১৮৪৮ সালে ইউরোপের নানা জায়গায় বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিপ্লবের বড় ঘটনাগুলোর একটি ছিলো কার্ল মার্ক্স ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেল্স লিখিত “কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার” প্রকাশ। এই ইশতেহারেরই একটি অতিসংক্ষিপ্ত রূপ হলো “জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির দাবিনামা”। ১৮৪৮ সালের মার্চ মাসে প্যারিসের জার্মান প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে “জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির দাবিনামা”টি প্রথম বিতরণ করা হয়।

তখনকার রাজন্যের দুঃশাসন ও অনাচারের প্রতিক্রিয়া ছিলো এই দাবিনামাটি। কিন্তু এই দাবিনামা কেবলই প্রতিক্রিয়া নয়। মার্ক্সের কাঙ্ক্ষিত কমিউনিজমে পৌঁছানোর লক্ষ্যে একটা পদক্ষেপও ছিলো এটি। শাশ্বত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভাবনার এটি একটি প্রতিনিধি। এই অর্থে দাবিনামাটি গুরুত্বপূর্ণ। নিচে এর অনুবাদের চেষ্টা করলাম।

“দুনিয়ার মজদুর, এক হও!”

১. সম্পূর্ণ জার্মানিকে এক ও অখণ্ড গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করতে হবে।

২. কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত না হলে একুশ বছর বা তার বেশি বয়সের যেকোনো জার্মান নাগরিককে ভোট দেবার ও নির্বাচিত হবার অধিকার দিতে হবে।

৩. সকল গণপ্রতিনিধিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বেতন প্রদান করতে হবে। এর ফলে শ্রমিকদেরও জার্মানির সংসদসদস্য হবার সুযোগ উন্মুক্ত হবে।

৪. জনতাকে সর্বজনীনভাবে অস্ত্রযুক্ত করতে হবে। ভবিষ্যতের সেনাবাহিনী একই সাথে হবে শ্রমবাহিনী। এতে করে সেনারা আগের মতো শুধুই সম্পদ ভোগ করবে না, বরং উৎপাদনও করবে। নিজেদের জন্যে যতোটুকু প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি উৎপাদন করতে হবে তাদেরকে।
এটা শ্রমিকদের সংগঠিত হতেও সাহায্য করবে।

৫. সকল আইনী সেবা হতে হবে বিনামূল্য।

৬. গ্রামের মানুষের উপর চাপানো সকল সামন্ততান্ত্রিক দায়-দেনা, বিনামূল্য শ্রম, ইত্যাদিকে কোনো প্রকার ক্ষতিপূরণ ছাড়াই বিলুপ্ত করতে হবে।

৭. রাজন্য কিংবা সামন্ত প্রভুর অধীনস্থ সকল ভূ-সম্পত্তি, খনি, ইত্যাদিকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসেবে অধিগ্রহণ করতে হবে। অধিগ্রহণকৃত জমিতে আবাদ করতে হবে গোটা সমাজের স্বার্থকে সামনে রেখে। উৎপাদন করতে হবে বৃহদাকারে এবং সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে।

৮. ছোট জমিওয়ালা কৃষকের বন্ধক দেওয়া সকল জমিকে রাষ্ট্রের সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করতে হবে। এই ধরনের বন্ধকের উপর যতো সুদ আসবে তা কৃষককে রাষ্ট্রের নিকট পরিশোধ করতে হবে।

৯. যেসব লোকালয়ে জমি বা সম্পত্তির উপর ভাড়া-ব্যবস্থা চালু আছে, সেখানে জমির উপর ভাড়া ইত্যাদিকে ট্যাক্স হিসাবে রাষ্ট্রের নিকট পরিশোধ করতে হবে।
দাবি ৬, ৭, ৮ ও ৯ এর উদ্দেশ্য হলো ক্ষেতমজুরদের ও অন্যান্য ক্ষুদ্র ভাড়াখাটা ক্ষেতমজুরদের উপর চাপানো বোঝাকে এমনভাবে লাঘব করা যাতে রাষ্ট্রের নিজের ব্যয় বহনের উপায়ও চালু থাকে, আবার উৎপাদন-ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
ভূমি মালিক যেহেতু ছোট জমিওয়ালা কৃষকও নয়, আবার ভাড়াখাটা ক্ষেতমজুরও নয়, ফলে উৎপাদনে তার কোনো অংশীদারও নেই। এ কারণে ভূমি মালিকের পক্ষে ভোগ করাটা উৎপাদনের একটা অন্যায় ব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়।

১০. সকল প্রাইভেট ব্যাংক বিলুপ্ত করে একটামাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক করতে হবে। একমাত্র সেই প্রতিষ্ঠান আইনত গ্রাহ্য মুদ্রা প্রকাশ করতে পারবে। এই পদক্ষেপের ফলে ঋণব্যবস্থাকে সমষ্টির স্বার্থে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এবং বড় পুঁজিপতিদের আধিপত্যকে খর্ব করা সম্ভব হবে। এছাড়া স্বর্ণ বা রৌপ্যমুদ্রা সরিয়ে ধীরে ধীরে কাগজের মুদ্রার প্রচলন ঘটানো হবে। এতে সর্বজনীন বিনিময়ের সস্তা উপায় তৈরি হবে। স্বর্ণ ও রূপাকে কেবল বাইরের দেশের সাথে বাণিজ্যের জন্যে বরাদ্দ রাখা হবে। এতে রক্ষণশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর স্বার্থ সরকারের সাথে একীভূত হবে।

১১. সকল প্রকার যোগাযোগ, রেলপথ, খালবিল, স্টিমচালিত জাহাজ, রাস্তা, ডাকযোগাযোগ, ইত্যাদি রাষ্ট্র দ্বারা অধিগ্রহণ করতে হবে। এগুলো হবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি। অর্থসম্বলহীনদের জন্যে এইসব সেবা বিনামূল্যে প্রদান করা হবে।

১২. সকল সরকারী চাকুরে সমান বেতন ভোগ করবে। তবে যেসব সরকারী চাকুরেকে পরিবারের খরচ চালাতে হয়, তারা বেশি বেতন পাবে।

১৩. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আর রাষ্ট্রকে সম্পূর্ণরূপে পৃথক করতে হবে। যাজকদের বেতন কেবল ধর্মীয় উপাসনালয়ে সমবেতদের দান করা অর্থ থেকে নির্বাহ করা হবে।

১৪. উত্তারাধিকারকে সীমিত করতে হবে।

১৫. উচ্চহারে ট্যাক্স আদায় করতে হবে এবং ভোগ্যপণ্যের উপর ট্যাক্সকে বিলুপ্ত করতে হবে।

১৬. রাষ্ট্রাধীন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্ট্রকে সকল শ্রমিকের জীবিকা নিশ্চিত করতে হবে এবং যারা কাজ করতে অক্ষম, তাদের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।

১৭. সকল মানুষের সর্বজনীন ও বিনামূল্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
সর্বশক্তি নিয়োগ করে এই দাবিনামার প্রতি সমর্থন জানানোর মাঝেই জার্মানির প্রলিতারিয়েত, পাতি বুর্জোয়া আর ছোট জমিওয়ালা কৃষকের মঙ্গল নিহীত। সম্পদের প্রকৃত উৎপাদনকারী যারা, জার্মানির সেই লক্ষ লক্ষ মানুষ, যারা গুটিকয়েক মানুষের দ্বারা শোষিত হয়ে এসেছে, আসছে, এই দাবিনামাকে পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার মাধ্যমেই কেবল তারা পারবে তাদের অধিকার এবং প্রাপ্য ক্ষমতাকে অর্জন করে নিতে।

কমিটি:
Karl Marx, Karl Schapper, H. Bauer, F. Engels, J. Moll, W. Wolff

(শেষ)

দাবিগুলোকে কেবলই দরিদ্র ও প্রোলিতারিয়েতের স্বার্থ দেখার কর্মসূচী মনে হতে পারে। তবে আমি এখানে মূলত তিন ধরনের দাবি দেখতে পাচ্ছি। ক) রাজনৈতিক অধিকার ও সংস্কার সংক্রান্ত দাবি, যার মধ্যে ২ ও ১৩ পড়ে। খ) দরিদ্র ও প্রোলিতারিয়েতের স্বার্থ সংরক্ষণমূলক কর্মসূচী, যেগুলো করতে রাষ্ট্রকে ব্যয় করতে হবে, যার মধ্যে ৩, ৫, ৬, ১২, ১৬ ও ১৭ পড়ে। গ) রাষ্ট্র যে ব্যয় করবে সেটা নির্বাহ করার জন্যে সে শূন্য থেকে অর্থ উৎপাদন করতে পারে না, ৪, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১, ১৪ ও ১৫ হলো সেই ব্যয় নির্বাহনের উপায়: বাধ্যতামূলক উৎপাদন, ট্যাক্স আদায়, ভূমি ও সম্পদ অধিগ্রহণ।