আমরা সবাই মোটামুটি কম-বেশি মিথ্যা বলি। একেবারে সাধু-সন্ন্যাসী না হলে একদমই মিথ্যা বলিনা এই রকম মানুষ পাওয়া আসলেই খুব কঠিন। এমনকি আমাদের মাঝে এই বিশ্বাসও বেশ প্রবল যে আসলে কিছু সময়ে মিথ্যে বলাটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। কিংবা মনে করি দুই-একটা নিরীহ মিথ্যা-যেমন ধরেন, ধানমন্ডীর জ্যামে বসে আমি এখন শাহবাগ মোড়, এই টাইপ মিথ্যা বললে আসলে কোন ক্ষতি নাই। কিন্তু আসলেই কি তাই?

 

স্যাম হ্যারিসের ‘লায়িং’ বইটি পড়ছিলাম। সত্য-মিথ্যা বিষয়ক এরকম অনেক পরিচিত প্রশ্নের উত্তরই দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বইটিতে। বইয়ের সাইজ অনেকটা আমাদের সদ্যপ্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ-এর বইয়ের মত, এক বসায় শেষ করে দেয়া যায়। মাত্র ৪৮ পৃষ্ঠার বই। স্যাম হ্যারিস নিজে নিউরোসায়েন্টিস্ট হলেও খুব ভারিক্কী কথাবার্তা যে উনি লিখেছেন তা নয়, বরং বেশ সাবলীল ভাষায় সহজ যুক্তিতে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন কেন নিরীহ মিথ্যে, বা প্রয়োজনীয় মিথ্যে গুলোও পরিহার করা উচিত।

 

প্রথমে প্রয়োজনীয় মিথ্যা নিয়ে কথা বলা যাক। হ্যারিস নিজে অনেক উদাহরণ দিয়েছেন, আমি না হয় ব্যক্তিগত একটা উদাহরণই দিই। গত বছর আমি ভার্সিটি’তে একটা পরীক্ষা ইচ্ছে করে মিস করলাম। গভীর রাতে ক্লাস মনিটরকে ফোন দিয়ে জানালাম, আমি কাল পরীক্ষা দিবনা। স্যার কে যাতে বলা হয় যে আমার দাদী মারা গিয়েছেন(যিনি আসলে চার বছর আগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন), তাই আমি পরীক্ষা দিতে পারিনাই। এই মিথ্যেটা বলেছিলাম যাতে স্যার পরে আমার পরীক্ষা নেন। আমি যদি বলতাম, স্যার, আমার পরীক্ষার প্রস্তুতি খুব বাজে ছিল, তাই আমি সেদিন পরীক্ষা দিইনাই, এইটা শুনে কখনোই আশা করা যায়না যে স্যার আমাকে পরে সেই পরীক্ষা আবার দিতে দিবেন। তাই আপাত দৃষ্টিতে মনে হতেই পারে, আসলে এখানে একটা সিরিয়াস টাইপ মিথ্যে বলাটাই প্রয়োজন ছিল। আমার নিজেরও তাই মনে হতো। হ্যারিসের বই পড়ে একটু অন্য রকম ভাবতে বাধ্য হচ্ছি। তাঁর মতে, ধরুন, আমি যদি ওই সত্যটা বলতাম যে আমি ইচ্ছে করেই পরীক্ষা দেইনাই, সেক্ষেত্রে আমাকে হয়ত স্যার ফেইল করিয়ে দিতেন, বা কোনমতে পাস করিয়ে দিতেন, কিন্তু এই ফেইল করার মাঝেও আমি হয়ত বুঝে যেতাম, ভালো করে টের পেতাম যে জীবনে কিছু ফাও মিলেনা, বা আমার খেয়াল খুশি মত আসলে সব কিছু চলেনা। সেই পরীক্ষায় ফেল করলে আমি হয়ত এরপর থেকে আরও সিরিয়াস হতে পারতাম আমার পড়াশুনার ব্যাপারে যা হয়ত আমার জন্য দূর ভবিষ্যতে ভালোই হতো। শর্ট টার্ম সুবিধার জন্য এই প্রয়োজনীয় মিথ্যে বলা হয়ত ভবিষ্যতে আমারই ক্ষতি হচ্ছে। একবার পার পেয়ে গেলে হয়ত এরকম আমি মাঝে মাঝেই পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না থাকলেই আমি পরীক্ষা দিতে যাবনা। আর এই প্রয়োজনীয় মিথ্যে আসলে আরও অনেক অস্বস্তিকর মিথ্যের জন্ম দিয়েছিল। ক্লাস মনিটর এর কাছে থেকে আমার দাদীর বানোয়াট মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার কিছু বন্ধু আমাকে এসএমএস করা শুরু করল যে আমার এই শোকে তারা সমবেদনা জানাচ্ছে। চিন্তা করুন, কি রকম লজ্জাজনক অবস্থা। আরও সমস্যা হচ্ছে যখন তারা সত্য জানতে পারল, আমার ধারণা তারা কনশাসলি না হলেও সাবকনশাসলি আমার উপর একটু হলেও আস্থা হারিয়েছে। স্রেফ সরাসরি সত্যটা বলে দিলে হয়ত আখেরে যেমন আমার জন্য ভালো হতো, আবার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবের সামনে এরকম বিব্রতকর পরিস্থিতিরও সম্মুখীন হওয়া লাগতো না।

কিংবা ধরুন খুব গুরুতর অসুখের কথা। স্যাম হ্যারিস অসুখ-বিসুখ নিয়ে বেশ ভালো একটা উদাহরণ দিয়েছেন। কেউ যদি কোন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন এবং বেশিদিন তাঁর বাঁচার সম্ভাবনা না থাকে, আমরা অনেক সময়ই তাকে প্রকৃত সত্য জানান দিতে চাইনা। আমাদের যুক্তি থাকে, এই কঠিন সত্য হয়ত সেই মানুষটি হজম করতে পারবেনা। কিন্তু যে মানুষটি হয়ত কদিন পর চলেই যাবে, তাঁর ব্যাপারে আমাদের এত বড় সিদ্ধান্ত না জানানোর অধিকার আদৌ আছে কিনা? হয়ত যদি সে জানত, প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠার পর সে হয়ত তাঁর আপনজনদের সাথে অনেক কিছু শেয়ার করত, আরও বেশি কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করত বা কোন ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা সে জানিয়ে যেতে পারত। প্রকৃত সত্য জানতে না দেবার জন্য হয়ত তাকে আমরা জীবনের শেষ মুহূর্তে জীবনের স্বাদ থেকেই বঞ্চিত করে ফেলি। সেইটা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?

 

এরপর ধরুন নিরীহ মিথ্যা বা ‘হোয়াইট লাই’-এর কথা। লেখার শুরুতে যেমন বললাম, ধানমন্ডী তে বসে শাহবাগ এ আছি-এই টাইপ আর কি। আরও চিন্তা করুন, এই মিথ্যে বলার সময় আপনার সাথে আরও একজন বন্ধু পাশেই বসা ছিল। আপাত দৃষ্টিতে সে হয়ত কিছুই মনে করবেনা, কিন্তু তার ঠিকই মনে থাকবে, আপনি এরকম ক্ষেত্রে অবলীলায় মিথ্যে বলেন। সে নিজেও তাই খুব সূক্ষ্মভাবে হলেও, অবচেতন ভাবে হলেও, আপনার উপর আস্থা হারাতে থাকবে। তাই বরং মিথ্যে বললেও মনে হয় একেবারে কোনই সাক্ষী রাখা উচিত না। আবার এইটাও মাথায় রাখতে হয় কাকে কখন কি মিথ্যে বলছেন, যখন তখন আবার বেফাঁস কিছু যাতে না বলে বসেন, এইটাও খেয়াল রাখতে হয়। মিথ্যে বলার হ্যাপা তাই অনেক। স্যাম হ্যারিস এর চাইতেও নিরীহ মিথ্যে যেমন ধরুন, আপনার বন্ধু আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করে, ‘এই সানগ্লাসে আমাকে কেমন লাগছে? ‘, সেখানেও ভদ্রতাবশত খুব মানিয়েছে এরকম বলার চাইতে, সত্য বলাটাই ভালো এইটা দেখাতে চেয়েছেন। তবে হ্যাঁ, একেবারে মুখের উপর বাজে ভঙ্গিতে না বলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সত্য মেসেজটা দিতে পারলেই ভালো, মোট কথা ইউফেমিজম আর কি।

 

তারপরও এমন কিছু সময় তো থাকেই যেখানে আসলেই হয়ত মিথ্যের কোন বিকল্প নেই। কেউ যদি কোন কারো দিকে অস্ত্র তাক করে থাকে এবং সেই মুহূর্তে আপনার একটি মিথ্যে তাকে বাঁচিয়ে দিতে পারে, এরকম ক্ষেত্রে মিথ্যে বলাই যায়। কিন্তু এরকম ‘এক্সট্রিম’ কেসে আসলে খুব কম মানুষই হয়ত জীবনে মুখোমুখি হয়।  কিংবা ধরুন, আপনি নিজেই ইলিগাল বা বেআইনি কিছু করেছেন যা স্বীকার করলে আপনার জেল বা আরও বড় শাস্তি হতে পারে, এতেও আসলে আপনার মিথ্যে বলা ছাড়া হয়ত উপায় নেই। বেআইনি কাজ করার এইটা একটা সমস্যা যে এখানে মিথ্যে বলা ছাড়া উপায় নাই। এখানে এইটাও বলা প্রয়োজন, আইন নিজেই যদি ত্রুটিপূর্ণ হয়, যেমন ধরুন কোন দেশে যদি নিয়ম থাকে অন্য ধর্মাবলম্বী কোন মানুষকে বিয়ে করা অবৈধ, তখন হয়ত পছন্দের মানুষকে বিয়ে করার জন্য মানুষকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধর্মান্তরিত হতে হয়, মিথ্যে বলতে হয়। তাই এরকম হাস্যকর রকমের ত্রুটিপূর্ণ আইন মানুষকে বাধ্য করতে পারে একজন সৎ ও স্বাভাবিক মানুষকে মিথ্যে বলতে।

 

এরকম আরও বেশ কিছু ইন্টেরেস্টিং বিষয় নিয়ে স্যাম হ্যারিস লিখেছেন। যাই বলার চেষ্টা করেছেন, অনেক উদাহরণ দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। একেবারে বেসিক থেকেই শুরু করেছেন, একেবারে সাধারণ প্রশ্ন যেমন, ‘ডু আই লুক ফ্যাট ইন দিজ ড্রেস?’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা নিয়েও আলোচনা করেছেন। সমালোচনা করতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে, আমার মত সাধারণ পাঠকের হয়ত যোগ্যতা হয়নি বইটির প্রতিটি অনুচ্ছেদের ব্যাপ্তি বুঝে উঠার, তারপরও আসলে বই শেষ করার পর মনে হয়েছে, বইটি কলেবরে একটু বেশিই ছোট, প্রতিটি অধ্যায়েরই মনে হয় আরও গভীরে যেতে পারতেন। কিংবা যে উদাহরণ গুলোই দিয়েছেন, এর চাইতেও আরও শক্তিশালী উদাহরণ, বিশেষ করে ‘লাইজ ইন এক্সট্রেমিজ’, অংশে টানতে পারতেন। পাঠককে হয়ত আরও জটিল জটিল সিচুয়েশনে ফেলে তারপর তার অবস্থান ব্যাখ্যা করলে আরও হয়ত নিজের ধারণাটুকু পোক্ত করতে পারতেন। বইয়ের শুরুতেই আনা ফ্র্যাঙ্ক এর কথা উল্লেখ করে ওই সময়েও নাৎসি বাহিনীকে সত্য বললেই লাভ হতো, এরকম একটা কথা এক সেমিনারে স্যাম হ্যারিসের এক প্রফেসর প্রমাণের চেষ্টা করেছিলেন এবং হ্যারিসের ভাষ্যমতে সেই যুক্তি প্রমাণে তিনি সফলই ছিলেন। কিন্তু ঠিক যুক্তি গুলো কি, বা এরকম ‘এক্সট্রিম কেস’-এ সত্য বলে কি লাভ হতে পারত, আমি এখনও ঠিক নিশ্চিত না।  যাই হোক, শেষ মেষ, ভালোই লাগছে বইটা। 🙂