“এইসব গাছেদের পূর্ব পূর্ব পুরুষের প্রাণ
তুমি স্পর্শ করেছিলে হাতে তুলে। বৈঁচি বাবলায়
জল বা আলোর ফোঁটা কতটা একাগ্র হয়ে পড়ে
শিষ থেকে শিষে যেতে পতঙ্গের কী গতি পাখায়
বনের কোন্ দিক থেকে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা গন্ধ আবির্ভূত।
কোথায় মাটির পারে অজানা বসতিশূন্য দেশ-
তুমি তার পরীক্ষাও নিয়েছিলে প্রাণ নেড়ে চেড়ে
এইসব মৃত্তিকার, এইসব মাটিমেদিনীর
আকর্ষণ, গন্ধ, দান, ধরেছিলে স্বীয় শস্যমুখে
মাটিতে বিছানো হাত আজও বুঝি টের পাই তোমার-
বিছানো, ছড়ানো হাত, হাতের রেখায় বহুমুখী
ছাপ, চিহ্ন, ভবিতব্য, গমনামগমন, কৃষিকাজ
এক যুগ থেকে অন্য যুগে হাত রাখা
করতলে খোলা যেত নিজে থেকে উল্টেপাল্টে গিয়ে
লুপ্ত বীজ ঠেলে তোলে হাতের পাতার থেকে গাছ।
গোল হয়ে পাখি ঘোর গ্রামান্তের আকাশে আকাশে
গন্ধে বশীভূত হয়ে, পালকের রঙে অন্ধ হয়ে
আমার সকল আত্মা এ বন সন্ধান করে ফেরে
যেন সেও লতা ছিল। ছিল সে লতায় বসা পাখি।
এইসব পাখিপক্ষী, ভিতরে অনেক মুক্ত রঙ
এইসব মৃত্তিকার অনেক ভাইভগিনী ছিল
এইসব পরিবার দূরে দূরে আলোজ্বলা কুঁড়ে
এক থালা দুঃখের ভাত, একযোগে গালগল্পে খাওয়া
এইসব লেপ-তোশক গায়ে টেনে সারি সারি ঘুম
মাটির আধারে ঘুম, অথবা জলের ধারে ধারে
দেহ ঢেলে পড়ে থাকা যেখানে তোমার মাটিদেশ
তোমার লেখার কাশ, তোমার লেখার উলুবনে
ঢুকে পড়া, ঘোরতর জঙ্গলের অতি পৌরাণিক
অধিষ্ঠাতা আছে বুঝি, ঈশ্বরেরও প্রাণ হাতে আসে।
তোমার পথের সাথে চলে গিয়ে, স্থির জনপদ…
শতশত দরকার সেইখানে স্তূপ হয়ে পড়ে।”

[এখানে তোমার মাটিদেশ, ২: জয় গোস্বামী]

একশো ষোল বছর আগে আজ জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের অনন্য এক প্রতিভা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সেসময়ের প্রথা মান্য করে জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাঁরও জন্ম হয় মাতুলালয়ে, কাঁচড়াপাড়ার কাছাকাছি ঘোষপাড়া-মুরাতিপুর গ্রামে। পৈতৃক ভিটে ছিলো যশোর জেলার (এখন চব্বিশ পরগনায় পড়েছে) বনগ্রাম মহকুমায় ব্যারাকপুর গ্রাম। তারাশঙ্কর যেমন তাঁর শেকড়সিঞ্চনের উৎস হাঁসুলীবাঁকের কথা ও কাহিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথায়’-য়, তেমনি ব্যারাকপুরের পাশের প্রবাহিণীকে বিভূতিভূষণ অমর করে রেখেছেন তাঁর ‘ইছামতী’ উপন্যাসে। পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন শাস্ত্রজ্ঞ, পেশা ছিলো তাঁর পুরাণের কথকতা। মায়ের নাম মৃণালিনী দেবী। পিতা ‘পথের পাঁচালী’-র হরিহরের মতোই কিছুটা উদাসীন, ভ্রমণপিয়াসী। কিছুটা গুণ সেসব বর্তেছে তাঁতেও। মাত্র ৫৬ বছর বয়েসে তাঁর মৃত্যু হয়, কিন্তু তার আগেই তিনি বাঙালি পাঠকের কাছে সমাদৃত ও পরিচিত হয়ে ওঠেন তাঁর লেখার গুণে। সাদামাটা প্লট, বাঙালিজীবনের অতিপরিচিত দৃশ্যকল্প, মাটির পৃথিবী ও আকাশের তারায় ডিটেলের বিস্তার তাঁকে ততদিনে বাংলা সাহিত্যের উঠোনে অনেক গভীরে শেকড়-গজানো এক মহীরুহ করে তুলেছে।

আপামর বাঙালির কাছে শুধু ‘পথের পাঁচালী’-র কথাই ফেরে মুখে মুখে। কিন্তু, এছাড়াও তিনি যে কত অমূল্য রত্ন রেখে গেছেন, তার সাথে আমরা পরিচিত নই অনেকেই। অনেক বিচিত্র উপন্যাস, অগণিত মন-কাড়া ছোটগল্প, হৃদয়হরণ কিশোর উপন্যাস, সাবলীল ভ্রমণকাহিনি-কথাসাহিত্যের নানান দিকেই ছিলো তাঁর মসৃণ, বিশদ বিচরণ। অনেকেই তাঁকে ভাবেন স্রেফ গ্রামীণ জীবনের নিস্তরঙ্গ রূপের একনিষ্ঠ চিত্ররূপকার। কিন্তু, বহিরঙ্গে নির্লিপ্তির উপস্থিতি থাকলেও তাঁর পর্যবেক্ষণক্ষমতা ছিলো অনন্য। শহুরে জীবনের নানান দিকও তাঁর একাধিক লেখায় ঠাঁই পেয়েছে। এক লেখায় তিনি নিজেই বলেছেন, “গভীর রহস্যময় এই মানব-জীবন। এর সকল বাস্তবতাকে এর বহুবিচিত্র সম্ভাব্যতাকে রূপ নেওয়ার ভার নিতে হবে কথাশিল্পীকে। তাকে বাস করতে হবে সেখানে, মানুষের হট্টগোল, কলকোলাহল যেখানে বেশী, মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের সুখ-দুঃখকে বুঝতে হবে, যে বাড়ীর পাশের প্রতিবেশীর সত্যিকার জীবনচিত্র লিখেছে, যে সকল যুগের সকল মানুষের চিত্রই এঁকেছে-চাই কেবল মানুষের প্রতি সহানুভূতি, তাকে বোঝার ধৈর্য। ফ্লবেয়ার বলেছেন, মানুষে যা কিছু করে, যা কিছু ভাবে, সবই সাহিত্যের উপাদান, তাই তাকে লিখতে হবে, শোভনতার খাতিরে তিনি যদি জীবনের কোন ঘটনাকে বাদ দেন, চরিত্রের কোন দিক ঢেকে রেখে অঙ্কিত চরিত্রকে মাধুর্য-মণ্ডিত বা শ্রেষ্ঠ করার চেষ্টা করেন-ছবি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।…
…মাঝে মাঝে একটা কথা শোনা যায় যে, আমাদের মত পরাধীন দরিদ্র দেশের সঙ্কীর্ণ সমাজের মধ্যে কথাসাহিত্যের উপাদান তেমন মেলে না। “আমাদের দেশে কি আছে মশাই যে এ নিয়ে নতুন কিছু লেখা যাবে, সেই খাড়া বড়ি থোড়”-একথা অনেক বিজ্ঞ পরামর্শদাতার মুখে শোনা যায়।

এই ধরনের উক্তির সত্যকার বিচার করতে বসলে দেখা যায়-এসব কথা মাত্র আংশিকভাবে সত্য। বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী, তাদের দুঃখদারিদ্র্যময় জীবন, তাদের আশা-নিরাশা, হাসি-কান্না-পুলক-বহির্জগতের সঙ্গে তাদের রচিত ক্ষুদ্র জগৎগুলির ঘাত-প্রতিঘাত, বাংলার ঋতুচক্র, বাংলা সন্ধ্যা-সকাল, আকাশ-বাতাস, ফলফুল-বাঁশবনের, আমবাগানের নিভৃত ছায়ায় ঝরা সজনে ফুল বিছানো পথের ধারে যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে-তাদের কথাই বলতে হবে, তাদের সে গোপন সুখদুঃখকে রূপ দিতে হবে।” [১]

সমগ্র সাহিত্যজীবনেই তিনি এই সারসত্য মেনে চলেছেন।

তাঁর লেখায় তো বটেই, তাঁর নানান ব্যক্তিগত রচনাতেও প্রচুর দেখা মেলে সেসব মূলসূত্রের। তাঁর ‘তৃণাঙ্কুর’, ‘অভিযাত্রিক’, ‘স্মৃতির রেখা’, ‘বনে পাহাড়ে’, ‘হে অরণ্য কথা কও’ ইত্যাদি নানান ভ্রমণকাহিনিতেও তিনি বারবার তাঁর নিজের চিত্তবৃত্তির বা দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলে গেছেন বারবার।

তাঁর সাহিত্যকৃতিতে যেসব বাদীসুর উঠে আসে সেসব হচ্ছে প্রকৃতিপর্যবেক্ষণ, মানুষের ছোটখোটা দুঃখব্যথা, চন্দ্রসূর্যগ্রহতারা ছাড়ি তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যতদূরে আমি ধাই, ইতিহচেতনা ও ভবিষ্যভাবনা। তাঁর লেখায় বাংলার প্রকৃতির যে-অতুলনীয় রূপ পরিস্ফুট, আমি বিশ্বসাহিত্যে (পাঠক হিসেবে গণ্ডি সীমিত, আগেই বলে রাখি) তার তুলনা খুব বেশি পাই নি। জ্যাক লন্ডন বড়ই বাস্তববাদী কর্কশতায় কট্টর, লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডার অতীব নারীসুলভ করুণকোমল, শুনেছি কনস্তানতিন পাউস্লোভস্কিও অনেকটাই প্রকৃতিপ্রবণ ছিলেন। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই তুলে এনেছেন প্রকৃতির অবাক-করা মনোলোভা সৌন্দর্যরাশি, কিন্তু জীবনের সাথে প্রকৃতিপ্রেমের এমন অতুল সঙ্গত, মহাজাগতিকতার মাধুর্যের বিপরীতে তুচ্ছ মানবাবস্থার মাধ্যাকর্ষণ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার এমনি প্রাণকাড়া টান সৃজন, এসব রবীন্দ্রনাথে চোখে পড়লেও আমার কাছে অন্তত বিভূতিভূষণের সাথে অন্তত বাংলা সাহিত্যে কেউ তুলনীয় নন। বারেবারে তিনি আমার আবেগ নিয়ে উদাসী মেঠোসুরের সহজিয়া বাউলের হৃদয়স্পর্শী দক্ষতায় লীলা করে গেছেন। কখনো তিনি আমায় বিশাল সর্ষেখেতের হলুদ রঙে প্রজাপতির চোখ দিয়েছেন, কখনো বৃষ্টি-নামার আগে ঠান্ডা হাওয়ার অমর্ত্য অনুভূতি ফিরিয়ে দিয়েছেন, কখনো ঝড়ের মুখে কুটো করে আমবনের ঝরাপাতার সাথে উড়িয়েছেন, কখনো সূর্যাস্তের রঙে চেতনা আর অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ করে আমায় রংধনুর সহগামী করেছেন। শিশুর বিষাদময় কলিছেঁড়া অকালমৃত্যু, কিশোরের কষ্টজ্ঞাত অনটনের আয়তন, তরুণীর বেদনাময় অকালবার্ধক্য, বয়স্কের বিষণ্নকারী অবহেলা, দারিদ্র্যে আর অসাফল্যে শিল্পীর শিল্পপ্রেমের করুণতর পরিণতি, সম্পর্কের নানামাত্রিক রূপরং, সবই তাঁর হাতে উঠে আসে অবলীলায়, খুব বেশি শিল্পকুশলতার মারপ্যাঁচের সেলাইয়ের দাগকাটা না দেখিয়ে।

তাঁর ব্যক্তিগত লেখা থেকে কিছু উদাহরণ:

“পনের বৎসর আগের এক সন্ধ্যা হঠাৎ বড় স্পষ্ট হয়ে মনে পড়লো। বাড়ীর পিছনের বড় কাঁঠালগাছটায় রাঙা শেষ সূর্যাস্তের রোদটুকু লেগে আছে, গাছে পাতায়, বাঁশবনে কাঁঠালগাছের তলায়। পথের ধারে শেওড়াবনে অন্ধকার নেমে আসছে, ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে, পাঁচিলের পুরোনো কোন্ কোণে, মাটির ঘরের দাওয়ায়, খড়ের চালের নীচে। সন্ধ্যায় শাঁখ বেজে উঠলো, চারধারে কাক, ছাতারে, ঘুঘু, নীলকণ্ঠ, শালিখ পাখীরা ছায়াভরা আকাশ বেয়ে বাসায় ফিরছে-তখনকার সেই দিনটির আশা আনন্দ আকাঙ্ক্ষা আকুল আগ্রহ—

আজকের এই সন্ধ্যায় আকাশটির রং যেমন মুহূর্তে মুহূর্তে বদলাচ্ছে, কোথাও ওই তুঁতের রং এখনই কালো হয়ে উঠছে, কোথাও রোদের সোনার রং ধূসর হয়ে গেল। মেঘের পাহাড় সমুদ্র হয়ে যাচ্ছে, সমুদ্র দেখতে দেখতে পাহাড় হয়ে উঠল। রক্তের পুকুর চোখের সামনে নীল মাঠ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীটাও ঐ রকম মূহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল-সূর্যাস্তের এই আকাশে যেমন মুহূর্তে মুহূর্তে বহুরূপীর মত রং বদলাচ্ছে ঠিক ঐ রকমই আকাশ যেন একটা মস্ত দর্পণ-পৃথিবীর এই অহরহ পরিবর্তনশীল রূপ ওতে যেন সব সময় ধরা পড়ছে। তাই সেটাও একটা বিরাট ছায়াবাজীর মত দেখা যায়।” [২]

মহাবিশ্বের মহাকাশ ছেড়ে, দেবযানে যাত্রা করে তিনি কালের যাত্রার ধ্বনি কিভাবে শোনেন, তার একটা বিবরণ। এখানে তিনি প্রবলভাবে কাব্যিকতায় বিজ্ঞানমনস্ক, বিবর্তনবিশ্বাসী ও প্রতি অণুপরমাণুতে ঋষিসুলভ মহাজাগতিক গতিময়তায় আচ্ছন্ন। তিনি চঞ্চল হে, তিনি সুদূরের পিয়াসী।

“Life! Life!
কাল রাত্রে অন্তরের মধ্যে জীবনের বিশাল তরঙ্গোদ্দাম অনুভব করলাম-ওরকম অনেকদিন হয়নি। শক্তির, উৎসাহের, কল্পনার, আনন্দের, উদ্দীপনার, সৌন্দর্যের, মাধুর্যের কি বিরাট প্রাণ মন মাতানো, পাগল করা, উদ্দাম, বাধাবন্ধনহীন গতি-বেগ! নদীর কূল ছাপিয়ে নিয়ে যাওয়া, ক্ষেপাজোয়ারের কি দুর্মদ, ফেনিল প্রণয়লীলা! মনের মধ্যে জীবন যেন বলছে-এই যে গণ্ডী তুমি তোমার চারিদিকে রচনা করে বসে আছো এরা তোমারই ভৃত্য তোমারই দাস। তুমি কেন ভুল করে এদের হাতে ইচ্ছে করে খাঁচার পাখীর মতো বন্দী হয়ে আছো? তুমি এদের চেয়ে অনেক বড়। জীবনটা ভালো করে দেখতে হবে। উপভোগ করতে হবে। জীবনের উৎসের মূল শুকিয়ে দেয় অলস নিষ্কর্মা জীবনযাত্রাকে। শত্রুকে তাড়াতে হবে।

কূল ছাপিয়ে বেরিয়ে চলো। উদ্দাম উন্মত্ত বিজয় বিমৃত্যু গতির বেড়ে বার হয়ে পড়ো। কি ঘরের কোণে বসে মোকদ্দমার ফাইল আর স্টেটমেন্ট ঘাঁটছো!-তোমার মাথার ওপর অনন্ত নাক্ষত্রিক জগৎ উদাস রহস্যময় অজ্ঞাত, নব-নব ঘূর্ণ্যমান গ্রহরাজিকে বুকে নিয়ে চলেছে। ধূমকেতু নীহারকণা নীহারিকা সুদূর লক্ষ লক্ষ কোটী কোটী আলোকবর্ষ পারের দেশ, নতুন অজানা বিশ্বরাজি, নতুন অজানা প্রাণীজগৎ, বিশাল প্রজ্জ্বলন্ত হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা, নিকেল, কোবাল্ট, এলুমিনিয়াম্;- প্রচণ্ড জাগতিক তেজ X-ray, বিদ্যুৎ, চৌম্বকশক্তি, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ঢেউ, অনন্ত শূন্যপথে ভ্রমণশীল জ্বলন্তপুচ্ছ, জানা অজানা ধূমকেতুরাজি, ঘূর্ণ্যমান ধাতুপিণ্ড, প্রস্তরখণ্ডের অতি অদ্ভুত রহস্যভরা ইতিহাস-এই জন্ম-মৃত্যু, পায়ের নীচের লক্ষকোটি প্রাণীর মরে যাওয়ার লীলাউৎসব। মৎস্যযুগ, অঙ্গারযুগ, সরীসৃপযুগের প্রাণীদের প্রস্তরীভূত কঙ্কাল, কত ফুল ফল বন নদী পাহাড় ঝর্ণা কত কূলহীন দিকহীন গর্জমান মহাসমুদ্র-অনাদি, অনন্ত, লীলাময়, রহস্যময়, অজ্ঞেয় জীবন-মৃত্যুর প্রবাহ। এর মধ্যে তুমি জন্মেছ। আত্মাকে প্রসারিত করে দাও এদের মধ্যে। চুপ করে চোখ বুজে বসে এই গতিশীল তাণ্ডব-নৃত্য-চঞ্চল মহাকালের মহাযাত্রার উৎসবের কথা ভাবো-কোথায় যাবে তোমার দুদিনের বদ্ধজীবনের দৈন্য, কোথায় যাবে তোমার রুদ্ধ ঘরের অনির্মল দুষ্ট হাওয়ার ভাণ্ডার-প্রাণের বেগে ছুটে বেরিয়ে পড়ে দ্যাখো জীবন কি মহিমাময়, কি বিরাট, ঋদ্ধিশীল! কি অক্ষয় অনাদি অনির্বাণ জীবন, সঙ্গীতের কি মধুর লয়-সঙ্গতি।” [৩]

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, দ্য বার্থডে বয়

তিনি জীবনমদে মত্ত, মোহিত বাঙালিদুর্লভ এ্যাডভেঞ্চারে ও ভ্রমণানন্দে। তাই তাঁর অপু নিশ্চিন্তপুরের জীর্ণ গৃহকোণ থেকে সুনীল সীমান্তে ‘অপরাজিত’, তাই তাঁর শঙ্কর জয় করে দুর্গম আফ্রিকার জুলুল্যান্ডে রিখ্‌টারসভেল্ডের ‘চাঁদের পাহাড়’, তাই তাঁর সুরেশ্বর ও বিমলের জন্যে সিঙ্গাপুরে ও চিনের নানকিঙে জাপদের অত্যাচারের বিপরীতে ‘মরণের ডঙ্কা বাজে’, তাই তিনি নিজেই সৌন্দর্যমত্ত হয়ে আকণ্ঠ পান করেন বিহারের বুনো বনের লবটুলিয়ার সরস্বতী কুণ্ডের ‘আরণ্যক’ আসব। আমায় তিনি ঊর্দ্ধগামীই করেছেন বারবার, বুঝতে শিখিয়েছেন মানুষের ব্যথা, দুচোখ খুলে দেখতে শিখিয়েছেন বনফুলের সৌরভসৌন্দর্য, প্রকৃতির ঘন মধুরময়তা।

এছাড়াও, পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিচিত্র মানবকুল, তাদের সংস্কৃতি, প্রকৃতির বহুধাবিচিত্র রূপ, সবই তুলে ধরেছেন তিনি প্রবল শ্রমে ও প্রেমে। তাঁর এমনি প্রবন্ধের কিছু উদাহরণ: ‘প্রশান্ত মহাসাগরের কয়েকটি মরুদ্বীপ’, ‘ব্রিটানির প্রাগৈতিহাসিক প্রস্তর-কীর্তি’, ‘পারস্য (পার্সিপোলিস)’, ‘বর্তমান মাঞ্চুরিয়া’, ‘প্যারিস হইতে স্থলপথে কাশ্মীর’, ‘বোম্বেটেদের শহর সেন্ট ম্যালো’, ‘সোসাইটি দ্বীপপুঞ্জ ও পলিনেসিয়া’, ‘ওয়েষ্ট ইণ্ডিজ দ্বীপপুঞ্জ (লা সিবা)’, ‘হাইতুরু দ্বীপ (পক্ষী দ্বীপ)’, ‘যবদ্বীপের আগ্নেয়গিরি’, ‘আরিজোনার মরুভূমি’, ‘তুর্কিস্থানের মরুপথ’, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম নদী আমাজন’, ‘পানামা খাল ও অরণ্য’, ‘ভূস্বর্গ সেচিলিস’ কত নাম করবো। যেন তারেক অণুর ভ্রমণবৃত্তান্তের দিনপঞ্জী আর কি! আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছিনু স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার প্রাণ-এই যেন ছিলো তাঁর মূলমন্ত্র। পৃথিবীর সে-ধূলিতে ছড়ানো আনন্দ যেন তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র, তাই তাঁর লেখা ধূলিধূসরিত পথপাশের ঝোপের ফুল থেকে মহাকাশের তারকামণ্ডলীতে ঘুরে বেড়ায়, আবার চুপটি করে ঠাঁই করে নেয় মানুষের অতল মনোজগতের ছায়াপথে।

“গূঢ় অন্ধ পৃথিবীর ভিতরে কী প্রবেশাধিকার
এ-মুহূর্তে লাভ করি, আর পরমুহূর্তে হারাই!
মুহূর্ত, সময়স্রোত একটি বিন্দুতে থেমে গিয়ে
আবার পেছনে চলে, যেন প্রজাপতির পশ্চাতে
দুর্গম বালক দৌড়ে দুর্ভেদ্য জঙ্গলে মিশে যায়,
থেকে থেকে দৃঢ় ভিত্তি আরণ্যক গুঁড়ি, বাধা রাখে,
পুরোনো বোলতার বাসা, ওঠানামা পিপীলিকা দাগ,
মাতা গন্ধ, মাতা প্রাণ, আমার কি লেখাধর্ম নেই?
মাতা গুল্ম, মাতা মূল, আমি হইনি ভূমিতে উদ্গত?
আমি বাইরে আসিনি কি আদিম কাদার স্রোত ঠেলে?
কেন এই চিনতে পারো, কেন পরমুহূর্তে হারাও?
আমি অঙ্কুরের ভাই, কপালে রোদ্দুর ঠিকরে দাও।”

[এখানে তোমার মাটিদেশ, ৬: জয় গোস্বামী]

সুমন চট্টোপাধ্যায় আকা কবীর সুমনের একটা গান দিয়েই তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। ধন্যবাদ জানাই সুমনকেও যিনি আমাদের এমনি অনেক প্রিয়জনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সুযোগ দিয়ে রেখেছেন গানে, সুরে, কথায়।

httpv://www.youtube.com/watch?v=9fj0ukHnnzw

সূত্র:
[১]: বিভূতি রচনাবলী (শতবার্ষিক সংস্করণ): তৃতীয় খণ্ড, পৃ. ২৬৪-২৬৫, অগ্রহায়ণ, ১৪০২, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ভারত।
[২]: ঐ; পৃ. ২০৬।
[৩]: ঐ; পৃ. ২১৪।