যে কোন জাতির গঠনেই শিক্ষা ব্যাবস্থা অন্যতম গুরুত্বপূর্ন উপাদান। যথাযথ শিক্ষার অভাব হতে পারে ভয়াবহ, তার থেকেও ভয়াবহ হতে পারে শিক্ষার নামে অশিক্ষা/কুশিক্ষা শিক্ষা দেওয়া; যা একটি জাতিকে করে তুলতে পারে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে পংগু। যেমন ধর্মশিক্ষা/সংস্কৃতির নামে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের সূতিকাগার বানাবার এক জ্বলন্ত উদাহরন হল পাকিস্তান। ধর্মীয় শ্রেষ্ঠত্ববোধের অহংকারে সে দেশে স্কুলের কচি শিশুদের মন বাল্যকাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিষিয়ে তোলা হয় ধর্মের নামে জাতিগত বিদ্বেষের বিষ ঢেলে। যে দেশে এ ফর আলিফ বি ফর বন্দকু শিক্ষা দেওয়া হয় সে দেশ থেকে পাইকারী হারে খুনে পাক আর্মি, জেহাদী নামের সন্ত্রাসী বেরুবে না মাদার টেরেসা বা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলরা বেরুবে তা বুঝতে তেমন কষ্ট হবার না। পরধর্ম, পরসংস্কৃতি ঘৃনা করার শিক্ষা এখন সে দেশে কেবল ধর্মশিক্ষার মাঝেই সীমিত নেই, ছড়িয়ে গেছে অন্যান্য বিষয়তেও।

আমাদের দেশে তূলনামূলনক ভাবে অবস্থা এখনো অতটা প্রকট না হলেও চিন্তিত হবার যথেষ্ট কারন আছে। নৈতিকতা শিক্ষার একমাত্র উপায় ধর্ম বলে সাধারন ভাবে আমাদের দেশে এখনো বদ্ধমূল ধারনা, সে ধর্ম শিক্ষার নামে কিছু মৌলিক নীতিকথার সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতার মৌলিক পাঠ এখন দেওয়া হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই, সরকার প্রনোদিত জাতীয় পাঠক্রমের সিলেবাসের আওতাতেই, গন্ডগ্রামের কোন কওমী মাদ্রাসা জাতীয় প্রতিষ্ঠানে নয় যাকে বিচ্ছিন্ন বলা যেতে পারে। আমাদের সময়ে মোল্লা আলেম, ধর্ম শিক্ষক গোছের লোকজনেরা মুখে মুখে কিছু উগ্র সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলে থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মনে পড়ে না এভাবে সরাসরি সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প ঢালা হত বলে। হয়ত তখনো কিছুটা চক্ষু লজ্জা ছিল যা এখন নেই, তাই মনে হয় কাজটি করা যাচ্ছে এক রকম বিনা বাধাতেই।

বেশ ক’বছর আগ থেকেই মাধ্যমিক পর্যায়ে ধর্মশিক্ষা আবশ্যিক করা হয়েছে। আজকাল ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেটেই পাওয়া যাচ্ছে দেশের সরকারী শিক্ষা বোর্ডের যাবতীয় বইপত্র। সেখান থেকে নবম-দশম শ্রেনীর ইসলাম-শিক্ষা বইটির [১] কিছু অংশ নিয়ে এই আলোচনা। বইটির প্রথম অধ্যায় হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন -‘আকাইদ’ অধ্যায়; কারন এটি ইসলামের মূল ভিত্তি। মূল ভিত্তি বলেই মনে হয় তেমন লুকোছাপার আশ্রয় নেওয়া হয়নি, অবিশ্বাসীদের অবস্থান ইসলামী দৃষ্টিভংগীতে সামগ্রিকভাবে কিভাবে দেখতে হবে তা পরিষ্কারভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য বর্ননা দেওয়া হয়েছে। ইসলামী পরিভাষায় সেই ‘কুফর’ বা অবিশ্বাসের পরিচয় দেওয়া হয়েছে বেশ ষ্পষ্ট ভাষায়ঃ [১] (পৃষ্ঠা ৩/৪)

নিঃসন্দেহে এই অধ্যায় থেকে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নৈতিকতা শিক্ষার, বৃহত্তর সমাজে পদচারনার এক মূল্যবান ধারনা পাবে। এই উচ্চমানের নৈতিক শিক্ষায় বলীয়ান হয়ে কোন ছেলে যদি তার হিন্দু সহপাঠিকে সরাসরি বলে, “কি হে, চরম অকৃতজ্ঞ অবাধ্য কাফের; পরকালে যে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে সে খেয়াল আছে?” তবে সে ছেলেকে কতটুকু দোষ দেওয়া যাবে? তাকে কি এই শিক্ষা সরাসরি দেওয়া হচ্ছে না? আমাদের ছেলেবেলায় আমরা হিন্দু সহপাঠীকে দেখিয়ে দেখিয়ে ‘হিন্দু’ পিপড়া বলে লাল পিপড়া নিধন করতাম, তেমন ব্যাবস্থায় মনে হয় কুলোচ্ছিল না।

কি উচ্চমানের নৈতিকতা শিক্ষা; ইসলামী বিশ্বাসের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতে অবিশ্বাসীরা হল কাফের; যারা নাকি অকৃতজ্ঞ, যাদের দুনিয়ায় কোন মর্যাদা নাই, তারা অবাধ্য ও বিরোধী, জঘন্য জুলুমকারি, হতাশ/নাফরমান। কাফেররা এতসব জঘন্য অপরাধের পরেও দুনিয়ায় মনে হয় নিতান্ত দয়া পরবশ হয়েই ধর্মশিক্ষকরা সরাসরি শাস্তির বন্দোবস্ত এখনো করছেন না, তবে তাদের জন্য আখেরাতে যে অন্ততকাল ভয়াবহ পরিনতি অপেক্ষা করছে তা কোরানের বানী সহ প্রমান করে মানসিক স্বস্থি পাচ্ছেন। কাফের ঠিক কারা তা পরিষ্কারভাবে এখানে বলা হয়নি মনে হয় কায়দা করে। কারন সরাসরি অপর কোন ধর্মের নাম বলে দিলে আবার যদি আমাদের মত ইসলাম বিদ্বেষী বা কম ঈমানের লোকে যদি ‘অমূক’ ধর্ম অবমাননা করা হয়েছে বলে শোরগোল তোলে, তাই সাধারন ভাবে ‘অবিশ্বাসী’ দিয়ে কর্ম সারা হয়েছে, কোন বিশেষ ধর্মের লোক আর অভিযোগ করতে পারল না। তবে পরিষ্কার ইংগিত দেওয়া হয়েছে যা থেকে শিক্ষার্থীরা ধারনা করে নিতে পারে সংজ্ঞায়িত কাফের কারা। যারা ক্রুশ, পৈতা পরিধান করে তাদের প্রতি আমাদের নুতন প্রজন্ম নিঃসন্দেহে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে তাকাবে আশা করাই যায়, ধর্মশিক্ষা বাদে এতবড় নৈতিক শিক্ষা নির্বিকারভাবে এবং বিনা প্রতিরোধে আর কেই বা দিতে পারে? আমি এতেও নিঃসন্দেহ যে অনেক ধার্মিক ভাই অবিশ্বাসী বা কাফের প্রজাতির প্রতি এহেন সব মূল্যবান বিশেষন শিক্ষাদানেও সাম্প্রদায়িকতার কোনই ছাপ পাবেন না। হাজার হোক এখানে কাফেরদের বৈশিষ্ট্য বর্ননা করা হয়েছে, কিন্তু ঘৃনা করতে হবে তা কোথায় বলা হল?? দূঁদে উকিলের মত চ্যালেঞ্জ করা হবে ঘৃন্য বলা হয়েছে, তবে ঘৃনা করতে হবে কোথায় বলা হল?? এই মিথ্যা অভিযোগ তো আমাদের মত ইসলাম বিদ্বেষীরা বানিয়ে দিচ্ছে। এহেন যুক্তির বিরুদ্ধে আসলে বলার কিছু থাকে না। এত সব মধুর বিশেষন কারো ওপর জাতিগত ভাবে লেপন করলে ভালবাসা হয়ত হয় না, তবে তাদের সম্পর্কে খারাপ ধারনা কি আর হতে পারে নাকি।

বইটিতে সবই যে এমন ধরনের কথাবার্তা আছে তা না, যে কোন ধর্মগ্রন্থতেই বেশ কিছু ভাল ভাল কথাবার্তা, সদুপদেশ যেমন পাওয়া যায় তেমন এখানেও আছে। সত নাগরিক, সুসন্তান,সুপ্রতিবেশী হবার সুপরামর্শ, দেশসেবা/সমাজ সেবার, গুরুত্ব এ জাতীয় বিষয় ধর্মের আলোকে জোর দেওয়া হয়েছে যেগুলি প্রসংশনীয়ই বলা চলে। যদিও এগুলির ফাঁকেও ফাঁকেও কায়দামত কিছু কিছু যায়গায় সাম্প্রদায়িক চেতনা ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে ঠিকই। যেমন ৫৬ পৃষ্ঠায় প্রতিবেশীর হক আলোচনায় মুসলমান প্রতিবেশীর হক বেশী এমন ধারনা সরাসরি দেওয়া হচ্ছে। ৭৪ পৃষ্ঠায় বন্ধু নির্বাচনের একটি গাইড লাইন হিসেবে মহাত্মা ইমাম গাযালী (রঃ) এর রেফারেন্স দিয়ে বলা হচ্ছে যে লোক কোরান সুন্নাহর পরিপন্থী কাজে লিপ্ত তাকে ত্যাগ করা কর্তব্য বলে। এই গাইড লাইন মেনে পাশের বাড়ির পৈতা পরিহিত, মূর্তিপূজক হিন্দু কিংবা গলায় ক্রুশ ঝোলানো খৃষ্টানের সাথে বন্ধুত্ব করা নিশ্চয়ই সম্ভব নয়। পৈতা পরা, ক্রুশ পরা যে আল্লাহর কাছে অমার্জনীয় অপরাধ কুফরের লক্ষন সেটা তো আগেই পরিষ্কার করা হয়েছে। এরপরে যা আসছে তার তূলনায় মুসলমান প্রতিবেশীর হক, অমুসলমানের সাথে বন্ধুত্ব ইস্যু আলোচনার যোগ্যও নয়। কিছু কিছু হাস্যকর তথ্য, তূলনাও আছে যেগুলি নিয়েও আলোচনার সময় আপাতত নেই, দরকারও নেই।

৫৩ পাতায় বেশ গুরুত্ব সহকারে জিহাদ সম্পর্কিত শিক্ষা বর্নিত হয়েছে। আল্লাহর দ্বীন ইসলাম ধর্মকে জয়ী করা বা প্রতিষ্ঠা করা জিহাদ এভাবে অধ্যায়ের শুরু। ভাল কথা। জিহাদ সম্পর্কিত কিছু প্রাথমিক তথ্যের পর জিহাদের প্রকারভেদ বর্ননা করা হয়েছে, কিভাবে এবং কাদের বিরুদ্ধে জিহাদ চালিয়ে আল্লাহর মনোনিত দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে হবে তা মোটামুটি ষ্পষ্ট ভাষায় বর্ননা করা হয়েছে কোরানের রেফারেন্স সহকারে। [১] (পৃষ্ঠা ৫৪)

কি মূল্যবান চিরশান্তির শিক্ষা, পাঠ করলেই মনে শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে। আমাদের ছেলেমেয়েরা শিখল যে তার পাশের বাড়ির নিরীহ ভালমানুষ রামলাল কাকা যে হয়ত ছেলেবেলা থেকে তাকে কোলে পিঠে করে নিজের বাবার মতই স্নেহ করেছে সে আসলে তার প্রিয় ধর্ম ইসলামকে দুনিয়া থেকে মুছে ফেলার চিরস্থায়ী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কাফের প্রজাতির লোক। শুধু তাই নয়, এই আল্লাহ বিরোধী লোকের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া যুদ্ধ করা হল তার পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব জেহাদ যা প্রিয় নবীজি শিক্ষা দিয়ে গেছেন। ভাগ্য ভাল যে ধর্মসূত্রের শিক্ষা লোকে যতটা না ভাব দেখায় তার কানাকাড়িও আসলে গুরুত্ব দেয় না।

এর আগে জিহাদের গুরুত্ব বর্ননা করা হয়েছে, ইসলাম ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করা বড় ইবাদত বলে বর্ননা করা হয়েছে। এর অন্তর্নিহিত শিক্ষা কি? শায়খ রহমান বাংলা ভাইরা দেশের সেক্যুলার ধারার আদালত মানতে চায়নি, বোমা মেরে বিচারক হত্যা শুরু করেছিল কারন সেগুলি ইসলামী শরিয়া সম্মত আইন কানুনের ধার তেমন ধারে না, তাদের ভাষায় সেগুলি তাগুতের (শয়তানের) আইনে চলে, আল্লাহর আইনে নয়। বাংলা ভাই/শায়খ রহমানকে সন্ত্রাসী বলা এই ধর্মশিক্ষার আলোকে কতটা যুক্তিসংগত? বেচারারা তো পরিষ্কার আল্লাহর আইনই প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিকুল শক্তির বিরুদ্ধে জেহাদ করছিল। কাফেরিয় ছায়ার মনুষ্য সৃষ্ট সেক্যুলার আদালত ধ্বংস করে ইসলামী আইন আদালত প্রতিষ্ঠার নিয়তকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? তাদের বোমা মারা/মানুষ হত্যা নিয়ে হয়তবা কথা হতে পারে, তবে পদ্ধুতিগতভাবে ভূল হবার সম্ভাবনা থাকলেও নীতিগতভাবে তো তারা দেখি ঠিকই ছিল। ইসলাম প্রতিষ্ঠায় প্রতিকুল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল।

লাদেন গং এবং তাদের সমমনারা যেহেতু ২০০১ সাল থেকে (আসলে ২০০১ থেকে নয়, ঠিক কবে থেকে বলা মুশকিল) বিশ্বের নানান দেশে (এমনকি বেশ কিছু মুসলমান প্রধান দেশও জেহাদি বোমার কবল থেকে রেহাই পায়নি) ইসলামী বিশ্বাসের পরম পবিত্র কোরান হাদীসের কিছু রেফারেন্স কোট করে নানান সন্ত্রাসী ততপরতা চালাচ্ছে। সেহেতু জিহাদ শব্দটি আসলেই ইসলামে কি অর্থে ব্যাবহার হয়েছে তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা, আগুন গরম বিতর্ক। কোরানে উপরোক্ত আয়াতের মত বেশ কিছু আয়াত আছে যেগুলি বিধর্মীদের প্রতি বেশ উত্তেজক, এসব আয়াত সর্বযুগের জন্য প্রযোজ্য মনেপ্রানে বিশ্বাস করে বসে থাকলে বিধর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব বা শান্তিপূর্ন সহাবস্থান দূরের কথা, তাদের সাথে সদা সর্বত্র যুদ্ধ করে যাওয়াই ফরজ বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক যেভাবে আমাদের জ্ঞানী ধর্মশিক্ষকরা শিক্ষা দিচ্ছেন। লাদেন জাতীয় চরমপন্থীদের ইন্টারপ্রেটেশন তেমনই। এর বিপরীতে যারা ইসলাম ডিফেন্ডার বা মডারেট তাদের আর্গুমেন্টের মূল যুক্তি থাকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতার দায়ে অভিযুক্ত আয়াতগুলির ভুল/বিকৃত ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কারন তাদের মতে কোরান হাদীস জাতীয় সহি ইসলামী সূত্রে নিরপরাধ, নির্দোষ, নিরীহ মানুষের ওপর হামলাবাজি করা একেবারেই নিষিদ্ধ; যেসব উত্তেজক জেহাদী আয়াত কোট করা হয় সেসব আয়াত প্রকৃতপক্ষে কেবলমাত্র আক্রান্ত হলেই প্রযোজ্য যা উপযুক্ত কন্টেক্সট কিংবা যথাযথ ইসলামী জ্ঞান থাকলে বোঝা যায়। কোরান হাদীসের আলোকে এমনকি বিধর্মীদের সাথে বন্ধুত্ব করাতেও কোন সমস্যা নেই যদি না তারা ইসলামের সাথে শত্রুতা না করে। তত্ত্বীয়ভাবে এ জাতীয় ব্যাখ্যা মন্দ নয়, কেউ আমার ওপর হামলা করলে আমি তাকে নিশ্চয়ই রসগোল্লা খাওয়াবো না, আমিও আত্মরক্ষার্থেই পালটা আঘাতই করব। ব্যাখ্যার সাথে সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবধারিতভাবে শোনা যায় যে ইসলাম ধর্মের উগ্রবাদের এসব অভিযোগ ইসলাম বিদ্বেষীদের আবিষ্কার। আরেকটু উদারমনা ধার্মিকরা ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্র হয়ত সেভাবে পান না তবে তারা পান পলিটিক্যাল ইসলামের গন্ধ; মানে লাদেন, বাংলা ভাই, কিংবা জামাত শিবির, হরকতুল জিহাদ জাতীয় রকমারি চরমপন্থী ধর্মীয় সংগঠনগুলি কোরান হাদীসের বিকৃত ব্যাখ্যা করছে তাদের বস্তুগত স্বার্থে, ধর্মের সাথে যাদের কোন সম্পর্ক নেই (যেমন আমাদের দেশে কিছু লোকে ’৭১ সালে রাজাকার বদর কেন হয়েছিল তার প্রচলিত সরল ব্যাখ্যা হল টাকা পয়সা ক্ষমতার লোভ)। আর কিছু মোল্লা আলেমও কেন এ জাতীয় উগ্র ধ্যান ধারনা প্রচার করে তারও ব্যাখ্যা সরল-তারা আসল ইসলাম জানে না, আসল ইসলাম জানতে প্রচুর পড়াশুনা করতে হয় যার জন্য বড় বড় প্রসিদ্ধ ইমাম আলেমনের শরনাপন্ন হতে হবে…ইসলাম সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে উপযুক্ত যোগ্যতা থাকতে হবে…এসব কথায় যুক্তি আছে, যোগ্যতা না থাকলে ব্যাখ্যা কেন গুরুত্ব দিতে হবে। এই বইতে যোগ্যতা সম্পন্ন আলেমদের অন্য ধর্ম ও বিধর্মীদের সম্পর্কে ধারনা কেমন তার কিছুটা আলামত পেয়েছি, তাদের কথা ভুল হতে পারে এ সম্ভাবনা মাথায় রেখে যথা সময়ে বিধর্মীদের সম্পর্কে ইসলামী জগতের কিছু অতি জনপ্রিয় হাই-প্রোফাইল বুজুর্গ ব্যাক্তিত্বের কথা শুনেও আমরা তূলনা করার চেষ্টা করব।

ইসলাম ডিফেন্ডার/মডারেট ভিউতে জিহাদের প্রকৃত মানে আত্মশুদ্ধি বা নিজের মনের কুপ্রবনতার (নফস) বিরুদ্ধে লড়াই (বই এ বর্নিত অপ্রকাশ্য জিহাদ), যুদ্ধবাজির যে জিহাদ (বই এর প্রকাশ্য জিহাদ) সেটা হলেও হতে পারে, কেবল মাত্র আক্রান্ত হলেই। মোদ্দা কথা লাদেন গং এর জিহাদের সাথে আসল প্রকৃত ইসলামী জিহাদের কোন সম্পর্ক নেই। এখন এ জাতীয় ইসলাম ডিফেন্ডিং যুক্তির সাথে কি উপরোক্ত কোট করা আয়াত, এবং তার সাথে ধর্মশিক্ষকদের দেওয়া ব্যাখ্যার তেমন মিল পাওয়া যায়?

প্রকাশ্য জিহাদের সংজ্ঞায় পরিষ্কার বলা হয়েছে যে কাফির, মুশরিক, ইয়াহুদিরা হল ইসলামের চিরশত্রু। এই সংজ্ঞা পড়ে কাফের, মুশরিক, ইহুদীরা জাতিগতভাবে মুসলমানের চিরশত্রু এই ধারনার বাইরে আর কোন কিছু কিভাবে পাওয়া যেতে পারে কেউ ব্যাখ্যা করতে পারেন? এখানে কিন্তু নমনীয় ব্যাখ্যাকাররা যেভাবে ব্যাখ্যা করেন যে এসব আয়াত জেনারেলাইজড নয়, কেবলমাত্র আক্রমনকারী বিধর্মীদের বা যুদ্ধকালীন অবস্থার কথাই বলা হয়েছে তেমন বোঝা কিভাবে সম্ভব? তেমন কোন ক্লজ কি মাননীয় শিক্ষকরা ইংগিত করেছেন? বর্নিত আয়াতের রেফারেন্সে বিধর্মীরা জাতিগতভাবেই ইসলামের চিরশত্রু (সরল মানে এখানে ব্যাক্তি ব্যাপার নয়, গুরুত্বপূর্ন হল তাদের ধর্মীয় পরিচয়) তারা ইসলামকে দুনিয়া থেকে মুছে দেবার ষড়যন্ত্রে সর্বদা লিপ্ত- কাজেই এসব আল্লাহ বিরোধী শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা জেহাদ করা পবিত্র দায়িত্ব এই শিক্ষা কি দেওয়া হছে না? এখানে কোথায় আক্রমনের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা আর কোথায় কেবলমাত্র “মন্দ” বিধর্মী, ভালদের সাথে কোন সমস্যা নেই এমন কনসেপ্ট? আল কায়দা, হরকতুল জেহাদ এদের জেহাদী ধারনার সাথে আমাদের ধর্মশিক্ষা বই এ বর্নিত জেহাদী ধারনার পার্থক্য ঠিক কতটা? নুতন প্রজন্ম তাহলে প্রথম অধ্যায়ে শিখল কেন কাফের বা অবিশ্বাসী/বিধর্মীরা ভয়াবহ ধরনের ঘৃন্য, পরবর্তিতে আরো শিখল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা যাবে না, এরপর অবশেষে শিখল যে কাফের, মুশরিক, ইয়াহুদিরা জাতিগতভাবেই তাদের চিরশত্রু কাজেই এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হল পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্ব জিহাদ যা আল্লাহ কোরানে সর্বকালের জন্য নির্দেশনা হিসেবে নাজিল করেছেন। এর সমর্থনে যে আয়াত দেওয়া হয়েছে তা অবশ্য সম্পূর্ন আয়াত নয়, অসম্পূর্ন আয়াত কেন দেওয়া হল তা পরিষ্কার নয়। সম্পূর্ন আয়াতের বংগানুবাদ (ইউসুফ আলী)ঃ [২]

হে নবী ! অবিশ্বাসী ও মোনাফিকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম [জিহাদ] কর, এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। জাহান্নাম হবে তাদের বাসস্থান, উহা কত নিকৃষ্ট আশ্রয়স্থান।

ধর্ম ডিফেন্ডারগনের দায় অস্বীকারের ক্ষমতা অসাধারন। আগেই বলেছি যে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে তাদের অনেকে এমন সব চরম সাম্প্রদায়িক শিক্ষার ভেতরেও নিশ্চিত কোন সমস্যা দেখবেন না। তারা এসব প্রচারনাকে তাদের ধর্মীয় অধিকার হিসেবে মনে করেন এবং নানান শব্দমালার আড়ালে এড়িয়ে যান, পরিশেষে সিদ্ধান্ত হয় যে অভিযোগকারিই হল মহা বদমায়েশ ইসলাম বিদ্বেষী। এবার ধরা যাক, হিন্দু ধর্মের ছেলেমেয়েদের ধর্মশিক্ষা বই খুলে পাওয়া গেল; “যারা ৩৩ কোটি দেবদেবীতে বিশ্বাস করে না তারা সব নরাধম (নরাধম কিন্তু গালি নয়, যেহেতু দেবদেবীদের চোখে এরা অতি ঘৃনিত তাই নরাধম),অকৃতজ্ঞ, অবাধ্য ও বিরোধী, নাফরমান, হতাশ, দুনিয়ায় এদের কোন মর্যাদা নাই পরকালেও তারা অন্ততকাল পূন্যম নরকে জ্বলে ছাই হবে। সুন্নতি কায়দার টুপি, দাঁড়ি, চোখে সুরমা দেওয়া,বোরখা/হিজাব পরিধান হল চির ঘৃনিত নরাধমদের বৈশিষ্ট্য।” এরপর ধরেন, “একশ্বেরবাদীরা তাদের ধর্মের জন্মলগ্ন থেকেই হাজার হাজার বছর ধরে প্রচলিত বহু কোটি মানুষের অতি আবেগের ৩৩ কোটি দেবদেবী আদিষ্ট মহান পৌত্তলিক ধর্মবিশ্বাস বাতিলের জন্য প্রকাশ্যে আহবান জানিয়ে আসছে, এমনকি দেশে দেশে মহান পবিত্র দেবদেবীর মূর্তি ভাংগায়ও লিপ্ত আছে। কাজেই পৌত্তলিকদের চিরশত্রু একশ্বেরবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে প্রকাশ্য জিহাদ বলা হয়। ৩৩ কোটি দেবদেবী একশ্বেরবাদীদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ও কঠোর হবার কড়া নির্দেশ দিয়েছেন।“ – এই কথাগুলিকে নির্দোষ ধর্মীয় বিশ্বাসের আওতায় কোনভাবে ফেলা যাবে? কোনভাবে কথার মারপ্যাঁচে কিংবা নানান ভুজং ভাজং দিয়ে প্রমান করার উপায় আছে যে ধর্মশিক্ষার আড়ালে এসব বিশুদ্ধ সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়ানো ছাড়া আর কিছু নয়?

আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য কোরান হাদীসে কতটা সাম্প্রদায়িকতা আছে কি নেই তা নয়, মূল উদ্দেশ্য হল মুশরিক, খ্রীষ্টান, ইহুদিরা মুসলমানদের চিরশত্রু, তারা সদা সর্বত্র ইসলাম ধ্বংস করার চক্রান্ত্র লিপ্ত আছে এই জাতীয় সাম্প্রদায়িকতার সহজ পাঠ কিভাবে বিনা প্রতিবাদে সরকার কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থের মাধ্যমে কচি ছেলেমেয়েদের মাথায় বছরের পর বছর ঢোকানো হচ্ছে সেটা আলোচনা করা। এই প্রশ্ন অবশ্যই যারা মনে মনে বা প্রকাশ্যে বিশ্বাস করেন যে এসব শিক্ষায় কোন সমস্যা নেই কিংবা এসব প্রচারনা তাদের ধর্মীয় অধিকার তাদের জন্য নয়। তাদের সাথে আমার কোন বিরোধ নেই, কারন তাদের মধ্যে অন্তত ভন্ডামি নেই। কেউ যদি সরাসরি স্বীকার করেন যে তার ধর্মে বিধর্মীদের ঘৃনা করার কথা আছে কিংবা বিধর্মীদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তার ধর্মীয় দায়িত্ব তবে তার সাথে কথা বাড়াবার আমার অন্তত কোন দরকার নেই। তবে ইসলাম ডিফেন্ডার যারা আছেন তাদের মধ্যে স্বনামখ্যাত আন্তর্জাতিক মানের স্কলার থেকে শুরু করে একটু কম বিখ্যাত বাংলা ব্লগের লেখকগন সকলেইকড়া সুরে এ জাতীয় আলোচনায় ইসলামে জাতিগত বিদ্বেষ/ধর্মবিদ্বেষ এ ধরনের কিছু আছে এমন অভিযোগ নাকচ করে দেন। প্রায় অবধারিতভাবে তারা মত দেন যে এসব অভিযোগের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই, ইসলাম বিধর্মীদের ধর্মাধিকার রক্ষার ও তাদের সাথে সদ্ভাব রাখার নির্দেশ দেয়,অকাট্য প্রমান হিসেবে বিধর্মীদের প্রতি কোরানের অন্য কোন নমনীয় আয়াত কোট করে কিংবা বিধর্মীদের সাথে নবীজি কিংবা সাহাবীদের ভাল ব্যাবহার/উক্তি জাতীয় কিছু হাদীস/ঘটনা কোট করে প্রমান করে দেন যে ইসলামের শত্রুরাই এই ধরনের অভিযোগ করে। আসলে ব্যাপারটা কি? বিধর্মীদের প্রতি ভাল ব্যাবহার করার কিছু কোরানিক নির্দেশনা, নবীজি কিংবা হাই-প্রোফাইল খলিফাদের উদারতার ভাল কিছু নিদর্শন অবশ্যই আছে। মুশকিল হল একই ভাবে বিধর্মীদের প্রতি বিদ্বেষ সূলভ আয়াত, নির্দেশনাও আছে এবং সুপার হাই-প্রোফাইল বিজ্ঞ আলেমগন যাদের ইসলামী জগতে সকলে পরম শ্রদ্ধা করেন তাদের লিখিত কোরানের ব্যাখ্যা, ইসলামী বিধিবিধানের পুস্তক ঘাটাঘাটি করলে চরম বিদ্বেষ সূলভ সুরের পরিষ্কার প্রাধান্য দেখা যায়, যার সামান্য প্রমান এই ধর্মশিক্ষা বই এ দেখা যায়। আমি নিশ্চিত এই ধর্মশিক্ষা গ্রন্থের রচনাকারীদেরও ইসলাম ধর্মে পরধর্মের সাথে কিংবা বিধর্মীদের সাথে কোন রকম বিদ্বেষসূলভ ধারনা আছে কিনা প্রকাশ্যে জিজ্ঞাসা করা হলে তারাও সরাসরি অস্বীকার করে বসবেন, ইসলাম বিধর্মীদের ব্যাপারে কত উদার তা নিশ্চিতভাবে নানান কায়দায় প্রমান করে দিতে পারবেন।

ধরা যাক ইসলাম ধর্মে আসলেই সাম্প্রদায়িকতা নেই, অন্য ধর্মবিশ্বাস কিংবা সেসব ধর্মে বিশ্বাসীদের সাথেও ইসলামের কোন সমস্যা নেই। এ ধরনের অভিযোগ সবই ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যা প্রচারনা কিংবা বড়জোর অশিক্ষিত কাঠমোল্লাদের অজ্ঞাতপ্রসূত কথা। কথা হল এই ধর্মশিক্ষা গ্রন্থের কোট করা অংশগুলি যারা বয়ান করেছেন, ওনারা কি ইসলামের শত্রু কিংবা তাদের ধর্মজ্ঞান নেই? এর যুক্তিসংগত উত্তর কি হতে পারে? ধর্মজ্ঞান যদি না থাকে তবে খুবই যুক্তিসংগত প্রশ্ন আসবে যে সেক্ষেত্রে দেশে প্রকৃত ইসলাম ধর্মে পন্ডিত এত এত মোল্লা আলেম কেন প্রতিবাদ করেন না? তারা সালমান রুশদি কঠিন ইংরেজীতে ইসলাম বিদ্বেষী কি লিখেছে (আমি নিজে সেই দাঁতভাংগা বই শুরু করেও শেষ করতে পারিনি) সেসব না পড়েও প্রসংশনীয় কড়া প্রতিবাদ করতে পারেন, আর নিজ দেশের স্কুলে বিশুদ্ধ বাংলায় ইসলামের নামে এমন ভুল/মিথ্যা শিক্ষার প্রতিবাদ কেন করেন না? নাকি প্রতিবাদ করে আসছেন, আমিই আসলে জানি না? এই ধর্মশিক্ষার বই প্রথম বেরিয়েছে ’৯৬ সালে, এরপর এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে এর প্রকাশনা চলছে, লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভুল ইসলাম শিখে আসছে আর প্রকৃত ইসলাম জানা আলেম স্কলার সকলে নীরব এটা কিভাবে সম্ভব? ব্লগের সদা জাগ্রত ইসলাম রক্ষক ভাইরা আজ পর্যন্ত ইসলামের নামে এই ভয়াবহ মিথ্যাচার, ঝুটা আঞ্জাম লেপনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে কটা কলাম লিখেছেন, সেগুলি কোথায়? নাকি ওনাদের সকলের মূলনীতি আসলে আদিলের মত লোকের যখন কোরানের কোন সরল বানী পড়ে মনে হয় যে মুসলমানদের সাথে বিধর্মীদের বন্ধুত্ব নিষেধ করা হয়েছে তখন ইসলাম বিদ্বেষীদের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে সদলবলে কলম জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়া, কিন্তু সুবিখ্যাত সব কোরান তাফসিরকারক, ইমামগন আরো ভয়াবহ সব কথা বললে পরম ইসলাম হিতৈষী? ডবল ষ্ট্যান্ডার্ড কোন ধর্মবোধের ভেতর পড়ে? এত বছরেও চোখে না পড়ে থাকলে এবার কি তারা সরকারের শিক্ষা বোর্ডের কাছে সংশোধনের আবেদন জানাবেন? ধর্মশিক্ষার নামে ইসলাম বিকৃতকারীদের ব্যাপারেই বা করনীয় কি হতে পারে? প্রতি বছর লাখ লাখ ছেলেমেয়েকে ভুল ইসলাম শেখানোর দায় কি সহজ অপরাধ বলে মানা যায়? ইসলামে সাম্প্রদায়িকতা, পরধর্ম বিশ্বাস অপমানের মত কিছু নেই আর দেশের সরকার প্রকাশিত ইসলাম ধর্মশিক্ষা বইতে বছরের পর বছর কিভাবে এসব মিথ্যাচার করা হচ্ছে দেখে ইসলাম বিদ্বেষীদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্রের জাল সম্পর্কে আর সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে?

বর্তমান কালে মূল ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রবনতা সবচেয়ে বেশী ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের মাঝে। এ ধর্মের বিশিষ্টতা এখানেই, এর ফলোয়াররা মনেপ্রানে বিশ্বাস করেন যে ইসলাম অন্যান্য ধর্মের মত স্রেফ একটি বিশ্বাসই নয়, এটা সৃষ্টিকর্তা মনোনিত একমাত্র, এবং পূর্নাংগ জীবনবিধান যার প্রতিটি আদেশ নির্দেশ কোন রকমের সংশয় প্রকাশ ছাড়া মেনে চলার সাথে কোন রকম আপোষ করা যাবে না। এই নিয়ম লঙ্ঘনের পরিনতি পরকালে হবে অতি ভয়াবহ, যা সম্পর্কে তাদের বাল্যকাল থেকেই নানান ভাবে অবহিত করা হয়। কাজেই এসব ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিধিবিধান সম্পর্কে প্রশ্নাতীত আনুগত্য ইসলামী বিশ্বাসের অন্যতম মূল বৈশিষ্ট্য। ইসলামী জীবন বিধান মূলত কোরানে বর্নিত নানান আদেশ নির্দেশ, এরপর হাদীস, কখনো বা দুয়ের সমন্বয়, এ দুয়ের মাঝে কোন বিধান না পাওয়া গেলে বিশিষ্ট আলেম স্কলার প্রদত্ত রায় বা ফতোয়া যার ভিত্তি হতে হবে কোরান হাদীস বা ইসলামী মহাপুরুষদের নানান নজির বিশ্লেষন। কোরান হাদীস পড়ে বোঝা অতটা সরল নয়, এর জন্য দরকার নাজেল হবার সময়কার প্রেক্ষাপট বিবেচনা, অন্য আয়াত বা কোন হাদীসের সাথে কখনো বা সম্পর্ক আনয়ন, সাথে গভীর আরবী জ্ঞান। সোজা কথায় কোরান বুঝতে হলে শুধু কোরানের আক্ষরিক অর্থ বোঝাই যথেষ্ট নয়, কোরানের ব্যাখ্যা বা তাফসির পড়া আবশ্যক। অনেক সময়ই কোরানের কোন আয়াত সাদা চোখে পড়ে যা মনে হতে পারে বড় বড় তাফসিরকারকের ব্যাখ্যায় হুবহু তেমন অর্থ নাও হতে পারে। বাস্তব হল ইসলামী বিশ্বাস যাইই হোক কোরানের সব নির্দেশনামূলক আয়াত, সহি হাদীসে বর্নিত মহানবী ও তাঁর সরাসরি পবিত্র সাহচার্য প্রাপ্ত সাহাবীদের জীবন বিধান সব যুগে মেনে চলা যায় না। কম বেশী আপোষ করতেই হয়, যে কারনে কোরানে বর্নিত অনেক বিধান আমাদের দেশে তো বটেই এমনকি কট্টর শরিয়া আইন মেনে চলা দেশেও পালন করা হয় না। হাদিসের তো কথাই নেই। উদাহরন এত বেশী যে বলার দরকার পড়ে না। বলাই বাহুল্য যে খোদ মুসলমানদেরই কোরান হাদিসের কিছু বিধিবিধান/মূল্যবোধের সাথে এহেন আপোষের কারন শয়তান বা বিধর্মীদের ষড়যন্ত্র নয়, যুগের সাথে সামাজিক বিবর্তনের অলংঘনীয় ধারাই। মুশকিল হল সামাজিক পরিবর্তনের ফসল হিসেবে কোরান হাদীসের সব বিধিবিধান/মূল্যবোধ মানা যায় না এটা সরাসরি স্বীকার করা আবার ইসলামী মূল বিশ্বাসের পরিপন্থী, কারন তাহলে স্বীকার করে নিতে হবে যে কোরান হাদীসের বিধিবিধান যুগের সাথে অচল হয়ে যাচ্ছে, সেগুলিতে সীমাবদ্ধতা আছে।

একজন মুসলমানের জন্য এমন সরল স্বীকৃতি সরাসরি দেওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, এতে তার মুসলমানত্ব চলে যায় কিনা তা অবশ্য জানি না, তবে খুব একটা কমও বলা যায় না। ইসলাম ঘটিত যাবতীয় যেসব সমস্যা বা বিতর্ক আমরা দেখি সেগুলির মূল সমস্যা আমার মতে নিহিত আছে এখানেই। ইসলামী নীতিমালার সাথে কতটা আপোষ করা যায় তা কেন্দ্র করে নিজেদের ভেতরেই গড়ে মৌলবাদী, মডারেট নানান গ্রুপ। যেহেতু সরাসরি সব প্রাচীনপন্থী বিধিবিধান আবার সমর্থনও করা যায় না আবার বাতিল বলে ঘোষনাও করা যায় না তাই নানান রকমের কায়দা করে এ দুরূহ সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়; নিজের মনকেও প্রবোধ দিতে হয় আবার সমালোচনাকারীদেরও জবাব দিতে হয়। এসব কায়দার মধ্যে ডিফেন্সিভ পদ্ধুতি হল ‘আমাদের ঈমান নষ্ট হয়ে গেছে’ গোছের কথা বলা। অফেন্সিভ ধরনের হল নানান রকমের বাক চাতুরীর আশ্রয় নেওয়া, আরবী ভাষার নানান শব্দের নিজ দরকার মোতাবেক ব্যাবহার করা, কোরান বুঝতে আক্ষরিক অর্থই যথেষ্ট নয় ঘোষনা দিয়েও কোরানের মূল তাফসিরকারকদের এড়িয়ে আধুনিক কালের কিছু ভিডিও স্কলার যারা উকিলী দক্ষতার সাথে সব কূল রক্ষা করা মতামত দিতে পারেন তাদের শরনাপন্ন হওয়া, সর্বোপরি সরাসরি দ্বি-চারী বা ডবল ষ্ট্যান্ডার্ড নীতির আশ্রয় নেওয়া (যেমন আমার কোরানের আয়াত পড়ে ইহুদী/খ্রীষ্টানের সাথে বন্ধুত্ব মুসলমানদের জন্য নিষিদ্ধ মনে হলে আমি বিরাট বদমায়েশ কিন্তু একই কথা কিংবা আরো ভয়াবহ কথা নিজেদের অতি শ্রদ্ধ্বেয় প্রিয় আলেমগন বয়ান করলে তারা হলেন অতি শ্রদ্ধ্বেয় হযরত, সেসব বয়ান ভক্তি ও নিষ্ঠার সাথে প্রচার করা), এবং অবধারিতভাবে অসংগতি উত্থাপনকারীদের নানান ভাষায় ঐক্যতানে গালাগাল করে গায়ের ঝাল মেটানো। আমাদের আলোচিত ধর্মশিক্ষা বই এ বিনা বাধায় সাম্প্রদায়িক শিক্ষা বছরের পর বছর ধরে চলে আসার পেছনেও মূলত দায়ী এই ডবল ষ্ট্যান্ডার্ড নীতি। ডবল ষ্ট্যান্ডার্ড নীতিতে আক্রান্ত কেউ কেউ জেনেশুনে কাজটি করেন, তবে বড় সংখ্যক করেন কিছুটা নিজের অজান্তে। পরবর্তি পর্বে এসব কিছুই জলন্ত উদাহরনসহ ইসলামী দৃষ্টিতে পরধর্ম/বিধর্মী বিষয়ে কিছুটা আলোচনা করব। সাথে সাথে এই নীতির বাস্তব প্রোডাক্ট কেমন তার দুয়েকটা উদাহরন স্বল্প পরিসরে দেখব।

[লেখাটি সাম্প্রতিক সময়ের নবী মোহাম্মদকে নিয়ে বানানো কুরুচিপূর্ন ছবি বিতর্কের অংশ নয় বা সেটার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়নি]

সূত্রঃ

১। ইসলাম শিক্ষা (নবম-দশম শ্রেনী) – (জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক ১৯৯৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম দশম শ্রেনীর পাঠ্যপুস্তকরূপে নির্ধারিত)

২. মাওলানা আবদুল্লাহ ইউসুফ আলীর ইংরেজী তাফসীর অনুসরনে অনুবাদ – অনুবাদে, অধ্যাপিকা হোসনে আরা খান।