পৃথিবীর যে কোন উন্নত দেশে কোন একটা সিস্টেম ঠিকঠাক চললে তা বদলানোর কথা কেউ ভাবেও না। যে সব সিস্টেমে গলদ আছে – সেগুলোকেই খোলনলচে পাল্টে দিয়ে ঠিক করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে হয় উল্টোটা। এখানে যেসব রাস্তা ভাঙাচোরা – সেগুলো সারাবছর ভাঙাচোরাই থাকে। সেসব রাস্তা মোটামুটি চলনসই – সেগুলোতে শুরু হয় খোঁড়াখুড়ি। এ অবস্থা যেমন আক্ষরিক অর্থে সত্যি – তেমনি প্রায়োগিক অর্থেও। যেমন – দেশের হাজারো সমস্যার সমাধান যেখানে জরুরিভিত্তিতে করা দরকার সেখানে সরকার উঠেপড়ে লেগেছে গ্রামীণ ব্যাংক ও প্রফেসর ইউনূসকে নিয়ে। যেন ওটাই প্রধান সমস্যা এবং তার সমাধান করতে পারলেই বাংলাদেশের আর কোথাও কোন সমস্যা থাকবে না।

এরকম কাজের সাম্প্রতিকতম সংযোজন – মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পরীক্ষা না নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রী ও সচিব মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষদের সাথে একটা মিটিং করেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন – এস-এস-সি ও এইচ-এস-সি’র রেজাল্টের ভিত্তিতে মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হবে। ঠিক কীভাবে শিক্ষার্থী নির্বাচন করা হবে যেখানে প্রায় লাখ খানেক ছাত্রছাত্রী সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েছে? বলা হচ্ছে এখনো সে ব্যাপারে কোন নীতিমালাই তৈরি করা হয়নি। তবে ‘কারো প্রতি অবিচার করা হবে না’ জাতীয় গালভরা বুলি আছে। দেশের বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ডের নম্বর ও জি-পি-এ’র যে সমন্বয় নেই তার কী হবে? তার জন্য নাকি জেলা-কোটাই যথেষ্ট। সে যাই হোক – কেন হঠাৎ এরকম একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার দরকার হলো হাজার হাজার ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উপর? এতদিন যে পদ্ধতিতে ভর্তি চলছিলো তাতে কি ত্রুটি ছিল?

অনেক বছর ধরে একটু একটু সংস্কার ও সমন্বয় করতে করতে মেডিকেল কলেজে ভর্তির যে ব্যবস্থাটা অর্জিত হয়েছিল তা সর্বজনগ্রাহ্য একটা কার্যকরী ব্যবস্থায় উন্নীত হয়েছিল। অনেক আগে একেক মেডিকেল কলেজে একেক সময় ভর্তি পরীক্ষা হতো। তাতে যেসব সমস্যা ছিল সব কলেজে এক সাথে পরীক্ষা নিয়ে সে সব সমস্যার কিছুটা সমাধান করা হলো। তখন লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হতো। দেখা গেলো মৌখিক পরীক্ষায় কিছুটা দুনীর্তির সুযোগ রয়ে যায়। পরে মৌখিক পরীক্ষা উঠে গেল। তারপর লিখিত পরীক্ষা বদলে গিয়ে এম-সি-কিউ পদ্ধতি চালু হলো। সেখানেও যেন না জেনে আন্দাজে উত্তর দিয়ে ‘ভাগ্যের জোরে’ কেউ সুযোগ পেয়ে না যেতে পারে – সেজন্য চালু হলো ভুল উত্তরের জন্য নেগেটিভ মার্কিং। ফলে পরীক্ষা পদ্ধতি হয়ে উঠলো আরো আধুনিক এবং যুক্তিপূর্ণ। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ চালু হবার পর থেকে সারাদেশের অর্ধ-শত বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির কোন সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি ছিল না। গতবছর বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোকেও নিয়ে আসা হয় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার অধীনে। ফলে সারাদেশে একটা নির্দিষ্ট নিয়মে সমন্বিত মেডিকেল ভর্তি ব্যবস্থা চালু হয়ে গেছে। তাহলে এ সুন্দর ব্যবস্থাকে একেবারে বন্ধ করে দেয়ার পেছনে যুক্তি কী?

যুক্তি যা দেখানো হচ্ছে তাতে পনের কোটি মানুষের একটা বিশাল দেশ যাঁরা চালান তাঁদের লজ্জা হওয়া উচিত। কিছু কোচিং সেন্টার নাকি ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে এবং আরো বিভিন্ন উপায়ে নাকি ভর্তি-পদ্ধতিকে কলুষিত করে। তাই ভর্তি-পরীক্ষা উঠিয়ে দিলে তাদের উচিত শাস্তি হবে। বাঃ কী সুন্দর সমাধান আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের এবং জ্বি-হুজুর মার্কা মেডিকেল-অধ্যক্ষদের। পৃথিবীর সবদেশে যে IELTS, TOEFL, GRE, GMAT ইত্যাদি আন্তর্জাতিক পরীক্ষাগুলো হয় – তাতেও তো কিছু কিছু দেশের ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে কথা ওঠে। কৈ সে কারণে তো পরীক্ষা বন্ধ করে দেয়ার কথা তো কখনো শোনা যায় না। বরং পরীক্ষা ব্যবস্থাটাকে কীভাবে আরো নিশ্ছিদ্র করা যায় তার ব্যবস্থা করা হয়। ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ না করে যেসব কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া যায় না?

সারা পৃথিবীতে মেডিকেল কলেজে ভর্তির ব্যাপারটাকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। আমাদের দেশের কিছু কিছু ‘উচ্চশিক্ষিত’ আমলা বলেই ফেলেছেন যে পৃথিবীর কোন উন্নত দেশেই নাকি ভর্তি-পরীক্ষা নেয়া হয় না। আমি জানি না তাঁদের কাছে উন্নত দেশের সংজ্ঞা কী। আমেরিকা নিশ্চয় একটি উন্নত দেশ। সেখানে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে গেলে MCAT – বা Medical College Admission Test স্কোর লাগে। এই টেস্ট পরিচালনা করে এসোসিয়েশান অব আমেরিকান মেডিকেল কলেজ বা AAMC। MCAT স্কোর ছাড়া আমেরিকায় মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া যায় না। ইংল্যান্ডে UKCAT বা UK Clinical Aptitude Test দিতে হয়। অস্ট্রেলিয়ায় স্নাতক পর্যায়ে মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য দিতে হয় UMAT বা Undergraduate Medical Admission Test, স্নাতকোত্তর পর্যায়ের মেডিকেল কোর্সে ভর্তির জন্য দিতে হয় Graduate Medical School Admission Test (GMSAT). Australian Council for Educational Research (ACER) এর তত্ত্বাবধানে এই টেস্ট এখন ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডেও প্রচলিত হয়েছে।

আমেরিকা, ইংল্যান্ড, বা অস্ট্রেলিয়ার স্কুল কলেজের নিয়মিত পরীক্ষাগুলোর ফলাফল তো প্রশ্নবিদ্ধ নয়। তবুও সেসব দেশে মেডিকেলে ভর্তির জন্য ভর্তি-পরীক্ষা দিতে হয়। আর আমাদের দেশে এক শ্রেণীর আমলা হঠাৎ বলতে শুরু করেছেন বোর্ডের পরীক্ষার চেয়ে ‘এক ঘন্টার ভর্তি পরীক্ষা বেশি কার্যকরী নয়’। এমন তো নয় যে বোর্ডের পরীক্ষার কোন গুরুত্বই দেয়া হচ্ছে না। এস-এস-সি ও এইচ-এস-সি’র নম্বর থেকে একটা অংশ তো প্রচলিত ভর্তি পদ্ধতিতেই সংযুক্ত আছে। যদি বেশি সংখ্যক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা নিতে সরকারের সমস্যা হয় বুয়েটের মত উচ্চ-মাধ্যমিকের গ্রেডের ভিত্তিতে মেধানুসারে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। কিন্তু ভর্তি-পরীক্ষাহীন ভর্তির সিদ্ধান্ত হবে ভীষণ গোলমেলে এবং তৈরি হবে আরো অনেক নতুন দুর্নীতির সুযোগ, এবং ভর্তি-বাণিজ্য। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত এখনি ত্যাগ করা দরকার।