কৈফিয়ত:- অনেকদিন আগে ব্লগে একটা প্রবন্ধ পড়ি এ নামে। নামটা খুব পছন্দ হওয়াতে ছোট গল্পের একটা তাগিদ অনুভব করি। নামের সাথে সংগতি রেখে আইডিয়া খুঁজে পেতে সময় লাগে কিছুদিন। গল্পটা সে সব মানুষের জন্য, যারা অন্ধকারকে পিছনে ফেলে আলোয় ফেরার তাগিদ অনুভব করেন প্রতিনিয়ত:।

কোন এক শীতের সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে এক চিলতে ব্যালকনিতে দাঁডিয়ে। একটু একটু করে গাছের ফাঁকে সূর্যের দেখা মিলছে। তুলোর মত নরম সাদা কুয়াশাও আস্তে আস্তে কেটে যেতে শুরু করেছে। গায়ে জড়ানো পুলওভার খুলতে গিয়ে চোখ পড়ে সামনে। ম্যাধাকর্ষণের অমোঘ নিয়মে টপ টপ করে মানিপ্ল্যান্টের পাতা থেকে এক এক করে ঝরে পড়ছে শিশির। সকালের নরম রোদ ঘাসের সাথে শিশিরের সখ্যতা কমায়। সূর্যের সাথে শিশিরের যেন চিরকালের আড়িপাতা। ভাবতে গিয়ে, ছোট্ট টেবিলের উপর মরার মত পড়ে থাকা সিগারেটের প্যাকেটটা লাইটার সমেত হাতে উঠে আসে। সিগারেটের ধোঁয়া আর সকালের নরম রোদ শরীরকে আরো উষ্ণ করে তোলে। টপ টপ করে ঝরে পড়া পানির সাথে জীবনের একটা মিল খুঁজে পাবার চেষ্টা করা যেতে পারে অবশ্য। আমরা এক এক করে স্বপ্ন সাজাই,এক জীবনে অনেক স্বপ্ন- আবার পড়ন্ত বিকেলে সে স্বপ্নগুলো আস্তে আস্তে মোমের মত গলে গলে তরল হয়ে উঠে। টুপটাপ ঝরে পড়ে। তারপরেও আমরা প্রতিনিয়ত: স্বপ্ন বুনে যাই। কেন জানি মনে হয়, এ গোলমেলে পৃথিবীতে কিছু স্বপ্ন যদি নাই থাকে তাহলে বাঁচব কি করে। অসংখ্য স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকার তীব্র আকাংখার নামই বুঝি জীবন। জীবনের প্রয়োজনে দু’টো মানুষ অনেক স্বপ্নে ঘর বাঁধে। সে ঘরে আরো নতুন জীবনের জন্ম দিয়ে চলে। ক্রমাগত: এ প্রক্রিয়ায় আমরা পৃথিবী নামক গ্রহে বেঁচে বর্তে থাকি। নিয়ম করে রাত যায়, সকাল আসে। সকালের এক কাপ ধুমায়িত চায়ের আমেজ আর স্বাদ একেবারে অন্যরকম, চনমনে করে তোলে পুরো শরীর। আমাদের ছোট্ট সংসারে একটা অলিখিত নিয়ম আছে। ঘুম থেকে যে আগে উঠবে চা তৈরীর দায়িত্ব তার। বলতে হয়, এ নিয়মে বরাবরই হেরে যাই আমি। কেন জানিনা, কোন কোন হারার মধ্যে এক ধরণের আনন্দ আছে। এ হারার আনন্দটা আজীবন উপভোগ করতে চাই। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে পড়ে অনেক ঘটনা।

১৯৬১ সালের কোন এক বিকেল। ম্যাট্রিক পাস দিয়ে সবে কলেজে ভর্তি হওয়া চার ফিট সাত ইঞ্চির লিকলিকে ফর্সা একটি মেয়ে চায়ের ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে বড়দের সামনে। কোনমতে শাড়ি পেঁচিয়ে দুরুদুরু বক্ষে এতগুলো মানুষের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির হাত থেকে চা সমেত ট্রে উল্টে পড়ে যাবার উপক্রম। শাড়িতে অনভ্যস্ত ছোট্ট মেয়েটি কোনমতে রক্ষা পায় পাশে থাকা মহিলার সহায়তায়। অনেকগুলো বয়স্ক মহিলার পাশে বসে কেমন জানি ভয় ভয় করে। ভালো রকমের প্রস্তুতি থাকলেও পরিস্হিতি আমাদের অপ্রস্তুত করে দেয় মাঝে মাঝে। জোড়া জোড়া চোখ মেয়েটিকে তীব্রভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে অনবরত। চোখ তুলে তাকাতে লজ্জা পায়। তারপর, সে মেয়েটির জন্য আরো কঠিন কিছুর অপেক্ষা। বিভিন্ন রান্না বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর, খোপা খুলে কালো লম্বা চুলে হাঁটাচলা কোনটাই বাদ পড়েনি সেদিন। লাল হয়ে ওঠে ফর্সা মুখ। মাথা নিচু করে কেবল নিচু লয়ে উত্তর দিয়ে চলা। দেখা গেল,তীরের মত ছুঁড়ে দেয়া অসংখ্য প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ছন্দ হারিয়ে ফেলে এক সময় আর মুখে কথা আসে না। তারপরেও অপ্রাসংগিকভাবে এসে পড়ে সেলাই আর গান বাজনার মত আরো কিছু ব্যাপার। মামুলি খুচরো রসিকতাও বাদ পড়ে না। মেয়েটি মহিলাদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচতে এক সময় ব্যাকুল হয়ে উঠে। কপালে জমে থাকা ঘাম ঝরতে ঝরতে কোনমতে টাল সামলিয়ে পৌঁছে যায় বাড়ির ভিতর। মাধ্যমিক পাস চার ফিট সাত ইঞ্চির ছোট্ট মেয়েটি আর কেউ নয়,আমার মা। এ গল্প আমার মায়ের। সে গল্প বড় হয়ে বেশ ক’বার শুনেছি। সে গল্প আমাকে ভাবায়, আমাকে বিষন্ন করে,আমাকে কষ্ট দেয়। একটা বোবা অনুভুতি আমাকে বিপর্যস্ত করে তোলে।

বিয়ে পূর্ববর্তী পাত্রী দেখা এদেশে এক ধরণের সামাজিক রীতি। এখন সে রীতি অনেকটাই বিলুপ্ত প্রায় ডাইনোসরের মতো,তবুও সিসিউতে কোমায় থাকা রোগীর মত কিছুটা বেঁচে আছে এখনো। পাত্রীকে নিয়ে আড়ালে কথা বলবার প্রস্তাব রাখতেই গুরুজনদের ধমক শুনতে হয়েছিল অন্নদা শংকর রায়কে। একশ বছর আগে যা ছিল একেবারেই কল্পনাতীত, এখন তা সর্বজন স্বীকৃত। সময়ের সাথে সাথে আমাদের চিন্তা চেতনা পাল্টে যায়। পাল্টায় সামাজিক নিয়ম কানুন। পাল্টানো সে নিয়মে, কোন এক পড়ন্ত বিকেলে দামি রেস্টুরেন্টের আলো আধাঁরিতে রূপকথা চৌধুরীর সাথে প্রথম আলাপ। সাধারণ পোষাক, বেশ পরিপাটি। উজ্জ্বল সপ্রতিভ সংকোচহীন একটি মুখ। আমার সামনে। একেবারে মুখোমুখি। হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় অনায়াসে। দু’হাত দুরুত্বে অচেনা দু’জন মানুষ আলোচনার বৃত্তের কেন্দ্রে আসার অপেক্ষা। শুভেচ্ছা বিনিময়, শুরুটা আমাকে দিয়ে হয়েছিল। দু’চার কথার পর আলাপ জমে ওঠে। ঘুরে ফিরে আসে নানা কথা। ব্যক্তিগত রুচি,ভাবনা,সৌন্দর্যবোধ কোন কিছুই বাদ যায় না সে আলাপে। ওর ব্যক্তিগত ছোট ছোট অবশ করা অনুভূতিগুলি আমাকে বেশ নাড়া দেয়। বিশ্বাস,বিশ্লেষণ,মতামত আর যুক্তি আমাকে প্রলুব্ধ করে আরো আলাপে। কথা শুধু বলার জন্য নয়, কথা বলা যে এক ধরণের আর্ট এ ব্যাপারটা আমি সেদিন নতুন করে বুঝলাম। ওর বলার ধরণটা এক ধরণের মুগ্ধতা ছড়িয়ে আস্তে আস্তে গড়িয়ে পড়ে সামনে রাখা ধুমায়িত কাপে। মনে আছে, সে চা আমি অনেকক্ষণ আগলে রেখেছিলাম পাছে হারিয়ে ফেলি সে ভয়ে। চায়ের অপূর্ব স্বাদ আমাকে বহুক্ষণ আপ্লুত করেছিল অজানা উত্তেজনায়, সে সাথে অনির্বচনীয় এক ভাললাগার অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত শরীরে।

ছাদে পাঁচতলায় ছোট্ট দু’টো ঘর। রূপকে নিয়ে আমার নতুন জীবনের পথচলা শুরু। ছোট্ট সে বিবর্ণ ঘরে আমরা দু’জন রংগিন মানুষের একসাথে প্রথম বসবাস। স্যাঁতাপড়া চার দেয়ালের মাঝে মেঘের মতো কিছু স্বপ্নের ওড়াওড়ি। প্রতিদিন সে স্বপ্নগুলো আমরা হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি,গায়ে মাখি। চোখে মুখে ঘোর লাগা সেই স্বপ্নে ইউক্লিডের জ্যামিতির মতো রূপের অনাবৃত শরীরের- প্রথম পাঠ। ছোট্ট সে ঘরে দু’জনের শরীরের ভাষা কোন এক রোদেলা দুপুরের মত তপ্ত হয়ে সারাঘরময় ছড়িয়ে পড়ে। শিহরণ জাগানো অব্যক্ত অনুভূতি এই বিবর্ণ ঘরের চার দেয়ালের ভেতরে পাঁক খেতে খেতে ক্রমাগত উপরের দিকে উঠতে থাকে। নিচু হয়ে আসা খসে পড়া পলেস্তরা ছাদ যতই আমার দুরে, রূপ ততই আমার বুকের কাছাকাছি।

– এই আজ অফিস যাবে না। ইউলিটি বিল দিতে হবে। আজ লাস্ট ডেট।
কানের কাছে রূপের কথা আমাকে বাস্তবে ফেরায়। অফিস যাবো না জানিয়ে দিই।
-তাহলে ভালই হলো, বিলগুলো মিটিয়ে দিও। আমার কলেজে তাড়া আছে। রাস্তায় খুব জ্যাম হয়। আমি বেরুছি।
কখন ফিরবে জানতে চাই।
-অনেকগুলো ক্লাস নিতে হবে। নতুন সেশান শুরু হয়েছে আজ। ফ্রিজে খাবার রাখা আছে। মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নিও।

আমাকে বাসায় একা রেখে বেরিয়ে পড়ে সে। সে পলেস্তরা খসা বাসায় আমাদের তিন বছরের রাতদিন। ছোট্ট ভাড়াবাড়িতে থাকতে থাকতে কেমন জানি এক ধরণের বিরক্তি এসে গেছিল। আমার অবর্তমানে অযাচিতভাবে বাড়ির মালিকের আর্বিভাব আমাদের বিব্রত করে। রূপের অসহ্য ঠেকে এ ব্যাপারটা। ওর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হত। অনেক চেষ্টায় সে নিজেকে সামলে নিত।

রেজাল্টের পর রূপ একটা কলেজে জয়েন করে। আমিও বেশি মাইনেতে জয়েন করি বহুজাতিক সংস্হায়। বাবার রিটায়ারমেন্টের টাকা আর অফিস থেকে লোন নিয়ে এপার্টমেন্ট বুকিং দিয়ে দু’বছর পর সে ঘিঞ্ছি থেকে বেরিয়ে আসা। ছোট্ট চার দেয়ালের মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ অনেক ঘটনাকে পিছনে ফেলে সাড়ে আট শ স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট নতুন এপার্টমেন্টে চারতলায় রূপের সাথে জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু।

যেদিন প্রথম নিজের এপার্টমেন্টে উঠি সেদিন ওর অনুভূতি ছিল একেবারে দেখার মতো। একটু একটু করে যত্নে বোনা স্বপ্নগুলো সে যেন ছুঁতে চায়। আজই সব ধরে ফেলতে তীব্র ব্যস্ত। চাঞ্চল্য, উৎসাহ কোনটার কমতি ছিল না। সব কিছুকে নিজের করে পাওয়ার আনন্দ ওকে উদ্বেলিত করে তুলেছিল, যা আট শ স্কোয়ার ফিটের চতুষ্কোণের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিল। ফিটিংস,ফার্নিচার,ইন্টেরিয়র ডিজাইন কোনটাতে উৎসাহের কমতি দেখিনি। সব কিছু প্ল্যান মাফিক করে চলেছে সে। মাঝে মাঝে টুকটাক পরামর্শ নিলেও ওর পছন্দটাই চুড়ান্ত। যা হোক, নিজে সব কিছু ম্যানেজ করে নিচ্ছে দেখে আমার নির্ভরতা আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল। সময়ে সময়ে গুছিয়ে তোলে সবকিছু।