বিয়ে না করলে হয় ব্যচেলর। আবার অনেক সময় বিয়ে করেও ব্যচেলর হওয়া যায়। যেমন, মিঞা-বিবির সন্তান না হলে তাকে বলে মেরিড ব্যচেলর বা ব্যচেলর দম্পতি। এমনি এক সংজ্ঞায়নের জটিলতার ভেতরে পড়ে গেছে জরি আর তার স্বামী। ব্যচেলরের খাতায় নাম উঠায় তারা যে লোকসানে আছে তা নয়, বরং একটুখানি লাভই হয়েছে তাতে বলা যায়। লাভটা বৈষয়িক। কর্নফুলির পাড় বরাবর গজিয়ে উঠা বিরাট কারখানাটার ঝকমকে কলোনীতে বড় কোন এক বাসা নিয়ে এখানে বাস করবে কারা, যাদের ছেলে-পুলে নিয়ে সংসার আছে বড়। কোন দুঃখে জরি তার টোনাটুনির সংসার নিয়ে বাসা বাঁধতে যাবে অমন বড় কোন মহলে, কর্তা কারখানায় কাজে চলে গেলে যে মহল খা খা করবে গুমোট নির্জনতায়। তার থেকে এই ভাল- ব্যচেলর কর্মকর্তাদের এই এক রুমের বাসাই সই। ছোট বাসায় ভাড়া কম- কিছু অর্থও সাশ্রয় হয় তাতে। নিজের মত থাকতে পারে জরি এখানে। বাড়ীর কর্তাদের অবর্তমানে তাদের গিন্নীরা খেজুরে আলাপ করতে বড় একটা আসেন না এখানে। দুনিয়ায় যেন কোন আর গল্প নেই, পরের নিন্দা গীবত ছাড়া। ছি ছি, কি সব গল্প পাড়ে মাঝে মাঝে ওরা, শুনলে গা ঘিন ঘিন করে জরির- অজু গোছল করে শুচি হওয়া লাগে। জরি নিশ্চিত, তার বিষয়েও ওরা এভাবে আলাপ করে। কতবার যে গিন্নীরা গায়ে পড়ে সওয়াল করেছে তাকে সেই একই কথা বারবার, তার ইয়ত্তা নেই। চার চারটা বছর হয়ে গেল এখনও তার ছেলে-পুলে কেন হয় না, এ চিন্তায় ভাবীদের যেন ঘুম নেই। প্রশ্ন শুনতে শুনতে ঝালা পালা জরির কান। বড় বেশী অসহায় লাগে নিজেকে এসব প্রশ্নের ঘায়ে। একান্তে নির্জনে বসে থাকলে আচমকা প্রশ্নগুলো উদোম শরীরে ধাওয়া করে তাকে। জরি তখন চমকায় অপমানে।

জরির হাতে এখন অনেক কাজ। আগামী সপ্তাহে তার মা আসছে সাতক্ষীরা থেকে। অনেক দিন পর মা’র একটু খেদমত করতে পারবে, প্রান ভরে ভাল-মন্দ খাওয়াতে পারবে মাকে। তবে মা যে কারনে আসছে তাতে মোটেই খুশি না জরি। মা চায় তার সওয়ালের জবাব- কেন তারা একা? কেন সন্তান আসে না কোলে? এসব প্রশ্নের উত্তর সে কাউকে দিতে চায় না, এমন কি নিজের মাকেও না। কারন সে জানে, উত্তরে আছে অনেক লজ্জা, অনেক অপমান। সেসব অপমানের দেয়াল টপকানো তার পক্ষে কোন দিনই সম্ভব হবে না। তার চেয়ে এই ভেবে সে শান্তিতে থাকতে চায়- সবই তার ভাগ্য। একদিন যে লেকু ভাইয়ের হাত ধরে বাপের সাথে ঝগড়া করে অনেক বড় মুখ নিয়ে সেই সাতক্ষীরা থেকে কর্ণফুলির তীরে এই ছোট্ট ঘরটায় বাসা বেঁধেছিল, ভালবাসার সেই মানুষটার মুখে সে কোন ভাবে কালি লেপে দিতে পারবে না- পারবেনা তার নিজের মুখটাকেও ছোট করে ফেলতে। তাই এই প্রশ্নের উত্তর তার অজ্ঞাত। তার মনের গোপনে যদি কোন জ্বালা, কোন ব্যথা থেকে থাকে সেটা একান্তই তার।

দোতলার ছোট্ট এক টুকরো ব্যলকনিতে বসে মধ্যবয়স পেরিয়ে যাওয়া মা তার মেয়ের মাথায় বিলি কাটতে কাটতে কথা বলে চলেছেন বিরামহীন। সেসব কথায় মিশে আছে হাসি কান্না অভিমান, আছে স্মৃতি আর তাবত অভিজ্ঞতার বয়ান। একটু একটু করে পশ্চিমের আকাশটা পোড়া মাটির রং নিয়েছে। সন্ধ্যা হতেও খুব বেশী বাকী নেই আর। এমন এক ঝলমলে দিনকে রাতের থাবার নীচে গুম হয়ে যেতে দেখে চারদিকের সকল চরাচর কেমন যেন চুপ মেরে গেছে ত্রাসে। সহসা সন্ধ্যার নির্জনতাকে ভেঙ্গে দিল একটা কন্ঠ- একটা পুরুষ কন্ঠ।
-ভাবী সালামালাইকোম। আপনার আম্মা আসছেন বুঝি? সালামালাইকোম খালাম্মা।
রাস্তা দিয়ে হেটে যেতে যেতে গলা উচিয়ে সালাম দিল সিদ্দিক। এই বিল্ডিংয়েই থাকে লোকটা, জরির স্বামীর সঙ্গে এক সাথে কাজ করে। দেখা হলে ভাবী ভাবী করে। সবে চাকুরী নিয়েছে, এখনো বিয়ে করেনি। ছেলেটাকে দেখলে কেমন মায়া লাগে জরির। ছেলেটার দিকে মুখ তুলে তাকায় জরির মা। মনে মনে সালামের উত্তর দেয়।
-কালো হলেও ছেলেটা বেশ সুন্দর রে জরি। কেমন মায়া ভরা মুখটা। তোদের এখানে আসে বুঝি?
-হ্য মা, ছেলেটা আমাদের নিজের লোকের মতো।
চুল বাঁধা, কথা বলা এক সাথে চলে। মায়ের মুখে কথার আজ শেষ নেই। হটাত করে মা তার সব কথার মাঝখান থেকে চলে আসেন আসল কথায়, কাজের কথায়।
-জরি, তুই কি আমারে চিরটা কাল আন্ধারে রাখবি?
-কিসের আন্ধার মা?
-তুই ভাল করেই জানিস, কিসের আন্ধার। তোর কোল খালি ক্যান? আমারে আর এটা ওটা বলে চুপ করায়ে রাখতে পারবি না। আজকে আমারে বলতেই হবে সব।
মায়ের চোখে মুখে অসীম জিজ্ঞাসা। সব হতাশা যেন তার চোখের মণি দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়।
-সেকথা বললে আমি বাচবো না, মা।
-আমার উপরে তোর দেখি এতটুক বিশ্বাস নেই। কথাটা আমারে বলেই দেখ, বাচিস না মরিস।
বেশ কিছু সময় পার হয়ে যায়। মা মেয়ে কারো মুখে কথা নেই। পশ্চিমে অস্পষ্ট হয়ে আসা সূর্য্যটার দিকে অপলক চেয়ে থাকে জরি। কি যেন ভেবে চলে সে একটানা। আচমকা ঘুরে বসে সে মায়ের মুখোমুখি। মায়ের কানের খুব কাছে মুখটা এনে ফিসফিসিয়ে কি জানি বলে আল্লাদী মেয়ে। তারপর একটানা চাপা কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছু শুনতে পায় না মা। অঝোরে বৃষ্টি ঝরে মেয়ের চোখে। মাকে জড়িয়ে বসে থাকে কিছুক্ষন হতভাগী জরি।
-তুই তো মরিছিস রে পোড়াকপালী।
মায়ের চোখ ভিজে যায় একই বৃষ্টির জলে। ভেতরটা তার মোচড়ায় করুন এক রাগীনির সুরে। কোন সে অসুর তার মেয়েকে জীবনের সব রূপ-রস-সুধা থেকে বঞ্চিত করে একটু একটু করে শুকিয়ে মারছে? কেন মারছে?
শক্ত হতে হবে। মেরুদন্ড সোজা করে দাড়াতে হবে ততোধিক শক্ত মাটিতে, তবেই না মেয়ে তার নিজের পতন ঠেকাবে- ভাবে মা মনে মনে। নিজের কথা ভাবে জরির মা। নিজের যৌবনের কথা, নিজের যুদ্ধের কথা ভেবে কঠিন হয়- ধাক্কা দিয়ে সোজা করে বসায় মেয়েকে সে।
-ও রে হতভাগী, একটা নারীতো একজন পুরুষের সাথেই ঘর বাঁধে। সে তো না-পুরুষ! এতদিন আমার কাছে এসব ক্যান বলিসনি, ক্যান গোপন করিছিস? ওকে তোর ছাড়তেই হবে, আর কোন পথ নেই খোলা। তোকে মা হতে হবে রে।
মায়ের কন্ঠস্বর শুকনো কঠিন, চোখের পানিও উড়ে গেছে বাস্প হয়ে।
-তুমি একবার বলো আর শতবারই বলো, আমি তাকে ছাড়তে পারবো না মা। সেই আমার সব।
ক্ষীন কন্ঠের শব্দ ধারায় মনের ভেতরের সব কথা যেন উগরে দিতে চায় জরি তার মায়ের সামনে। কি নেই তার স্বামীর ভেতর, ঐ একটা জিনিস ছাড়া? তার আছে ঐশ্বর্য্যময় চলার গতি- চলনে বলনে আর কাজে। সেই তার সুর, সেই তার অসুর। উজ্জলতায় অসুরের সমান শক্তি নিয়ে সে তার মন হরণ করে নিয়েছে, দেহ তাই বিদ্রোহ করে নাই কোন দিনও। সেই সন্মোহনে হয়তো ভবিষ্যতেও জীবন চলবে একই পথে। কোন অপরাধে জরি তার স্বামীকে কাঠগড়ায় উঠাবে? এ দোষ তো তার অর্জিত নয়।
-তুই কি চিরকালই বোকা রয়ে যাবি রে জরি? বোকার মতো পড়ে পড়ে মার খাবি? ছেলাটাকে আমার পছন্দ হয়েছে- ঐযে, যে ছেলেটা সালাম দিয়ে গেল। ওর চোখে মুখে একটা জিনিস আমি দেখিছি। আমার এই বুড়ো চোখ যদি ফাঁকি না দেয়, তবে তাইই ঠিক। আর কতইবা ছোট হবে তোর চেয়ে। তাতে কি হয়েছে- তোর মতো সুন্দরীইবা কয়টা আছে এই কলোনীতে! তুই একটু চেষ্টা করলেই হয়। এই দানবটাকে ছেড়ে ঐ দিকে একটু চেষ্টা কর জরি। তা না হলে সারা জীবন আক্ষেপ করতে হবে। দুনিয়ায় কত মেয়েইতো বিয়ে ছাড়া বাচ্চা নিচ্ছে- জীবনের স্বাদটাকে বুঝে পাচ্ছে। তোকে তো আমি তা করতে বলছি না। মা হলে বুঝতিস আমার কোথায় লাগে।
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে মা ভেতরটা হালাকা করে। মেয়ের কষ্টটা শতগুন হয়ে তার অন্তরাত্মাটাকে তছনছ করে ফেলে। কি দোষ করেছে তার মেয়ে? দেহের চরম আনন্দ, জীবের শীর্ষ সে ভোগ চিরকালই অধরা রয়ে যাবে তার কাছে? আমৃত্যু রয়ে যাবে ফলহীন শুকনো মরু? আকাশ পাতাল ভাবে জরির মা। খুজে ফেরে মুক্তির পথ- সমাজ-সংসারে খাড়া হয়ে দাড়াবার তাকদ।
মায়ের কথা শুনে শরীরের সমস্ত রক্ত যেন মুখে চলে আসে জরির। ফর্সা মুখে সে রক্ত আরেকটা সূর্য্যের জন্ম দেয়। যার তেজ ভুল-ভাল বকে যাওয়া মা’কে জ্বালিয়ে দিতে চায়। মায়ের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে মেয়ে। এমন একটা কথা মা তাকে বলতে পারলো?
-মা, তোমার আর আমার কাছে থাকার দরকার নেই। কালকেই তুমি সাতক্ষীরা চলে যাবে। তুমি কেমন মা?
পরদিন চলে যায় মা- জরির মা। যে আগুন এতদিন কোন রকম চাপা ছিল ছাই দিয়ে, তা আবার উস্কে দিয়ে গেল মা। কিছুদিন জ্বলবে আগুন আপন শীখায়, তারপর আবার চাপা পড়বে ছাইয়ের তলায়।

জরির মা চলে গেছে প্রায় দুই মাস হয়ে গেল। সব কিছু সেই আগের মতো। সংসারের টুকিটাকি ঘরকন্যা, অবসরে বই পড়া, বই দেখা- বড্ড বেশী এক ঘেয়ে সব। কখনো ঘরে থাকা, কখনোবা ঘরের বাইরে যাওয়া- এইসব নিয়েই জরির জীবন। অন্যসব দিনের মতো আজকের দিনটাও ঠিক একই রকম একঘেয়ে। কে একজন গিন্নী-ভাবী দরজায় এসে বলে গেল- সিদ্দিক সাহেব অসুস্থ্য। ভীষন অসুস্থ্য। জন্ডিস হয়েছে- দেখার কেউ নেই, ঘরের ভেতরে পড়ে আছে একা। খবরটা শুনে মনটা কেমন জানি করে জরির। আহারে বেচারার কেউ নেই, ভাল-মন্দ কিছু একটা হয়ে গেলে কে দেখবে? ন্যাবা রোগে পরিমিত সঠিক আহার খুবই জরুরী, না হলে বিপজ্জনক হতে পারে। সকাল থেকে দুপুর অব্দি নানান পদের ব্যঞ্জন বানালো জরি অসুস্থ্য লোকটার জন্য। বাসায় গিয়ে দেখলো ঠিক তাই- অযত্নে অবহেলায় ছেলেটা পড়ে আছে একা।
-এই অবস্থা তোমার হলো কিভাবে? আমাদের জানাওনি কেন?
গাঢ় হলুদ রং-এর চোখ দুটো মেলে তাকাল সিদ্দিক তার ভাবীর দিকে। পাংশু দুর্বল শরীরে নড়াচড়ার তেমন তাকদ নেই। চোখের দৃষ্টিতে কেমন এক শিশুসুলভ স্নেহের প্রত্যাশা। সেবা প্রত্যাশী রোগীরা হয়তো শিশুই হয়ে যায় ভেতরে। সহপাঠি বন্ধু, সহোদর ভাই অথবা অসহায় শিশুর প্রতি মানুষ যেমন এক স্বাভাবিক টান অনুভব করে ঠিক তেমন এক মমতার বন্ধন অনুভব করলো জরি নিজের বুকের ভেতরে। সেই টানে হাত-পা তার সচল হলো। ঘর-দোর গোছগাছ করলো, খাওয়ালো রোগীকে যত্নে-আদরে।
-থাক আর কষ্ট করে বেশী কথা বলার দরকার নেই। সব সময়তো আসতে পারবো না- খাবার দাবার যা লাগে পাঠিয়ে দেব। শরীরে একটু তাকদ হলেই আমদের বাসায় চলে এসো- সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি না হয় আমিই দেখাশোনা করবো।
ভাবীর কথায় শুধু উপর নীচে মাথা নাড়লো সিদ্দিক। তারপর তার প্রস্থানের পথে অপলক তাকিয়ে রইলো সে হলুদ দৃষ্টি মেলে।

সিদ্দিক এখন জরির ঘরে- সকালের নাস্তা সেরে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। থাক বেচারা ঘুমোক, ওকে ডেকে তুলে কাজ নেই। কর্তা কাজে- আসবে সেই সন্ধ্যায়, তখন রোগী চলে যাবে নিজের ঘরে। ঘরে অযথা টুকটাক শব্দ করলে বেচারা জেগে যেতে পারে। এখন বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। প্রতিবেশীদের সাথে গল্পে-কথায় আর বারান্দায় পায়চারী করে জরি সচ্ছন্দে ঘন্টা দুই পার করে দিতে পারবে। দরজাটা আস্তে ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল সে। কথায় কথায় বেলা হলো বেশ। দুপুরের খাবারটা দিতে হবে ছেলেটাকে। রোগী নিয়ে জরির ব্যস্ততা বেড়ে গেছে- কিছু করার ছিল না, এখন অনেক কাজ পেয়েছে সে। বেলা বয়ে যায়। ধীরে নিঃশব্দে দরজাটা খোলে জরি। কিন্তু এসব কি দেখছে সে? একদিন মায়ের এক ভয়াবহ কথায় শরীরের সমস্ত রক্ত তার মুখে এসে পড়েছিল অপমানে লজ্জায়, আর আজ সাক্ষাত এক দৃশ্য দেখে তার সব রক্ত একেবারে মাথায় উঠলো। মাথাটা সহসা ঘুরে গেলো- অন্য রকম এক ঘোরা। এখন সে কি করবে? পায়ে পায়ে জরি রোগীর মাথার কাছে এসে দাড়ালো। কে যেন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে এলো সেখানে। ঘুমোচ্ছে তখনো সিদ্দিক, মাঝে মাঝে নাক ডাকছে শব্দ করে। এও কি সম্ভব? ঘুমের ভিতরেও কি জেগে থাকে পৌরুষ- জেগে থাকে চির-অঙ্গটা? মনে করতে পারে না জরি। তার স্মৃতিতে এমন দৃশ্য একটিও নেই। নিঃশ্বাস পড়ছে তার দ্রুত বেশ শব্দ করে। হৃদপিন্ড চলছে প্রচন্ড বেগে। আস্তে হাত রাখে সে রোগীর কপালে। গা বেশ গরম। তার তো জ্বর ছিল না। এটা তবে কিসের জ্বর? নিজের অজান্তে ধীরে ধীরে তার হাত চলে যায় কপাল থেকে বুকে, বুক থেকে আরো আরো নীচে। সেখানে খপ করে ধরে ফেলে জরি প্রকম্পমান চির-অঙ্গটাকে- ধরে ফেলে ইচ্ছেটাকে নাগালের ভিতর। অত বড় জীবনটা তার কেন্দ্রীভূত হয়ে যায় ছোট্ট একটা বিন্দুর ভেতরে। মুহুর্তে হাজার বছরের লালিত সংস্কার ভেসে যায় তার জীবনের তীব্র স্রোতের তোড়ে। জীব হয়ে বাচার একমাত্র সান্তনা, একমাত্র তীব্র সুখ-ভোগের ভান্ডার তার নেশা ধরিয়ে দেয়।

পাপে নেশা ধরে জরির। নেশার ঘোরে সমাজ-সংসারের সজাগ চোখের তীক্ষ্ণ ভ্রুকুটি ফস্কে যাওয়া তীরের মতো তার গায়ের পাশ দিয়ে চলে যায়। আজকে বাণগ্রস্থ না হলেও আগামীতে যে সে বাণাহত হবে না এমন নিশ্চয়তা কে দেবে তাকে? গোপন পাপের কথা গোপন থাকে না একটুও। এখানে জরির আত্মীয় আছে, স্বজন আছে, স্বামী আছে, স্বামীর সুনাম আছে- তারপরেও পাপের বাতাস কানে কানে ঘুরে একটা তিব্র ঘুর্ণী সৃষ্টি হতে পারে এমন সংকেত আসতে দেরী হয় না তার কানে। যেমন দেরী হয় না তার দেহের খবর মাথায় পৌছাতে। দেহের ভেতরে তার নতুন প্রানের নড়াচড়া। মনে সে খবর আসার সাথে সাথে তার গোপন নেশার সব অভিসার বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে- নিজ হাতে সব ছিন্ন করে যেন নিজেকেই ফিরে পায় আবার। দ্বিখন্ডিত দুই সত্তা তার এক হবার চেষ্টা করে যায় নিজের ঘরে নিজের সংসারে আবার। কি এক ভয়াবহ বিস্ময়- মনটা তার স্বামীর দখলে ছিল, এখনো আছে, কিন্তু দেহটা কি এক ভয়ংকর নেশায় পড়ে অন্য কারো দখলে চলে যাচ্ছিল যেন। আবার ফিরে এসেছে সে নিজের কাছে। কিন্তু তার সন্তান? কি ভাবে স্বামীর কাছে, মানুষের কাছে তুলে ধরবে তাকে ওদের একজনের মত করে? তার পাপের সব দায় তার একার। তার জন্যে তার সন্তান অন্ততঃ দায়ী নয়। একদিন যেমন সন্তান না হওয়ার দায় ব্যথা সবই তার একার ছিল। সে দায় থেকে তাকে উদ্ধার করার কেউ ছিল না তখন, তবে সন্তান লাভের এ দায় থেকে কেন এখন তাকে উদ্ধার করার জন্য সবাই এতটা প্রস্তুত? সে কি শশা অথবা চাল কুমড়া- একটু পঁচন ধরলেই ভাগাড়ে? এসব নিয়ে আকাশ পাতাল ভাবে জরি। যে করেই হোক ঝড়ের ভিতরে সাঁতরে কুলে তাকে উঠতেই হবে।

শরীরে আর নতুন প্রানের চিহ্নগুলো গোপন রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই। জরি ততপর হয়- অন্তত তার স্বামীকে তো জানতে হবে সব। তা না হলে মরেও যে শান্তি নেই তার। লজ্জা আর অপমান সরাসরি বলার সব শক্তি তার কেড়ে নেয়। আকারে ইঙ্গিতে সন্তানের আগমনের বার্তা শুনে বাঁকা হাসি হাসে লিয়াকত- হেসে হেসে বলে, “ও তাই বুঝি”? সে হাসি যেন ছুরির ধারালো ফলার মত জরির হৃতপিন্ডটায় এফোড় ওফোড় হয়ে যায়। কেন সে সব বিস্তারিত জানতে চাইলো না? সব জেনে কেন একটা প্রচন্ড চড় কসিয়ে দিল না গালে? তার বদলে সেই আগের মতো হাসি, আগের মত কথা বলা- নিস্পাপ সাধারন। সব কিছুতে তার উদাসীনতার বদলে আছে নির্ভেজাল ভালবাসার অদ্ভুত গন্ধ। এমন কেন সে? সে কি সত্যিই দানব? নতুন প্রান শরীরে ধরে বিরামহীন জ্বলে জরি। তার বড় পাপকে ততোধিক বড় ক্ষমার আগুনে ক্রমাগত দহন করে চলেছে লিয়াকত। এমন ক্ষমা তার চাই না- এ যে বড় যন্ত্রনার।

যতো সহজে স্বামীর কাছে ক্ষমা পাওয়া যায়, বিরাট এই সংসারের কাছে তা অত সস্তায় পাবার নয়। বাইরে মানুষের মনে প্রচন্ড তাপ আর ঘরে স্বামীর বাঁকা হাসির খঞ্জর জরির রাতের ঘুম প্রায় কেড়ে নিয়েছে। অতন্দ্র কান তার এখন প্রায় প্রতিটি গভীর রাতেই শুনতে পায় ঘরের দরজায় ভারী কিছু পতনের শব্দ। চারদিকে তাপাহত মানুষের কথা চিন্তা করে ভীত হয় জরি- ভীত হয় জীবনের জন্যে, অনেক ত্যাগে পাওয়া সন্তানটার জন্যে। সেই রাতেই স্বামীকে জাগিয়ে ভয়ে ভয়ে বলে জরি- “চল, শিগগির আমরা দূরে কোথাও চলে যাই। অন্ততঃ আমার সন্তানটা বাঁচুক”। সাবধানী হয় জরি। চালকুমড়া বা শশার পরিণতি হওয়ার আগেই তার বিদায় জানাতে হবে এই ঘরকে, এই নদীকে। তাই জ্বালামুখ বন্ধ হয়ে যাওয়া আগ্নেয়গীরিতে বিস্ফোরন ঘটার আগেই সবার অগোচরে সরে পড়ে জরি আর তার স্বামী তাদের কর্নফুলির কোল ঘেষা ছোট্ট বাসাটা ছেড়ে। জরির স্বামী চাকুরী নেয় দূরের এক শহরে। জরির এখন নতুন জীবন। নতুন জীবনে তার নতুন সন্তান। সেই সন্তানের মুখে আধো আধো নতুন শব্দ, নতুন কথা। পায়ে পায়ে তার হাটার পতপত নতুন শব্দ। এখন তারা আর ব্যচেলর নয়। বাড়ীটা এখন তাদের অনেক বড়- সেখানে নেই কোন গুমোট নির্জনতা। ছুটির দিনের কর্মহীন সকালের অবসর। বড় প্রশস্ত ব্যলকনিতে এক চিলতে রোদ্দুর এসে পড়েছে- সকালের সোনালী রোদ্দুর। বাপের হাত ধরে কালো মেয়েটা সেই রোদ্দুরে খেলছে- খিলখিল হেসে গলে পড়ছে বাপের কোলে বারবার। সে দৃশ্য জানালার ফাঁক দিয়ে অপলক দেখে জরি। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে- বুঝতে পারে, মেয়ের বাপের কাছ থেকে বিরামহীন তার শাস্তি পাওয়াটা এবার বুঝি শেষ হলো- একটা বড় ফাড়া কাটলো তার। আরো বুঝতে পারে- সন্তানকে কেন বলে বংশধর। সন্তান সত্যিই বংশ ধরে রাখে, বাচিয়ে রাখে জনক-জননীদের কাল থেকে কালান্তরে অমরতার টক-ঘোল স্বাদে- তা সে সন্তান যে ভাবেই পাওয়া হোক। কর্ণফুলীর পাড়ের মতো এখানেও প্রতিবেশীরা বেড়াতে আসে তাদের ঘরে। তাদের চোখে মুখেও থাকে অনেক প্রশ্ন। মেয়েটা অমন কালো কেন? দেখতে বাবা-মা কারো মতো নয় কেন বাচ্চাটা? এমন অনেক অনুসন্ধানী প্রশ্ন বিরামহীন শুনতে হয় জরির। এসবের তেমন কোন যুতসই জবাব দিতে পারে না সে। প্রশ্নাহত নিরুত্তর চোখ দুটো তার অপ্রস্তুত হয়ে নিজের সন্তানের দৃষ্টিতে গিয়ে আটকে যায়, যেখানে সে দেখতে পায় চির-প্রত্যাশিত অমরতার নির্লঙ্ঘ প্রতিশ্রুতি।