লিখেছেন: পাভেল মাহমুদ

cyujyy

আমার ল্যাবমেট গোঁড়া ক্রিশ্চিয়ান। বিবর্তন তো দূরে থাক সে বিশ্বাস করেনা পৃথিবীর বয়স ছয় হাজার বছরের বেশী। লাঞ্চ টাইমে আমরা অন্য ল্যাবমেটরা মাঝে মধ্যে কনজারভেটিভ রিপাবলিকানদের নিয়ে হাসি তামাশা করি। কখনো কখনো বাইবেল, জেসাসও বাদ পড়েনা আমাদের ফাজলামির হাত থেকে। আমাদের গোঁড়া ক্রিশ্চিয়ান ল্যাবমেট এইসব আলোচনায় অংশ নেয়না। কিন্তু সে কখনো আমাদের হাসি-তামাশায় ক্ষেপেও ওঠেনা, কিংবা বলেনা তার ধর্মীয় অনুভূতি আহত হয়েছে। আমি ভাবছিলাম, ঠিক কি কারণে তার অনুভূতি আহত হয়না অথচ একটা ইউটিউব ভিডিও মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে আহত করে, ক্ষুদ্ধ করে তোলে?

উত্তরটা সম্ভবত ‘এক্সপেক্টেশন’। আমার ল্যাবমেট আশা করেনা সবাই জেসাসকে নিয়ে ভালো কথা বলবে। সে জানে জেসাস তার ব্যাক্তিগত বিষয় না, অন্য মানুষ তাকে নিয়ে কথা বলবে, কখনো সমালোচনা করবে, কখনো উপহাস করবে। তার ভাল না লাগলে, সে এই আলোচনা যেখানে হচ্ছে সেখান থেকে চলে যাবে। সে জানে তার এই কথা বলার অধিকার নাই যে, “তোমরা কেউ জেসাসকে নিয়ে বাজে কথা বলবে না।”

আমার ল্যাবমেট কোন বিচ্ছিন্ন উদাহরণ নয়। বেশীরভাগ ক্রিশ্চিয়ান এভাবেই চিন্তা ভাবনা করে। কিন্তু কেন তাদের ‘এক্সপেক্টেশন’ মুসলিমদের তুলনায় এত কম? আমি সমাজ বিজ্ঞানী না হয়েও বলতে পারি এটা একদিনে হয়নি। বরং শত শত বছর ধরে চার্চের সাথে আধুনিক চিন্তা ভাবনার সংঘর্ষের ফলাফল আজকের তুলনামূলক শান্ত পরিস্থিতি। এর জন্য বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ অনেককেই শূলে চড়তে হয়েছে।

মুসলিমদের মধ্যে তারা ক্রিশ্চিয়ানিটি এবং অন্য সব ধর্ম থেকে ভাল এমন ভাবার প্রবণতা আছে। আসলেই তারা ভাল কি মন্দ সেই আলোচনায় না গিয়েও বলা যায় ‘এক্সপেক্টশনের’ দিক থেকে তারা এখনো ১৬’শ শতকে পড়ে আছে। কোরাণে বলা আছে, হাদিসে বলা আছে; ইসলাম-মুহাম্মাদ-কোরাণ নিয়ে কোন সমালোচনা করা যাবেনা, হাসি-তামাশা করা যাবেনা। মুসলিম হলেও করা যাবেনা, অমুসলিম হলেও করা যাবেনা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও, অমুসলিমরা মঙ্গল গ্রহে বাস করেনা। তারা ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবের বদৌলতে মুসলিমদের আশে-পাশেই থাকে। ছয় বিলিয়ন মানুষের পৃথিবীতে সব সময়ই ডকিন্স, হিচেন্স, হ্যারিসের মতো কিছু লোক থাকবে যারা যুক্তি দিয়ে বই লিখে ইসলামের বিরোধিতা করে যাবে, সালমান রুশদীর মতো কিছু লোক থাকবে যারা ইসলাম মুহাম্মদ মিশিয়ে ফ্যান্টাসি নভেল লিখবে, ভ্যান গগের মতো কিছু লোক ভিডিও বানাবে, কিছু লোক কার্টুন আঁকবে। আবার টেরি জোন্সের মতো কিছু সাইকোও থাকবে। তাই, মার্ক জুকারবার্গের এই জগাখিচুড়ি পৃথিবীতে কেউ কখনো কোরাণ-মুহাম্মদ-ইসলাম নিয়ে হাসি-তামাশা করবেনা এমনটা ভাবাও একটা তামাশা।

একটি বড় জনগোষ্ঠীতে অনেক ধরনের মানুষ থাকে। ইউটিউব ভিডিও দেখে সবাই এমব্যাসী ভাঙতে ছোটেনা। কিন্তু কি পরিমাণ লোক ছুটে যায় ভাংচুর করতে তা দেখে যারা ঘরে বসে থাকে তাদের বড় একটা অংশ সম্পর্কে ভাল ধারণা পাওয়া যায়। ঘরে বসে তারা রায় দেয়, ঠিক এইখানে, না না ঐখানে, মুহাম্মদকে অপমান করা হয়েছে, কোরাণকে অসম্মান করা হয়েছে, ইসলামকে ছোট করা হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এরাই শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের দাবী জানায়। অথচ ভাল মতোই জানে তাদের জনগোষ্ঠির একটি বড় অংশ এখনো বাস করে হাজার বছর আগের কোন সময়ে, ‘শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ’ যাদের অভিধানে এখনো যুক্ত হয়নি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে নামিয়ে আনা যায় মুসলিম জনগোষ্ঠির এই ‘এক্সপেক্টেশন’? খুব বেশি কিছু না করলেও আশা করা যায় ৪০০ বছরে মুহাম্মদ-কোরাণ-ইসলাম নিয়ে তাদের ওভার-সেন্সিটিভিটি নেমে আসবে আজকের ক্রিশ্চিয়ানদের ‘জেসাস’ লেভেলে। সমস্যা হচ্ছে ১৬’ শতকের ডাইনামিক্স এখন আর নেই। তখন সাইন্স ছিলনা, ইন্টারনেট ছিলনা, ম্যাস-মার্কেট পেপারব্যাক বই ছিলনা, কার্টুন ছিলনা, মুভি ছিলনা। আজ আধুনিক মানুষ অজস্র মিডিয়ামে তাদের মতপ্রকাশ করতে পারে। সমালোচনা, উপহাস, হাসি-তামাশা বন্ধ করার কোন উপায় নেই। তাই, সময় এসেছে মধ্যম-পন্থি ঘরে বসে থাকা মুসলিমদের ‘এক্সপেক্টেশন’ নিজে থেকেই নামিয়ে আনার। টম-ডিক-হ্যারী ইসলামের সমালোচনা করবে, কার্টুন আঁকবে, ভিডিও বানাবে। এই অধিকার এমনকি টেরি জোন্স সাইকোরও আছে। এর মধ্যে কারো কারো গঠনমূলক উদ্দেশ্য থাকবে, কারো কারো উদ্দেশ্য থাকবে অহেতুক খেঁপিয়ে তোলার। যত তাড়াতাড়ি মধ্যম-পন্থি মুসলিমরা সত্যটা বেছে নিয়ে আবর্জনাটা বর্জন করতে শিখবে, উপলদ্ধি করবে আবর্জনাটা ছুড়ে দেয়ার অধিকারও একজনের আছে, এবং তাদের হাজার বছর অতীতে বাস করা ভাইদের এটা বোঝাবে, তত তাড়াতাড়ি সবার জন্য মঙ্গল।