লিখেছেন: মিলন আহমেদ

সন্ধ্যার পর রেলগেট দিয়ে যাওয়ার সময় ওদের দু’একজনকে দেখা যায়। মুখে পাওডার মেখে দাঁড়িয়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। খরিদ্দারের অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে চারিদিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে এই একজন খরিদ্দার জুটবে। সবাই ওদেরকে ’পতিতা’ বলে। সবাইকে দোষ দিয়েই বা লাভ নেই। স্বয়ং অভিধানেও শব্দটি রয়েছে। কিন্তু তন্নতন্ন করে সকল অভিধান খুঁজেও ওই শব্দটির কোনো পুরুষবাচক প্রতিশব্দ পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ পুরুষেরা ’পতিত’ বা এজাতীয় কোনোকিছু হয় না। সেদিন ওইরকম একজন মেয়েকে দেখে একটু দূরে মোটর সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুপিসারে লক্ষ্য করলাম। মনে হচ্ছিল কাছে এগিয়ে গিয়ে হাতে দু’শ টাকা দিয়ে বলে দেই, আজকের মতো তোমার বাসায় ফিরে যাও। কিন্তু আমার পক্ষে তা সম্ভব হয় না। শুধু সামাজিকতার কারণেই সম্ভব হয় না তা নয়, সম্ভব না হওয়ার আর একটি কারণ একজনকে একদিন টাকা দিয়ে যেহেতু ওদের দূরাবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। তাই গাড়ি ষ্টার্ট দিয়ে চলে যাই। কখন সে খরিদ্দার পেয়েছিল তা জানি না। ওরা যৌনকর্মী। টাকার বিনিময়ে ওরা পুরুষকে ওদের দেহ ব্যবহারের সুযোগ দেয়। টাকা নিয়েছে কিন্তু দেহ দেয়নি এমন কথা আজ পর্যন্ত শোনা যায়নি। কিন্তু একজন বা দু’জনের জন্য চুক্তি করে নিয়ে গিয়ে বিশ/ত্রিশ জন পুরুষ মিলে গণধর্ষণ করে টাকার পরিবর্তে মারপিট করে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা কম ঘটে না। শুধু তাই নয় মাঝে মাঝেই পাটের ক্ষেতে বা আখের ক্ষেতে ওদের বিবস্ত্র লাশ দেখতে পাওয়ার খবর পাওয়া যায়। মজাকরে ওদেরকে গণধর্ষণ করে, খুন করে আনন্দ পায় এবং বিবস্ত্র অবস্থায় লাশ ফেলে রেখে সে দৃশ্য উপভোগ করে। লাশ পাওয়ার পর সমাজের ভদ্র মানুষেরা ওই মৃত মেয়েটির লাশের প্রতিও ঘৃণা ছুঁড়ে দিয়েই তৃপ্তি পায়।

পতিতাবৃত্তির ইতিহাস খুঁজতে আমরা যদি একটু পেছনে যাই দেখতে পাব সমাজের আদিম অবস্থায় আজকের মতো পরিবার প্রথা ছিল না। মানুষ দলবদ্ধভাবে বাস করতো। মর্গানের মতে, এক একটা গোষ্ঠীর মধ্যে অবাধ যৌন মিলন চলতো। সেখানে প্রত্যেক পুরুষেরই প্রত্যেক নারীর উপর সমান অধিকার ছিল, আবার প্রত্যেক নারীরও প্রত্যেক পুরুষের উপর সমান অধিকার ছিল। অবশ্য অবাধ যৌন মিলনের স্তর এতই সুদূর অতীত হয়ে গেছে যে বর্তমানে তার শেষ চিহ্নটিও আবিস্কার করে প্রত্যক্ষ প্রমাণ উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া আজকের মানুষ সভ্যতার যে স্তরে পৌঁছেছে তাতে অবাধ যৌন মিলনের স্তর সম্পর্কে বলতে এখন লজ্জা পায়। যাই হোক তারপরেই মানুষ পদার্পণ করেছিল যৌথ বিবাহের যুগে। বাকোফেন এ বিষয়ে সর্বপ্রথম গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা করেন এবং ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের মধ্যে থেকে এর প্রমাণও হাজির করেছেন। যৌথ পরিবার ব্যবস্থায় নারীদের প্রাধান্য ছিল। কারণ উক্ত ব্যবস্থায় সন্তানের বাবা কে তা বুঝতে পারা অসম্ভব ছিল, কিন্তু মাকে চিনতে ভুল হত না। সে সময় অনেক দম্পতি তাদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে একত্রে বসবাস করতো, সেখানে নারী যে ঘর-সংসার দেখাশোনার কাজ করতো তা পুরুষের খাদ্য সংগ্রহের কাজের সমান সামাজিক প্রয়োজন বলে বিবেচিত হত। তারপর মানব পরিবারের ক্রমবিকাশের পরবর্তী স্তরে আর যৌথ পরিবার প্রথা টিকলো না। যৌন সম্পর্কের আওতা থেকে প্রথমে নিকটতম লোকদের তারপর একটু দূর সম্পর্কের আত্মীয়দের বাদ দিতে থাকায় যৌথ পরিবার প্রথা লোপ পেল। অবশেষে একজোড়া নর-নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল পরিবার। বিশ্বের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীসমূহের পারিবারিক সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে এখনও এসব তথ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। বলা যেতে পারে যে একবিবাহ প্রথা প্রবর্তনের পিছনে নিয়ামক হিসেবে প্রধান ভূমিকা ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তির আবির্ভাব। পরিবর্তিত উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা সৃষ্ট অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে অর্থাৎ সম্পত্তির উপর যৌথ অধিকারের স্থলে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলেই একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার উদ্ভব হয়েছে। সুতরাং অবাধ যৌন মিলনের যুগে এবং যৌথ পরিবারের যুগে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনো লিঙ্গ বৈষম্য ছিল না। লিঙ্গ বৈষম্য শুরু হয়েছে পুরুষরা যখন থেকে একচেটিয়া সম্পত্তির মালিক হয়েছে এবং তখন থেকেই একবিবাহমূলক পরিবার প্রথার প্রচলনও ঘটেছে। উহাই ছিল নারী জাতির ঐতিহাসিক মহা পরাজয়। সে সময় থেকেই ঘর সংসারের কাজকে আর সামাজিক কাজ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, সাংসারিক কাজকর্মগুলো তখন হয়ে দাঁড়ায় ব্যক্তিগত বিষয়। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করলেও তা মূল্যায়িত হয় না। স্ত্রী হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক দাসী, বঞ্চিত হয় ধনসম্পদের মালিকানা থেকে। ঠিক ওই সময় থেকেই মেয়েদেরকে নামানো হয়েছে বেশ্যাবৃত্তিতে, যা সম্পূর্ণভাবে পুরুষ আধিপত্যের দ্বারা সৃষ্ট। পুরুষ যখন চেয়েছে উত্তরাধিকারী হিসেবে তার সম্পদ যেন নিজের নির্দিষ্ট সন্তান ছাড়া আর কেহ না পায়, তখনই তারা একবিবাহ প্রথার প্রবর্তন করেছে। কাজেই শুরু থেকেই একবিবাহ বাধ্যতামূলক শুধু নারীর জন্যে, মোটেই তা পুরুষের জন্যে নয়। দলগত বিবাহ প্রথার যৌন স্বাধীনতা শুধু নারীরাই হারালো, পুরুষদের বেলায় তা হলো না। ফলে তখন থেকেই পুরুষের জন্যে একাধিক স্ত্রীর রাখার বৈধতার পাশাপাশি গোপনে বা প্রকাশ্যে বহুপত্নী ব্যবহারে অথবা বেশ্যার ব্যবহারের প্রচলন চলে আসছে। ঘরের স্ত্রীর যৌনাঙ্গে লোহার বেড়ি পরিয়ে তালাবদ্ধ করে আটকিয়ে রেখে পুরুষের বিভিন্ন যায়গায় যৌনকর্ম করে বেড়ানোর ইতিহাস বেশি দিনের পুরোনো নয়। বাস্তবিক পক্ষে পুরুষদের ক্ষেত্রে আজও কিছুটা দলগত বিবাহ প্রথা বিদ্যমান, যা নারীর জন্য নয়। তাই একাধিক পুরুষের সাথে নারীর যৌনতাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয় এবং যার জন্য আইনের দৃষ্টিতে, ধর্মীয় রীতিতে এবং সমাজের কাছে তাদের কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হয় অপরপক্ষে পুরুষের ক্ষেত্রে তাহলো সম্মানের কাজ, যদিও কোনো কোনো সময় উহা পুরুষের নৈতিক পদস্খলন হিসেবে দেখা হয় তবে হাসি মুখেই তা মেনে নেয়া হয়। একই কারণে অভিধানে ‘পতিতা’ শব্দটি থাকলেও ‘পতিত’ নামক কোনো শব্দ নেই এবং থাকার কথাও নয়। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবে ইহাই প্রতিষ্ঠিত এবং বাস্তব সত্য এই যে, যখন থেকে একবিবাহ প্রথার উদ্ভব হয়েছে তখন থেকেই স্ত্রীর পাশাপাশি বেশ্যারও সৃষ্টি হয়েছে। এঙ্গেলস তাঁর ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থে বলেছেন, “বেশ্যাদের থেকে সেই স্ত্রীর পার্থক্য কেবল এই যে, সে সাধারণ বেশ্যাদের মতো রোজই নিজের দেহকে দিন-মজুরের মতো ভাড়া খাটায় না, কিন্তু তার দেহকে সে একেবারেই চিরকালের দাসত্বে বিক্রি করে দেয়।” কিন্তু এত কিছুর পরেও সন্দেহাতীত ভাবে বলা যায় যে, একবিবাহ প্রথার উদ্ভব ছিল সভ্যতার ক্রমবিকাশের পথে একধাপ অগ্রগতি। তাই এঙ্গেলস ইহাও মনে করেছেন যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর হলে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে প্রেমময় এবং মধুর, থাকবে না কোনো লিঙ্গ-বৈষম্য। যাইহোক পতিতাবৃত্তি চলে আসছে লক্ষাধিক বছর পূর্বে থেকে এবং ধর্মগুলি এসেছে মাত্র দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে। লক্ষ্য করার বিষয় যে সকল ধর্মই এসব ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে এসেছে। ক্রীতদাসীর সাথে যৌনকর্মের পক্ষে যেমন অধিকাংশ ধর্মই রায় দিয়ে আসছে তেমনি নারীর দেহ বিক্রয় করার অর্থও মন্দিরের তহবিলে জমা হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়। মহাভারতে উল্লেখ আছে যে, একজন বেশ্যা ভাল প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। একইরূপ মত পোষণ করতে দেখা যায় বৌদ্ধ ধর্মের বিধানেও। আর্মেনিয়ার আনাইতিস দেবতার মন্দিরের ক্রীতদাসীরা, করিন্থের আফ্রোদিতে দেবতার মন্দিরের ক্রীতদাসীরা, ভারতীয় মন্দিরসমূহের দেবদাসী নর্তকীরা, পর্তুগীজ বায়াদের নর্তকীরা সবাই ছিল দুনিয়ার সেরা বেশ্যা। এভাবে যুগের পর যুগ, শতাব্দির পর শতাব্দি, সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ ধরে চলে আসছে পতিতাবৃত্তি। এক কথায় বলা যেতে পারে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে নারী ও পুরুষের মাঝে বিরাজমান বৈষম্যের এক শোচনীয় পরিণতির নাম হচ্ছে পতিতাবৃত্তি।

বাংলাদেশেও সেই ধারাবাহিকতা যথারীতি চলে আসছে। এদেশে বহু পতিতালয় ছিল এবং এখনও বেশ কিছু রয়েছে। পতিতালয়ের সংখ্যা কমলেও পতিতার সংখ্যা বেড়েছে এবং এখনও বেড়ে চলেছে বলেই মনে হয়। এদেশে পতিতার সংখ্যার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান যদিও নেই, তবে বাংলাপিডিয়ার দেওয়া তথ্যমতে সে সংখ্যা এক লক্ষের কিছু কম বা বেশি। বাংলাদেশে পতিতাবৃত্তিকে অনুমোদনের জন্যে তেমন আইন না থাকলেও ১৮ বছরের উপরের যুবতীদের এফিডেভিটের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তি গ্রহনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। একটা বিষয় কি কেহ ভেবে দেখেছে তারা কেন ওই পেশায় এসেছে? আমার জানা মতে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় একজন মেয়েও স্বেচ্ছায় উক্ত পেশা গ্রহন করেনি। ওদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো পুরুষের ষড়যন্ত্রের শিকার। প্রেমের অভিনয় করে অথবা মিথ্যা চাকুরী দেওয়ার কথা বলে নাটক সাজিয়ে সহজ সরল মেয়েকে ঠান্ডামাথায় ডেকে নিয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে বিক্রী করে দেওয়ার খবর যেমন আমরা অহরহ দেখি তেমনি স্বামী নামক দেবতাকেও তার স্ত্রীকে সেখানে বিক্রী করে টাকা গুণে নেওয়ার খবর আমরা মাঝে মাঝেই দেখতে পাই। আবার অত্যাধিক দারিদ্রের তাড়নায় ক্ষুধার জ্বালা মেটাতেও এ পেশা বেছে নেয় কিছু সংখ্যক মেয়ে। সকল যৌনকর্মীরই এ পেশায় আসার সূত্রপাতটা এভাবে সম্পূর্ণ নিজের অনিচ্ছায় ঘটেছে। ‘বড় হয়ে আমি একজন পতিতা হব’- এই বাসনা কি একজন মেয়েরও ছিল? অর্থাৎ কোনো মেয়েই পেশা হিসেবে স্বেচ্ছায় তা বেছে নেয়নি বরং নিশ্চিত তাকে বাধ্য করা হয়েছে। পূর্বটেংরী ঊচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম বিশ্বাস বললেন, “সবচেয়ে নিরাপরাধী যদি কাউকে বলতে হয় তাহলে পতিতাদেরকেই বলতে হবে এবং সবচেয়ে পবিত্র আয় যদি কেহ করে থাকে তাহলে পতিতারাই তা করে।” তাহলে এ পেশায় আসার জন্যে কোনো মেয়েই কি সামান্যতম অপরাধী? মোটেই নয়। সুতরাং রেলগেটে যে মেয়েটিকে খরিদ্দারের আশায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম সেও অপরাধী নয়। কিন্তু সমাজের চোখে সে ঘৃণিত! শুধু ঘৃণিত বললে ভুল, চরমভাবে দূষিত! মৃত্যুর পর তার লাশটাও নিকৃষ্ট। সাধারন মানুষের জন্য যেসকল কবরস্থান উম্মূক্ত রাখা হয় সেখানে কোনো পতিতার মৃতদেহকে সমাহিত করতে দেওয়া হয় না। কিন্তু যে মানুষটি কোনো অপরাধই করলো না, সে কিভাবে ঘৃণিত হলো? এ প্রশ্নের উত্তর কি কেহ খুঁজেছে? যেহেতু সমাজ ওদেরকে মিথ্যে মিথ্যে অপবাদ দিচ্ছে তাই আমি বলবো ওরা ঘৃণিত নয়, প্রকৃতপক্ষে সমাজটাই ঘৃণিত। শুনে দুঃখ পেতে হয় যে, আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবি তাদের লেখনীতে পতিতাদেরকে আবর্জনা এবং পতিতালয়কে ডাস্টবিনের সাথে তুলনা করে থাকেন। আমি তাদেরকে ধিক্কার জানিয়ে বলতে চাই যারা নিরাপরাধ অসহায় নারীদেরকে আবর্জনা বলতে পারে প্রকৃতপক্ষে তারাই আবর্জনা। এসব বুদ্ধিজীবি নামধারী আবর্জনার দুর্গন্ধেই দেশেরও একই দূরাবস্থা। আবার কেহ কেহ পতিতাবৃত্তির মধ্যে শিল্পগুণ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেন, আমি তাদেরকে পতিতাদের দালাল ছাড়া কিছুই মনে করি না। ওদের নিয়ে তেমন গবেষণাও এদেশে পরিচালিত হয়নি। নেই তেমন চিকিৎসার ব্যবস্থা। এক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, ওদের এক-চতুর্থাংশই গনোরিয়া বা ক্ল্যামিডিয়া রোগে ভুগছে। সিফিলিসের হারও আশংকাজনক। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে ইতোপূর্বে প্রকাশিত সরকারের এইডস সংক্রান্ত কৌশলগত প্রকল্প প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জরিপ করা ৯৮৪ জন পতিতার মধ্যে ৫৪%-এর বর্তমানে বা পূর্বে সিফিলিস আছে বা ছিল। পতিতারা ঘৃণিত বা অবহেলিত হলেও তাদের কাছে যাচ্ছে কিন্তু সব শ্রেণীর পুরুষই। ডোম থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, কর্মচারী, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, যুবক, বৃদ্ধসহ সকলশ্রেণীর পুরুষদেরই কিছু অংশ নিয়মিত পতিতালয়ে যায়। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, মেয়েগুলি স্বেচ্ছায় সেখানে না আসলেও খরিদ্দারগুলি কিন্তু স্বেচ্ছায় যায়। পতিতাদের নাম নিবন্ধিত হয় কিন্তু সেখানে গমনকারী পুরুষদের নাম তালিকাভূক্ত হয় না। আজ থেকে তের বছর আগে (১৯ আগষ্ট’ ১৯৯৯) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন পতিতালয়ে গমনকারী পুরুষদের নামও নিবন্ধিত করা উচিত যাতে সমাজ জানতে পারে কারা পতিতালয়ে যায়। কিন্তু তিনি শুধু বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেননি। পতিতালয়ের নির্দিষ্ট স্থানে যেমন ওরা রয়েছে তেমনই রয়েছে ভাসমান হিসেবে, তাছাড়া বহু আবাসিক হোটেলেও গোপণে পতিতাবৃত্তি চলে আসছে। যে প্রকারের পতিতাই হোক না কেন তার দেহ বিক্রী করা আয়ের খুব কম অংশের মালিকই সে হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রকার দালাল, পুলিশ, বাড়ির মালিক, মাস্তান, পাতিনেতা এমন কি কিছু বড় নেতার পকেটেও ওই টাকা চলে যায়। মাঝে মাঝে পতিতাদের পুনর্বাসনের কথা বলে তাদেরকে উচ্ছেদ করা হয়। ১৯৯৯ সালের ২৩ জুলাই মধ্যরাতে ৩৫০ জন পুলিশের একটি দল টানবাজার পতিতাপল্লীতে বর্বরভাবে হামলা চালিয়ে অমানবিকভাবে তাদেরকে উচ্ছেদ করেছিল। সেসময় সেখানকার প্রায় পাঁচ হাজার পতিতার নেতৃত্ব দিচ্ছিল সাথী নামক একজন পতিতা। দুদিন অনাহারী অবস্থায় সাথী তার কোলের শিশুকে দেখিয়ে বলেছিল ওকে যারা জন্ম দিয়েছে সেই লোকেরাই তাদের উচ্ছেদ করছে।

নিউইয়র্ক শহরে দশ বছর যাবৎ যৌনকর্মীর কাজ করতো স্টেলা র্মা নামক একজন মেয়ে। যৌনকর্মীরা সমাজের অন্য দশজনের থেকে কম মেধাবী বা কম যোগ্যতাসম্পন্ন একথা একশতভাগ মিথ্যা প্রমাণ করেছে স্টেলা র্মা। পরবর্তীতে তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অত্যন্ত ভাল ফলাফল করে খ্যাতির সাথে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছেন। কাজেই আমরা যাদেরকে পতিতা বলছি তারা অন্য কোনো গ্রহ থেকে আসেনি বরং সাধারন মানুষের মতোই স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নিয়েছিল এবং আমাদের মতই ক্ষুধা, পিপাসা, ঘুম, ক্লান্তি, অনুভূতি সবকিছু নিয়েই একইরকম মানুষ। যৌনকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলবো, অন্যরা তোমাদের যতই ঘৃণা করুক, প্রকৃতপক্ষে তোমরা ঘৃণিত নও, তবে তোমাদের ওই পেশাটা বাদ দিতে হবে। যৌনকর্ম হবে তোমার অনুভূতিকে তৃপ্ত রাখার জন্যে একমাত্র ভালবাসার মানুষের সাথে। টাকার বিনিময়ে শরীর দেওয়া মানেই দাসত্ব। কাজেই ওই যৌনদাসত্ব থেকে বের হয়ে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াও, সকল প্রকার দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই কর, স্টেলা র্মা এর নিকট থেকে শিক্ষা গ্রহণ কর, যদি তা পার তবে আমি তোমাদের সালাম দেব। আর বিবেকবান সকল মানুষের কাছে আমার আহবান, আসুন পতিতাবৃত্তির মতো মারাত্মক ব্যাধির হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করি এবং নারী-পুরুষ সবার জন্যে একটি আধুনিক প্রেমময় সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখি।

লেখকঃ কলেজ শিক্ষক এবং নারীবাদীকলামিস্ট, ঈশ্বরদী, বাংলাদেশ।
ই-মেইলঃ [email protected]