জীবনের গল্পের শুরুর দিকের কাহিনী ভুলে গেছেন নিশ্চয়। সেটাই স্বাভাবিক, সমস্যা নাই, একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। মানুষসহ যেকোন জীবের জীবনের রহস্য লুকিয়ে আছে কোষের মাঝে, যা আবিষ্কার করেছিলেন রবার্ট ব্রাউন সেই ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এর ২০০ বছর পর গ্রেগর জোহান মেন্ডেল নামের এক ধর্মযাজক ১৮৬৫ সালে মটরশুটি চাষের মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানসম্মত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তত্ত্ব প্রদান করেন যে, প্রজাতির বংশানুক্রমিক বৈশিষ্ট্যের জন্য ‘জীন’ দায়ী। প্রতিটা বৈশিষ্ট্যের জন্য এই জীনের ২টা অংশ থাকে – একটা অংশ আসে মায়ের কাছ থেকে, আরেকটা বাবার কাছ থেকে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, মেন্ডেল কিন্তু স্বচক্ষে জীন দেখেননি, বরং যা বংশগতির বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তারই নাম দিয়েছিলেন জীন। এরও প্রায় ৫০ বছর পর বিজ্ঞানী মরগ্যান বের করলেন যে, জীন অর্থাৎ বংশগতির ধারক থাকে কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ক্রোমোজোমের ভিতরে। মা ও বাবার ক্রোমোজোমের মধ্যে ক্রস-ওভারের ফলে সন্তান-সন্ততিরা মিশ্র বৈশিষ্ট্য পেয়ে থাকে।

জীনের কাজ কি তা বের হলো যেভাবে

যে কথা বলছিলাম, ১৯৪০ সালের শুরুর দিকেও বিজ্ঞানীরা জানতেন না জীন কী দিয়ে তৈরি, এর কাজই বা কি। একে একে নানান মজার মজার ছোট ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার মাধ্যমে জেনেছেন তারা। এমনই এক মজার পরীক্ষার মাধ্যমে বিডল আর ট্যাটম জীনের কাজ কি তা বের করেছেন ১৯৪১ সালে। তাদের পরীক্ষা Neurospora নামের রুটির ছত্রাক নিয়ে। এই ছত্রাক কেবল চিনি (সুক্রোজ) আর লবণ পেলেই বেঁচে থাকতে ও বংশ বৃদ্ধি করতে পারে। এই দুই বিজ্ঞানী করলেন কি, ছত্রাকের উপর এক্স-রে ফেললেন। তাতে হলো কি, ছত্রাকের বংশবৃদ্ধি থেমে গেল। এতে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, এক্স-রে নিশ্চয় এমন কোন জীন মেরে ফেলেছে যা বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করতো। এখানেই তারা থামলেন না। তারা জানতেন যে, চিনি আর লবণ থেকে অ্যামিনো এসিডসহ জীবের পুষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তৈরি করার জন্য যে ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া প্রয়োজন, তা করা যায় প্রোটিন বা এনজাইমের সাহায্যে। তাই তারা বংশবৃদ্ধি বন্ধ হওয়া ছত্রাককে ভিটামিন বি-৬ খাওয়ালেন। আশ্চর্যের সাথে লক্ষ করলেন যে, ছত্রাকগুলো কেবল পুনরায় বংশবৃদ্ধি শুরু করেনি, বৃদ্ধির হারও অনেক বেড়েছে। এর সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা ছিল এমন – এক্স-রে নিশ্চয় এমন কোন জীন মেরে ফেলেছে যা ভিটামিন বি-৬ সংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন তৈরি করতো। সব মিলিয়ে মানে দাঁড়াল, জীনের কাজ হচ্ছে প্রোটিন তৈরি করা! এত সহজ আর মজার পরীক্ষার মাধ্যমে তারা আবিষ্কার করে ফেললেন জীবনের অন্যতম এক সত্য। এ কাজের জন্য তারা ১৯৫৮ সালে নোবেল প্রাইজও পেয়ে গেলেন।

উপেক্ষিত ডিএনএ’র জীন-গবেষণায় অন্তর্ভূক্তি

আজকাল বিজ্ঞান সম্বন্ধে সামান্যতম ধারণা আছে কিংবা নেই, কিন্তু ডিএনএ’র নাম শোনেনি এমন লোক পাওয়া বোধ হয় দুষ্কর। বেশিরভাগই হয়তো এ সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানে না, তবে “ডিএনএ টেস্ট করলেই সব জানা যাবে!” এ ধরনের জ্ঞানগর্ভ উক্তিদাতার খুব একটা অভাব দেখা যায় না! এই ডিএনএ ১৮৬৯ সালে আবিষ্কৃত হলেও জীন গবেষণায় উপেক্ষিত ছিল প্রায় ৭৫ বছর। কেন এই উপেক্ষা? দাঁড়ান, বলছি। শ্বেত রক্তকণিকার নিউক্লিয়াস থেকে ফ্রেডরিক মিশার এক ধরনের বস্তু আলাদা করেছিলেন, যার নাম দিয়েছিলেন নিউক্লিন। পরবর্তীতে এর নাম হয় ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড বা সংক্ষেপে ডিএনএ। বিংশ শতকের শুরুর দিকে বিজ্ঞানীরা জানলেন যে, ডিএনএ আসলে একটা অনেক বড়-সড় অণু, যা তৈরি চিনি, ফসফেট এবং অ্যাডেনিন (সংক্ষেপে A), থাইমিন (T), গুয়ানিন ( G) আর সাইটোসিন (C) নামক চার ধরনের ক্ষার দিয়ে। A,T,G,C এই চার ধরনের ক্ষারের ভিন্ন ধরনের সন্নিবেশের কারণেই একেকটা ডিএনএর স্বাতন্ত্র্য। বিজ্ঞানীরা একটু ভুল করলেন এই সন্নিবেশ ধরতে। তারা শুরুতে একে অন্যান্য পলিমার অণুর মতো বিবেচনা করলেন, যেখানে একই প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি ঘটে বারবার। যেমন ACTGAACTGAACTGA – তে ACTGA প্যাটার্নটি আছে ৩ বার। একই প্যাটার্নের অতি সাধারণ পুনরাবৃত্তিসম্পন্ন ডিএনএ এত বৈচিত্রময় জীবনবৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে পারে না – এই ভেবে বিজ্ঞানীরা নজরই দিলেন না এই মহাগুরুত্বপূর্ণ অণুটির উপর। অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো ১৯৪৪ সালে যখন অসওয়াল্ড অ্যাভেরি এবং তার দুই সহকর্মী ম্যাকলিউড আর ম্যাককার্টি প্রমাণ করলেন যে, ডিএনএর ভিতরেই জীনের অবস্থান!

অ্যাভেরিদের পরীক্ষাটাও মজার। তারা ব্যাক্টেরিয়া থেকে বিভিন্ন জৈব পদার্থ সরিয়ে ফেলার কৌশল ব্যবহার করলেন তাদের পরীক্ষায়। Streptococcus pneumoniae নামের এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়া আছে। নামের ২য় অংশ দেখেই আশা করছি বুঝে গেছেন যে, এটি নিউমোনিয়ার অন্যতম কারণ। এই ব্যাক্টেরিয়ার ২টা রূপ আছে – মসৃণ আর অমসৃণ, নিচের ছবির মতো।

চিত্র ১: মসৃণ ও অমসৃণ S. pneumoniae
Dr. Harriet Ephrussi-Taylor এর গবেষণার ছবি, সৌজন্যে: The Rockefeller University

অমসৃণ থেকে মসৃণ রূপে রূপান্তর হলেই রোগ দেখা দেয়। অ্যাভেরিদের আগে বিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে, জীন আছে প্রোটিনের ভিতর। তাই তারা শুরুতে এই ব্যাক্টেরিয়া থেকে প্রোটিয়েজ ব্যবহার করে সকল প্রোটিন ধ্বংস করে ফেললেন। কিন্তু তাতে রোগ সারলো না, অর্থাৎ অমসৃণ থেকে মসৃণ রূপে রূপান্তর চলতেই থাকলো। তার মানে, অমসৃণ থেকে মসৃণে রূপান্তরের জন্য যে তথ্য দরকার, তা প্রোটিনের ভিতরে থাকে না, থাকলে তো প্রোটিন ধ্বংসের সাথে সাথে এই রূপান্তর বন্ধ হয়ে যেত। এরপর তারা ডিএনএ ধ্বংসকারী এনজাইম দিয়ে সকল ডিএনএ ধ্বংস করে ফেললেন। এবং তাতে রোগ সেরে গেল। এতে প্রমাণ হয়ে গেল যে, জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যাদি ডিএনএর ভিতরেই ছিল, যে কারণে ডিএনএ ধ্বংসের সাথে সাথে অমসৃণ থেকে মসৃণ কোষে রূপান্তর বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যভাবে বললে, জীন অর্থাৎ বংশগতির তথ্যাদি আছে ডিএনএর ভিতরেই।

তবে কেন যেন এত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের পরেও এই তিন বিজ্ঞানীর কেউ নোবেল পুরস্কার পাননি। ব্যাপারটা একটু অবাক হওয়ার মতোই।

ডিএনএতেই জীনের অবস্থান – আরো এক প্রমাণ

কোন ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে তা নিয়ে যত পরীক্ষা করাই হোক না কেন, ফলাফল হবে সেই একই, তাই না? তবে আগের ভুল ধারণা মুছে দিতে হলে কেবল একটা পরীক্ষায় পাশ করলেই হয় না, বরং নানান ধরনের পরীক্ষায় পাশ করতে হয়, এতে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় জোরালো ভাবে। জীন থাকে প্রোটিনের ভিতর – অনেক দিনের এ ধারণা মুছে দিতে হার্শেচেস এক পরীক্ষা করেছিলেন। এ পরীক্ষায় তারা ব্যবহার করেছিলেন ভাইরাস ও ব্যাক্টেরিয়া। কিছু ভাইরাস আছে যারা ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে, এদেরকে বলে ব্যাক্টেরিওফেজ বা সংক্ষেপে ফেজ। ফেজগুলো ব্যাক্টেরিয়াকে আক্রমণ করে এর ভিতর ঢুকে বংশবৃদ্ধি করে। ফেজ ভাইরাসের গঠন সহজভাবে বুঝাতে চাইলে বলতে হয়, এর খোলস অংশ (মাথা, কলার ও লেজের বাইরের অংশ) প্রোটিন দিয়ে তৈরি, আর মাথার ভিতরে থাকে ডিএনএ, নিচের ছবির মতো।

চিত্র ২: ব্যাক্টেরিওফেজের গঠন

হার্শে আর চেস করলেন কি, কিছু ফেজ ভাইরাসের প্রোটিনসহ খোলসকে তেজস্ক্রিয় সালফার (35 S) দিয়ে চিহ্নিত করে দিলেন, যাতে প্রোটিনের চলাফেরা/গতিপথ ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। একইভাবে কিছু ভাইরাসের ডিএনএকে তেজস্ক্রিয় ফসফরাস (32 P) দিয়ে চিহ্নিত করে দিলেন। এরপর দেখতে লাগলেন ফেজগুলোর আক্রমণ প্রক্রিয়া।

চিত্র ৩: হার্শে ও চেসের পরীক্ষা

তারা দেখলেন যে, ফেজগুলো ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণের সময় ফেজের খোলস (প্রোটিন) অংশ ব্যাকটেরিয়ার ভিতরে ঢুকেনি, কিন্তু ডিএনএ অংশ ভিতরে ঢুকেছে। এরপর দ্রতগতিতে নাড়িয়ে মিশ্রণ তৈরি করলেন যেন ব্যাক্টেরিয়ার গায়ের বাইরের দিকে লেগে থাকা খোলসগুলো গা থেকে খসে যায় এবং শেষমেশ খসে যাওয়া খোলস আলাদা করে ফেললেন। এতে বাইরের প্রোটিন আলাদা হয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু ব্যাক্টেরিয়ার ভিতরে ঢুকে যাওয়া ফেজের ডিএনএ ব্যাক্টেরিয়ার ভিতরেই রয়ে গেল। কিন্তু এরপরেও দেখা গেল যে, ফেজ ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি ঠিকমতোই হচ্ছে। অর্থাৎ, প্রোটিন না থাকার পরেও কেবল ডিএনএ থাকার ফলেই বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। তার মানে, বংশগতির বৈশিষ্ট্যগুলো প্রোটিন নয়, বরং ডিএনএতেই ছিলো; না হলে তো আর বংশবৃদ্ধি ঘটতো না।

এসব মজার মজার বুদ্ধিদীপ্ত গবেষণাগুলোর কারণেই জীবনের গল্প আজ এত সমৃদ্ধ! তবে, গল্পের কাহিনী যে আরো কিছু বাকি রয়ে গেল, সে কারণে দুঃখিত।

রেফারেন্স:
১) Neil C. Jones and Pavel A. Pevzner, Introduction to Bioinformatics Algorithms
২) Stuart M. Brown, Essentials of Medical Genomics