জেনেটিক্স গত শতাব্দীর একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। প্রতিটি মানুষের প্রতিটি কোষের অভ্যন্তরে নিউক্লিয়াসের ভেতরে সুন্দরভাবে সাজানো আছে সেই মানুষটির সকল বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্য। যতোই দিন যাচ্ছে আমরা জিনের নানান আজব কারসাজি জানতে পারছি। অনেক রোগের কারণ যে এইসব জিনের মধ্যে লুকিয়ে আছে তা জানা গেছে এবং তার প্রতিকারও ভাবা শুরু হয়েছে। এই জেনেটিক্স এখন মানুষের বংশানুক্রমিক ইতিহাসকে খুঁজে পেতে সাহায্য করছে। তাই এখন জানা সম্ভব হচ্ছে মানুষের আদিমাতা কেউ সত্যিই ছিলেন কি-না। নাকি সবই কেবল মিথের গল্পই। চলুন দেখা যাক বিজ্ঞান কী বলে।

মাইটোকন্ড্রিয়া

মানবদেহের সকল কোষেই ছোট ছোট মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। এরা কোষের ‘পাওয়ার হাউজ’; এরা এটিপি নামক একটি বিশেষ কার্যকর অণু তৈরি করে। এই অ্যাডিনোসিন ট্রাই ফসফেট বা এটিপি অণু অক্সিজেনের উপস্থিতিতে খাদ্যের দহনে সাহায্য করে। কোষ এভাবে শক্তি উৎপাদন করে। যে কোষ যত ব্যস্ত তার মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা তত বেশি। যেমন – স্নায়ু, পেশী ও মস্তিষ্ককোষে প্রায় হাজার খানেক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। মজার ব্যাপার হলো, এই মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতরেও ডিএনএ থাকে। অবশ্য কোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ থাকে তাতে ক্ষার বা বেজের সংখ্যা প্রায় এক বিলিয়ন। অথচ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’তে এই ক্ষারের সংখ্যা মাত্র ষোলো হাজারের মতো। বিজ্ঞানীরা বলছেন, আদিতে এই মাইটোকন্ড্রিয়া আসলে স্বাধীন ব্যাকটেরিয়া গোছের কিছু একটা ছিল। কালক্রমে এরা কোষের ভেতরে আশ্রয় করে নেয়। অনেকটা পরজীবির মতো। তারপর থেকে চলছে কোষ ও মাইটোকন্ড্রিয়ার সিমবায়োসিস বা মিথোজীবিতা। অর্থাৎ, পরস্পরের হাত ধরে পথ চলা। কোষের সুবিধে হলো এদের উপস্থিতিতে শক্তি উৎপাদনের দক্ষতা বাড়ে, মাইটোকন্ড্রিয়ার সুবিধা হলো সুরক্ষা।
মানবদেহের কোষে যে মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে তার প্রায় সবটাই আসে মায়ের শরীর থেকে। মানুষের ডিম্বাণুতে প্রায় লাখ খানেকের বেশি মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে, অথচ শুক্রাণুতে থাকে যৎসামান্য। ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছতে শুক্রাণুর যেটুকু শক্তির দরকার তার অনুপাতে শুক্রাণুতে নগণ্য সংখ্যক মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে। ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ মানবভ্রƒণতে যত মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে তা পুরোটাই মায়ের দিক থেকে আসে। আরো দেখা গেছে, নিউক্লিয়াসের তুলনায় মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র মিউটেশন বেশি হয়। এই মিউটেশনের কারণে একজন মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ আরেকজনের থেকে পৃথক হয়। এভাবে বলে দেওয়া সম্ভব ঠিক কয়টি জেনারেশন আগে এই পার্থক্যের সূচনা ঘটেছে এবং এইভাবে দুজন মানুষের আদিমাতা খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, এই আদিমাতার থেকেই দুই বা ততোধিক বংশধারার সূচনা ঘটেছে যার শেষ প্রান্তে আছে আজকের মানুষ।

আফ্রিকা থেকে 'ইভ'

গত প্রায় দুই দশক ধরে এই মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ নিয়ে গবেষণা চলছে। দেখা গেছে, পৃথিবীর আজকের জনগোষ্ঠীর প্রত্যেকে মোট তেত্রিশজন আদিমাতার কোনো-না-কোনোজনের বংশধর। এঁদেরকে বলা হয় ‘ক্ল্যান মাদার’ বা গোত্রমাতা। ইউরোপের প্রায় সকলেই এরকম সাতজন গোত্রমাতার সন্তান। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই গোত্রমাতাদেরও আদিমাতা সম্ভব এবং তিনি আফ্রিকাতেই থাকতেন। এঁকে বলা হয় ‘মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ’ – অবশ্য ইনিই যে বিবি হাওয়া বা বাইবেলের ইভ তা নাও হতে পারেন। কারণ তাঁরও আদিমাতা ছিলেন। কিন্তু এই বিশেষ আদিমাতার বংশই আজো টিকে আছে।

শিল্পের 'ইভ'

বংশের বার্তা এভাবে মা থেকে মা’য়ে চলে আসছে। একজন গোত্রমাতা হতে হলে একজন মহিলাকে অন্তত দুটি কন্যা সন্তানের জননী হতে হবে। তারপর মা থেকে মা’য়ে জিনের বার্তা হাত বদল হতে থাকে। তবে সকল মহিলাই গোত্রমাতা হতে পারেন না। কারণ, তাঁদের সন্তানাদি নাও হতে পারে অথবা কেবল পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারেন। এভাবে কেবল গুটিকয়েক গোত্রমাতারই সন্ধান পাওয়া যায়, বাকিদের ডিএনএ কালের গর্ভে কোথায় মিলিয়ে গেছে কে জানে।
একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন আমার মা আমার নানী সাহেবার একমাত্র কন্যা সন্তান এবং আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান। ফলে আমার নানীর গোত্রমাতা হওযার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আমার নানীর অন্যান্য বোনেদের একাধিক কন্যা সন্তান আছেন এবং তাঁদেরও কন্যা সন্তান (আমার খালাত বোনেরা) আছে। ফলে আজ থেকে হাজার বছর পর তাঁদের বংশধর থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। যদি সেটা সম্ভব হয় তবে আমার নানীর মা একজন গোত্রমাতা হতে পারবেন। ব্যাপারটা এরকম।

মজার্টুন

মজার্টুন

কাজেই ঠিক এভাবে বংশগতির ধারায় প্রায় দেড় লক্ষ বছর আগে কোনো একজন আদিমতম মাতার থেকে আমাদের সকলের আদিমাতা (মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ) এসেছেন। তারপর কালক্রমে এই আদিমাতা থেকে শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত হয়ে অনেক গোত্রমাতার জন্ম হয়েছে। নানান কারণে এদের সকলে গোত্রমাতা হতে পারেননি। মাত্র তেত্রিশজনই তা পেরেছেন। ফলে আজকের দিনের প্রতিটি মানুষের মাইট্রোকন্ড্রিয়াতে এই তেত্রিশজনের ভেতর থেকে কোনো একজন গোত্রমাতার রক্তবীজ বংশ পরম্পরায় সুন্দরভাবে রক্ষিত হয়ে এসেছে।
জেনেটিক্সের এই অভূতপূর্ব অগ্রগতি জানতে হলে আগ্রহী পাঠক ব্রিটিশ জেনেটিসিস্ট ব্রায়ান সাইকসের ‘সেভেন ডটার্স অব ইভ’ পড়ে দেখতে পারেন। আর হ্যাঁ, যদি আপনি আপনার আদি গোত্রমাতার সন্ধ্যান জানতে চান তবে www.oxfordancestors.com এ যোগাযোগ করুন। কিছু সম্মানীর বিনিময়ে ওরা আপনার আদী মাতামহীর খোঁজ দিয়ে দেবে।

বুশম্যানের পেইন্টিং: আদিমাতার হাতের ছাপ?

[যায়যায়দিন, ২০০৫]