The more the Universe seems comprehensible, the more it also seems pointless – Nobel Laureate Physicist Steven Weinberg

বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউস একটি চমৎকার বই লিখেছেন সম্প্রতি – ‘A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing’ শিরোনামে[1]। বাংলা করলে বলতে পারি – ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব – কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ বইটিতে পদার্থবিদ ক্রাউস পদার্থবিদের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে শূন্য থেকে আমাদের চীরচেনা বিপুল মহাবিশ্ব উদ্ভূত হতে পারে একেবারেই প্রাকৃতিক উপায়ে। যারা লরেন্স ক্রাউসের ব্যাপারে জানেন না, তাদের জন্য দু লাইন বলি। অধ্যাপক লরেন্স ক্রাউস বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সুপরিচিত জ্যোতির্পদার্থবিদ, পিএইচডি করেছিলেন এমআইটি থেকে ১৯৮২ সালে এবং বর্তমানে অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অরিজিন’ নামের একটা বিদঘুটে প্রজেক্টের কর্নধর। এই প্রজেক্টে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, পদার্থের উৎপত্তি থেকে প্রাণের উৎপত্তি সহ নানা ধরণের প্রান্তিক বিষয় আশয় নিয়ে তার তত্ত্বাবধানে গবেষণা করা হয়।

শূন্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ব্যাপারটি নিয়ে আমি আগে বহুবারই লিখেছি। আমি আমার প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫) বইটিতে তথাকথিত শূন্য থেকে কিভাবে জড় কণিকা উৎপত্তি হয় তা নিয়ে বিশদভাবে বাঙ্গালী পাঠকদের জন্য আলোচনা করেছিলাম[2]। বছর কয়েক আগে সায়েন্স ওয়ার্ল্ডের জন্য একটি লেখা লিখতে গিয়ে আরেকটু বিস্তৃতভাবে লিখেছিলাম ‘স্ফীতি তত্ত্ব ও মহাবিশ্বের উদ্ভব’ শিরোনামে। সম্প্রতি আবারো উল্লেখ করতে হয়েছে স্টিফেন হকিং এর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইটি নিয়ে রিভিউ করতে গিয়েও (এখানে এবং এখানে )। কাজেই শূন্য থেকে মহাবিশ্বের ধারণাটি আমার কাছে নতুন কিছু ছিল না। সেদিক থেকে ক্রাউসের বইটি নিয়ে আমার না লিখলেও চলতো।

কিন্তু লিখতে হলই। কারণ, বইটির যে ব্যাপারটিতে নতুনত্ব খুঁজে পেয়েছি আমি, তা হল – বইটিতে আলোচিত হয়েছে দর্শনের সবচেয়ে প্রগাঢ় সমস্যাটি – আমাদের অস্তিত্বের একদম গোঁড়ার সমস্যা –কেনইবা একেবারে কিছু না থাকার বদলে গ্যালাক্সি, তারকাপুঞ্জ, সৌরজগত, পৃথিবী, জীবজগৎ সহ এতকিছুর অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের চারপাশ জুড়ে। এত কিছু থাকার বদলে নিঃসীম আঁধার থাকলেই বা কি ক্ষতি ছিল?

বইটি বেরিয়েছে এ বছর, অর্থাৎ ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আমি তখন বাংলাদেশের বইমেলায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আমার দুইজন প্রিয় ব্লগ লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী এবং পৃথ্বীর জন্য দুই কপি বগলে নিয়ে প্লেনে উঠে পড়লাম এবং প্লেনের দীর্ঘ যাত্রায় পড়ে ফেলি পুরো বইটা। পড়তে গিয়ে পৃষ্ঠায় ভাঁজ ফেলা বইটা শেষ পর্যন্ত কাকে গছিয়েছিলাম – ফারসীমকে না পৃথ্বীকে এখন অবশ্য মনে নেই। মনে হয় ফারসীমই হইবো!

ক্রাউসের বইটির মুখবন্ধে বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স বলেছেন, ‘জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ডারউইনের অরিজিন অব স্পিশিজ যেমনি, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ক্রাউসের শূন্য থেকে মহাবিশ্বও তেমনি’। ডারউইনের বইয়ে বর্ণিত বিবর্তন তত্ত্ব যেমন জীবজগতের ক্ষেত্রে কোন অপ্রাকৃত সত্ত্বা থাকার অনুকল্পকে বাতিল করে দিয়েছে, ক্রাউসের বইও জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অর্থাৎ, মহাবিশ্বের অস্তিত্বের পেছনে কোন অপ্রাকৃত বা অপার্থিব সত্ত্বার অস্তিত্ব থাকার সকল দাবীকে বাতিল করে দিয়েছে। তবে লরেন্স ক্রাউসের বইটিতে যাবার আগে চলুন আমাদের অস্তিত্বের সমস্যাটি নিয়ে কিছু হাল্কা আলোচনা সেরে নেয়া যাক।

কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে? – প্রথম কবে এ প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়েছিলাম তা আজ আমার মনে নেই। সম্ভবত: জঁ-পল সাত্রের (১৯০৫- ১৯৮০) অস্তিত্ববাদী দর্শন ‘বিয়িং এণ্ড নাথিংনেস’ কিংবা মার্টিন হাইডেগারের (১৮৮৯- ১৯৭৬) অধিপদার্থবিদ্যা বিষয়ক বই ‘ইন্ট্রোডাকশন টু মেটাফিজিক্স’ পড়তে গিয়ে। শেষোক্ত বইটির প্রথম লাইনটিই বোধ করি ছিল – ‘হোয়াই দেয়ার ইজ সামথিং র‍্যাদার দেন নাথিং?’। তারপর থেকে বহু বইয়ে, অসংখ্য জায়গাতেই এর উপস্থিতি টের পেয়েছি। দার্শনিক উইলিয়াম জেমস (১৮৪২ – ১৯১০) তার ‘সাম প্রবলেমস অব ফিলসফি’ গ্রন্থে এ প্রশ্নটিকে চিহ্নিত করেছিলেন ‘অন্ধকারতম দর্শন’ হিসেবে। জ্যোতির্পদার্থবিদ স্যার আর্থার বার্নার্ড লোভেল (১৯১৩ – ২০১২) একে দেখেছেন ‘ব্যক্তির মনকে ছিন্ন ভিন্ন করা’ প্রশ্ন হিসেবে। এ বিষয়ে আমার পড়া এখন পর্যন্ত সর্বশেষ বই জিম জোল্টের ‘হোয়াই ডাস দ্য ওয়ার্ল্ড এক্সিস্ট’ (২০১২)। সেখানে লেখক রসিকতা করে বলেছেন –‘সাইকিয়াট্রিক রোগীরা এই প্রশ্ন দিয়ে বরাবরই আচ্ছন্ন থাকে’!

দার্শনিকদের পাশাপাশি আছেন ধার্মিক বিরিঞ্চিবাবারাও। কিছুদিন আগ পর্যন্ত এ প্রশ্নটি ধর্মবেত্তাদের প্রিয় একটি প্রশ্ন হিসেবে বিরাজ করেছিল। বিজ্ঞানীদের মুখে কুলুপ আঁটাতে এ প্রশ্নটি উচ্ছ্বাসভরে ব্যবহার করা হত। হ্যাঁ, ‘হোয়াই দেয়ার ইস সামথিং র‌্যাদার দ্যান নাথিং’ – এ প্রশ্নটি সত্যই ছিল বিজ্ঞানীদের প্রতি বড় সড় চ্যালেঞ্জ; প্যালের ঘড়ি, হয়েলের বোয়িং, কিংবা হাল আমলের হুমায়ুনের নাইকন ক্যামেরা যেমন ধার্মিকদের তৃপ্তির ঢেকুর উৎপাদন করতো, এই প্রশ্নটিও অনেকটা বিজ্ঞান-ধর্মের বিতর্কে বিজ্ঞানের কফিনে শেষ পেরেক পোতার মতোই হয়ে উঠেছিল যেন অনেকের কাছে। মূল ধারার বিজ্ঞানীরা এতদিন ধরে এর উত্তর প্রদানে অনীহ এবং নিশ্চুপই ছিলেন বলা যায়। অনেকে আবার এ ধরণের প্রশ্ন বিজ্ঞানের বিষয় নয় বলে পাশ কাটিয়ে যেতেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে পরিস্থিতি অনেক বদলেছে। এখন অনেক বিজ্ঞানীই আস্থার সাথে অভিমত দিচ্ছেন যে তারা এর উত্তর জানেন। প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর নিয়ে হাল্কা বিতর্ক থাকলেও ধর্ম এবং দর্শনের বলয়ে পড়ে থাকা এ প্রশ্নটিতে পদার্থবিজ্ঞানীরা যে নাক গলাতে শুরু করেছেন, এবং এ নিয়ে একটা অবস্থানে পৌঁছুতে চাইছেন সেটি এখন মোটামুটি নিশ্চিত। সেজন্য বেশ ক’বছর ধরেই দেখছি পদার্থবিজ্ঞানীদের লেখা বইগুলোতে বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসতে। আমি পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘গড দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ এবং ব্যাখ্যা দেখেছি, দেখেছি বিজ্ঞানী হকিং-ম্লোডিনোর ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে, এবং অবশ্যই পদার্থবিদ লরেন্স ক্রাউসের ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব – কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ বইটিতেও, যেটি আজকের প্রবন্ধের অন্যতম আলোচ্য বই হিসেবে নিয়েছি। পাঠকেরা নিশ্চয় লক্ষ্য করেছেন ক্রাউসের বইটির শিরোনামটিই কেন্দ্রীভূত হয়েছে ধার্মিকদের ছুঁড়ে দেয়া প্রিয় এ প্রশ্নকে উপজীব্য করে। বলা বাহুল্য যে সমস্ত মূলধারার পদার্থবিদের কথা আমি উল্লেখ করেছি আমার লেখায়, তারা সবাই বিজ্ঞানের চোখ দিয়েই সমস্যাটি মোকাবেলা করেছেন এবং সমাধানে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছেন, ধর্মবেত্তা কিংবা দার্শনিকদের মত নানা পদের ত্যানা না পেঁচিয়ে। যেমন, ক্রাউস তার বইয়ে বলেছেন (‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, পৃষ্ঠা ১৪৩) –

‘আমাদের মহাবিশ্বের আধুনিক বিজ্ঞানের ছবি, এর ইতিহাস, সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ, এবং সর্বোপরি শূন্য বলতে আসলে কী বোঝায় তা অনুধাবন এবং পর্যালোচনা করে আমরা এটুকু বলতে পারি যে, এখন এ প্রশ্নটিকে মোকাবেলা করার জন্য সবচেয়ে ভাল অবস্থায় আছি’।

লরেন্স ক্রাউস কোন অতিশয়োক্তি করেননি। একটা সময় ভাবা হত ‘নাথিং’ ব্যাপারটা হচ্ছে বস্তুর কিংবা জগতের জন্য স্বাভাবিক অবস্থা, আর ‘সামথিং’ ব্যাপারটা আরোপিত। যেমন জার্মান গণিতবিদ লিবনিৎস তার ১৬৯৭ সালে লেখা ‘অন আল্টিমেট অরিজিন অব থিংস’ নামক একটি প্রবন্ধে এ বিষয়ে অভিমত দেন এই বলে যে, ‘নাথিং’ ব্যাপারটা স্বতঃস্ফূর্ত, কিন্তু অন্যদিকে ‘সামথিং’ ব্যাপারটা অর্জন করতে কাজ করতে হয়[3]। আর এমনি এমনি নাথিং থেকে সামথিং এ উত্তরণ ঘটেনা বাইরের কোন কিছুর হস্তক্ষেপ ছাড়া। লিবনীৎসের কাছে এর সমাধান ছিল যথারীতি ‘ঈশ্বর’।

তারপর থেকে এভাবেই আমাদের দিন গেছে। ‘কেন কোন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?’ উত্তর খুব সোজা – কারণ হলেন ঈশ্বর। আসলে স্টিফেন হকিং এবং তার সমসাময়িক অন্যান্য ট্যাটনা বিজ্ঞানীদের হাতে সত্তরের দশকে ‘কোয়ান্টাম কসমোলজির’ জন্ম হবার আগ পর্যন্ত বিজ্ঞান এর বিপরীতে সফল উত্তর দিতে পারেনি, ঠিক যেমনি ডারউইন আসার আগ পর্যন্ত আমরা প্যালের ডিজাইন আর্গুমেন্টকে ঠিকমতো দলাই মলাই করার উপকরণ খুঁজে পেতামনা। তারপরেও কিছু ঘার ত্যাড়া দার্শনিক যে ছিলেন না তা নয়। তারা এ ধরণের ‘হোয়াই দেয়ার ইজ সামথিং র‍্যাদার দেন নাথিং’ মার্কা প্রশ্ন মুচকি হেসে বলতেন, তা যদি ‘নাথিং’ ব্যাপারটা স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত হয়, তাহলে ঈশ্বরেরই বা থাকার দরকার কি ছিল? Why there is God rather than nothing?[4] ‘নাথিং’ বাবাজিকে প্রতিহত করতে অদৃশ্য অপ্রমাণিত ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে দেখানো যাবে, কিন্তু বাস্তব যে মহাবিশ্বটা আমরা চোখের সামনে হরহামেশা দেখছি সেটাকে নয়, এ ব্যাপারটা একটু হাস্যকর হয়ে যাচ্ছে না? এমনকি অন্তিম প্রশ্নগুলোর উত্তর হিসেবে ঈশ্বরকে সাক্ষীগোপাল করে হাজির করার ব্যাপারটা যে আসলে কোন উত্তর নয়, তা কৃষক দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের মাথায়ও এসেছিল। এ জন্যই ‘সত্যের সন্ধান’ বইয়ে তিনি প্রশ্ন করেছেন – ‘ঈশ্বর সময়কে সৃষ্টি করেছেন কোন সময়ে?’ কিংবা ‘স্থানকে সৃষ্টি করা হলো কোন স্থানে থেকে?’ কিংবা ‘শক্তি সৃষ্টি করা হলো কোন শক্তি দ্বারা?’[5]। ধার্মিকেরা এই ধরণের প্রত্যুত্তরে খুব একটা ভাল উত্তর কখনোই দিতে পারেননি। বরং গোসসা করেছেন। এক দুর্মুখ নাস্তিক একবার খ্রিষ্টীয় ধর্মবেত্তা সেন্ট অগাস্টিনকে জিজ্ঞাসা করেছিল – ‘ফাদার, এই মহাবিশ্ব বানানোর আগে ঈশ্বর বাবাজি কী করছিলেন বলুনতো?’ অগাস্টিন রাগে ক্ষেপচুরিয়াস হয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তোদের মত লোক, যারা এ ধরণের প্রশ্ন করে, তাদের জন্য জাহান্নাম তৈরি করছিলেন ঈশ্বর’!

তবে ধার্মিকেরা গোস্বা করলেও দার্শনিকেরা এভাবে সবসময়ই লিবলীৎসের উপসংহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে গেছেন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। আগেও করেছেন, এখনো করছেন। যেমন, এই সেদিন দেখলাম জার্মান দার্শনিক এডলফ গ্রুনবোমের একটি সমালোচনা – ‘দ্য পভার্টি অব থিইস্টিক কসমোলজি’ নামে[6]। প্রবন্ধটিতে পদ্ধতিগত-ভাবে লিবনীৎসের উপসংহারের সমালোচনা হাজির করেছেন, এই সময়ের প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী শন ক্যারল সেটা তার একটি ব্লগে উল্লেখ করেছেন এখানে

তবে সনাতন দার্শনিকেরা উত্তর দিতে পারলেও আমার মতে সেগুলো ছিল মোটা দাগে স্রেফ ‘পিছলামী কথার প্যাঁচ-ঘোচ’, বৈজ্ঞানিক কোন সমাধান নয়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হল – লিবনীৎসের সময়কালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং এ সংক্রান্ত অগ্রগতি সম্বন্ধে বিজ্ঞানীদের কোন ধারনাই ছিল না। চোখের সামনে দেখা বিশ্বজগতের জন্য যে নিয়ম প্রযোজ্য, সেটার ভিত্তিতেই তারা এবং তাদের মত দার্শনিকেরা সিদ্ধান্ত নিতেন। তারা জানতেন না যে, তাদের দৃশ্যমান জগতের বাইরে বিশাল একটা জগৎ আছে; এই সেই আন্তঃআণবিক জগৎ, যে জগতের নিয়মগুলো অনেকটা হ্যারি পটারের গল্পের ‘হগওয়ার্টস স্কুল’-এর নিয়ম কানুনের মতোই অদ্ভুত। আমাদের দৃশ্যমান জগতে আমরা শূন্য থেকে কিছু তৈরি হতে দেখি না, কিংবা আমরা আমাদের বাড়ীর ইটের দেয়াল দেয়াল ভেদ করে হেঁটে ওপারে চলে যেতে পারি না। কিন্তু কোয়ান্টাম জগত যেন ভিন্ন, এখানে কণা আর প্রতি-কণারা রীতি মত শূন্য থেকে উদ্ভূত হয়, নিশ্চিত অবস্থান নেয়ার বদলে সম্ভাবনার বলয়ে থাকতে পছন্দ করে, আর মাঝে মধ্যেই তারা ‘কোয়ান্টাম টানেলিং’ এর মাধ্যমে দুর্লঙ্ঘ্য বাধার প্রাচীর গলে চলে যায় অশরীরী সত্তার মতোই। কোয়ান্টাম জগতের নিয়ম কানুনগুলোকে অবাস্তব ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। এটা আমার এই প্রবন্ধের মতোই নিখাদ বাস্তব। যারা ইলেকট্রনিক্সের যন্ত্রপাতি নিয়ে নাড়াচাড়া করেন তারা সবাই টানেল ডায়োড এবং জোসেফসন জাংশনের কথা জানেন[7], এগুলো কিন্তু কোয়ান্টাম রাজ্যের হ্যারি পটারের সেই ‘হগওয়ার্টস স্কুল’-এর মতো নিয়ম কানুনের উপর ভর করেই চলে। এমনকি আমাদের পরিচিত সূয্যি মামার ভেতরে অনবরত যে হাইড্রোজেনের ফিউশন ঘটে চলছে বলে আমরা জানি, সেটাও কিন্তু কোয়ান্টাম জগতের নীতি মেনেই হচ্ছে[8]

বিগত সত্তর এবং আশির দশকে বিজ্ঞানীরা কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখলেন, কোয়ান্টাম জগতে ‘নাথিং’ ব্যাপারটি ডিফল্ট কিছু নয়, বরং ‘সামথিং’ ব্যাপারটাই বরং সেখানে ‘ডিফল্ট’। নাথিং ব্যাপারটা সেখানে মোটা দাগে ‘আনস্টেবল’ বা অস্থিতিশীল। শূন্যতা অস্থিতিশীল বলেই ওটা কখনো শান্ত সমাহিত ভাবে পড়ে থাকতে পারে না, সেখানে অনবরত ভাবে তৈরি হতে থাকে অসদ কণিকা, অহর্নিশি চলতে থাকে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের রহস্যময় খেলা। এরিস্টটল বহু আগে প্রকৃতিজগৎ দেখে মন্তব্য করেছিলেন, ‘প্রকৃতি শূন্যতাকে একদম পছন্দ করে না’। এরিস্টটল কোয়ান্টাম জগতকে দেখে যাওয়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু তার এই উচ্চারণ কোয়ান্টাম জগতের জন্য যেন হাড়ে হাড়ে সত্য হয়ে গেছে[9]

‘নাথিং’ ব্যাপারটা যে অস্থিত এবং নড়বড়ে টাইপের কিছু, তা আমি প্রথম জানতে পারি নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক উইলজেক এর একটি প্রবন্ধের মাধ্যমে[10]। সায়েন্টিফিক আমেরিকানে ১৯৮০ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘The Cosmic Asymmetry Between Matter and Antimatter ’ । মহাবিশ্বের উৎপত্তির ঊষালগ্নে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ যখন উদ্ভূত হয়েছিল এক রহস্যময় কারণে প্রকৃতি প্রতিপদার্থের তুলনায় পদার্থের প্রতি খুব সামান্য হলেও পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েছিল। এই পক্ষপাতিত্বের ব্যাপারটা যদি না ঘটতো, তাহলে আজ আমরা এখানে বসে বসে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে এই আঁতেলেকচুয়াল প্রশ্ন করার সুযোগ পেতাম না। ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার একে অপরকে আলিঙ্গন করে ধ্বংস করে দিত, আর আমাদের সামনে তখন চেনা জানা পদার্থ, জীবজগত নক্ষত্ররাজির বদলে থাকত কেবল তেজস্ক্রিয়তায় পরিপূর্ণ অবারিত এক শূন্যতা। আমাদের এই পার্থিব প্রাণ-চাঞ্চল্যের বদলে বিরাজ করতো একেবারে কবরের নিস্তব্ধতা। তবে একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য। কোন ‘অলৌকিক’ কোন কারণে এই পক্ষপাতিত্ব ঘটেনি। আর এমনও নয় যে প্রকৃতিকে বিশাল কোন পক্ষপাতিত্ব দেখাতে হয়েছিল এর জন্য। বরং বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন সূচনা লগ্নে পদার্থ-প্রতিপদার্থের মধ্যে এক বিলিয়নের এক ভাগ মাত্র অসমতাই খুলে দিতে পারতো আমাদের এই চেনা জানা মহাবিশ্ব তৈরি হবার দুয়ার। আর সত্য বলতে কি – ঠিক তাই সম্ভবত হয়েছে। আজকের মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ বা কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ঠিক তেমনটিই দেখছেন, যা তারা তাত্ত্বিকভাবে গণনা করে পেয়েছিলেন[11]। ফ্রাঙ্ক উইলজেক তার সেই প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন কীভাবে অলৌকিক নয়, বরং নিতান্ত প্রাকৃতিক উপায়ে প্রতিসাম্যতার ভাঙনের মাধ্যমে শুরুতে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থের মধ্যকার অসমতা তৈরি হয়েছিল, এবং তার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল – হ্যাঁ, যে কথাটা আগে আমি বলেছি – ‘শূন্য ব্যাপারটা অস্থিতিশীল’। ব্যাপারটা তিনি তার পেপারে লিখেছিলেন এভাবে[12]

‘ধারণা করা যায় যে, মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল যতদূর সম্ভব সর্বোচ্চ প্রতিসম দশার (symmetrical state) মধ্য দিয়ে, এবং এ দশায় কোন পদার্থের অস্তিত্ব ছিল না, মহাবিশ্ব ছিল একটি ভ্যাকুয়াম। দ্বিতীয় দশায় পদার্থ এলো। এই দশায় প্রতিসাম্যতা ছিল কিছুটা কম, কিন্তু শক্তিও ছিল কম। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষাকৃত কম প্রতিসম দশা এসে সেটি বেড়ে গেল খুব দ্রুত। এই অবস্থান্তরের ফলে যে শক্তি নির্গত হল সেটা কণা তৈরি করল। এই ঘটনা মহাবিস্ফোরণ বা বিগব্যাং হিসেবে চিহ্নিত করা যায় … কাজেই “কেন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?” – প্রাচীন এ প্রশ্নটির যথার্থ উত্তর হল – ‘নাথিং’ ব্যাপারটা অস্থিতিশীল’[13]

জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানদের দেয়া সর্বাধুনিক তত্ত্ব থেকে আমরা এখন জানি যে, আমাদের এই মহাবিশ্ব একটি ‘কোয়ান্টাম ইভেন্ট’ হিসেবেই একসময় আত্মপ্রকাশ করেছিল[14]। কাজেই কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মূল সূত্রগুলো মহাবিশ্বের উৎপত্তির সময়ও একইভাবে প্রযোজ্য হবে সে আর নতুন কি! এটা বললাম বটে, কিন্তু সেটা করতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা দেখলেন শূন্য থেকে মহাবিশ্বের আবির্ভাব কেবল সম্ভব তাই নয়, রীতিমত অবশ্যম্ভাবী। সেজন্যই ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ বইয়ে স্টিফেন হকিং বলেছেন তার বহুল পঠিত এই উক্তিতে [15]

‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সূত্রের মতো পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন সূত্র কার্যকর রয়েছে, তাই একদম শূন্যতা থেকেও মহাবিশ্বের উৎপত্তি সম্ভব এবং সেটি অবশ্যম্ভাবী। ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপত্তি’ হওয়ার কারণেই ‘দেয়ার ইজ সামথিং, র‌্যাদার দ্যান নাথিং’, সে কারণেই মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের। মহাবিশ্ব উৎপত্তির সময় বাতি জ্বালানোর জন্য ঈশ্বরের কোন প্রয়োজন নেই।’

আসলে কোয়ান্টাম শূন্যতা অস্থিতিশীল বলেই সেখানে ‘স্বতঃস্ফূর্তভাবে উৎপত্তি’র মাধ্যমে বস্তু কণার উদ্ভব অবশ্যম্ভাবী। ব্যাপারটি খোলাসা করেছেন লরেন্স ক্রাউসও তার সাম্প্রতিক ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বইয়ে (‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, পৃষ্ঠা ১৬৯) :

‘কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির ক্ষেত্রে মহাবিশ্ব শূন্য থেকে উদ্ভূত হতে পারে, এবং হবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সে সমস্ত মহাবিশ্ব ফাঁকা হবার দরকার নেই, তাতে পদার্থ এবং শক্তি থাকতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত না এর মাধ্যাকর্ষণের সাথে যুক্ত ঋণাত্মক শক্তি সহ এর সর্বমোট শক্তি শূন্য হবে’।

এবং বইয়ে ক্রাউসের সুচিন্তিত উপসংহার ছিলো এরকমের (‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’, পৃষ্ঠা ১৭০) –

‘ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার। কোয়ান্টাম মাধ্যাকর্ষণ কেবল মহাবিশ্বকে শূন্য থেকে উদ্ভূত হতে কেবল অনুমতি দিয়েই ক্ষান্ত হয় না, একেবারে অবশ্যম্ভাবী করে তুলে। কারণ, স্থান কালের অবর্তমানে যে শূন্যাবস্থার কথা আমরা বলছি সেটা একেবারেই আনস্টেবল বা অস্থিতিশীল ।

এর পরেও ব্যাপারটা আমি পরিষ্কার করতে না পারলে সেটাকে আমার অক্ষমতা বলেই ধরে নেব। কথার প্যাচপ্যাচানি না বাড়িয়ে ভিডিও বাবার উপর ভরসা রাখি বরং। ইউটিউবের একটা লিঙ্ক হয়ত এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে, তবে মোল্লাদের তাণ্ডবে সরকার ইউটিউব বন্ধ করে দিয়েছে, কাজেই ভিডিও এম্বেডেড না করে লিঙ্কায়িত করে দিলাম ।

যা হোক, একই বক্তব্যের প্রতিফলন আমরা দেখি পদার্থবিদ ভিক্টর স্টেঙ্গরের এই প্রবন্ধে এবং আরেকটু বিস্তৃতভাবে এখানে। অধ্যাপক স্টেঙ্গারও তার প্রবন্ধ দুটি শেষ করেছেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক উইলজেকের পেপার থেকে উদ্ধৃতিটি হাজির করে, যেখানে তিনি অভিমত দিয়েছেন কোয়ান্টাম স্তরে ‘নাথিং’ ব্যাপারটা অস্থিতিশীল’।

স্কেপ্টিকস সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সংশয়বাদী দার্শনিক মাইকেল শারমার সম্প্রতি ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’[16] এবং তার সম্পাদিত ‘স্কেপ্টিক’[17] পত্রিকায় এ বিষয়টি নিয়ে দু’ দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। স্কেপ্টিক পত্রিকায় প্রকাশিত দ্বিতীয় প্রবন্ধটিতে কেন কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে – এই রহস্যের সমাধান করতে গিয়ে অন্ততঃ বারোটি সমাধান হাজির করেছেন। তার মধ্যে ধার্মিকদের ‘ঈশ্বর অনুকল্প’টি বাদ দিলে শারমার আরো যে এগারোটি সমাধান হাজির করেছেন তার সবগুলোই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের দেওয়া বৈজ্ঞানিক সমাধান, যেগুলোতে অপার্থিব এবং অলৌকিক কোন সত্তা আমদানি না করেই ব্যাপারটিকে মোকাবেলা করা যায়। এর মধ্যে লরেন্স ক্রাউসের সমাধানটি সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক সমাধান বলে মত দিয়েছেন শারমার – ‘শূন্যতা অস্থিতিশীল’ ।

এবং এটাই ‘বিজ্ঞানের চোখে’ আমাদের অস্তিত্বের মূল কারণ। এই জন্যই কিছু একদম না থাকার বদলে কিছু আছে বলে আমরা জানি। অন্ততঃ আধুনিক বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখলে সেটাই এর এখন পর্যন্ত পাওয়া সর্বশেষ উত্তর ।

:line:

তথ্যসূত্র –
[1] Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012.

[2] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী (অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫, পুনর্মূদ্রণ ২০০৬) ; মূল বইয়ের সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।

[3] Leibniz, “On the Ultimate Origination of the Universe”, 1697

[4] Victor Stenger, God: The Failed Hypothesis: How Science Shows That God Does Not Exist, Prometheus Books, 2007

[5] আরজ আলী মাতুব্বর রচনা সমগ্র, পাঠক সমাবেশ।

[6] Grunbaum, Adolf. “The Poverty of Theistic Cosmology” in Brit. J. Phil. Sci. 55, 4, 2004.

[7] লিও এসাকি, ইভার গিয়াভার এবং ব্রায়ান জোসেফসন ১৯৭৩ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পান। এসাকি টানেল ডায়োড আবিষ্কার করেছিলেন, এবং ব্রায়ান জোসেফসন আবিষ্কার করেছিলেন জোসেফসন জাংশন। এ দুটো যন্ত্রই কোয়ান্টাম টানেলিং এর মাধ্যমে কাজ করে।

[8] বিজ্ঞানী হ্যান্স বিথে ১৯৬৭ সালে নোবেল পুরষ্কার পান তারার ভিতরকার ফিউশন প্রক্রিয়া সফলভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য।

[9] Frank Close, Nothing: A Very Short Introduction, Oxford University Press, 2009

[10] Frank Wilczek, “The Cosmic Asymmetry Between Matter and Antimatter,” Scientific American 243, no. 6, 82-90, 1980

[11] Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012

[12] Frank Wilczek, পূর্বোক্ত।

[13] বোল্ড করা অংশটির মূল ইংরেজী পেপারে ছিল এরকম – “The answer to the ancient question ‘Why is there something rather than nothing?’ would then be that ‘nothing’ is unstable.”

[14] এ প্রসঙ্গে স্টিফেন হকিং তার গ্র্যন্ড ডিজাইন বইয়ের ষষ্ঠ অধ্যায়ে লিখেছেন (অনুবাদ তানভীরুল ইসলাম) – “যদিও আমরা এখনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষের কোনো পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব পাইনি তারপরও আমরা জানি মহাবিশ্বের সূচনা একটি কোয়ান্টাম ঘটনা। ফলে, আমরা যেভাবে কোয়ান্টাম তত্ব এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাকে বিশেষভাবে মিলিয়ে মহাস্ফিতির তত্ত্ব নিরূপণ করেছি, সেভাবে যদি আরো অতীতে যাই এবং মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কেই জানতে চাই, তাহলেও অবশ্যই সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সম্পর্কে আমর যা কিছু জানি তার সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বকে মেলাতে হবে।”।

[15] Stephen Hawking & Leonard Mlodinow, The Grand Design, Bantam, 2010

[16] Michael Shermer, Much Ado about Nothing, Scientific American, April 27, 2012.

[17] Michael Shermer, Nothing is Negligible: Why There is Something Rather than Nothing, Skeptic, Vol 17, No. 3, 2012.