সেই ছোটবেলার কথা। এক ভিখারিনী আসত ভিক্ষা করতে। পরনে শতচ্ছিন্ন ময়লা বস্ত্রখণ্ড, আলুথালু ধুলোমাখা বিবর্ণ চুল; চোখমুখ উদ্ভ্রান্ত,সদা অস্থির, অসংলগ্ন কথাবার্তা। ছিন্ন বস্ত্রখণ্ডটি ঠিকমত গায়ে জড়ান থাকত না তার। কোন দিক দিয়ে কাপড় পড়ে যাচ্ছে, কোন দিক দিয়ে লেগে আছে সে দিকে তার পরোয়াই ছিল না! ঝড়ের বেগে বিচলিত হয়ে দৌড়াত সে দিক-বিদিক। কখনো সে সন্তানবতী থাকত, কখনো বা থাকত তার কোলে একটি ছোট্ট শিশু। শিশুটির দেহে স্পষ্ট লেগে থাকত অপুষ্টি ও অনাদরের চিহ্ন। সবাই তাকে ডাকত, সাজুনী পাগলী। অন্যান্য ভিক্ষাজীবীদেরকে দেখতাম, যাদের কাছে তারা ভিক্ষা চাইত তাদের উদ্দেশ্যে নিজেদের মুখ হতে অবিরত আশীর্বাদ, স্তুতিবাক্য মুষলধারায় বর্ষিত হত। নিত্যনতুন কথায় ও সুরে অভিনব ভিক্ষা-সংগীত তো আছেই। তারা জানত মানুশ পটানর নানান কলা-কৌশল। সাজুনী কোনো কৌশল জানত না, বা সে কৌশলের ধার ধারত না। কোনো বাসার দরজা খোলা পেলেই সে দৌড়ে এসে বাসায় ঢুকে যেত। বলত, কী দেবে তাড়াতাড়ি দাও। একটু খাবার দাও, তিনদিন কিছু খাইনি। বাচ্চাটার জন্য একটু দুধ দাও। ওকে দেখলেই সবাই সজোরে দরজা বন্ধ করে দিত। নারী পুরুশ সকলেই দূর দূর, ছি ছি করত। দৈবক্রমে কারো বাসায় ঢুকে গেলে তারা বলত, তুই নাপাক তুই পাপী কুলটা খবরদার আর কভুও বাসায় ঢুকবি না। হায় আল্লা সবই নাপাক হয়ে গেল, এবার সবকিছু জমজম কুয়ার পানি দিয়ে ধুতে হবে। সাজুনীর বাচ্চাটাকে দেখিয়ে সকলে জিজ্ঞেস করত, এই বাচ্চা পেলি কোথা, বাচ্চার বাবা কোথা, সে তোদের দেখাশোনা করে না? সাজুনী নির্দ্বিধায় নির্লিপ্তভাবে জবাব দিত, বাচ্চার বাবা কে তা আমি কী করে জানব? ছি ছি তোর বাচ্চার বাবা কে তা তুই জানিস না! ছি জাহান্নামী পাতকী লজ্জা লাগে না তোর! দূর হ, পাপমুখ আর দেখাবি না কারুকে। সাজুনী বলত, আ-মরি আমায় যারা পাপী বানাল, যেসব ছাপ কাপড়ের পুরুশ আসে এই নোংরা আমার সাথে পাপ করতে তারা পাপী না! আমি গাছতলায় ঘুমোতে গেলেই চারদিক থেকে শেয়াল-কুকুরের দল আমায় ঘিরে ধরে। শূকরের বাচ্চারা আমায় পাগল করে ছাড়ল। একেক দিন একেক জায়গায় যাই ঘুমোতে। যেখানে যাই সেখানেই কুকুরের উৎপাত। ওঁত পেতে থাকে হারামির দল। আমি কি ওদের জ্বালায় গাছ তলায়ও ঘুমোতে পারব না শান্তিতে! নিত্যনতুন জায়গায় নিত্যনতুন কুকুর আসে আমায় ছিঁড়ে খেতে। এতগুলি কুকুরের মধ্যে এই কুকুরের বাচ্চার বাবা কে তা কি করে জানব?

নারী-পুরুশ, বৃদ্ধ, বালক-বালিকা সবাই সাজুনীকে ছি ছি দূর দূর করত। কারুকেই তার প্রতি একটুখানি সহানুভূতি দেখাতে দেখিনি। এমন কি কোনো নারীও সেই দুখিনী নারীর দুঃখ বোঝেনি কভু। যে সকল ভদ্রলোকেরা সাজুনীর প্রতিটি রাতকে নরকে পরিণত করত তারা কারা? দিনের আলোর মানীগুণী ছাপকাপড়ের লোকেরা রাতের আঁধারে কেমন করে শকুনে রূপান্তরিত হয়? যে শিশুকে সবাই একবাক্যে “জারজ” বলত সেই শিশু ভদ্র সমাজের কারো ঔরসজাত হতে পারে না কি?

আমার এক ভাবীর কাছে কলকাতার একটি মুভির কাহিনী শুনেছিলাম। মুভিটি আমার এখনো দেখা হয়ে উঠেনি। মুভির নাম “ফালতু” কাহিনীটি এমন;
এক পাগলী বাস করে এক গ্রামে। ছোট্ট একটা কুড়ে ঘরে তার বাস। দিনমান ভিক্ষা করে। রাতে স্বাভাবিকভাবে কুটিরে শকুনিদের উপদ্রব। একদিন সবাই বুঝতে পারল যে, পাগলিনীটি সন্তানবতী হয়েছে। একদা সন্তান জন্মদান-কালে সে মারা গেল। বেঁচে রইল নবজাত শিশু পুত্রটি। বাচ্চাটিকে গ্রামের সবাই মিলে লালন-পালন করে বড় করল। তার কোনও নাম রাখা হয়নি। সবাই তাকে ডাকে “ফালতু।” সেই গ্রামেরই এক মেয়ের সাথে ফালতুর প্রণয় হল, তাদের বিয়ে ঠিক হল। বিয়েতে গ্রামবাসী মহা-খুশি। বিয়ের দিন মেয়ের বাবা বিয়েতে বাধ সাধল। বলল, ভাইবোনে কখনও বিয়ে হতে পারে না। ফালতু কার ঔরসজাত তা তো নিশ্চয় করে বলা যায়না। তবে নিশ্চিত হওয়া যায় অজস্র শকুনের ঝাঁকের মধ্যে কন্যার বাবাও ছিল, যার মেয়ের প্রেমে পড়েছিল ফালতু!

যে সকল অন্নহীন, বস্ত্রহীন, গৃহহীন, সহায়হীন নারীরা গাছতলায় বা আকাশের নিচে যে কোথাও ঘুমায় তাদের আর কিছু থাক বা না থাক শরীর আছে। হয়ত বা সেই শরীরে মন বলে কোনো বস্তুও আছে। তাদের শরীরের প্রক্রিয়াও বিত্তশালী, উচ্চশিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত, গৃহী নারীদের মত। তারাও বংশ বিস্তারের ক্ষমতা রাখে, যেমন রাখে অন্যান্য প্রাণীকুল। পেটের খিদার মত দেহের খিদাও থাকে ধনী-দরিদ্র সবার। সব কিছুতেই জাত-হীনদেরই কেবল জাত যায়। উচ্চ-বংশজাতদের বা পুরুশদের সেই ভয় নেই। যেই হতদরিদ্র নোংরা নারীদের দেখলে সবার ঘৃণা জন্মে, থু থু আসে, বিবমিষা জাগে; যাদের দুর্গন্ধে লোকে নাকে রুমাল চাপা দেয়, কোন মহামানব যান তাদের কাছে বীরত্ব কিংবা পুরুশত্ব প্রদর্শন করতে! দু’পক্ষের সম্মতিক্রমেও যদি কোনো সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকে সেই মাশুল কেন শুধু নারীকেই দিতে হয়? বোঝা কেন শুধু নারীকেই বইতে হয়? পুরুশ তার পৌরুশ চরিতার্থ করেই কেটে পড়তে পারে। নারী সেই বীরপুরুশের পৌরুশ ও ঔরস বয়ে যায় সবার লাথি-ঝাঁটা খেয়ে। হাজার প্রতিকূলতা ও লাঞ্ছনার মাঝেও হয়ত সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ভ্রূণটি ভূমিষ্ঠ হয়। জন্মদাত্রী ও শিশু উভয়কেই শিকার হতে হয় যাবতীয় চরম ধিক্কার এবং ঘৃণার। চিরকালের সীলমোহর এঁটে যায় তাদের ললাটে। চিরদিনের তরে মা-টি হয়ে যায় পতিতা, কুলটা, মহাপাপী। যে নির্দোষ শিশু তার জন্মের ইতিহাস কিছুই জানে না, যে মোটেই দায়ী নয় তার জন্মের জন্য সে হয়ে যায় “জারজ”। ঔরসদাতা মহাপুরুশের দেহে বা মনে এসবের বাতাসও লাগেনা।

সমাজ, সংসার, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি সবকিছুই নারীর প্রতিকূল। প্রকৃতিও কেন নারীর প্রতি বিরূপ? যে দুর্ঘটনার জন্য নারী দায়ী নয় সে দুর্ঘটনার সম্পূর্ণ দায়ভার এবং চূড়ান্ত ফলাফলের ভারী বোঝা প্রকৃতি কেন কেবল নারীর উপরেই স্থায়ীভাবে চাপিয়ে দিয়েছে? প্রকৃতিও কি নারীর বিরুদ্ধে পুরুশের সাথে যুক্তি করেছে? যেই মাতৃত্বকে মহান ব্যাপার বিবেচনা করা হয়, পিতৃ-পরিচয়হীন হলেই কেন সেই মাতৃত্বের মহত্ব ঘৃণ্যতায় পর্যবসিত হয়? ঔরসদাতা মহাপুরুশ যে-ই হোক না কেন; গর্ভধারিণী, জন্মদাত্রী মা নির্বাচনে তো কারো গবেষণার প্রয়োজন হয় না!