লেখকঃ দেবা ভাই

ফুলবাড়ির কান্না

ফুলবাড়ি কাঁদেরে
লাশ নিয়ে কাঁধেরে,
আর হাসপাতাল আছে শুয়ে
র’বে না তারা নুয়ে,
শ’খানেক লোক।
চারদিকে তাকালেই শোক আর শোক।

ফুলবাড়ির লোকেরা নয় যেন মানুষ!
তাই বিডিআরে করে গুলি ‘ঠুশ ঠাশ ঠুশ…!’
ক্ষমতার নির্দেশে কত লাশ পড়ে,
আর কিছু বামনেতা ‘আহা-উহু’ করে!

ফুলবাড়ি জেগে রয় কান্নার ধূমে,
আর বাকি বাঙালি পড়ে রয় ঘুমে!
কিছু লোকে ছবি তোলে প্রমোশনের লোভে!
কিছু লোকে লিখে যায় রাজনীতি-ক্ষোভে!
লাশ হবে যত লাভ হবে তত!
দেখেও কেউ বুঝবে না হৃদয়ের ক্ষত।

গদিখানা বাঁচাতে নেতা যাবে ছুটে,
কত শত কথা দিবে।
ফটোগ্রাফার ছবি নিবে,
সময়ের সাথে সাথে হয়ে যাবে চুপ!
লাশ ফেলে খোঁড়া হবে কয়লার কূপ!
ঐ ফুলবাড়ি লাথ খাবে ক্ষমতার বুটে।”

কবিতাটা ২৬ আগস্ট, ২০০৬ এ ফুলবাড়ি আন্দোলনে গুলি চালানোর রাতে লেখা। ঐদিন চারদলীয় জোট সরকার ও এশিয়া এনার্জির আঁতাতের বহিঃপ্রকাশ রূপে আন্দোলনে গুলি চালানো হয়। আল-আমিন, সালেকিন ও তরিকুল নামের তিনজন নিহত হয়। গুলবিদ্ধ হয় কুঁড়িজন, আর প্রায় দু’শ লোক আহত হয়। রক্তাক্ত আন্দোলনের মুখে চারদলীয় জোট সরকার আপাতভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৩০ আগস্ট ঐতিহাসিক ‘ফুলবাড়ি চুক্তি’ সাক্ষরিত হয়। চুক্তির মূল বক্তব্য ছিল ‘এশিয়া এনার্জি’-কে বিতাড়ন, উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন নিষিদ্ধ করা এবং জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে কয়লা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ঐ চুক্তিকে জনগণের বিজয় বলে এর সাথে পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,

“ফুলবাড়ি চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ’ [১]”

চারদলীয় সরকারের সময় শেষ হয়ে যায় কিছুদিন পরেই। এরপর আসে সামরিধায়ক সরকার। তারপর তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে নতুন সরকার পরিচালনা করেছেন কিন্তু ঘটনার কোন পরিবর্তন ঘটেনি শুধু খোলস বদলেছে।

এবার ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পের ইতিহাসটা সংক্ষেপে তুলে ধরবার চেষ্টা করি।

প্রকল্পের অবস্থান
প্রকল্প এলাকা ঢাকা থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমে এবং দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী, নওয়াবগঞ্জ, বিরামপুর ও পার্বতীপুর উপজেলার মধ্যে অবস্থিত।

ফুলবাড়ী একটি ছোট শহর যা জাতীয় প্রধান সড়ক ও উত্তর-দক্ষিণাঞ্চলীয় রেলওয়ের সাথে যুক্ত এবং এর ৪০ কিলোমিটার উত্তরে সৈয়দপুর বিমানবন্দর অবস্থিত। ফুলবাড়ী থেকে ১৮ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত পার্বতীপুর একটি গুরুত্বপূর্ণ রেলজংশন এবং এর সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের রেল সংযোগ রয়েছে।

এই প্রকল্পটি বরেন্দ্র এলাকায় অবস্থিত, যা একটি উঁচু মালভূমি এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের ২৫-৩২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। বরেন্দ্র এলাকার কিঞ্চিত উঁচু ভূ-প্রকৃতির কারণে সমীক্ষা এলাকাটি সাধারণভাবে বন্যামুক্ত। এই এলাকায় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ ৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং শীতকালে সর্বনিম্ন ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস, মে মাসের শেষদিক থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভারী ধরনের বৃষ্টিপাত হয়। বছরে গড় বৃষ্টিপাত ১,৮০০ মিলিমিটার।

প্রকল্প উদ্যোক্তা
এশিয়া এনার্জি করপোরেশন (বাংলাদেশ) প্রোঃ লিঃ, যা লন্ডন ভিত্তিক জিসিএম রিসোর্সেস পিএলসির (ভূতপূর্ব এশিয়া এনার্জি পিএলসি) বাংলাদেশী সাবসিডিয়ারী।

মোট বিনিয়োগ
খনির মেয়াদকালে মোট বিনিয়োগ ২০০ কোটি মার্কিন ডলার যার অর্ধেকের বেশী খনি উন্নয়নের সময় ব্যয় হবে।

চুক্তি
কয়লার অনুসন্ধান ও খনি উন্নয়ন করার জন্য এশিয়া এনার্জি এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে চুক্তি সম্পাদিত রয়েছ।

লাইসেন্স
এশিয়া এনার্জি মূল কয়লা সম্পদ এলাকার খনি ইজারা এবং তদ্‌সংলগ্ন অন্যান্য এলাকার অনুসন্ধান লাইসেন্স পেয়েছে (বর্তমানে তা খনি ইজারায় রূপান্তরের জন্য আবেদনকৃত ও বিবেচনাধীন রয়েছে)।

বর্তমান অবস্থা
দু-বছরব্যাপী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানের বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সমাপ্ত হয়েছে এবং পরিবেশগত ছাড়পত্র পাওয়া গেছে।

খনি পদ্ধতি
উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি।

কয়লা
বিটুমিনাস জাতীয় কয়লা (উচ্চ তাপমান সম্পন্ন, অল্প ছাই ও অল্প সালফার যুক্ত)- তাপীয় (থারমাল) ও সেমিসফট কোকিং কয়লা।

মোট কয়লা সম্পদের মজুদ
৫৭২ মিলিয়ন টন (দক্ষিণে ড্রিলিং করলে যার পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশা করা যায়)।

বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা
১৫ মিলিয়ন টন।

সহ-সম্পদ
কাদা, বালি, নুড়ি, চীনামাটি (কেওলিন), পান।

প্রকল্প এলাকা
দিনাজপুর জেলার ৪ টি উপজেলা ফুলবাড়ী, বিরামপুর, নবাবগঞ্জ ও পার্বতীপুর এর অধীন ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার অংশ প্রকল্প এলাকার ভিতরে অবস্থিত।

প্রকল্পের মোট প্রয়োজনীয় জমি
খনির মেয়াদকালে প্রায় ৫,৯৩৩ হেক্টর জমির প্রয়োজন হবে। তবে খননের জন্য প্রকল্পভুক্ত জমির এক তৃতীয়াংশ ব্যবহৃত হবে এবং তা হবে পর্যায়ক্রমে।

ফুলবাড়ী শহর
পৌরসভা ঠিক থাকবে তার পুনঃনির্ধারিত সীমানা নিয়ে। পূর্ব ফুলবাড়ীর খুব সামান্য অংশ খনির ভিতরে পড়বে এবং একটি নতুন শহর ছোট যমুনা নদীর পশ্চিম পাশে বিদ্যমান পশ্চিম ফুলবাড়ীর বর্ধিতাংশরূপে গড়ে উঠবে।

জনগোষ্ঠীর স্থানান্তর ও পুনর্বাসন
খনির মেয়াদকালে প্রায় ৪০,০০০ ব্যক্তিকে (যার বেশিরভাগ প্রথম দশ বছরে) স্থানান্তরের প্রয়োজন হবে।

পুনঃস্থাপন
প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সকলকে প্রয়োজনে বা তাদের ইচ্ছানুযায়ী নতুন সম্প্রসারিত শহর অথবা নতুন উন্নত গ্রামে পুনর্বাসন করা হবে।

ক্ষতিপূরণ
প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের জমি, সম্পদ ও জীবিকার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হবে নগদ অর্থ, জমি, বাড়ি, উন্নততর জীবন-যাপনের সুবিধা, উন্নততর শিক্ষা ও চিকিৎসা সুবিধা, প্রশিক্ষণ, বিকল্প জীবিকার সুযোগ এবং সমাজ উন্নয়ন তহবিল হতে সহায়তা। তাদের কেউ বর্তমানের অবস্থা থেকে খারাপ অবস্থানে যাবে না বরং অধিকাংশের অবস্থা হবে উন্নততর।

খনি পুনর্বাসন
উন্মুক্ত খনি ক্রমান্বয়ে ভরাট করে আগের প্রাকৃতিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হবে; শেষাংশে খাদটি একটি স্থানীয় জনগোষ্ঠির পানি সরবরাহ, বিনোদন ও মৎস্যচাষের জন্য একটি মিঠা পানির লেকে রূপান্তর করা হবে। খনি উন্নয়নকালে খনিখাদ শুঙ্ক রাখার জন্য খনি এলাকায় পানি উত্তোলন করতে হবে এবং এ পানি কৃষিজমি ও বসতবাটিতে সরবরাহ করা হবে। কিছু পরিমাণ পানি সরবরাহ করা হবে নতুন শহর ও অন্যান্য পুনঃস্থাপন এলাকায়। আশুরার বিলের প্রতিবেশ ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক আবাস সংরক্ষণের জন্যও কিছু পানি সরবরাহ করা হবে। এতে প্রকল্প এলাকায় পানির অভাব হবেনা এবং প্রকল্পের কারণে কোন এলাকা শুকিয়ে যাবেনা। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত পৃথক সমীক্ষা করা হয়েছে।

পরিবেশ
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হবে এবং শব্দ, ধূলা ও বর্জ্যপানি গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার ভিতরে রাখা হবে। পরিবেশগত সকল উপাদান সবসময় পর্যবেক্ষণাধীন রাখা হবে এবং খনির মেয়াদকালে সকল কার্যক্রম যাতে পরিবেশগতভাবে গ্রহণযোগ্য মাত্রার ভিতরে থাকে তা নিশ্চিত করতে বিস্তারিত পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে।

বাংলাদেশ সরকারের লাভ/প্রাপ্তি
বিনিয়োগ ও ঝুঁকি শূন্য। লাভের প্রায় ৫০% প্রাপ্তি ছাড়াও (এর অন্তর্ভুক্ত ৬% রয়্যালটি, ৪৫% কর্পোরেট ট্যাক্স এবং ২.৫% আমদানী শুল্ক) অন্যান্য প্রাপ্তির মধ্যে রয়েছে দেশে একটি সহজলভ্য দীর্ঘ মেয়াদী নতুন জ্বালানী শক্তির উৎস, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নতুন শিল্পক্ষেত্র, নতুন রেল ও বন্দর অবকাঠামো, সম্ভাবনাময় সহযোগী শিল্পের বিকাশ, চাকুরীর সুযোগ সৃষ্টি, আঞ্চলিক উন্নয়ন, এবং দারিদ্র বিমোচন। [২]”

ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্প হতে ‘এশিয়া এনার্জি’ এর দাবিকৃত সুবিধাসমূহ হলঃ

জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে ইতিবাচক অর্জন

জাতীয়
• প্রতি বছর জাতীয় জিডিপি-তে ১.০% সংযোজন
• প্রকল্প মেয়াদকালে জিডিপি-তে ২১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অবদান
• ট্যাক্স ও রয়্যালটির মাধ্যমে সরকারের ৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সরাসরি আয়
• ব্যালান্স অব পেমেন্টের উপর বছরে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ইতিবাচক প্রভাব
• বাংলাদেশ রেল-এর নীট আয় ১.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার
• দারিদ্র দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়ন
• টেকসই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিকল্প জ্বালানীর নিশ্চয়তা

বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল
• উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নতুন কয়লা শিল্পের উন্নয়ন
• এশিয়া এনার্জি কর্তৃক পরিচালিত ১,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র
• সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী কর্তৃক আরো কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন
• প্রায় ১২,০০০ নতুন স্থানীয় কর্মসংস্থান (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ)
• সহসম্পদ (কো-প্রডাক্ট) নির্ভর এবং খনি সহযোগী বেশ কিছু নতুন শিল্প-কারখানা স্থাপন
• প্রকল্পের মেয়াদকালে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়
• পুনঃস্থাপন ও নতুন শহরের জন্য ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ
• স্থানীয় নীট কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি
• উন্নত সুবিধাসহ নতুন পরিকল্পিত শহর ও গ্রাম

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল
• পশ্চিম রেলের পথের উন্নতি
• খুলনায় কয়লা টার্মিনাল স্থাপন
• আকরাম পয়েন্টে গভীর সমুদ্র কার্গো হ্যান্ডলিং সুবিধা
• খুলনা ও মংলা বন্দরের অর্থনৈতিক অবকাঠামোর পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়ন
• প্রায় ৮,০০০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ)
• বন্দর উন্নয়নে ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ
• স্থানীয়ভাবে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবনা
• সহসম্পদ ভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা [৩]”

‘এশিয়া এনার্জি’ বিভিন্ন লাভের কথা বললেও কোথাও এই প্রকল্পের সমস্যার ব্যাপারগুলো পরিষ্কার করা হয় নি। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের মূল সমস্যাগুলো হলঃ

১) এটি খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া এবং এর মাঝে অনেকগুলো অংশ থাকে, এবং এর কোন এক অংশের সম্যস্যার জন্য পুরো প্রক্রিয়াটি বন্ধ থাকবে। তাই ৩৫ বছরের প্রকল্প আদৌ ৩৫ বছরে শেষ হবে কি না সন্দেহ আছে।

২) এই পদ্ধতিতে কয়লা উৎপাদনে ডাস্টের পরিমাণ অনেক বেশি হবে যা পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকারক।

৩) এশিয়া এনার্জি ফুলবাড়ি থেকে প্রতিদিন গড়ে ৬০০ মিলিয়ন লিটার পানি তোলা হবে বলে জানিয়েছে। খনি উন্নয়ন এবং পরিচালনার ৩৮ বছর জুড়ে এই পানি তোলা হবে। এর মাত্র ১৫ ভাগ তারা রিইনজেক্ট করবে। এতে করে ওই এলাকার পানি সরবরাহ এবং কৃষি কাজে পানিপ্রাপ্তি একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দেবে।

৪) প্রকল্প শেষে খনি পুনর্বাসন প্রক্রিয়াটি একটি জটিল প্রক্রিয়া, এবং এটি সফল না হবারও সম্ভাবনা আছে। এবং পানিস্তর আগের পর্যায়ে মিলিয়ে দেওয়াটা খুবই কঠিন হবে। এই এলাকার মানুষ তিস্তা ও মহানন্দা বাঁধের কারণে এমনিতে পানির কষ্টে আছে, তাই খনি পুনর্বাসন সফল না হলে পুরো এলাকা মরুতে পরিণত হতে পারে।

এত সমস্যার পরেও ‘এশিয়া এনার্জি’ কেন সুরঙ্গ পদ্ধতিতে খনন না করে উন্মুক্ত পদ্ধতিতেই কয়লা উত্তোলন করতে চাচ্ছে এ প্রশ্ন আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এর কারণটা হল আর্থিক লাভ। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে যেখানে ৯৫-৯৮% কয়লা উৎপাদন সম্ভব সেখানে সুরঙ্গ পদ্ধতিতে সর্বোচ্চ ৬৫-৭০% কয়লা উত্তোলন সম্ভব। [৪]

‘এশিয়া এনার্জি’ এর ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পের বর্ণনায় আরো কিছু অসামঞ্জস্যতা ও সমস্যা পরিলক্ষিত হয়ঃ

১) প্রকল্পকালে ৪০,০০০ লোক সরিয়ে নিতে হবে বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যাটা লক্ষাধিক হতে পারে। আমাদের মত ছোট একটা দেশে এত লোককে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া খুবই কঠিন হবে।

২) অনেক কৃষি জমিও এই প্রকল্পের আওতাভূক্ত হবে, তাই এই প্রকল্প আমাদের কৃষিক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

৩) প্রকল্পের ব্যবসায়িক হিসেবে শুধুমাত্র কয়লাই দেখানো হয়েছে কিন্তু উপজাত হিসেবে পাওয়া বালি, নুড়ি, চিনামাটির হিসেবটা কী হবে আর কে কতটুকু পাবে তা পরিষ্কার না।

৪) চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার মাত্র ৬% রয়ালটি পাবে এবং কয়লার সাথে তেল, গ্যাস কিংবা মহামূল্যবান হীরে পাওয়া গেলে কী হবে সেটা পরিষ্কার না।

৫) বলা হয়েছে উত্তোলিত কয়লা দিয়ে ‘এশিয়া এনার্জি’ ১০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প হাতে নেবে। অর্থাৎ ‘এশিয়া এনার্জি’ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমাদের কাছেই বিক্রি করবে না প্রতিবেশীদেরকে দিতে পারবে ব্যাপারটা পরিষ্কার না। আর উৎপাদিত বিদ্যুতের দামই বা কী হবে সেটাও কোথাও বলা হয় নি। তাই ওরা চাইলেই আমাদেরকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করতে পারে, এবং সে সম্ভাবনা প্রবল।

সরকার এত সব সমস্যা বিবেচনা না করে ব্যবসায়ী ‘এশিয়া এনার্জি’ এর পক্ষেই তার অবস্থান নিয়েছে [৫], এবং হয়তো তারা বাহ্যিক চাপে কিছুটা দিশেহারা, অসহায়। টাকার অঙ্কে এই প্রকল্পের লাভ নিরূপন করা হলেও এর লোকসানটা টাকার অঙ্কে পরিমাপ করা সম্ভব হবে না। আর ফুলবাড়িবাসী কি সরকারের এই অবস্থান বিনে বাঁধায় মেনে নেবে?! সে সম্ভাবনা অন্যরা দেখলেও অন্তত আমি দেখছি না। ফুলবাড়ি এখনো জেগে আছে। আর বাকি দেশবাসিও হয়তো তাদের পাশে থাকবে। কেউ পারতপক্ষে ফুলবাড়ির সর্বনাশ মেনে নেবে না। তাই এখনো আন্দোলন চলছে, এবং আশা করি চলবে।

তথ্য উৎসাবলিঃ
[১] দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত আনু মুহাম্মদের কলাম ‘ফুলবাড়ী চুক্তি বাস্তবায়ন না করার পরিণতি হবে ভয়াবহ’
[২],[৩] ফুলবাড়ি কয়লা প্রকল্পের অফিসিয়াল ওয়েব সাইট – ‘ফুলবাড়ী কয়লা প্রকল্প’
[৪],[৫] দৈনিক জনকণ্ঠ

চিত্র-উৎসঃ
[১] বিপ্লব রহমান-এর ব্লগ ‘ফুলবাড়ি- লাল সেলাম!, উন্মোচন ব্লগ