অনেক দিন আগে এক সরকারী কর্মকর্তার সাথে আলাপের সুযোগ হয়েছিল। ভদ্রলোক বাংলাদেশের পশ্চাৎপদতা নিয়ে স্পষ্টতই খুব হতাশ ছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন, ‘এই জাতির কোন উন্নতি হবে না। মুসলমানদের রক্ত গরম। নইলে দেখেন, নজরুল এত মেধা থাকার পরও নোবেল জিততে পারল না। নজরুল আর রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাশাপাশি পইড়া দেইখেন। তাইলেই বুঝতে পারবেন, কি আকাশ-পাতাল তফাত। কারণ আর কিছু না। ঐ যে মাথা গরম! না হলে, নজরুলরে আল্লাহ পাক যে মেধা দিছিল, সে তা ঠিকঠাক ব্যবহার করলে, রবীন্দ্রনাথ তার ধারে-কাছেও ঘেঁষতে পারত না।‘

বলা দরকার, ঐ সরকারী কর্মকর্তা কিন্তু ধার্মিক মুসলমান ছিলেন। তাহলে, তার ভিতর এই মুসলিম বিদ্বেষ বা আরও স্পষ্ট করে বললে নজরুল বিদ্বেষ কেন? গভীরভাবে চিন্তা করলে প্রতীয়মান হয়, আসলে লোকটির ভিতর কোন মুসলিম বা নজরুল বিদ্বেষ ছিল না। আমরা প্রায়শই অনেক বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের নিয়ে আক্ষেপ করতে দেখি, ‘ব্রেন তো আল্লাহপাক কম দেয় নাই, শুধু যদি একটু মনোযোগী হইত..’। নজরুলকে নিয়ে ঐ কর্মকর্তার আক্ষেপ অনেকটা ওরকমই মনে হয়। উনি নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের তুলনায় আপন মনে করেন, কিন্তু কেন সে তার মেধার সদ্ব্যবহার করে নোবেল ছিনিয়ে আনতে পারল না, তা নিয়েই তার যত আক্ষেপ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, নজরুলকে নিয়ে ঐ কর্মকর্তার মূল্যায়ন কি সঠিক? সোজাসুজি উত্তর হল, না। সত্যি বলতে কি, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ কাউকেই মূল্যায়ন করার যোগ্যতা বা সাহিত্যিক বোধ তার নেই। তার চিন্তা-ভাবনা বরং নানাবিধ সংকীর্ণতায় বন্দী। নজরুল ও রবীন্দ্রনাথ দুজনেই পশ্চিমবঙ্গে জন্মেছেন এবং বাংলা সাহিত্যে যে যার অবস্থানে স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল। দুজনেই বাংলার প্রধান দুধর্মের মানুষের জীবনকে তুলে এনেছেন সাহিত্যে। কিন্তু তবু আমাদের আলোচিত সরকারী কর্মকর্তা নজরুলকে যে আপনার লোক মনে করেন আর রবীন্দ্রনাথকে মনে করেন পর, তার কারণ আর কিছুই নয়, লোকটির ধর্ম-কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র জাতীয়তা-বোধ। দুঃখের বিষয় হল, এমন জাতীয়তা-বোধে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা আমাদের দেশে নেহাত কম নয়! ঘটা করে রবীন্দ্রনাথে জন্ম-মৃত্যু দিবস পালন বা রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পাওয়ায় তারা সর্বদাই মনোবেদনায় ভোগেন।

কথা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ কি সত্যি আমাদের নন? মনে পড়ছে, প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের কথা, যিনি মৃত্যুর কয়েক মাস পূর্বে রবীন্দ্রনাথকে বাংলাদেশ বিরোধী আখ্যায়িত করেছিলেন এই যুক্তিতে যে, রবীন্দ্রনাথ নাকি পূর্ববঙ্গের (আজকের বাংলাদেশ) প্রতি বিরাগ থেকেই শান্তিনিকেতন এখানে না করে পশ্চিমবঙ্গে প্রতিষ্ঠা করেন! একই কারণে নাকি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন! সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, একই ঘরানার বুদ্ধিজীবীগণ আরেকটি দাবী করেন যে, রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি লিখেছেন বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে, যাতে পূর্ববঙ্গের প্রতি লোক দেখানো ভালবাসা প্রকাশ করা হয়েছিল শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষার তাগিদে! এইসব দাবীর অসারতা নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু সেসব লেখা সংকীর্ণতার দেয়াল ভেদ করতে সক্ষম হচ্ছে না কিছুতেই! তবে নিন্দুকেরা একটি বিষয় বেমালুম ভুলে যান, তা হল, রবীন্দ্রনাথের সাথে আজকের বাংলাদেশের যে এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে এবং তা যে কিছুতেই ঘুচবার নয়।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের দিকটি সবচেয়ে ভালভাবে তুলে ধরেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রমথনাথ বিশী। তার মতে, রবীন্দ্রনাথ যদি বাংলাদেশের শিলাইদহ, সাজাদপুর বা পতিসরের জমিদারিত্ব না পেয়ে ভারতের কোন অনুর্বর জায়গার জমিদারিত্ব (বাংলা ছাড়া ভারতবর্ষের আরও কিছু জায়গায় ঠাকুর পরিবারের বিশাল ভূসম্পত্তি ছিল) পেতেন, তাহলে তিনি হয়ত বাংলা ভাষার বড় কবি হতেন, কিন্তু বিশ্বকবি হতেন না। প্রমথনাথ বিশীর মতে, বাংলাদেশের পদ্মা নদী রূপে-গুনে-চরিত্রে বিশ্বের একটি অনন্যসাধারণ নদী, যে কিনা অপেক্ষা করছিল বিশ্বের একজন অনন্যসাধারণ কবির সাথে মিলিত হবার জন্য। তার মতে, রবীন্দ্রনাথের অক্ষয় কীর্তি ‘ছিন্নপত্রের’ নায়িকা পদ্মা আর নায়ক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ!

রবীন্দ্রসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার ছোট গল্প। আর তার সেরা ছোটগল্পগুলোর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে আজকের বাংলাদেশ। ১৯৩৬ সালে ভারতের ফরোয়ার্ড পত্রিকায় দেয়া এক সাক্ষাতকারে রবীন্দ্রনাথ নিজেই আমাদের জানাচ্ছেন,

ছোটগল্প আমি লিখতে শুরু করেছিলুম একেবারে যৌবনে। জমিদার হওয়ার কারণে আমাকে গ্রামে যেতে হতো আর এর ফলে আমি গ্রামের মানুষের আর তাদের সাধারণ জীবন-যাপনের সংস্পর্শে আসতে পেরেছি। উপভোগ করতুম গ্রামবাংলার আপন সৌন্দর্য আর আশেপাশের দৃশ্য।এই প্রদেশের শ্রেষ্ঠে অংশ নদীমাতৃক বাংলাদেশ আমাকে মুগ্ধ করেছে এবং এই নদীগুলোকে আমি ভাল করেই চিনি। যেসব মানুষের জীবন আমি দেখেছি তা আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। কলকাতায় জন্মগ্রহণ আর সেখানে বড় হওয়ায় প্রথমত গ্রামের জীবনের সাথে আমি একেবারেই অপরিচিত ছিলাম। আর সে কারণে আমার কাছে এটা একটা রহস্যময় ব্যাপার ছিল। তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আসার পর থেকেই আমার সমগ্র হৃদয় গ্রামের মানুষের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তাদেরকে মনে হয়েছে ভিন্ন এক জগতের মানুষ, কলকাতা থেকে খুবই আলাদা। আমার প্রথমদিককার গল্পগুলোয় এই পটভূমি রয়েছে আর সেগুলোতে গ্রামের মানুষের সাথে আমার যোগাযোগের কথা আছে, তাদের মধ্যে যৌবনের একটা সজীবতা রয়েছে। এই গল্পগুলো লেখার আগে বাংলা সাহিত্যে এ ধরণের কিছু ছিল না।

অথচ নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা ঘিরে ধরাতে রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের গল্পগুলো তার নিজের কাছেই ঠিক সেরকম মর্যাদা পায়নি,

আমি অনুকূল পরিবেশ বেশ পছন্দ করি এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কোনও বিশেষ আবহে আসছি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনও শৈল্পিক কাজ করতে পারি না। যৌবনে আমি যা কিছু দেখতাম তা-ই আমার কাছে বেশ গভীর বেদনা নিয়ে হাজির হতো আর তাই আমার প্রথমদিককার গল্পগুলোর স্বতঃস্ফূর্ততার কারণে একটা বড় ধরণের সাহিত্যমূল্য রয়েছে। কিন্তু এখন তো ভিন্ন রকম। আমার শেষদিকের গল্পগুলোতে টেকনিকটা বেশ আছে বটে কিন্তু আমি ভাবি যদি আমার আগের জীবনে একবার ফিরে যেতে পারতাম।

এভাবেই তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে ‘অনুকূল পরিবেশ’ যুগিয়েছে, দান করেছে শৈল্পিক কাজ করার আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। তাইতো রবীন্দ্রনাথ তার গীতাঞ্জলীর ইংরেজি অনুবাদ (যা তাকে এশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী সাহিত্যিক বানিয়েছিল) করার জন্য কোন এক ছুটিতে চলে আসেন এই বাংলাদেশের শিলাইদহে। শিলাইদহের জমিদারী পাট চুকে যাবার পরও সময় পেলেই পূর্ববঙ্গে এসেছেন। প্রমথনাথ বিশীর মতে, পূর্ববঙ্গ ও পদ্মা শেষ জীবন পর্যন্ত তার সাহিত্যে বিশাল প্রভাব ফেলেছে।

সুতরাং, এ ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে না যে, তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, এই দান কি একতরফা? রবীন্দ্রনাথ কি কিছুই দেননি বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মানুষকে? বস্তুত রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্য-সম্ভারের দিকে তাকালে দেখা যায়, এর একটা বড় অংশের সাথেই জড়িত রয়েছে বাংলাদেশের পরিবেশ-প্রকৃতি-মানুষ।

এ কথা বলা খুব অযৌক্তিক শোনাবে না যে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন প্রকৃতিকে ডাকার ভাষা। শিলাইদহে রচিত তার অমর একটি গানের দিকে লক্ষ্য করা যাক:

আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়
লুকোচুরির খেলা।
নীল আকাশে কে ভাসালে
সাদা মেঘের ভেলা।
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে,
উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে,
আজ কিসের তরে নদীর চরে
চখাচখির মেলা।
ওরে যাবো না আজ ঘরে রে ভাই,
যাবো না আজ ঘরে!
ওরে আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ
নেব রে লুঠ করে।
যেন জোয়ার জলে ফেনার রাশি
বাতাসে আজ ফুটেছে হাসি,
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি
কাটবে সারা বেলা।

উপরের গানটির যে বর্ণনা তা বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশের হতে পারে? আর বাংলাদেশের এই চিরন্তন প্রকৃতি রবীন্দ্রনাথের হাতেই কি সবচেয়ে বেশী প্রাণ পায়নি?

রবীন্দ্রনাথ চলন-বিলে ঝড়ের মুখে বোটে বসে রচনা করেন নীচের গানটি:

তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা
মম শুন্যগগণ বিহারী
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা-
তুমি আমারি, তুমি আমারি,
মম অসীমগগন বিহারী।।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা, তুমি আমার সাধের সাধনা

প্রেম-পূজার এমন অনবদ্য ও অনির্বচনীয় ভাষা আমদের জন্য রবীন্দ্রনাথের এক অবিস্মরণীয় অবদান নয় কি? আমরা যদি বাঙ্গালি হয়ে থাকি, তাহলে কি করে এমন সম্পদকে এড়িয়ে যেতে পারব? আমরা যদি বাংলা ভাষাতে ছাড়তে না পারি, তাহলে রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়া সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে, কারণ বাংলা ভাষার তাজমহলে মহামূল্যবান পাথর হয়ে পরতে পরতে গেঁথে রয়েছে রবীন্দ্রনাথে শব্দ, চিন্তা, আর আবেগ!

এই সময়ের বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি জয় গোস্বামী এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ হলেন দিনের বেলার তারার মত বাস্তব। দিনের সূর্যের প্রভাবে তার চেয়েও বড় নক্ষত্রদের আমরা দেখতে পাইনা সত্যি, কিন্তু তাই বলে সেইসব নক্ষত্ররা অবাস্তব হয়ে যায় না আমাদের কাছে। একইভাবে বলা যেতে পারে, আজকের বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে আমরা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি না সত্যি, কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে বিরাজ করছেন দিনের বেলার নক্ষত্রদের মতই। তার অস্তিত্ব এক অবশ্যম্ভাবী সত্য আমাদের জাতীয় জীবনে।

বস্তুতু, রবীন্দ্রনাথ যেমন পূর্ববঙ্গ ও আজকের বাংলাদেশের কাছে ঋণী, তেমনি আমরা বাংলাদেশিরাও সমান ঋণী তার কাছে।এই পারস্পরিক ঋণ আমাদের উভয়কে (রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ) এক চিরকালীন আত্মীয়তার সম্পর্কে বেঁধে রেখেছে, যাকে কখনোই বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়।

তথ্যসূত্র:
১.শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ, প্রমথনাথ বিশী
২.কথোপকথন, রাজু আলাউদ্দিন
৩.উইকি ও অন্যান্য ইন্টারনেট উৎস