এই লেখাটি যারা পড়ছেন তাদের মধ্যে বোধকরি এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি কোনো পুরোনো দেয়ালের মধ্যে মানুষের মুখাবয়ব আবিষ্কার করেন নি, কিংবা মেঘের দলার মাঝে ঘোড়ার ছবি দেখেন নি অথবা আধো অন্ধকারে কোনো অবয়ব দেখে ভুত দেখেছেন বলে চমকে ওঠেন নি। অনেকেই হয়তো নির্জন ঘরে ফিসফাস শব্দ শুনেছেন (সেখান থেকে বিশেষ বিশেষ শব্দার্থও বের করে ফেলেছেন) এবং ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন সেটা বাতাসের শব্দ। কখনো কখনো টেলিফোনের রিংও শুনে থাকবেন যদিও ঘরে হয়তো কোনো টেলিফোনই নেই। সম্পুর্ণ বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত বিষয় থেকে অর্থপূর্ণ কোনো ইঙ্গিত খুঁজে নেয়ার এই প্রবণতার নামই হল প্যারিডোলিয়া (Pareidolia)।

Pareidolia শব্দটি দুটি গ্রীক শব্দ para (পরিবর্তিত, পাশাপাশি) এবং eidolon (ছবি, আকৃতি) নিয়ে গঠিত। এই বৈশিষ্ট্যের সবচেয়ে সাধারণ প্রভাব হচ্ছে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত নকশার মধ্যে মানুষের মুখাবয়ব খুঁজে পাওয়া। নিচে কয়েকটি উদাহরন দেয়া হল:

উপরের প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে মানব মুখের অবয়ব পাওয়া যায়

প্যারিডোলিয়া আত্মরক্ষার একটি কৌশল যা বিবর্তনের ধারায় মানুষের মধ্যে উৎসাহিত হয়েছে। মূলত জন্মলগ্ন থেকেই মানুষের মধ্যে অপর মানুষের মুখাবয়ব চিনে নেয়ার একটা প্রবণতা তৈরি হয়। একটি শিশুর জন্মের দুদিনের মধ্যেই সে অন্যান্য মানুষের বিভিন্ন মুখভঙ্গি শনাক্ত করা এবং সেগুলো অনুকরন করা শিখে ফেলে। শিশুর বয়স যখন সাতমাস হয় তখন সে একটি ভীতিপূর্ণ মুখভঙ্গী এবং একটি হাসিখুশী মুখভঙ্গীর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে এবং ভীতিপূর্ণ মুখভঙ্গীর প্রতি বেশী মনোযোগ দেয় যা তাকে বিপদ-আপদ থেকে সতর্ক থাকার অভ্যাস তৈরি করে দেয়। ধীরে ধীরে শিশুর সামাজিকীকরন ঘটে এবং শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছু বুঝে ফেলার ক্ষমতা তৈরি হয়। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরী একটি বৈশিষ্ট্য। চেহারা সনাক্তকরন যথেষ্ট জটিল একটি প্রক্রিয়া এবং এই কাজে মস্তিষ্কের বিরাট একটি অংশ ব্যবহৃত হয়। ২০০৯ এর এক গবেষণা থেকে দেখা যায় মুখমন্ডলের সাথে মিল পাওয়া যায় এমন যে কোনো বস্তু মস্তিষ্কের কর্টেক্সে অত্যন্ত দ্রুত উদ্দীপনা তৈরি করে এবং বস্তুটিকে দ্রুত(অন্য অনুভূতি আসার আগেই ) মুখমন্ডল হিসেবে সনাক্ত করতে সহায়তা করে। এই কারনেই কয়েকটি বৃত্ত ও রেখায় সমন্বয়কে আমরা মানুষের চেহারা হিসেবে ধরে নিই। শুধু তাই নয়, কয়েকটি রেখার সমন্ধয়ে মানুষের অনেক রকম অভিব্যক্তি প্রকাশ করা সম্ভব যদিও বাস্তব চেহারার সাথে সেই সব রেখা সমষ্টির কোনো মিলই থাকে না। নিচের ছবি দুটি লক্ষনীয়।

তিনটি বৃত্ত ও একটি সরলরেখা দ্বারা মানুব মুখাবয়ব বোঝা যাচ্ছে।

কয়েকটি রেখা, বৃত্ত ও বিন্দুর সমন্বয়ে বিভিন্ন রকম মৌখিক অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।

ধর্মে ব্যাবহার:
প্রায় প্রত্যেকটি বড় ধর্মই প্যারাডোলিয়ার মাধ্যম্যে অলৌকিকত্ব(!) প্রদর্শন করে থাকে। সাধারণ মানুষ প্রকৃত ব্যপারটি ধরতে না পেরে সেগুলোকে মিরাকল মনে করে থাকে। অথচ একটু সচেতন হলে দেখতে পেত প্রত্যেকটি ধর্মেরই এ ধরনের নিদর্শন রয়েছে। নিচে কিছু উদাহরণ দেয়া হল:

১. ইসলাম ধর্ম: আজকাল প্রায়শ:ই ফেসবুক বা ব্লগে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তুর আরবীতে আল্লাহ (الله) লেখা দেখানো হয় এবং সেগুলোকে মিরাকল বলে প্রচার করা হয়। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আরবী বর্ণগুলো বেশ সরল প্রকৃতির এবং আরবী ক্যালিগ্রাফী অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। যার ফলে একই বর্ণ বিভিন্ন আকৃতিতে লেখা যায়। এই কারনে কয়েকটি লাইন এবং লুপের মাধ্যমেই কোনো লেখা ফুটিয়ে তোলা যায়। নিচে কয়েকটি উদাহরন দেয়া হল:


মাঝে মধ্যে প্রতারণার আশ্রয় নেয়া হয়। যেমন নীচের ছবিটিকে জার্মানির একটি খামারের ছবি হিসেবে প্রচার করা হয় (যদিও সেই খামারের ঠিকানা কোথাও দেয়া হয় না) যেখানে আরবীতে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ” লেখা রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটি একজন মিশরীয় চিত্রশিল্পীর আঁকা একটি তৈলচিত্র।

২. খ্রীষ্ট ধর্ম: খ্রীষ্ট ধর্মে মীরাকল হিসেবে প্রায়ই কুমারী মেরি কিংবা যীশুর ক্রুশবিদ্ধ ছবি দেখানো হয়ে থাকে। নিচের কয়েকটি নমুনা দেখুন:

হিন্দু ধর্ম: হিন্দু ধর্মের ও’ম প্রতীকটি বিভিন্ন সময় সনাক্ত করা হয়েছে। যেমন:

২০০৭ সালে সিঙ্গাপুরে monkey tree phenomenon নামের একটি ঘটনা আলোচিত হয়ে যায়। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা গাছের মধ্যে হনুমানসদৃশ অবয়ব আবিস্কার করেন এবং পরবর্তীকালে গাছটিকে পুঁজো করা শুরু হয়।

কিছু বিশেষ ঘটনা:

১৯৫৪ সালে কানাডিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংক রাণী এলিজাবেথের ছবি সংবলিত একটি পাঁচ ডলারের নোট প্রকাশ করে। কিন্তু নোটটি বাজারে আসার পর থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অভিযোগ আসতে থাকে যে নোটটিতে রানীর চুলের একটা অংশে শয়তানের অবয়ব ফুটে আছে। আপত্তির মুখে এক পর্যায়ে ব্যাংকটি পাঁচ ডলারের বিলটির সবগুলো নোট নষ্ট করে ফেলে এবং নতুন ডিজাইনের নোট বাজারে ছাড়ে।

২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বিমান হামলায় সৃষ্ট ধোঁয়ায় অনেকেই শয়তানের অবয়ব খুঁজে পেয়েছিলেন।

এসব ছাড়াও প্রকৃতিতে প্যারিডোলিয়ার নানাবিধ উপকরন ছড়িয়ে আছে। পোস্ট আর ভারী না করে google image search এর লিংকটি দিয়ে দিচ্ছি। সবাই দেখে নিন।

তথ্যসূত্র:

A.L Bouhuys et al, Journal of Affective Disorders, 43, 1997, 213–223
http://en.wikipedia.org/wiki/Pareidolia
http://www.weird-encyclopedia.com/pareidolia.php

http://en.wikipedia.org/wiki/Face_perception
http://www.planetperplex.com/en/item/canada-5-dollars/
http://www.september11news.com/Mysteries1.htm
http://www.faithfreedom.org/Articles/sina/miracles_of_allah.htm