ এদের বিষ নেই আর এক প্রকার সাপ বেশি দেখা যায় (মেটেসাপ ও ঢোঁড়াসাপের চাইতে অনেক কম)। এ সাপগুলো খুব বিষাক্ত বা ভয়ংকর এগুলো হচ্ছে জাতি বা জাতসাপ। এগুলোর মধ্যে দুটো ভাগ একটি হলো কালোজাতি অপরটি হলো খাইয়াজাতি। এদের মধ্যে কালোজাতিসাপ বেশি রাগি ও বেশি বিষাক্ত। অন্যান্য বিষাক্ত সাপের মধ্যে লাউলতা সাপও বিষাক্ত এটি প্রায়ই গাছে থাকে এবং যে গাছে যায় সে গাছেরই রূপ ধারণ করতে পারে ইত্যাদি। তিনি বলেছেন, মামা শুধু বলার সুযোগ পেল, আল্লাহ আমাকে বাঁচাও আমি বাকি জীবন তোমার সেবা করব। মামা শুধু এটুকু বলার সুযোগ পেয়েছিলো বলা হলেও এর পূর্বেই মনের অজান্তে মামা যে লাফিয়ে কয়েকহাত দূরে সরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি তা কেমন করে বুঝবো। গ্রামে থাকতে এরূপ অজস্র কাহিনীর সম্মুখিন হয়েছি এবং প্রথমেই যে কাজটি করেছি তাহলে সাপের মুখ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে দাঁড়ানো। মামা সরে গিয়েছিলো তা বলেননি কিন্তু আল্লার নাম নিয়েছিলেন বলা হয়েছে আর সাপও বুঝে ফেলেছিলো এ আল্লার খাঁটি বান্দা একে কামড়ানো চলবে না! যাহোক, দয়াময় সাপ বলতে হবে! সেজন্যই বোধকরি মনোসা পূঁজা দেয় মানুষ, সাপের দয়া পাবার জন্য! সত্যিই যদি ভয়ংকর অর্থাৎ বিষাক্ত সাপ হয়ে থাকে আর ফণা তুলে যদি ওটা কামাড়তে চাইতো অথবা মামা লাফিয়ে সরে না যেতো তাহালে মামার কামড় না খেয়ে উপায় ছিলো না। আর যদি ওটা ঢোঁড়া বা মেটেসাপ হয় তাহলে কামড় দিলেও কিছু হতো না শুধু একটু জ্বলতো। ওগুলোর কামড় আমরা বহু খেয়েছি।

এবার নিজের একটা অভিজ্ঞতা বলছি। একদিন বৈশাখ মাসের প্রচণ্ড গরমের মধ্যে সন্ধ্যা রাতে কোথাও থেকে বাড়ি ফিরছি। বাড়ির কাছাকাছি এসে একটি সাঁকো পেরিয়ে রাস্তা ছেড়ে জমির মধ্য দিয়ে সোজা হাঁটছি। তখনও পুরো অন্ধকার না হলেও ভালো করে কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। জমিতে ছোট ছোট ধানগাছ। ধান গাছের মধ্যে দিয়ে এক বিশাল সাপ যাচ্ছিলো, আমি ওটাকে মাড়িয়ে দেই। তখন আমরা খালি পায়ে হাঁটতাম। ওটার গায়ে পা পড়তেই পায়ের নিচে অনুভব করলাম কিছু একটা পিচ্ছল টাইপের পড়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই আবছা অন্ধকারে দেখি ওটা হাত দুয়েক উপরের দিকে মুখ তুলে ফেলেছে এবং ফোঁস ফোঁস শব্দ করছে। আমি কিন্তু সেদিন আল্লা-হরির নাম নেইনি (কারণ ভূত-পেত্নি তাড়াতেই আমরা ওটা ব্যবহার করতাম, সাপ তাড়াতে নয়, কারণ গ্রামের ভয়ার্ত স্থানগুলো দিয়ে যাবার সময় যারযার ভগবান/আল্লার নাম করতে করতে যেতো মানুষ)। সাপটা যতোটা না উপরের দিকে মাথা তুলেছে আমি ততোধিক উপরের দিকে লাফিয়ে উঠলাম, একেবারে স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার হাইজাম্প খেলার মতো। উপরদিক লাফ দেওয়ার সাথে সাথে সামনের দিকে কয়েকহাত দূরে সরে গিয়ে দৌড় দিয়ে ঘরে ঢুকে খাটের উপর হাত-পা গুটিয়ে বসে ভাইবোনদের বললাম, হ্যারিকেনটা দরজার সামনে রাখ, দেখ তো সাপটা আসছে কি-না? মা রান্নাঘরে, তাকে ডেকে বললাম, পাশের বাড়িতে যাও, গিয়ে সাপের মুখ খিলায়ে আসো। তখনকার দিনে কেউ যদি সাপের গায়ে আঘাত দিতো তাহলে মুখ খিলানো/আটকানো বাধ্যতামূলক ছিলো। সকলেরই বিশ্বাস ছিলো দিনের বেলায় বাড়ির আশেপাশে বা জঙ্গলে কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি সাপ দেখতো বা ওটার গায়ে আঘাত লাগতো তাহলে সাপের মুখ খিলাতো। মুখ খিলালে নাকি সাপ আর ক’দিন পর্যন্ত খেতে পারে কাউকে কামড়াতেও পারে না। এখন বুঝি সবই ছিলো ভাওতাবাজি। সাপের মুখ খিলানো পদ্ধতিটা হলো, কি এক মন্ত্র পড়ে একটি রুমাল বা কোন নেকড়ায় একটি গিঁট দিয়ে দেয়া হতো, তা সঙ্গে রাখলে ব্যাথা পাওয়া সাপটি আর কামড়াতে পারে না…। এ বিশ্বাস নিয়েই আমরা বড় হয়েছি এবং এরূপ মুখখিলানো বহু করেছি ও দেখেছি। যদিও এখন আর ওসবে বিশ্বাসী নই। স্যারের মামা আল্লার নাম নিয়ে ঠিক কাজ করেছেন বলে বিশ্বাস করলেও করতে পারেন কিন্তু সাপটি যে বিষাক্ত তা কি করে জানলেন? সাপকে আমরা ভয় পাই, ভয় পাই খোদকে/ভগবানকে, ভয় পাই শয়তান বা ভূতকে…। এসব ভয়গুলো আমাদের জন্মগতভাবে প্রাপ্ত ভয়। অতএব এরূপ ভয়গুলো মন থেকে কখনোই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। ভয় পাই বলেই সাপ ফোঁস না করলেও ফোঁস শব্দটি শুনি, ফণা না তুললেও ফণা তুলেছে দেখি। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশাল বিশাল মেটেসাপ, ঢোঁড়াসাপ অন্ধকারে দেখে বিষাক্ত সাপ ভেবে কতোই না ভয় পেতাম। দেখতাম ওগুলো যেন বিশাল ফণা তুলে আমাদের দিকে তাড়িয়ে আসছে, আসলে ওরা কখনোই তাড়িয়ে আসে না, ফোঁস করে না, ওরা প্রাণভয়ে পালাতে চায়, তবুও ভয়ে অনেকেই অজ্ঞান হতে দেখেছি সাধারণ মেটে বা ঢোঁড়া সাপ দেখেই। তবে আমরা যখন অন্ধকার রাতে কোন কারণে বাড়ির বাইরে একাকি পথ চলতাম অথচ হাতে আলো থাকতো না তখন এমনিতেই এক ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি হতো, গা ছমছম করতে ভয়ে না জানি কোথা থেকে ভূত এসে চেপে ধরে, সাপ এসে কামড় দেয় ইত্যাদি। দিনের বেলা দেখা অনেক ঝোপঝাড়কেও রাতে মনে হয়েছে ভূত বুঝি চুপ করে বসে আসে ওখানে। একটি শুকনো কলাগাছের ডগা বা নারিকেল পাতা পথের এপাশ ওপাশ পড়ে আছে দেখে অন্ধকারে তাকে সাপ ভেবেছি কতোদিন, চিৎকার করে আশেপাশের বাড়ির কাউকে আলো নিয়ে আসতে বলেছি এবং দেখেছি ওটা ময়লা ছাড়া কিছু নয়। ভয়ের চোটে মানুষ অনেক আবগুবি জিনিষ যে দেখে তার কিছুটা প্রমাণ নিচে দিচ্ছি।

স্যার যে ভৌতিকতায় বিশ্বাস করতেন তার প্রমাণ: “…একদিন বই নিয়ে পড়ছি, পাশের টেবিল থেকে একজন এসে কাঁধে হাত রেখে বলল, কী, আপনার সমস্যা কী? আমি যে সারাক্ষণই আল্লাহু আল্লাহু করছি, এটা আমি নিজেই আর বুঝতে পারছিলাম না। …এদিকে রাত্রে স্বপ্ন দেখি একটা বিশাল ঘর, বহু লোকজন বসে আছে এবং প্রত্যেকেই আল্লাহু আল্লাহু করছে। চারদিকে শুধু একটা সাউন্ড হচ্ছে। এক লয়ের সাউন্ড হচ্ছে, চারদিকে। একসময় ঘুম ভেঙে যায়, আমি দেখি নিজেই আল্লাহু আল্লাহু করছি। বিষয়টা এতই কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়, ভাবি কীভাবে এ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। আমার জীবন শেষ। প্রতি রাত্রেই এই ঘটনা। আল্লাহু আল্লাহু শব্দে ঘুম ভাঙে, দেখি আমি সিজদার ওপরে। ঘুম ভাঙে আবার ঘুম ধরে, এক রাতে চোখ খুলে দেখি, ঠিক আমার মুখের সামনে এক বিঘত দূরে একটা ফেস। ফেসটা মাথার সামনে চুল নাই, পেছনেও চুল নাই। কঠিন চেহারা, দাঁত নাই। হাঁ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। …চোখে চশমা পরলাম, দেখি আছে। যেন ভেসে আছে মুখটা। …পরে মামার ব্যাখ্যা ছিল আমি ভুল করেছি। এটা গ্যাপ দিয়ে দিয়ে করতে হতো। রং ওয়ে টু ডু। আমি সিরিয়াসলি নিইনি। মামার কথা ঠিক ছিল। যে কারণে আমি বিষয়টার জন্য আসলে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত ছিলাম।”

তিনি আরেকটি ঘটনার কথা বলছেন, “…আমি যাকেই দেখি মনে মনে বলি আসসালামুয়ালাইকুম। …বলল, এই শুনে যা! আমার বন্ধু আতিক খুব রেগে গেল। এত বড় স্পর্ধা! তুই করে বলছে! আমি থামালাম তাকে। লোকটা কাছে এগিয়ে এল। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওয়ালাইকুম সালাম। এবার যা! আমি তো স্তম্ভিত। ও মাই গড! এ তো সেই লোক, আমি এদ্দিন যাকে খুঁজছিলাম। এমন ভয় পেলাম আতিককে টানতে টানতে আমি হাঁটা দিলাম। দূরে এসে পেছনে ফিরে দেখি ওই লোক তখনো তাকিয়ে আছে। একদৃষ্টে। …অনেক মানুষের ভেতরে কঠিন ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ থাকতে পারে। যে মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে। আমি যদি দূর থেকে তাকে মনে মনে বলি আসসালামুয়ালাইকুম। তাহলে তার টের পাওয়া উচিত এবং সালামের জবাব দেওয়া উচিত। এটা একধরনের খেলা।”

কি আগুবি কথাবর্তা! তবে আমার জীবনেও এরূপ ঘটনা রয়েছে কিন্তু কখনোই এ নিয়ে ভাবিনি ফলে আমি চিরদিনের মতো একজন মুক্ত মানুষ ও সুখী মানুষ হিসেবে (অখ্যাত, অশিক্ষিত হলেও) বেঁচে আছি। তবে একটি কথা বিশ্বাস করি যদি কেউ (মহাশক্তিধর আল্লা/ভগবান/হরি/ঈশ্বর…) থাকে তবে তারা তাদের বান্দাদের মাফ করবে আমাকে করবে না, কারণ যতোই সৎভাবে জীবন-যাপন করি না কেন তার প্রশংসা আমি কখনোই করি না অর্থাৎ ধর্মীয় অনুশাসন মানি না অতএব কঠিন জীবন যাপন করতে হয়। বিশ্বাসীদের চেয়ে অবিশ্বাসীদের হাজার গুণ বেশি কষ্ট করে বাঁচতে হয় কারণ সমাজ তাদের কোন সাহায্যই করে না। তাই অবিশ্বাসী না হওয়াই বোধকরি ভালো এবং সেজন্যই হয়তো অত্যন্ত জ্ঞানীগুণিজও ধর্মকে অস্বীকার তো করেই না ধর্মীয় নানা কাজে, ধর্মীয় বাক্যকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেয়। যাহোক, যা বলছিলাম, স্বপ্নের কথা।
একদিন স্বপ্ন দেখলাম, (গভীর রাত) কবরস্থানের গাঁ ঘেঁষে একাকী বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ করেই জঙ্গেলের মধ্য থেকে বিশাল এক হাত আমার মুখের সামনে চলে এলো। হাতটি লম্বায় ৩/৪ হাত হবে! বেশ লম্বা এবং ঘন লোমপূর্ণ হাত এবং তাতের তালুতে বিশাল এক প্রদীপ (কূপিবাতি) দাউ দাউ করে জ্বলছে যেন আমার মুখ পুড়ে যাবে। আমি ভয়ে চিৎকার দিয়ে খাট থেকে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। বারান্দায় একা ঘুমাতাম। মা-বাবা, ভাইবোনেরা ভিতরের ঘরে ঘুমাতো। চিৎকার শুনে সকলেই জেগে উঠলো, ঘর অন্ধকার মা হ্যারিকেনটা জ্বালালো এবং এসে দেখলো আমার সমস- শরীর ঘামে ভেজা এবং আমি ভয়ে কাঁপছি। মায়ের কোন কথার উত্তর তখনও আমার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না।

এরূপ আজগুবি আরেকটি ঘটনা সংক্ষেপে বর্ণনা করছি। তখনকার সময়ে গ্রামের যাতায়ত ব্যবস্থা ছিলো অত্যন্ত নাজুক। বর্ষকালে রাস্তাগুলো পানির তোড়ে ভেঙ্গে যেতো, রিক্সা ছিলো না। আমাদের গ্রাম থেকে থানা সদর ১০ মাইল দূরে সেখানে যেতে প্রায় দিন শেষ হয়ে যেতো। সেইসময় থানা সদরে গিয়ে মেট্রিক পরীক্ষা দিতে হতো। একসাথে কয়েকজন কারো বাড়িতে বা থানা সদরে মুলিবাঁশের বেড়া ও টিনের ছাউনি দেয়া হোস্টেল অথবা স্কুলঘর ভাড়া করে থেকে পরীক্ষা দিতে হতো। আমারা একসাথে ৫/৬ জন একটি হোস্টেলের একটি রুমে থাকবো বলে সিদ্ধান- নিয়েছি। এক স্যার রুমটির ব্যবস্থা করেছেন। তখন পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই কারণ সকালে একটি পরীক্ষা হতো বিকেলে আরেকটি প্রতিদিন দু’টি করে পরীক্ষা ছিলো। লিখতে লিখতে হাত ব্যাথা হয়ে যেতো, কারো কারো ফুলে উঠতো। ১০ বিষয়ের পরীক্ষা ৬/৭ দিনের মধ্যেই শেষ। পরীক্ষার কয়েকদিন আগেই যাবার ব্যবস্থা করা হলো। আমি কি এক কারণে যেন দু’দিন পরে যাবো বলে মনসি’র করেছিলাম। আমি যেদিন রওনা হই সেদিন মায়ের আদেশ মতো খুব ভোরে সূর্য ওঠার আগেই শুভক্ষণ বিধায় রওনা হতে হবে, রাস্তায় যেন খারাপ লোকের মুখ না দেখি, তাই কেউ জাগার আগেই গ্রাম ছাড়তে হবে।

প্রায় ৪ মাইল হেঁটে গিয়ে আমাকে রিক্সা বা নৌকায় যেতে হতো। আমি সামান্য কিছু বই ব্যাগে করে খুব ভোরে রওনা হলাম, বাড়ি থেকে জমির (মেঠোপথ) মধ্য দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। আধামাইলের মতো পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি, সূর্যিমামা তখনও জাগেনি, একটি বাড়ির নিচ দিয়ে যাচ্ছি হঠাৎ এক পরিচিত ভদ্রলোক আমার সামনে কোথা থেকে যে উদয় হলো আমি জানি না। তাকে বললাম, আঙ্কেল আমি পরীক্ষা দিতে যাই দোয়া চাই, বলেই তার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করলেন। আমি তার পাশ কাটিয়ে গিয়েই আবার পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি তিনি নেই। জমিতে তখন কোন ফসল ছিলো না যে তিনি তার মধ্যে বসে পড়লে দেখা যাবে না, অথচ তিনি নেই তো নেই-ই। আজন্ম কুসংস্কারের ফলশ্রুতিতে শরীরটা কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। তারপর আপন মনে যা করার তাই করলাম, তার নাম জপতে জপতে চলে গেলাম। নাম জপার (ঈশ্বর/আল্লা/হরি/যীশু/মোহাম্মদ…) প্রচলন সকল ধর্মের লোকদের মধ্যেই ছিলো প্রকট। কোন ভয়ার্ত স্থান দিয়ে যাবার সময় এমন কাউকে দেখিনি যে নাম জপেনি। রাতের বেলায় গ্রামের রাস্তাগুলো দিয়ে যাবার সময় কেউ হরি-হরি… কেউ মোহাম্মদের নাম জপেছি… কেউ যীশু-যীশু বলে ডাকি আমি… এরূপ সুর প্রায়ই শুনতাম। অতএব তখন এমন একটা বিশ্বাস ছিলো যে, তার নাম জপলে সমস- বিপদ কেটে যাবে।

যাহোক, একটি জিনিষ মাথায় ঢুকছে না স্যার বলছেন, “…ও মাই গড! এ তো সেই লোক, আমি এদ্দিন যাকে খুঁজছিলাম। এমন ভয় পেলাম আতিককে টানতে টানতে আমি হাঁটা দিলাম।” কেন যে স্যারেরা এমন ফেরেশতার ন্যায় নূরানী চেহারার মানুষটিকে (স্যারের বর্ণনা এটি) দেখে ভয় পেলেন তা বোধগম্য নয়। নূরানী চেহারা বা স্বর্গীয় চেহারার কাউকে দেখলে তো ভয় না পেয়ে খুশি হবারই কথা অথচ তিনি ভয় পেয়েছিলেন কেন? কারণ তিনি তো এমন লোককেই খোঁজার জন্য জিকির করতেন। যাকে পাবার জন্য জিকির তাকে দেখে ভয় কেন? ভক্তিতে গদগদ হয়ে তাকে কেন সালাম করা বা জড়িয়ে ধরা হলো না?

প্রেম সম্পর্কে এই জ্ঞানী লেখক যা বলেছেন, “…এ জন্য ৯০ বছর বয়সে পিকাসোর প্রেমে পাগল হয়ে যায় ১৬ বছরের মেয়ে। নেচার চাচ্ছে পিকাসোর যে প্রতিভা, এটি যেন প্রবাহিত হয়। আমরা হয়তো ভাবি যে প্রেমে পড়ছি, আসলে তা প্রকৃতিরই খেলা। এটাই কেমিস্ট্রি অব লাইফ।” যা আমার বোধগম্য নয়। তিনি অতি উচ্চবুদ্ধি সম্পন্ন আর আমি অত্যন্ত নিচুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ তাই হয়তো বুঝছি না। যাহোক, ভগবান যারে দেন তাকে নাকি ছপ্পর ফাইরা দেন। আমাকে ভগবান যেমনি দেয়নি জ্ঞান তেমনি দেয়নি বিদ্যা তথাপিও জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে যা পেয়েছি তা থেকে বলছি। ওনি যে বয়সে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, আমরা ধরাণা এই বয়সে এসে প্রায় সব মানুষের মধ্যে অস্বাভাবিক সেক্স দেখা দেয়, বিশেষ করে কচি মেয়ের প্রতি লোভ জাগে। আমার আশে-পাশের মানুষদের সাথে আলোচনা ও প্রত্যক্ষ করে এ ধারণাটি হয়েছে জানি না বুদ্ধিমানেরা কি বলেন। ওনি যে বয়সে মেয়ের বান্ধবীর প্রেমে (মোহ) মজেছেন, সেই বয়সটা এবং প্রথম যৌবনকালটাই আমার ধারণায় বিপজ্জনক। তাই বুঝি এই বয়সে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব পুরুষই নতুন কিছু আশা করে, কারণ যৌবন শেষের পথে এটা একরকম মোহ। এ মোহ মেটাতে চায় সকলেই কিন্তু অনেকেই পারে না কারণ ক্ষমতা না থাকলে সমাজের নিয়ম-নীতির বিরুদ্ধে যাওয়া যায় না। অতএব বুড়ি বৌ ঘরে থাকতে কচি মেয়ে বিয়ে করতে হলে তাকে হতে হয় ক্ষমতাশালী। যারা সমাজে ক্ষমতাশালী তাদেরই তো দুটো তিনতে, চারটে বা ততোধিক বৌ থাকে। এই ক্ষমতা হতে হবে নবী-রাসূল বা পীর-আওউলিয়াদের ন্যায়, যারা অত্যন্ত জনপ্রিয় অথবা টাকা বা সম্পদের দিক থেকে সম্বৃদ্ধশালী। অর্থ থাকলে অথবা জনপ্রিয়তা থাকলে এসব প্রেমে পড়া কোন ব্যাপারই নয়। কেউ কেউ বলেন, ইনটেকচ্যুয়ালরা এমন এক আধটু না করলে ইনটেকচ্যুয়াল হতে পারে না। মূলত তা চরম মিথ্যাচার কারণ ইনটেকচ্যুয়াল হওয়ার আগে তারা এটা করেন না, করেন ইনটেকচ্যুয়াল হওয়ার পরে। কারণ যারা জীবনে প্রেম করেনি, বিয়ে করেনি তারাও কি বিখ্যাত হয়নি। দু’চারজন গুণিজনেরা বহু বিয়ে বা বহু প্রেম করেন বলে এর দোহাই দিয়ে নিজেদের খায়েশ জায়েজ করতে হবে এমন ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা প্রেম নয়, এটা মোহ। তবে এরা স্বীকার করুক আর নাই করুক এতে শান্তি দিতে পারে না। ক্ষমতাহীনরা সমাজকে ভয় পায়, ক্ষমতাবানরা সমাজকে চোখ রাঙায়। সমাজ তাদের উপদেশ গ্রহণ করে, সাধারণদের কথার কোন মূল্য সমাজে নেই, এরূপ কাজ করলে সমাজ এদের প্রকাশ্যে সমালোচনা করে আর ক্ষমতাবানরা করলে সমাজ চুপ থাকে এবং স্বর্গীয় প্রেম বলে আখ্যা দেয়।

এসবের কারণ হয়তো জন্মের পর আমরা যে পরিবেশে বিশেষ করে ধর্ম ও সমাজে বেড়ে উঠি তা আমাদের চিন্তার জগৎটা সীমিত করে দেয় এবং থেকে আমরা মৃত্যু পর্যন্তই আর কখনোই বেরিয়ে আসতে পারি না। তাই বোধকরি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পরগাছা জাতি আমরাই। কারণ আমরা অপরের বুদ্ধিতেই বেশি চলি ও বলি। নিজের বুদ্ধি-বিবেক বন্দি করে রেখে অন্যের শেখানো বুলি আওড়াতেই অভ্যস্ত আমরা। নিজের বুদ্ধি ততোটুকুই খাটাই, যতোটুকু খাটালে একটি সার্টিফিকেট ও একটি ভালো চাকুরি মিলবে অথবা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যাবে। আর একবার প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারলে তো কথাই নাই তখন কেবল যা জানি তারচেয়েও বেশি বেশি উপদেশ ফলাতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার।

অতএব যতোদিন ভূত-ভগবানের কাহিনী কোমলমতি শিশুরা শুনতে থাকবে এবং বুদ্ধিজীবিরা এ নিয়ে নাটক-নোভেল লিখে মানুষকে সস্তা বিনোদন দিয়ে নিজেদের আখের গোছাবে ততোদিন ভূত ও ভগবান আমাদের ঘাড় থেকে নামবে না। তাই আসুন ভূত-ভগবান নিয়ে সস্তা কাহিনী পড়া বন্ধ করি। এতে বিশ্বাসী হলে আল্লার ঘর ভগবান এবং ভগবানের ঘর আল্লায় ভাঙ্গতেই থাকবে। যেমন কদিন আগেই আল্লা ভাঙ্গলো বৌদ্ধ ও হিন্দু মন্দির, ভগবান ভাঙ্গলো বাবরি মসজিদ।