Jane Goodall

পৃথিবীর অন্য যে কোন প্রাণীর চাইতে আলাদা মনে হলেও একটা ব্যাপারে কোন সন্দেহ নাই যে আমরা নিজেরাও প্রাণী। অন্য সব প্রাণীর মতই আমাদের রয়েছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ, জিন, কিংবা জৈবিক অণু। আমরা এটাও জানি আমরা ঠিক কি ধরণের প্রাণী – স্তন্যপায়ী প্রাণী । বাহ্যিক দিক থেকে আমাদের শিম্পাঞ্জীর প্রচুর সাথে মিল আছে তবে আমাদের বেশ কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা অন্যসব প্রাণীদের থেকে অনেক বেশী আলাদা যেমন, কথা বলতে পারা, লিখতে পারা, জটিল মেশিন তৈরি করতে পারা ইত্যাদি। আমরা জীবন ধারণের জন্য আমাদের দুহাত ছাড়াও যন্ত্রপাতির উপর পুরোপুরি ভাবে নির্ভরশীল। কিছু আদিবাসী ছাড়া আমরা অধিকাংশ মানুষই জামাকাপড় পড়ি, শিল্পকলা উপভোগ করি এবং কোন একটি ধর্ম বিশ্বাস লালন করি। আমাদের মধ্যে আবার কিছু খারাপ গুণাবলীও আছে যা অন্য কোন প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় না যেমন, গণহত্যা করা, অত্যাচার করে আনন্দ পাওয়া, ড্রাগ ব্যবহার করা এবং অন্য প্রজাতির প্রাণীদের নির্বংশ করা। যদিও এ সকল বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলিই অন্যান্য বেশ কিছু প্রাণীর মধ্যে দেখা যায় তবে এ ব্যাপারে আমরা অন্য যে কোন প্রাণীকে ছাড়িয়ে এক নূতন উচ্চতায় পৌছাতে সক্ষম হয়েছি।

যদি কিছু মানুষের পোশাক খুলে, ব্যবহার্য্য সব জিনিষ সরিয়ে ফেলে, কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে – শুধু মুখ দিয়ে কিছু আওয়াজ করার মত সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দিয়ে এবং দৈহিক কাঠামোতে কোনরকম পরিবর্তন না করে চিড়িয়াখানায় শিম্পাঞ্জীদের খাঁচার পাশে থাকতে দেয়া হয় তবে মানুষকে এক প্রজাতির শিম্পাঞ্জী ছাড়া আর কিছুই মনে হবে না। পার্থক্য শুধু তাদের শরীরে লোমের সংখ্যা খুবই অল্প এবং তারা সোজা হয়ে হাটতে পারে। অন্য কোন গ্রহ থেকে আসা প্রাণী বিজ্ঞানীরা আমাদের সরাসরি তৃতীয় প্রজাতির শিম্পাঞ্জী হিসাবে চিহ্নিত করবে। অন্য দুটি প্রজাতি হল জায়ারের পিগমি শিম্পাঞ্জী বা বনবো এবং ট্রপিক্যাল আফ্রিকার সাধারণ শিম্পাঞ্জী। শিম্পাঞ্জীরা শুধুমাত্র আমাদের মত দেখতেই না ওরা আমাদের মত ব্যবহারও করে থাকে। ওরা টুল তৈরি এবং ব্যবহার করতে পারে। সেগুলো আবার তাদের বাচ্চা কাচ্চাদের শিখিয়েও থাকে। অন্য প্রাণী শিকার করে, কখন কখনও নিজেদের মধ্যে খুনোখুনিও করে। ওদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। কথা বলতে সক্ষম না তবে সাংকেতিক ভাষা এবং বিভিন্ন ধরনের প্রতীক ব্যবহার করে একে অন্যের সাথে ভাব-বিনিময় করতে সক্ষম। এবং কখনও কখনও বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ করে কয়েক ধাপের জটিল কিছু সমস্যার সমাধানও করতে পারে।

বাকী দুই ধরণের শিম্পাঞ্জীর সাথে আমাদের জেনেটিক মিল ৯৮ ভাগেরও বেশী। যে দুইভাগ অমিল আছে সে গুলোই আমাদের মধ্যে যাবতীয় পার্থক্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী বলে ধারণা করা যেতে পারে। বিবর্তনের ইতিহাসের খুব স্বল্প সময়ে আমরা বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছি যার ফলাফল আপাতদৃষ্টিতে অনেক বড়। বস্তুত পক্ষে এক লক্ষ বছর আগেও ভিনগ্রহের প্রাণী বিজ্ঞানীরা কিছু কিছু কৌতূহলোদ্দীপক আচরণ সত্ত্বেও আমাদের একটি বড় আকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী ছাড়া আর কিছুই ভাবত না। সেই সব আচরণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আগুন জ্বালানো এবং হাতিয়ার ব্যবহারের ক্ষমতা। ভিনগ্রহ বাসীদের কাছে এই আচরণগুলোও বিভার কিংবা বাওয়ার পাখীর আচরণের তুলনায় খুব বেশী কিছু অদ্ভুত বলে মনে হত না। কিন্তু গত এক লক্ষ বছরের মধ্যেই আমাদের মধ্যে এমন কিছু পরিবর্তন ঘটেছে যার ফলে আমরা অন্য প্রাণীদের সাথে পার্থক্য সৃষ্টিকারী এইসব অভিনবত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি।

কী ছিল সেই সব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সমূহ?

গরিলা, ওরাং উটান, বনবো, এবং শিম্পাঞ্জীর সাথে মানুষের মিল খুঁজে পেতে জীববিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের সাথে মানুষের অস্বাভাবিক মিলগুলি একটি বাচ্চার দৃষ্টিতেও ধরা পরে। গ্রেট এপসরা আমাদের মত দক্ষতার সাথে হাতের ব্যবহার করতে পারে যা অন্যান্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সবচাইতে লক্ষণীয় ব্যাপার হল তাদের মুখে বিভিন্ন রকমের আবেগের যে ছাপ পড়ে তা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত। শুধুমাত্র বাহ্যিক সাদৃশ্যই নয় তাদের মধ্যেও সামাজিক ক্রমাধিকারতন্ত্র আছে এবং আমরা যাকে সংস্কৃতি বলি সেসবের কিছু আভাসও তাদের মাঝে দেখা যায়। এতসব মিল থাকা সত্ত্বেও আমাদের জিনোমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্থক্যই তৈরি করেছে আমাদের যত বৈসাদৃশ্যগুলো। কৃষিকাজ, ভাষা, শিল্পকলা, সঙ্গীত, প্রযুক্তি, দর্শন — এই সব সাফল্য যা আমাদের শিম্পাঞ্জীদের থেকে খুব পরিষ্কার ভাবেই আলাদা করেছে – সেগুলো আমাদের বংশানুগতি সংকেতের মধ্যে কোন এক ভাবে আবদ্ধ হয়ে গেছে। খুব সাম্প্রতিক অতীতেও আমাদের পক্ষে এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য গুলির কারণ নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। ঠিক কি কারণে আমরা সোজা হয়ে হাটতে পারি বা আমাদের জটিল মস্তিষ্কের পেছনের কারণই বা কী? এর সাথে সাথে সাথে আমদের বেশ কিছু রোগ যেমন নির্দিষ্ট ধরণের ম্যালেরিয়া, আলঝেইমার, যেগুলো শিম্পাঞ্জীদের আক্রান্ত করে না — এগুলো আমাদের কাছে রহস্য। কিন্তু খুব দ্রুতই সেই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ডারউইনের সময়েরও বহু আগে থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা ফসিল সংগ্রহ করে প্রাণীদের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যের এক বিশাল তথ্য ভাণ্ডার গড়ে তুলতে সমর্থ হন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দুপায়ে হাঁটা, মস্তিষ্কের আকার, করোটির আকৃতি, মুখমণ্ডল, পেষণ দাঁত, এবং অপোজিবল বৃদ্ধাঙ্গুলি ইত্যাদি। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক গবেষণা এবং বিভিন্ন প্রকার বয়স নির্ধারণী পদ্ধতি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই বৈশিষ্ট্যগুলির উদ্ভবের এবং বিলুপ্ত হওয়ার সময়কাল বের করতে সমর্থ হয়েছেন এবং তৈরি করেছেন একটি বিস্তারিত জীবন বৃক্ষ যা কিনা বন মানুষ, মানুষের পূর্ব পুরুষ, এবং মানুষের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

Homo

৬০ লক্ষ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ শিম্পাঞ্জী এবং গরিলাদের পূর্বপুরুষ থেকে আলাদা হয়ে যায়। শুরুর সেই পূর্ব পুরুষদেরকে বন মানুষেরই আরেকটি প্রজাতি ছাড়া অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই। কিন্তু পরবর্তীকালে পরপর তিনটি পরিবর্তন আমাদের কে আধুনিক মানুষ হিসাবে বিবর্তিত হওয়ার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রথমটি পরিবর্তনটি ঘটে প্রায় ৪০ লক্ষ বছর আগে যখন হাত পায়ের ফসিলের গঠন থেকে বুঝতে পারা যায় যে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা স্বভাবগত ভাবেই দুই পায়ের উপর সোজা হয়ে হাটতে অভ্যস্ত ছিল। দ্বিতীয় পরিবর্তনটি আসে ৩০ লক্ষ বছর আগে যখন আমাদের বংশানুক্রম অন্তত: দুটি ভিন্ন ধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। এরা হল Australopithecus Robustus – যার মাথার খুলি ছিল অত্যন্ত শক্ত এবং ভারী এবং বৃহদাকার চোয়ালের দাঁত ছিল এবং Australopithecus Africanas – যার মাথার খুলি অনেক হাল্কা ছিল এবং দাঁতগুলোও ছিল ছোট আকারের। তৃতীয় এবং বড় পরিবর্তনটি যা কিনা আমাদের পূর্ব পুরুষদের বেশী করে আধুনিক মানুষের মত এবং বনমানুষদের থেকে আলাদা করে তুলতে শুরু করে তা হচ্ছে পাথরের হাতিয়ার ব্যবহার।

২৫ লক্ষ বছর আগে অস্ট্রালোপিথেকাস আফ্রিকানাসদের থেকে আলাদা হয়ে হোমো গণের প্রথম সদস্য হোমো হ্যাবিলিসদের (man the handyman) উদ্ভব ঘটে। হোমো হ্যাবিলিসরাই প্রথম আদি মানুষ যাদের হাতিয়ার ব্যবহারের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। একেবারে শুরু দিকের এই হোমিনিনদের মস্তিষ্কের আকার ছিল শিম্পাঞ্জীদের সমান। এদের সবচাইতে বড় বিবর্তনীয় অর্জন ছিল যে এরা সোজা হয়ে দুপায়ের উপর ভর করে হাঁটতে পারত। পরবর্তী দশ লক্ষ বছরে মস্তিষ্কের আকার বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয়বারের মত আমাদের বংশানুক্রমে আরেকবার বিচ্ছিন্নতার ঘটনা ঘটে এবং হ্যাবিলিসের দুটি আলাদা প্রজাতির সৃষ্টি হয়। এদের মধ্যে হোমো হ্যাবিলিস নিজে একটি প্রজাতি আর অন্যটি হল রহস্যময় “তৃতীয় মানুষ” (The third man)। ফলে ২০ লক্ষ বছর আগে অন্ততপক্ষে দুটি এমনকি তিনটি প্রোটো হিউম্যান প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল। সতের লক্ষ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিসের বর্ধিত মস্তিষ্ক এবং দেহ সহ শারীরিক বৈশিষ্ট্য এতটাই আলাদা হয়ে যায় যে বিজ্ঞানীরা আমাদের সেই পূর্বপুরুষদের একটি নূতন নাম দেন, হোমো ইরেক্টাস (Homo Erectus)। ১২ লক্ষ বছর আগে অস্ট্রালোপিথেকাস রোবোস্টাসরা বিলুপ্ত হয়ে যায় আর রহস্যময় “তৃতীয় মানব”রাও ততদিনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। উপরের এই সব ঘটনার পুরোটাই ঘটেছে আফ্রিকা মহাদেশে। এরপর ১০ লক্ষ বছর আগে হোমো হ্যাবিলিসদের উত্তর পুরুষ হোমো ইরেক্টাসরা আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে আসে এবং ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পরে। এদের তৈরি পাথর এবং হাঁড়ের হাতিয়ার থেকে জানা যায় এরা নিকট প্রাচ্য, দূর প্রাচ্য এবং ইউরোপে পৌছাতে সমর্থ হয়েছিল। তখনো এদের মস্তিষ্কের আকার বড় হচ্ছিল এবং করোটির আকৃতি গোলাকার হয়ে আধুনিক মানুষের দিকে ধাবিত হচ্ছিল। বিবর্তনের ইতিহাসে কমপক্ষে দুইবার হোমো ইরেক্টাস এবং তাদের বংশধরদের আফ্রিকা থেকে অভিবাসনের ঘটনা ঘটে। প্রথমবার অভিবাসনের সময় এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক যারা আফ্রিকাতেই রয়ে গিয়েছিলো তারা হোমো এরগেস্টর নামেও পরিচিত। এরাই প্রথম আগুনের নিয়ন্ত্রণ এবং আরেকটু উন্নত হাতিয়ার তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। হোমো ইরেক্টাসরা আফ্রিকা ছেড়ে বেড়িয়ে এসে পুরনো পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পরে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন ভূ-অঞ্চলে দীর্ঘদিন বসবাস করার ফলে এরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যেতে শুরু করে। হোমো ইরেক্টাসদের এই উত্তরসূরিরা পরবর্তীকালে হোমো এন্টিসেসর, হোমো হাইডেলবার্জেনেসিস এবং হোমো নিয়ান্ডারথালেনিস এ বিবর্তিত হয়। এই সময় এশিয়াতে পিকিং মানব এবং জাভা মানবদের অস্তিত্ব ছিল যারা “এশিয়ান” হোমো ইরেক্টাস নামেও পরিচিত । অন্যদিকে, ২ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে আধুনিক মানুষের মত দৈহিক বৈশিষ্ট্যের এক নতুন প্রজাতি হোমো সেপিয়েন্সের উদ্ভব ঘটে। প্রথম দিককার হোমো সেপিয়েন্সরা দৈহিক ভাবে আধুনিক মানুষের মত হলেও আচরণগত দিক থেকে আধুনিক মানুষের মত ছিল না। ১ লক্ষ ৩০ হাজার বছর আগে ইউরোপে দীর্ঘদিন যাবত বসবাস করার দরুন দৈহিক দিক থেকে নিয়ান্ডারথালরা ততদিনে এতটাই আলাদা হয়ে পরে যে তাদেরকে একটি আলাদা প্রজাতি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ৭০ হাজার বছর আগে দ্বিতীয়বারের মত হোমো ইরেক্টাসদের বংশধর হোমো সেপিয়েন্স বা আধুনিক মানুষেরা যখন আফ্রিকা ছেড়ে বেড়িয়ে ইউরোপে আসে তখন ইতিমধ্যে সেখানে নিয়ান্ডারথালরা হাজার হাজার বছর ধরে টিকে আছে। ৫০ হাজার বছর আগে ইউরোপে আধুনিক মানুষদের যে নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে স্পষ্টত দেখা যায় যে সেই সময় তাদের মধ্যে ভাষা, সঙ্গীত, এবং সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে গেছে। প্রথম প্যালিওলিথিক যুগে ইউরোপে বসবাসকারী হোমো সেপিয়েন্সদের এই দলটিকে জীব বিজ্ঞানীরা ক্রো ম্যাগনন নামেও উল্লেখ করে থাকেন।

এতক্ষণ আমরা জানলাম ফসিল রেকর্ড এবং আর্টিফ্যাক্টস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মানব বিবর্তনের ইতিহাস। এখন দেখা যাক জেনেটিক গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে আমরা কি জানতে পারি। স্মরণ রাখা কর্তব্য যে শুধুমাত্র জেনেটিক পার্থক্যই প্রজাতির সমূহের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে না। বিজ্ঞানীরা এখন জানেন মলিকিউলার সুইচও কখনো কখনো নির্দিষ্ট জিনকে নির্দেশ দিয়ে থাকে কখন অন এবং কখন অফ হতে হবে যা প্রজাতি সমূহের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করতে পারে।

human vs chimp

২০০৮ সালে পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যানসেল স্টেটম্যান এবং তার সহকর্মীরা ক্রোমোজোম ৭ এর একটি জিনে খুব ছোট্ট একটি মিউটেশন চিহ্নিত করেন যা মায়োসিন নামের একটি প্রোটিন উৎপাদন করে। এই প্রোটিনটি মাংসপেশি সংকোচনে সাহায্য করে। চোয়ালের মাংশপেশিতে এই বিশেষ মিউট্যান্ট জিনটির মায়োসিন ভ্যারিয়্যান্ট MYH16 এর অভিব্যক্তিতে বাঁধা দেয়। পেশীটি কামড় দেয়া এবং চর্বণের কাজে ব্যবহৃত হয়। গবেষকদের মতে ২০ লক্ষ বছর আগে ঘটা ছোট্ট এক মিউটেশন আমাদের চোয়ালের পেশীকে ছোট হতে সাহায্য করে যা পরবর্তীতে মস্তিষ্কের কুঠুরি এবং মস্তিষ্কের আকার বড় হতে সাহায্য করে। তবে কিছু বিজ্ঞানী এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাদের মতে চোয়ালের পেশী ছোট হওয়ায় মস্তিষ্ক বড় হয়নি বরং মস্তিষ্ক বড় হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের নিয়ম মেনে, বড় মস্তিষ্কের অধিকারীরা অতিরিক্ত বংশধর রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে বলে। The American Journal of Human Genetics এ প্রকাশিত এক গবেষণায় ডেনভারের কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস সিকেলা এবং তার সহকর্মীরা উচ্চতর কগনিটিভ কার্য সম্পাদন এবং জটিল ও বৃহৎ আকারের মস্তিষ্কের বিবর্তনের কারণ হিসাবে DUF1220 নামে একটি প্রোটিন একককে বা প্রোটিন ডোমেইনকে চিহ্নিত করেছেন। অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় মানুষের মধ্যে এই প্রোটিন এককটির অনেক বেশী সংখ্যক অনুলিপি পাওয়া যায়। মানুষের জিনোমে DUF1220 এর ২৭০টিরও বেশী অনুলিপি আবদ্ধ থাকে। মানুষের সাথে যে প্রজাতির যত বেশী মিল সেই প্রজাতির মাঝে এই প্রোটিনটির তত বেশী অনুলিপি পাওয়া যায়। শিম্পাঞ্জিদের মাঝে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক অনুলিপি দেখা যায় যা হল ১২৫। এরপর গরিলাদের মাঝে দেখা যায় ৯৯ টি অনুলিপি। মারমোসেটস ৩০ এবং ইঁদুরের মাঝে পাওয়া যায় ১টি অনুলিপি। গবেষণায় একটা জিনিষ অত্যন্ত পরিষ্কার, তা হল যে প্রাণীর মাঝে যত বেশী DUF1220 এর অনুলিপি পাওয়া যায় সেই প্রাণীর মস্তিষ্ক তত বড় হয়। এবং এটা প্রতিটা প্রজাতির ক্ষেত্রে সত্যি এমনকি মানুষের ক্ষেত্রেও।

নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা পত্রে বিজ্ঞানীরা আরেকটি জিন চিহ্নিত করেছেন যা মস্তিষ্কের উন্নয়নে সাহায্য করে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীব-পরিসংখ্যানবিদ ক্যাথরিন পোলার্ড এবং সোফি সালামা মানুষ সহ শিম্পাঞ্জী, এবং অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীদের জিনোমের উপর গবেষণা চালিয়ে ৪৯টি সুনির্দিষ্ট অঞ্চল চিহ্নিত করেছেন যার নাম দিয়েছেন HARS (Human accelarated Regions)। শিম্পাঞ্জী এবং মানুষের মাঝে যে অঞ্চলটিতে সবচাইতে বেশী পার্থক্য দেখা সেটি হল HAR1। জিনের এই অংশটি মায়ের পেটে ৭ থেকে ১৯ সপ্তাহের মধ্যে শিশুর মস্তিষ্কের টিস্যুতে কার্যকর (একটিভ) থাকে। যদিও এই জিনটির সুনির্দিষ্ট কাজ এখনও পুরোপুরি জানা যায়নি তবে লক্ষণীয় ব্যাপার হল ঠিক ঐ সময়টাতেই Reelin নামক একটি প্রোটিন মানব শিশুর সেরেব্রাল কর্টেক্স গঠনে সাহায্য করে। ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি (Caltech) এর একদল গবেষক National Academy of Sciences (PNAS) এ একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন যাতে তারা দেখাতে সক্ষম হয়েছেন যুক্তি বিন্যাস (reasoning) এবং আচরণ (behavioral) নিয়ন্ত্রণ ফ্রন্টাল লোবের বিভিন্ন অংশের উপর নির্ভরশীল। ফ্রন্টাল লোবস হল মানব মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ যা মানব বিবর্তনে সবচাইতে বেশি প্রসারিত হয়েছে।

এই পর্যন্ত পড়ে পাঠক যদি ভেবে থাকেন যে দৈহিক গঠন এবং বৃহদাকৃতির মস্তিষ্কই আমাদের আজকের এই উন্নতির পেছনের মূল কারণ তাহলে ভুল করবেন। তখন পর্যন্ত এটা আসলে তেমন কোন ঘটনা হয়ে ওঠেনি। গুহাচিত্র, বাড়ী বানানো, তীর ধনুক বানানো এসব তখনো লক্ষ লক্ষ বছর পরের কথা। গত দশ লক্ষ বছর আগে থেকে হোমো ইরেক্টাসরা যে সাধারণ পাথরের হাতিয়ার বানিয়ে আসছিল সেগুলোই টিকে ছিল আরও অনেকদিন। তখন পর্যন্ত হোমো সেপিয়েন্সের বর্ধিত মস্তিষ্কের আকার আমাদের জীবন ধারণে কোন রকম নাটকীয় পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়নি। আফ্রিকা মহাদেশের বাইরে সেই পুরো সময়টা হোমো ইরেক্টাস এবং হোমো সেপিয়েন্সদের কোন সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ছিল না বললেই চলে। বস্তুতপক্ষে, সেই লম্বা সময়ের একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি ছিল আগুনের নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হওয়া। আধুনিক মানুষ হিসাবে আমাদের উত্থান আমাদের জেনেটিক পরিবর্তনের সাথে একশ ভাগ সরাসরি সম্পর্কিত না। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যোগ করা তখনো বাকী ছিল যা কিনা তৃতীয় শিম্পাঞ্জীকে পরবর্তী কালে সিস্টিন চ্যাপেলের ছবি আঁকতে সাহায্য করবে।

হোমো সেপিয়েন্সরা এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে এসে পৌছায়। প্রায় এক লক্ষ বছর আগে মানুষের শিকার করবার দক্ষতা সম্পর্কে পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু তখনও তা ছোট প্রাণী শিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে বড় প্রাণী শিকার শুরু করার কারণে আদিম মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা, ভাষা, দলবদ্ধ জীবন যাপন, এবং খাদ্য ভাগাভাগির মত জিনিষগুলি ঘটতে শুরু করে। ৪০-৫০ হাজার বছর আগে ক্রো ম্যাগনন এবং নিয়ান্ডার্থালরা ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় সহাবস্থান করত। দলবদ্ধ হয়ে বসবাস এবং খাদ্য ভাগাভাগির চর্চা, এমনকি মেয়েদের শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট্যও বড় প্রাণী শিকারের সাথে সাথে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। অন্যান্য মেয়ে প্রাইমেটরা ওভুলেশনের সময় যে রকম বাহ্যিক শারীরিক উপসর্গ প্রদর্শন করে মানুষের ক্ষেত্রে তা গোপন হতে শুরু করে যাতে করে পুরুষদের মধ্যে যৌন প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে না যায় এবং শিকারের সময়ে পারস্পরিক সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী মানব প্রজাতির মাঝে অল্প স্বল্প সাংস্কৃতিক বিকাশ দেখা গেলেও আধুনিক বুদ্ধিমত্তার বিকাশ এবং দ্রুত সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটতে শুরু করার প্রমাণ পাওয়া যায় ৫০-৬০ হাজার বছর আগে। পৃথিবীর বুকে মানব ইতিহাসের এই সময়টাকে ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে। ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের’ ঠিক আগে আগে পুরনো পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে কমপক্ষে তিনটি পৃথক মনুষ্য প্রজাতির বসবাস ছিল। এরা ছিল সত্যিকার অর্থেই শেষ আদিম মানুষ যারা ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ডের’ সময় আধুনিক মানুষ দ্বারা অপসারিত হয়ে যায়। কোথায় এদের বাস ছিল? পশ্চিম ইউরোপ থেকে শুরু করে দক্ষিণ ইউরোপের রাশিয়া এবং নিকট প্রাচ্য থেকে মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্থান এবং আফগানিস্তানের সীমান্ত পর্যন্ত এদের বিস্তৃতি ছিল। একই সময় দেখা পাওয়া যায় নিয়ান্ডার্থালদের। এদের পেশী ছিল আজকের দিনের যে কোন মিস্টার ইউনিভার্সের তুলনায়ও অনেক বেশী শক্তিশালী বিশেষ করে কাঁধে এবং ঘাড়ে। নিয়ান্ডার্থালদের মস্তিষ্কের আকার ছিল আধুনিক মানুষের তুলনায়ও বেশ কিছুটা বড়। কিন্তু তারপরও ওরা আমাদের মত হয়ে উঠতে পারেনি। এদের হাতিয়ারগুলি ছিল খুবই সাধারণ ধরণের যা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে বানান হতনা। কোন হাঁড়ের তৈরি হাতিয়ার কিংবা তীর-ধনুক ছিল না। বড় প্রাণী শিকারে খুব সিদ্ধহস্ত ছিল না বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। এমনকি সেই সময় আফ্রিকায় বসবাস করা আরও আধুনিক দেহের অধিকারী হোমো সেপিয়েন্সরাও শিকারি হিসাবে খুব একটা ভাল ছিল না। ক্রো ম্যাগননদের তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব ছিল অনেক কম। তবে নিয়ান্ডার্থালরাই প্রথম নিয়মিত আগুনের ব্যবহার করত এ ব্যাপারে সন্দেহ নাই। এবং তারাই সম্ভবত প্রথম নিয়মিত ভাবে মৃতদেহ কবর দেয়া শুরু করে এবং অসুস্থ এবং বয়স্কদের দেখাশোনা করত। নিয়ান্ডারথালদের পাথুরে হাতিয়ার গুলিও ছিল খুবই বিশেষত্বহীন। তাই আধুনিক মানুষদের মত দৈহিক গঠন, বৃহদাকার মস্তিষ্ক, এবং আধুনিক জিনম থাকা সত্যেও সেগুলো কিন্তু আজকের দিনের মানুষের মত আচার-ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট ছিল না। আধুনিক মানুষের কথা ভাবলেই যে জিনিষগুলি আমাদের মানস পটে ভেসে ওঠে এরকম অনেক জিনিষেই অস্তিত্ব নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। যেমন ওরা কোন শৈল্পিক বস্তুর নিদর্শন রেখে যায়নি। ঠাণ্ডার হাত রক্ষা পাওয়ার জন্য পোশাক ব্যবহার করত তবে সেগুলোর মধ্যে কোন সৃজনশীলতা ছিল না। অনেক সময় সমুদ্রের কিংবা জলাধারের খুব কাছাকাছি বসবাস করা সত্যেও নৌকার মত কোন কিছুর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই এটা খুব স্পষ্ট যে বৃহদাকার মস্তিষ্ক থাকা সত্বেও নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে নিঃসন্দেহে এমন কিছু একটার অভাব ছিল যা তাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়নি।

আমরা আজকে যাকে কুল-বৃদ্ধাদের সেবা এবং বৃদ্ধ বয়স বলি সেটাও নিয়ান্ডার্থালদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। তাদের ফসিল রেকর্ড থেকে বোঝা যায় পূর্ণবয়স্ক নিয়ান্ডারথাল ৩০ কিংবা ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচত। কিন্তু কোনভাবেই ৪৫ বছরের বেশী না। আমরা যদি আজকে লিখতে না পারতাম এবং আমরা কেউই যদি ৪৫ বছরের বেশী না বাঁচতাম তাহলে কল্পনাই করতে পারব না আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় জ্ঞানের সংরক্ষণ এবং তার উত্তরণ ঠিক কতটুকু হত! নিয়ান্ডার্থালদের সাথে তুলনীয় ছিল সমসাময়িক কালের আফ্রিকা থেকে আসা হোমো সেপিয়েন্সদের বর্তমান সময়ের আধুনিক মানুষের মত করোটি ছিল। এর মানে কি এই যে ১ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকাতে মানুষের সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল? শুনতে অবাক লাগলেও উত্তরটা হল, না। এই আধুনিক দেখতে মানুষগুলোর হাতিয়ারও ছিল নিয়ান্ডার্থালদের মত অতি সাধারণ। আর যে কারণেই তাদেরকে মধ্য প্রস্তর যুগের আফ্রিকান মানব হিসাবে উল্লেখ করা হয়। তাদের মাঝেও হাঁড়ের তৈরি হাতিয়ার, তীর ধনুক, মাছ ধরার জাল, বড়শি, শৈল্পিক বস্তু এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের অভাব ছিল। তাদের আধুনিক মানুষের মত দৈহিক বৈশিষ্ট্য থাকা সত্যেও এমন কিছু একটার অভাব ছিল যা তাদের “পরিপূর্ণ” মানুষ হয়ে ওঠা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আধুনিক জিন থাকা সত্যেও আমাদের মত আধুনিক মানুষ হতে পারেনি তারা।

১ লক্ষ বছর আগে থেকে ৫০ হাজার বছর আগে পর্যন্ত মানুষের উপস্থিতি থেকে আমরা জানি যে উত্তর ইউরোপ, সাইবেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সামুদ্রিক দ্বীপ সমূহ, এবং পুরো নূতন পৃথিবীতেই মানুষের কোন উপস্থিতি ছিল না। ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়াতে নিয়ান্ডার্থালরা বসবাস করত। আফ্রিকায় আমাদের মত দৈহিক গড়নের এবং এশিয়াতে আফ্রিকান হোমো সেপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডার্থালদের থেকে আলাদা ধরনের মানুষের বসবাস ছিল। এই তিন প্রজাতির মানুষই আচার আচরণ, হাতিয়ার, এবং উদ্ভাবনী শক্তির দিক থেকে খুবই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে তৈরি হয়ে গিয়েছিল দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের মঞ্চ। এদের মধ্যে থেকে কারা নিয়েছিল পরবর্তী পদক্ষেপটি?

human migration

চল্লিশ হাজার বছর আগে বরফ যুগের শেষপ্রান্তে ফ্রান্স এবং স্পেনের বিভিন্ন যায়গায় যেখানে আগে নিয়ান্ডার্থালদের বসবাস ছিল সেখানে পুরোপুরি আধুনিক মানুষের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া যেতে শুরু করল। এই আধুনিক মানুষ গুলোকে আমরা ক্রো ম্যাগনন হিসাবে জানি। এদের ছিল উন্নত ধরণের হাতিয়ার যা দিয়ে বড় এবং বিপজ্জ্বনক প্রাণী শিকার সম্ভব ছিল। যেমন বার্বড হারপুণ, ডার্টস, বর্শা, এবং তীর ধনুক। আগের চাইতে উন্নত হাতিয়ারের কারণে ক্রো ম্যাগননরা নতুন নতুন পরিবেশ দখল করে নিতে থাকে এবং ছড়িয়ে পরতে থাকে নতুন এবং পুরনো পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গায়। ৫০ হাজার বছর আগে মানুষ প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ায় পৌছায়। ২০ হাজার বছর আগে উত্তর রাশিয়া এবং সাইবেরিয়ায় এবং সেখান থেকেই ১১ হাজার বছর আগে উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে যায় মানুষ। ইউরোপে ক্রো ম্যাগননরা এবং তাদের সমসাময়িকরা অনেক দূর দূরান্ত পর্যন্ত হাতিয়ার এবং কখনও কখনও অর্থহীন গয়না তৈরির রসদ সংগ্রহের জন্য ভ্রমণ করত। ক্রো ম্যাগননদের যে সমস্ত শৈল্পিক নিদর্শন উল্লেখযোগ্য তাদের মধ্যে গুহাচিত্র, বিশেষ ধরণের ভাস্কর্য (Bas relief), গলার হার, লকেট এবং সিরামিকের ভাস্কর্য অন্যতম। নিয়ান্ডার্থালরা যেখানে মাত্র চল্লিশ বছর বাঁচত সেখানে ক্রো ম্যাগননরা বেঁচে থাকত ৬০ বছর পর্যন্ত। আর এটা ছিল ক্রো ম্যাগননদের উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল উন্নয়নের অন্যতম প্রধান কারণ। প্রাক শিক্ষা যুগের মানুষদের জন্য এরকম একজন বা দুজন বয়স্ক মানুষ ছিল অত্যন্ত গুরত্বপূর্ন। এরকম একজন মানুষই হতে পারে মৃত্যু এবং বেঁচে থাকার মধ্যকার পার্থক্য। ক্রো ম্যাগননদের নিয়ান্ডার্থালদের তুলনায় বিশ বছরের মত বেশী বেঁচে থাকাটা নিঃসন্দেহে তাদের উত্থানের পেছনে বড়সড় অবদান রেখেছিল।

grandparents_table

[“আজকে যেভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের পরিমাণ কয়েক গুণ হয়ে যাচ্ছে তখন কিন্তু তেমনটি কোনভাবেই হতে পারতো না। কারণ তখন কোন মানুষের জীবন দিয়ে অর্জিত সকল জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা সীমাবদ্ধ থাকতো কেবলই তার সন্তান-সন্ততিদের মাঝে, তাও যদি সে মৃত্যুর সময় পূর্ণবয়স্ক সন্তান রেখে যেতে পারে। জ্ঞানের এই ঘনীভবনই হয়ত আদিম যুগে মানুষের ধীর অগ্রগতির প্রধান কারণ। ভাষা, শিল্প এবং লিখনপদ্ধতি আবিষ্কারের পর মানুষ খুব দ্রুত অগ্রসর হতে শুরু করে। বলা যায় মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতি এবং জ্ঞান সংরক্ষণ ও সরবরাহ ব্যবস্থার অগ্রগতি একে অপরের পরিপূরক। তো যখন জ্ঞানের কোন সংরক্ষণ পদ্ধতি ছিল না তখন সামষ্টিক প্রগতির একমাত্র উপায় ছিল সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে যতটুকু সম্ভব পূর্ব প্রজন্মের জ্ঞানের ধারা অব্যাহত রাখা। কিন্তু এতেও বাধ সেধেছিল মানুষের স্বল্পায়ু। আনুমানিক ৪০ হাজার বছর পূর্বে মানুষের আয়ু হঠাৎ এত বেড়ে যাওয়ার কারণ দুই ধরণের হতে পারে: জৈবিক বা সাংস্কৃতিক। জৈবিক কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে, হয়ত দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষের মধ্যে যেসব জিনগত বৈশিষ্ট্য প্রভাব বিস্তার করেছিল তারই একটি দীর্ঘায়ু। গবেষকরা নিয়ানডার্থাল ও আধুনিক মানুষের জীবাশ্মের উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এবং দেখেছেন এদের বৃসানুপাত ১ এর বেশ কাছাকাছি যা ইউরোপের নিয়ান্ডার্থালদের (০.৩৯) চেয়ে অনেক বেশি কিন্তু ইউরোপের আধুনিক মানুষদের (২.০৮) চেয়ে বেশ কম। এই ফলাফল বিস্ময়কর। দৈহিক দিক দিয়ে পশ্চিম এশীয়দের সাথে ইউরোপীয়দের তেমন কোন পার্থক্য না থাকা সত্ত্বেও তাদের বৃসানুপাত যথেষ্ট আলাদা। এ থেকেই প্রমাণিত হয়, জৈবিক কারণে আয়ু বাড়েনি। জৈবিক কারণে বাড়লে তো পশ্চিম এশিয়ার অপেক্ষাকৃত আদিম মানুষদের বৃসানুপাতও আধুনিক ইউরোপীয়দের সমান হওয়ার কথা। এই পরীক্ষায় আরও মজার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যেমন, পশ্চিম এশিয়ার নিয়ান্ডার্থালদের বৃদ্ধ জনসংখ্যা ইউরোপীয় নিয়ান্ডার্থালদের চেয়ে বেশি। এর কারণও সহজবোধ্য- বরফ যুগের ইউরোপের তুলনায় উষ্ণ আবহাওয়ার পশ্চিম এশিয়া তথা মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করা ছিল সহজ, এজন্যই সেখানে মানুষ বেশি বয়স পর্যন্ত টিকে থাকতো। কিন্তু সেক্ষেত্রে ইউরোপের আধুনিক মানুষদের আয়ু পশ্চিম এশিয়ার আধুনিক মানুষদের চেয়ে এত বেশি হওয়াটা আরও বিস্ময়কর হয়ে ওঠে। ইউরোপে পরিবেশ এত প্রতিকূলে থাকার পরও সেখানকার আধুনিক মানুষদের জীবনে এমন কি ঘটেছিল যা দৈহিকভাবে অন্য অঞ্চলের মানুষদের মত হওয়া সত্ত্বেও তাদের আয়ু এত বাড়িয়ে দিয়েছিল? বোঝাই যাচ্ছে কারণটি জৈবিক নয় বরং সাংস্কৃতিক। দেহের তাড়না নয় বরং সাংস্কৃতিক চেতনাই আয়ু বৃদ্ধির কারণ। সংস্কৃতি যে ৪০ হাজার বছর পূর্ব থেকেই মানব জীবনে এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছিল তা বোধকরি এর আগে এতটা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করা সম্ভব ছিল না। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে মানুষের আয়ু বৃদ্ধির কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে আমরা প্রথমবারের মত বুঝতে পারব কুল-বৃদ্ধাদের সেবা ও প্রজ্ঞা এবং সংস্কৃতির বিকাশ ছিল একে অপরের কার্যকারণ।

আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জিদের বেশ মিল আছে। এই উভয় প্রজাতির নারীদের ক্ষেত্রেই প্রজননের সবচেয়ে ভাল সময় ৩০ বছরের একটু আগে থেকে প্রায় ৪৫ বছর বয়স পর্যন্ত। কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে শিম্পাঞ্জিদের গড় আয়ু অনেক কম, শতকরা তিন ভাগেরও কম শিম্পাঞ্জি ৪৫ বছরের বেশি বাঁচে। মানুষের প্রজনন ক্ষমতা শেষ হয়ে যাওয়ার সময়কে বলে রজোনিবৃত্তি (মেনোপজ)। শিম্পাঞ্জিরা যেখানে প্রজনন ক্ষমতা হারানোর পরপরই মারা যায় মানবীরা সেখানে রজোনিবৃত্তির পরেও অনেকদিন বেঁচে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে মানুষের প্রজননে অক্ষমতা কিভাবে বংশবিস্তারে সহায়ক হয়ে উঠল?

এই অনুকল্পে বলা হচ্ছে, বৃদ্ধ বয়সে যদি কেউ সন্তান নেয় তাহলে শিশু সন্তান রেখেই সে মারা যাবে, আর মা মারা গেলে শিশুটি বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও অনেক কমে যাবে। কিন্তু কেউ যদি সে বয়সে সন্তান না নিয়ে বরং তার জীবিত সন্তানদের দেখভাল এবং নাতি-নাতনিদের সেবা করে দিন কাটায় তাহলে সার্বিকভাবে তার বংশের ভাল হবে। যে কুলের বৃদ্ধারা সন্তান না নিয়ে নাতি-নাতনির সেবা করবে সেই কুল বেশি বিস্তার লাভ করবে। সুতরাং অনেককাল পর দেখা যাবে কেবল সেই কুলের মানুষই টিকে আছে। অন্যদিকে, নিজে সন্তান না নিয়ে নাতি-নাতনির সেবা করার কারণে কুল-বৃদ্ধাদের স্বাস্থ্য-সবলতাও বাড়বে। অর্থাৎ, যে বৃদ্ধারা সবল তারা বেশি সেবা করতে পারবে, সুতরাং প্রাকৃতিক নির্বাচন সবল বৃদ্ধাদেরই নির্বাচন করবে। এ কারণে হয়ত প্রাকৃতিকভাবে সেই কুলই নির্বাচিত হয়েছে যে কুলের বৃদ্ধাদের রজোনিবৃত্তি ঘটতো এবং যে কারণে তারা নিজে সন্তান না নিয়ে নাতি-নাতনির সেবা করতে পারতো। কুলবৃদ্ধা তত্ত্ব তো কেবল নারীদের আয়ু বৃদ্ধির কথা বলছে, তাহলে পুরুষের কি হবে? এটা ঠিক যে, পুরুষের আয়ুর বিবর্তনে আরও কিছু প্রভাবক নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে, কিন্তু নারীর আয়ুর্বৃদ্ধি নির্ঘাত পুরুষের দেহেও প্রভাব ফেলবে। কারণ, আমাদের দেহের কোষগুলোর সংরক্ষণ ও সংস্কারের প্রক্রিয়া অন্যান্য প্রাইমেটদের চেয়ে কার্যকর। যে দৈহিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বৃদ্ধায়ন ধীরে ধীরে ঘটে তা কিন্তু বংশ পরম্পরায় মায়ের দেহ থেকে ছেলে-মেয়ে উভয়ের দেহেই প্রবাহিত হবে। এভাবেই কুল-বৃদ্ধাদের নাতি-নাতনি লালন-পালনের সংস্কৃতি আনুমানিক ৪০,০০০ বছর পূর্বে মানুষের আয়ু বৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল।

হিলার্ড ক্যাপলান ও তার সহকর্মীরা দীর্ঘায়ু লাভের আরেকটি তত্ত্ব প্রস্তাব করেছিলেন যা আয়ুষ্কালের বিবর্তনে একই সাথে শারীরবৃত্ত, মনস্তত্ত্ব এবং আচার-ব্যবহারের অবদান স্বীকার করে। তারা প্রথমেই বলেছিলেন, একজন মানুষের জীবনেতিহাস অন্তত পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্য সব স্তন্যপায়ী এবং প্রাইমেটদের থেকে আলাদা। এগুলো হচ্ছে দীর্ঘায়ু, শিশু-কিশোরদের বড়দের উপর অনেক বেশি নির্ভরতা, সন্তান লালন-পালনে কুল-বৃদ্ধাদের অবদান, মা এবং শিশুদেরকে পুরুষদের খাদ্য সরবরাহ এবং উন্নত মস্তিষ্ক যা বোধ, শিক্ষা ও অন্তর্দৃষ্টির মত মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ধারণে সক্ষম। তত্ত্বটি বলে, উন্নত খাদ্যাভ্যাসের সাথে এই সবগুলো বৈশিষ্ট্যের সহবিবর্তন ঘটেছে। মানুষ এক সময় উন্নত কিন্তু দুর্লভ খাদ্য গ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট হয় যা তৈরিরে জন্য অনেক দক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, জ্ঞান এবং শক্তির প্রয়োজন ছিল। শিশু-কিশোর বয়সে মানুষ এই গুণগুলো অর্জন করতো, কিন্তু সরাসরি কোন খাদ্য সংগ্রহ করতো না। বড়রা খাদ্য সংগ্রহ করে শিশু ও মায়েদের খাওয়াতো। শিশু-কিশোররা এত কম উৎপাদনশীল বলেই বয়স্ক পুরুষদের উৎপাদনশীলতা এত বেশি। বয়সের সাথে সাথে উৎপাদনশীলতা বাড়ে বলেই মৃত্যুর হার কমে এবং আয়ু বৃদ্ধি পায়। খাদ্য যোগানের দক্ষতা অর্জনের পর তা থেকে ফল পেতে অনেক সময় লাগে যে কারণে মানুষের কৈশোর বেশ দীর্ঘ। খাদ্য সংগ্রহে এত চেষ্টা চরিত্তির করে বলেই তা পরিবারের সবার সাথে ভাগ করার প্রবণতা মানুষের বেশি। মা এবং শিশুদের খাদ্যের চিন্তা থাকে না বলে শিশু-কিশোর মৃত্যুর হার কম। সংক্ষেপে বলা যায় মানুষের দীর্ঘায়ু লাভের মূল কারণ উন্নত খাদ্যাভ্যাস এবং তা অন্য তিনটি বৈশিষ্ট্যের সাথে সহবিবর্তিত হয়েছে: দক্ষতা তৈরির উপযোগী জটিল মস্তিষ্ক, দক্ষতা অর্জনের জন্য দীর্ঘ কৈশোর এবং ছোটদেরকে খাদ্য ও সেবা দিয়ে বড়দের সাহায্য করা।” (৫ নং সূত্র থেকে সরাসরি উদ্ধৃত)]

আমরা যদি টাইম মেশিনে করে ৪০ হাজার বছর আগে ফিরে যেতে পারতাম তবে আশ্চর্য হলেও দেখতে পেতাম ক্রো ম্যাগননরা ঠিক আমাদের মতই আধুনিক মানুষ যারা কিনা বিমান চালানোর বিদ্যা শিখতে সক্ষম। কিন্তু তারা শুধুই পাথর এবং হাঁড়ের তৈরি হাতিয়ার বানিয়েছে। কেন? কারণ আর কোন ধরণের হাতিয়ার তখনও আবিষ্কার হয়নি, তাই। ঐ টুকুই আবিষ্কৃত হয়েছিল তাদের শিখবার জন্য। কিন্তু ৬০ হাজার বছর আগে আমাদের দৈহিক কাঠামোতে একটি ম্যাজিক্যাল টুইস্ট যোগ হয় আর সেই টুইস্টের কারণেই সৃজনশীল আধুনিক মানুষেরা নিকট প্রাচ্য থেকে পশ্চিমে দিকে ইউরোপে ছড়িয়ে পরে এবং নিয়ান্ডার্থালদের অপসারণ করে। ২০ লক্ষ বছর আগে প্রথম-মানুষের বেশ কয়েকটি শাখা পাশাপাশি অবস্থান করেছিল। তারপর এক শেকডাউনে তা একটি মাত্র শাখায় নেমে আসে। সেরকমই আরেকটি শেকডাউন ঘটেছিল ৬০ হাজার বছর আগে। পরবর্তী সময়ে এবং আজকের আমরা সবাই সেই শেকডাউনে জয়ীদের বংশধর। কি ছিল সেই অর্জন যা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে জয়ী হতে সাহায্য করেছিল?

Vocal Tract

উত্তরটা হল যৌগিক (complex) ভাষায় কথা বলতে পারার জন্য শারীরিক কাঠামো। শিম্পাঞ্জী, গরিলা এমনকি বানরেরাও কথ্য ভাষার উপর নির্ভরশীল না এমন সাংকেতিক ভাষায় নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান করতে সক্ষম। প্রাইমেটরা সংকেত এবং কম্পিউটার (শেখানো) কি’র ব্যবহার ছাড়াও শব্দকে প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করতে সক্ষম। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ভেরভেট বানরদের প্রতীকী ভাব বিনিময় করার জন্য একটা প্রাকৃতিক ফর্ম আচে যা তারা মুখ দিয়ে চাপা ঘোঁতঘোঁত (Grunt) শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করে। কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন চাপা শব্দের দ্বারা চিতাবাঘ, ঈগল, কিংবা সাপ বুঝিয়ে থাকে। ভিকি নামের একটি শিশু শিম্পাঞ্জী সর্বসাকুল্যে চারটি শব্দ বলতে শিখেছিল। শব্দ চারটি হল “papa”, “mama”, “cup”, এবং “up”। ভিকি ঠিক কথা বলত না বরং শব্দগুলো বলত নিঃশ্বাস ছাড়ার মত করে। শব্দের সাহায্যে এই সাংকেতিক ভাষায় ভাব বিনিময়ের সক্ষমতা সত্যেও প্রাইমেটরা কেন তাদের নিজস্ব যৌগিক ভাষার উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম হয়নি? উত্তরটা জড়িত আছে তিনটি জিনিষের সাথে – আমাদের জিহ্বা, স্বরযন্ত্র, এবং এদের সাথে সংযুক্ত পেশি যা আমাদের উচ্চারিত শব্দের উপর নিখুঁত নিয়ন্ত্রণ করতে দেয়।

শিম্পাঞ্জীরা শারীরিক ভাবেই আমরা যে সমস্ত স্বরবর্ণ ব্যবহার করি সেগুলোর মধ্য থেকে বেশিরভাগই উচ্চারণ করতে অক্ষম। আমরা যদি অল্প কিছু সংখ্যক স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জন বর্ণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতাম তবে আমাদের শব্দভাণ্ডারও অনেক সীমিত হত। যেমন এই লেখার যেকোনো একটি অনুচ্ছেদের “অ” এবং “ই” ঠিক রেখে যদি অন্য স্বরবর্ণ গুলোকে এই দুটি স্বরবর্ণের একটিতে পরিবর্তন করা হয় তবে এবং “ক”, “ড”, “ল”, এবং “স” ব্যঞ্জন বর্ণগুলোকে ঠিক রেখে বাকী বর্ণগুলোকে যদি এই চারটি ব্যঞ্জন বর্ণের যে কোন একটিতে পরিবর্তিত করা হয় তবে সেই অনুচ্ছেদটি কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব হবে না বলেই ধরে নেয়া যাতে পারে। শারীরিক কাঠামোর ছোট্ট একটি পরিবর্তন যা আমাদের কথা বলাকে সম্ভব করেছিল এবং যার ফলশ্রুতিতে আমাদের আচরণে একটি বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল তা খুব সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি। ভাষার সাহায্যে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই আমরা ভাব আদান-প্রদান করতে পারি। “চার নাম্বার গাছটা পার হয়েই ডানে মোড় নিয়ে পুরুষ হরিণটাকে লাল রঙের বড় পাথরটার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে আসবে — ঐখানে আমি লুকিয়ে থাকব এবং হরিণটা আসা মাত্রই বর্শা দিয়ে গেঁথে ফেলব।” ভাষা ছাড়া এই বার্তাটি কোন ভাবেই আরেকজনকে বোঝানো সম্ভব না। ভাষা ছাড়া দুজন আদি মানুষের পক্ষে কিভাবে আরও উন্নত হাতিয়ার বানানো যায় অথবা একটি চিত্রের মানে কি হতে পারে সেটা আলোচনা করে বের করা সম্ভব না। এমনকি ভাষা ছাড়া একজন আদিম মানুষের পক্ষে নিজে নিজেই কিভাবে আরও ভাল হাতিয়ার বানানো যায় সেটা ভেবে বের করাও খুবই কষ্টকর হওয়ার কথা।

একটা কথা বলে রাখা দরকার, যে মুহুর্তে আমাদের জিনে পরিব্যাপ্তি হয়েছিল যা আমাদের জিহ্বা এবং স্বরযন্ত্রে পরিবর্তন এনেছিল ঠিক সেই মূহুর্তেই “গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড” শুরু হয়েছিল এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। আজকে আমরা ভাষার যে নির্মিতিকে (structure) নিখুঁত হিসাবে মেনে নিয়েছি সঠিক দৈহিক কাঠামো সত্যেও অবধারিতভাবেই ভাষার সেই নির্মিতিকে দাঁড় করাতে আধুনিক মানুষের হাজার হাজার বছর সময় লেগেছে।

২০০১ সালে জার্মানির লিপজিগের ম্যাক্স প্লাঙ্ক ইনস্টিটিউটের আণবিক জিনতত্ববিদ এসভ্যাস্টে পাবো এবং তার সহকর্মীরা আবিষ্কার করেন যে মানুষের দেহে FOXP2 নামে একটা জিন আছে যা কিনা আমাদের কথাবলা এবং ভাষার ব্যবহারের ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই জিনটির বিবর্তন হয়েছে ২ লক্ষ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্সদের আবির্ভাবের পর। লস এঞ্জেলসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল গেশুইন্ড এর গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারছি যে FOXP2 এর যে ভার্শনটা মানুষের মধ্যে আছে সেটাতে শিম্পাঞ্জীদের ভার্শনটা থেকে দুটো ভিন্ন এমাইনো এসিড আছে। এই ভিন্ন ভার্শনের FOXP2 মানুষের এবং শিম্পাঞ্জীর জিনে এবং মস্তিষ্কে ভিন্ন ভিন্ন ধরণের প্রভাব ফেলে।

UCLA and the Technion, Israel’s Institute of Technology এর বিজ্ঞানীরা ২১ আগস্ট, ২০১২ Nature Communications এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে আমাদের মস্তিষ্কের কোষে আলাদা আলাদা ভাবে প্রতিটি স্বরবর্ণের উচ্চারণের সংকেত আবদ্ধ করা থাকে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে মস্তিষ্কের যে দুটি অঞ্চল কথা বলা এবং স্বরবর্ণের সাথে ওতপ্রোতভাবে সেগুলো হল সুপিরিয়র টেম্পোরাল জাইরাস এবং মিডিয়াল ফ্রন্টাল লোবের একটি অঞ্চল। মানুষের বাচন ক্ষমতা প্রজাতি-নির্দিষ্ট দৈহিক কাঠামোর সাথে সম্পর্কিত। এই কাঠামোর উদ্ভব হয়েছে অন্ননালীর উপরে অবস্থিত গহ্বরে জিহ্বার অবনমনের ফলে। বাচন ক্ষমতার জন্য আরও প্রয়োজন এমন একটি মস্তিষ্কের যা বাধাহীন ভাবে সঞ্চালক পেশির সীমিত সংখ্যক ভঙ্গিকে বস্তুত:পক্ষে অসীম সংখ্যক শব্দে বা বাক্যে পুনঃ বিন্যস্ত করতে সক্ষম। শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে সূক্ষ্ম শব্দ তৈরি করতে সক্ষম এবং একইসাথে শব্দ তৈরি এবং উপলব্ধি করার কাজকে সহজ করে তোলা বাগ যন্ত্রের উপরে অবস্থিত কণ্ঠনালীর বর্ধিত অংশটি অনুপস্থিত। এছাড়াও শিম্পাঞ্জীদের মধ্যে বিদ্যমান নির্দিষ্ট ভোকালাইজেশনের শাব্দিক বৈষম্যের পুনর্বিন্যাস করতে সক্ষম মস্তিষ্ক নেই। মানুষের কথা বলা এবং ভাষার শুরুটা সম্ভবত হয়েছিল হাঁটতে এবং দৌড়াতে শেখার সময় থেকেই। কিন্তু পুরোপুরিভাবে কথা বলতে পারার মত দৈহিক কাঠামো প্রথমবারের মত পাওয়া যায় ঊর্ধ্ব প্যালিওলিথিক যুগে, ৫০ হাজার বছর আগে। নিয়ান্ডার্থাল এবং এর আগের যুগের মানুষদের মধ্যে যা অনুপস্থিত। এটা পরিষ্কার যে স্নায়বিক সক্ষমতা যা মানুষকে কথা বলতে সাহায্য করে তা বেঁচে থাকা অন্যান্য নিকট আত্মীয় প্রজাতিগুলোর মধ্যে অনুপস্থিত। মানুষের কথা বলতে পারার জন্য পুনর্বিন্যস্ত করার সক্ষমতার জন্য যে স্নায়বিক সার্কিটের দরকার হয় তা শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য প্রাইমেটদের মধ্যে নেই।

আমরা ধরেই নিতে পারি যে যখন থেকে কণ্ঠনালীর কারণে আমরা শব্দকে খুব সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি তখন থেকেই আমাদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার ক্রম উন্নতি ছিল শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার। কথা বলতে শুরু করাটাই ছিল আমাদের মুক্তির শুরু। কিন্তু তারপরও কথা থাকে। কথা বলতে শুরু করার পরেও কেন এত বছর সময় লেগেছিল লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে কিংবা পার্থেনন তৈরি করতে? কারণ, লিখন পদ্ধতি আবিষ্কার কিংবা পার্থেনন তৈরি করাটা ছিল হাজার হাজার বছরের সম্মিলিত উন্নয়নের উপর নির্ভরশীল। গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের আগে পর্যন্ত মানুষের সংস্কৃতির উন্নয়ন হয়েছে খুবই ধীর গতিতে – শামুকের গতিতে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে। কিন্তু গ্রেট লিপ পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন আর শুধুমাত্র জেনেটিক পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল হয়ে রইল না। খুব ছোট একটি দৈহিক কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে গত ৪০-৫০ হাজার বছরে মানুষের মধ্যে যে বিশাল পরিবর্তন হয়েছে তা এর আগের ২০ লক্ষ বছরেও হয়নি। নিয়ান্ডারথালদের সময়ে কোন ভিনগ্রহ বাসী যদি পৃথিবীতে আসত তবে তার কাছে মানুষ কোন বিশেষ প্রাণী হিসাবে বিবেচিত কিনা সন্দেহ। খুব বেশী হলে তারা মানুষকে বিভার কিংবা বাওয়ার পাখীর মত অদ্ভুত আচরণ করতে সক্ষম একটি প্রজাতি হিসাবেই গণ্য করত। তবে তারা হয়ত কল্পনাও করতে সক্ষম হত না যে খুব শীঘ্রই এই প্রাণীটি পৃথিবীর বুকে জীবনের ইতিহাসে প্রথম প্রাণী হিসাবে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচণের দ্বার প্রান্তে এসে উপস্থিত হবে।

তথ্যসূত্র:

1. The Third Chimpanzee : The Evolution and Future of the Human Animal By Jared M. Diamond
2. How Man Began – Time Magazine March, 1994
3. Origins of Modern Humans: Multiregional or Out of Africa? – By Donald Johanson
4. What Makes us Different? By MICHAEL D. LEMONICK
5. মানুষের আয়ুষ্কালের বিবর্তন – (বিবর্তন উইকি স্পেস ডট কম)
6. Evolution of Human Brain By Ralph Holloway
7. Evolutionary Genetics: Is brain evolution still continuing in modern humans?
8. Brain’s Code for Pronouncing Vowels Uncovered:
9. The Evolution of Human Speech – Its Anatomical and Neural Bases by Philip Lieberman; Brown University (Providence, RI)
10. Evolutionary Increase in Size of the Human Brain Explained: